নিখোঁজ

নিখোঁজ

– আচ্ছা মায়া একটা সম্পর্ক কতদিন অতিবাহিত হলে দুজনে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে পারে?
রুদ্র, মায়া দুজনে কতক্ষণ চুপ থেকে প্রকৃতির এই অসাধারণ রূপ নিজেদের মাঝে অনুভব করার চেষ্টা করছিল। প্রকৃতির এই রূপ নিজেদের মাঝে অনুভব করার বুদ্ধিটা মায়ার। জায়গা টা শহর থেকে বাইরে একদম নিরিবিলি বললে ভুল হবে তবে এ জায়গায় শহরের মতো এতো কোলাহল নেই, নেই গাড়ির শব্দ, নেই বড় বড় দালানকোঠা। এখানে আছে প্রকৃতির একের পর এক অপরূপ দৃশ্যপট। এখানে আসলে যেন রুদ্র, মায়া দুজনেই বুক ভরে শান্তিময় নিশ্বাস নিতে পারে।

মায়া ডুবন্ত সূর্যের থেকে চোখ সরিয়ে খুবই স্বাভাবিক দৃষ্টিতে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বললো,
– তুমি কি বললে আমি ঠিক শুনিনি আরেকবার বলো প্লীজ।
– আরে বলতে বলেছ বলবো তো অবশ্যই প্লীজ বলার আবার কি দরকার এখানে!
– আচ্ছা ঠিক আছে বলবো না আর। এবার বলো কি যেন বললে!

শ্বাস দীর্ঘ করে রুদ্র মায়ার মুখ থেকে চোখ সরিয়ে ডুবন্ত সূর্যের আলো নদীর জলের প্রতিফলনের দিকে দৃষ্টি দিয়ে আবারও বললো,
– একটা সম্পর্ক কতদিন অতিবাহিত হলে সে সম্পর্কে জড়ানো দুজন শারীরিক সম্পর্কে জড়াতে পারে?
মায়া কয়েক সেকেন্ড রুদ্রের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিল অন্য দিকে। রুদ্র জানে মায়া এ কথায় কেমন রিয়্যাক্ট করবে। মায়া ঠিক বুঝতে পারছেনা একথা কেন আনলো রুদ্র।

– এ কথার উত্তর তুমি আমার থেকে কেন শুনতে চাইছ?
– তোমার থেকে উত্তর শোনার ইচ্ছে হলো হঠাৎ। একেকজনের অনভিমত তো একক রকম তোমার অভিমত এতে কেমন সেটাই জানতে চাওয়া।

– তুমি ইদানীং এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছ নাকি! কজনের থেকে এর উত্তর নিয়েছ তুমি?
– এর আগে দুইটা মেয়ের থেকে উত্তর শুনেছি, তারা তো বলেছে সম্পর্কের মাঝামাঝি থাকলেই যাওয়া যায়। এবার তুমি বলো।
এবার মায়া যেন রাগান্বিত হলো। মায়া রাগলে অদ্ভুত এক অভ্যাস আছে এক হাতের নক দিয়ে অন্য হাতের নাক কোড়ে। মায়ার হাত দেখে বুঝা যাচ্ছে মায়ার রাগ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। রাগ দেখে রুদ্র ঝগড়া হওয়ার মোটেও ভয় পাচ্ছেনা আবার আশঙ্কা ও কাজ করছে ভয়ের। মায়া এক মুচকি হাসি দিল এ হাসিতে রাগ ভরা। এ হাসির রাগ কেউ না বুঝলে ও রুদ্র বুঝতে পারে।

– এর উত্তর আমার থেকে পাওয়ার আশা কখনও করোনা। তোমার এমন প্রশ্নে আমি সত্যি আহত। তোমার প্রশ্নের মাঝে তুমি আমার থেকে উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা থেকে আমার কাছ থেকে কিছু পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তোমার মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি। তোমার এই আকাঙ্ক্ষা আমাকে কি পরিমাণের কষ্ট দিতে পারে তা কি বুঝতে পারছো? অবশ্য সেই বোধ তো এখন তোমার মাঝে থাকার কথা ও না।

রুদ্র নিশ্চুপ মায়ার কথা গুলো মন দিয়ে শুনছিল। তার প্রশ্নে এমন ঘৃণা যুক্ত উত্তর আসাই উচিত।
– তুই এই ভাবে রিয়্যাক্ট করছো কেন? এ আর এমন কি!
– বাহ বাহ হাতে তালি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে তোমার কথায়। রুদ্র তুমি যদি তোমার ভেতর থেকে এই আকাঙ্ক্ষা দূর করতে পারো তবেই সেদিন আমার সাথে যোগাযোগ করো।

মায়া জল ভর্তি চোখ নিয়ে রুদ্রের পাশ থেকে উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেল। রুদ্র একটুও নড়লোনা। মায়া উঠে যাওয়ার সময় রুদ্র মায়ার হাত ধরে রাখতে চেয়েছিল তবে মায়ার কাছে এখন রুদ্রের হাতের স্পর্শ ও কষ্ট দিচ্ছে। রুদ্রের মাঝের আকাঙ্ক্ষা আছে কি-না মায়া তা বিচার কেন করেনি এ নিয়ে রুদ্রের মাঝে আক্ষেপ থেকেও যেন নেই।

রুদ্রের পরিবার নেই, বাল্যকাল থেকে অনাথাশ্রমেই বেড়ে ওঠা। নিজের বাবার দেখা কখনও পায়নি রুদ্র, বাবা-মা কে এই সাতাইশ বছর বয়সে এসে ও জানেনা সে। অনাথাশ্রমের বুয়ার সাথে রুদ্রের সম্পর্ক খুবই ভালো, এই রিনা বেগমকেই মাঝে মাঝে মা বলে বুকের শূণ্যতা দূর করে রুদ্র। রুদ্র এখন মোটামুটিরকম একটা বেতনের চাকরী করে তবে এখন অনাথাশ্রমে থাকেনা, থাকে অনাথাশ্রমের পাশে অল্প টাকায় একটা মেসে। প্রতিদিন অফিস শেষে রিনা বেগমের জন্য কোননা কোন খাবার রুদ্র নিয়ে আসবে এইটা বলা চলে রুদ্রের প্রতিদিনকার এক অভ্যাস। মাঝেমাঝে তো মায়া ও রুদ্রের সাথে এসে রিনা বেগমের সঙ্গে দেখা করে যায়।

মায়ার মন খারাপের রাত আজ সহজে পার হবেনা। মাথা থেকে রুদ্রের মনের আকাঙ্ক্ষা থেকে করা প্রশ্ন নামবেনা সহজে। তবু বেহায়া মন রুদ্রের সঙ্গে কথা বলার জন্য আনচান করছে। ফোন হাতে করে বারান্দায় বসে আছে মায়া মাঝেমাঝে ফেসবুকে ঢুকে দেখছে রুদ্র অনলাইনে আছে কি-না! মায়া রাগ করলে রুদ্র বারবার ফোন দিবে ফোন রিসিভ না হওয়া অব্ধি মায়ার ফোনে রিং হতেই থাকবে। রাগ করে থাকলে সেই রাগ ভাঙ্গাতে রুদ্রের খুব বেশি মাফ চাওয়ার কাঠখড়ি পোড়াতে হয়না। কয়কটা কথাতেই মায়ার অভিমান বাষ্প ন্যায় উড়ে যায়। ভালোবাসা কি অদ্ভুত!

মায়ার নার্সিং দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত। মায়ার পরিবার বলাচলে মধ্যবিত্ত, চার ভাই বোনের মাঝে মায়া দ্বিতীয়। এই মায়াকে পেত রুদ্রের কতনা চোট পেতে হয়েছে। কতদিন রোদে পুড়েছে, বৃষ্টিতে ভিজেছে তা মায়ার ক্যাম্পাসের পাশের টং এর দোকানদার আর টং টা সাক্ষী। চাকরীতে ঢুকার আগে মায়াকে দেখার জন্য কতো দুপুরের খাবার এই টং দোকানের চা আর একটা পাউরুটি দিয়ে চালিয়েছে। মায়ার ছুটি শেষে মায়ার বাসার আগ অব্ধি যাওয়া তো প্রতিদিনকার রুটিন হয়েছিল। এ নিয়ে মায়ার কাছে কতইনা অপমানিত হতে হয়েছে তার ইয়েত্তা নেই। প্রতিদিন মায়াকে দেখতে ক্যাম্পাসের সামনে যাওয়ার আগে অনাথাশ্রমের বুয়ার কাছ থেকে দোয়া নেওয়া আর দেখা শেষে ফিরে এসে একটা কেক খাইতে খাইতে সব বুয়াকে খুলে বলা ছিল রুদ্রের অভ্যাস। বুয়া রুদ্রের কথা শুনে মুচকি হাসতো।

রুদ্র মায়ার নাম্বারে ডায়েল করে বার বার কেটে দিচ্ছে। ও দিকে মায়ার চোখের জলে মুখ ভিজে একাকার। ভেতরে রুদ্রের প্রতি রাগ অন্যদিকে অবাধ্য ভালোবাসা দুয়ে মিলে মায়ার মাঝে যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত প্রিয় মানুষের প্রতি পাহাড় সমান রাগ থাকার পরেও তার সঙ্গে কথা বলার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে থাকে! মায়ার ফোন মুহূর্তের জন্য কেঁপে উঠলো, স্ক্রীনে দেখাচ্ছে রুদ্রর নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে। চোখ মুছে দ্রুত ফোনের লক খুলে ম্যাসেজ ওপেন করলো মায়া। ম্যাসেজ দেখে মনে হচ্ছে রুদ্র তার কথার জন্য মোটেও অনুতপ্ত নয়।

” মায়া জীবন সুন্দর, আমাদের ভালোবাসার সম্পর্ক ও সুন্দর, তেমনি আমাদের ভালোবাসা পবিত্র। তবে আমি করতে চাই অপবিত্র”
ম্যাসেজ দেখে রুদ্রকে এবার ফোন দিল মায়া। ওপাশ থেকে দুইবার রিং হওয়ার পরে ফোন রিসিভ করলো রুদ্র।
– তোকে আপন করে নিয়েছিলাম তার মানে এইনা তোর সাথে আমি বিছানায় যাবো। তুই মানুষের কাতারেই পড়িস না। তুই অমানুষ রুদ্র তুই একটা অমানুষ।

কথা গুলো বলে মায়ার কান্না আরও বেড়ে গেল। রুদ্র ওপাশ থেকে নিরব শ্রোতার মতো মায়ার কান্না শুনতে লাগলো। এক সময় এই মেয়েটার মন খারাপ হলে পাগলের মতো কতনা চেষ্টা করছে মন ভালো করতে রুদ্র। মায়ার মায়াবতী চেহারায় মন খারাপের ছাপ মানায় না বলে মায়ার মুখের হাসি দেখতে কতকি করেছে রুদ্র তার ইয়েত্তা নেই। সেই মেয়েটা আজ রুদ্রকে ফোন দিয়ে কথা শুনিয়ে অঝোরে কান্না করছে অথচ রুদ্র নিরব শ্রোতা হয়ে কান্না শুনছে! রুদ্র চায় মায়া কান্না করুক প্রচুর কান্না করুক, কান্না করে এক পর্যায়ে রুদ্রকে বিদায় বলে ছুড়ে ফেলুক। মায়াকে আর রাখতে চায়না জীবনে রুদ্র।

– মায়া আমি যা বলেছি তা তুমি বুঝতে পেরেছ। আর এসব এখন হয়ে থাকে তুমি বিষয়টাকে সহজ করে নিলেই সহজ। তুমি শুধু শুধু কান্না করছো এসব কান্না আমার কাছে অসহ্য লাগছে মায়া। তুমি বিষয়টা নিয়ে একটু ভেবেই বলো।
মায়া নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। এসব রুদ্র বলছে! যে রুদ্র মায়ার কপালে একটা চুমু খেতে দশবার মুখ সরিয়ে নিয়েছিল ভয়ে। যে রুদ্র সারাটা দিন কথা বলার জন্য পাগল হয়ে থাকতো সেই এখন এতো কঠিন আর ঘৃনা যুক্ত কথা অনর্গল বলে যাচ্ছে!

– রুদ্র তোর জায়গা আমি আমার মনে দিয়ে ভুল করেছিলাম। তুই রাস্তা থাকার মতোই মানুষ তোকে তুলে মনে ঠাঁই দেওয়া জীবনের চরম ভুল। তোর মতো নিকৃষ্ট মস্তিষ্কজাতের মানুষের জায়গা অনাথাশ্রমে ও হওয়ার কথা না। তুই অমানুষ কখনও আর ফোন দেওয়া তো দূরের কথা কোন রকম যোগাযোগ করার চেষ্টা তুই করবিনা। আমার জীবন নিয়ে তিন বছর যে ভাবে খেললি অন্য কোন মেয়ের জীবন নিয়ে আর খেলিস না। অঅভিশাপে তুই নিশ্বেস হয়ে যাবি রুদ্র। থু রুদ্র থু!

রুদ্র বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। এই সিগারেট খাওয়া নিয়ে সসম্পর্কের প্রথম দিকে প্রতি সপ্তাহে দু-একবার ঝগড় হতোই মায়ার সাথে। রাগলে মেয়েটাকে অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগে, গাল ফুলে বসে থাকে মায়া। সেই সৌন্দর্য দেখেই বোধহয় পার করে দেওয়া যায় দিনের পর দিন। মায়ার রাগ দেখে রুদ্রের হাসি পায় খুব তবে হাসতে পারেনা মেয়েটার রাগ বেড়ে যায় এই ভয়ে।

রুদ্রের সিগারেট খাওয়া বারন মায়ার তরফ থেকে। রুদ্র মেনে নিছিল এ বারন, রুদ্র মায়ার ভালোবাসা পেতে এমন হাজার বারন মানতে ও প্রস্তুত। কত দিন পরে সিগারেট রুদ্রের ঠোঁট ছুঁয়েছে তার ইয়েত্তা নেই। সিগারেট না খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে রুদ্রের ধোঁয়া নিলে ভেতর থেকে কাঁশি হচ্ছে। পেছন থেকে রাতুল উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,

– কিরে রাতুল তুই সিগারেট খাচ্ছিস! তুই না সিগারেট বাদ দিয়েছিলি! ভুল করেও তো সিগারেটে হাত লাগাইতিনা মায়ার বারন অমান্য হবে বলে।

– মায়াকে আর চাইনা আমার, ভালো লাগেনা তার বারন দিয়ে এখন কি হবে।

এ কথায় রাতুল বেশ অবাক হলো। মেসের সবাই জানে রুদ্র মায়ার সম্পর্কের কথা। দুজন দুজনকে পাগলের মতো করে ভালোবাসে সেটা ও জানতে কারো বাকি নেই। রাতুল নিজের ভেতরের প্রশ্ন গুলোকে আটেকে দিলো ভেতরেই। রুদ্রের ভেতর মায়ার ভালোবাসার অতীত আনার চেষ্টা করলো রাতুল।

– আচ্ছা কেন চাস না মায়াকে তা পরে শুনবো। কখন ও বলিস নি তুই কি ভাবে মায়াকে তোর জীবনে পেয়েছিস! আজ বল শুনি, আজকে তুই এইটা না করতে পারবিনা রুদ্র।

রুদ্রের হাতের সিগারেট নিভিয়ে মুচকি হেসে বললো,
– শুনতে যখন চেয়েচিস শুনাবো আজ। কোন প্রশ্নে আর আজ না করবো না তোকে। শোন তাহলে, ” আমার পড়ার খরচ আমাদের ওই অনাথাশ্রমের একটা পুরনো ডাক্তার চালাত কিন্তু আমি কখনও ওই ডাক্তার কে দেখিনি কথা ও হয়নি। তো আমি তখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র, আর মায়া তখন নার্সিং প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ওর সাথে আমার দেখা হয় এক পাবলিক বাসে, মায়া আমার পাশের সিটে বসে হুমায়ূন আহমেদ এর “মেঘ বলেছে যাব যাব” বইটা পড়ছিল। এক পর্যায় দেখলাম তোর চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমি অবাক হয়ে ওর এই কান্নার দৃশ্য দেখতে লাগলাম, ভাবতেছিলাম পাবলিক বাসে বসে বই পড়ে এভাবে কেউ কান্না করে!! কি বোকার মতো কাণ্ডকারখানা, এক হাত দিয়ে চোখ মুচছে অন্য হাতে বই ধরে পড়ছে। বাসের কিছু কিছু মানুষ যে তাকে চিড়িয়াখানার প্রাণী দেখার মতো দেখছিল সেদিক তার কোন খেয়ালই ছিলনা। ভাবলাম মেয়েটার সাথে কথা বলে জানবো বইয়ের এই শেষের দিকের পেইজে এমন কি আছে যার জন্য পাবলিক বাসে চোখের পানি ফেলতে হবে! তবে সেদিন আর কথা বলা হয়নি পরের বাসস্টপেজে চোখ মুছতে মুছতে নেমে গেল, আমি পেছন পেছন নামার সাহস করলাম না। পরের দিন থেকে বাসস্টপেজে অপেক্ষা করতে লাগলাম, প্রতিদিন ই মায়ার সাথে দেখা হতো কিন্তু কথা বলার সুযোগ পেতাম না, সুযোগ পেলে সাহস পেতাম না। এভাবে টানা এক সপ্তাহ পরে কথা বলার সুযোগ হয়ে সাথে সাহসও হয়। অদ্ভুত ভাবে সেদিন কথায় কথায় অনেক কথা হয়ে যায়, তার নাম, কি করে, কোথায় থাকে। অবাক হই মায়ার সরলতা দেখে তখন মনে হচ্ছিল এই মেয়েকে আমার জীবনে প্রয়োজন অতিব প্রয়োজন। সে আমার জীবনে এমন কেউ হবে ”’যার অভাব অনুভব করলে আমায় শূণ্যতায় গ্রাস করে ফেলবে, যার সাথে কথা না বলে থাকাই যাবেনা, যার উপর রাগ করা যাবে তবে রাগ বা অভিমান দীর্ঘ হবেনা, যাকে ছাড়া যাবে কিন্তু ছেড়ে থাকা যাবেনা!”’

প্রতিদিন মায়ার ক্যাম্পাসের সামনে টং দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা মাঝে মাঝে কথা বলতে গিয়ে অপমানিত হওয়া সব কিছু নিয়ে মায়ার প্রতি দূর্বলতা বাড়তে থাকলো। এভাবে ছয় মাস ঘুরার পরে এক বৃষ্টির দিনে তার ক্যাম্পাসের সামনে রাস্তার পাশে তার পায়ে পায়েল পড়িয়ে শুরু করি আমাদের প্রেমের গল্প। আর সেই প্রেমের গল্প গড়িয়ে আজ তিন বছর।

– শুরু টা যার এতো সুন্দর, যার চেহারায় তোর শান্তি খুঁজতি তাকে কেন আর চাস না??
– যার কোন জাত, ধর্ম, বর্ণ নেই তার জীবনে আবার ভালোবাসা কি করে ঠাঁই পায়। তার জীবনে আবার মায়া কি করে থাকবে!
– তোর কথা ঠিক বুঝলাম না। কি বুঝাতে চাইলি এ কথায়?
রুদ্র প্যাকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো। ধোঁয়া উপরের দিকে ছাড়তে ছাড়তে ধরা গলায় বললো,
– আমি জারজ রাতুল, আমি একটা জারজ সন্তান যার কোন জাত নেই ধর্ম নেই।

রাতুলের চোখ মার্বেল ন্যায় হয়ে গেল। কত সময় থম খেয়ে বসে রইলো রুদ্রের দিকে তাকিয়ে। নিজের সম্পর্কে কেউ এভাবে বলতে পারে তা ভাবতে পারছেনা রাতুল। রুদ্রের চোখ ভিজতে শুরু করেছে চোখের পানিতে। চোখে পানি মুছলোনা রুদ্র তার ধারনা এ চোখে পানি ও অপবিত্র এ পানি ঝরতে দিতে হবে।

– কি তুই বিশ্বাস করতে পারছিস না তাইনা? আরে বিশ্বাস তো আমি ও সেদিন করতে পারিনি যেদিন বুয়ার কাছ থেকে জোর করে শুনেছি আসলে আমি একটা জারজ অপবিত্র একটা সম্পর্কের ফসল। সারাটা জীবন জেনে এসেছি আমার বাবা-মা আমার জন্মের পরে রোড এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছে। কিন্তু আমি ভুল জানতাম ভুল। আমি কাদের অপবিত্র সম্পর্কের ফসল শুনতে চাস না? শুনবি আজ সব ই শুনবি, আমি ওই অনাথাশ্রমের পুরাতন ডাক্তার শ্যামল কান্ত আর ওখানকার নার্স নাজমা আক্তারের অপবিত্র সম্পর্কের ফসল আমি। পাপ করছিল ওরা আর ফসল হিসাবে আমাকে নিয়ে আসছে এই পৃথিবীতে। কি দোষ ছিল আমার বল, আমি তো এই অপবিত্র সম্পর্কের ফসল হয়ে আসতে চাইনি দুনিয়াতে। কি কারনে ওই নিষ্ঠুর মহিলা আমাকে দশমাস গর্ভে ধরে এই পৃথিবীতে আনছিল! জন্মের পরে আমাকে মেরে না ফেলে কেন বুয়ার কাছে রেখে চলে গেল দুই পাপী। এই জারজের জীবনের কোন প্রেমিকা থাকতে পারেনা। মায়াকে আমি আমার এই অপবিত্র জীবনে আনতে চাইনা। আরে আমি কাঁদছি কেন! পুরুষ মানুষের তো কান্না করা নিষেধ। কান্না করা যাবেনা, যাবেনা আত্যহত্যা করা তাতেও নাকি মহা পাপ। নাহ কাঁদবো আজ আমি ঝরে যাক এই চোখ থেকে সব অপবিত্র যত পানি।

রাতুল কখন রুদ্রের কথা গুলো শুনে চোখের পানি ফেলতে শুরু করেছে তা ঠিক বুঝতেই পারেনি। রুদ্র চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে গলা ভিজে চলেছে। রাতুল অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে টিশার্ট দিয়ে চোখ মুছে নিলো।
– রাতুল আমাকে একটা হেল্প করতে হবে তোর।
– কি হেল্প?
– মায়া আমার উপর রাগ করে আছে…..
রুদ্রের কথা শেষ না করতেই রাতুল বলে উঠল
– কি আমার কিছু করা লাগবে রাগ ভাঙ্গানোর জন্য তাহলে কাল সকালেই যাবো আমি মায়ার কাছে।
– নাহ মায়ার রাগ ভাঙ্গাতে তোর যেতে হবেনা। মায়ার রাগ খুবই কঠিন আমি রাগ না ভাঙ্গালে ওর রাগ ভাঙ্গবেনা আমি জানি। আর এবার আমি এমন কিছুই বলেছি যে কথায় ওর রাগ ভাঙ্গার নয় সহজে বরংচ রাগ ঘৃণা দুইটায়ি বাড়বে। ওর বিয়ের কথা চলছে, আমার জন্য বিয়ে তো আর কম ভাঙ্গেনি। আমি চাই এবার এই ছেলের সাথে ওর বিয়েটা হয়ে যাক আর বিয়ে হয়েও যাবে জানি। কারন আমার প্রতি ওর রাগ, ঘৃনা থেকে এবার বিয়েতে মনের বিরুদ্ধে হলে ও রাজি হয়ে যাবে।

আর তোর কাজ যা হবে, আমি তোকে একটা চিঠি দিবো যেই চিঠিটা তুই মায়ার কাছে ঠিক দেড় মাস পরে পৌঁছে দিবি। ততোদিনে শুরু হয়ে যাবে ওর নতুন সংসার। আর আমার চিঠিতে লিখা থাকবে আমার মৃত্যুর কথা।
– মৃত্যুর কথা মানে?? কি বলছিস তুই এসব ঠিক আছিস তো তুই রুদ্র??

– ভয় নেই আত্যহত্যা আমি করবোনা। তবে এ শহর ছেড়ে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবো আমি। এ শহরে থাকলে মায়াকে ছেড়ে থাকা আমার হবেনা জানি, আর মায়াকে এই অপবিত্র ফসলের জীবনে আমি চাইনা আনতে। ওর কাছে আমি মৃত থাকতে চাই। আমি চাই ও জানুক আমি মৃত। যতদিন বেঁচে থাকবো তাতোূুন দূর থেকেই মায়ার ভালোাসা নিয়ে বঁচে থাকবো। যদি আমার কবর দেখতে চায় তাবে নেইম প্লেট ছাড়া কোন একটা কবর ওকে দেখিয়ে দিস।

মায়ার উদ্দেশ্যে নিজের মৃত্যুর খবর দিয়ে চিঠি লিখে নীল খামের ভিতরে মুড়িয়ে শেষ রাতে রাতুলের টেবিলের উপর রেখে সেদিন রুদ্র কাউকে না জানিয়ে এশহর কে সে বিদায় জানায়। সঙ্গে করে বুকের বাম পাশে নিয়ে নিয়ে যায় মায়ার জন্য অসীম ভালোবাসা। সেদিনের পর থেকে রুদ্র হয় নিখোঁজ।

দেড় মাস পরে রাতুল মায়ার নিকট রুদ্রের লিখা চিঠিটা পৌঁছে দেয়। ততোদিনে মায়ার সংসার শুরু হয়েছে এক মাস। চিঠিতে রুদ্রের মৃত্যুর খবরে মায়া বেশ ভেঙ্গে পড়ে, রাতুলের কাছে রুদ্রের কবর দেখতে চাইলে কেনন একটা নতুন কবর দেখায় রাতুল মায়াকে। সেদিনের পর থেকে মায়া প্রতি সপ্তাহে একদিন এক গুচ্ছ গোলাপ নিয়ে রাতুলের দেখানো কবরের উপর রেখে আসে।

এভাবে এ শহরের কত রুদ্ররা নিখোঁজ হয়ে যায় আর মায়ার মতো প্রেমিকারা গোলাপ রেখে আসে ভুল কোন কবরের উপরে। এসব কিছুর মূলে থাকে একটা অবৈধ মেলামেশা।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত