আপনার সাফল্যের শুরুটা কিভাবে? যেদিন থেকে আমি পর্ণ দেখা বাদ দিলাম, সেদিন থেকে। মানে? মানে..একসময় আমি পর্ণাসক্ত ছিলাম। খুলে বলুন তো আমার কোনো স্বাভাবিক জীবন ছিল না। কোনো কাজে মনযোগ দিতে পারতাম না। সারাদিন বিভিন্ন পর্ণো আর চটি সাইটে ঘুরাঘুরি করতাম। এমনও দিন গেছে উত্তেজনায় সাত-আট বার পর্যন্ত মাস্টারবেট করে ফেলেছি।
ওএমজি! কোনো শারীরিক সমস্যা হয়নি? ঐরকম না। তবে মানুষিক সমস্যা ছিল। যেমন? আমার কোনো স্বাভাবিক যৌনজীবন ছিল না। কোনো মেয়েকে দেখলে ভালবাসা বা ভালোলাগার যে ন্যাচারাল ব্যাপারগুলা ছিল, সেরকম কিছু ছিল না। সবাইকে আমি চোখ দিয়েই উলঙ্গ করে ফেলতাম। কাপড় ভেদ করে আমার চোখ ঢুকে যেত। বিকৃত যৌনসঙ্গমগুলো বেশী ভালো লাগতো। মানে? মানে স্বাভাবিক মিলন না। যেগুলাতে জোরাজোরি থাকতো, টর্চার থাকতো, গা ঘিনঘিনে কোনো ব্যাপার থাকতো সেইগুলো। সেই গা ঘিনঘিনে ব্যাপারগুলোই তখন ভালো লাগত, উত্তেজনা বোধ করতাম। ভয়ংকর ব্যাপার। এর শুরুটা কিভাবে?
তখন আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। এক বন্ধু একদিন একটা এমপি-ফোর প্লেয়ারে করে নিয়ে আসে, সেই থেকে শুরু। আমার কাছে নেশার মতো লাগতে থাকে। লুকিয়ে-লুকিয়ে এর-ওর মোবাইলে দেখতে থাকি। কারো ফোন হাতে পেলেই দ্রুত খোঁজাখুঁজি করে দেখতাম অমন কিছু আছে কি-না। তারপর? তারপর ক্লাস এইট-এ পড়ার সময় বাসায় কান্নাকাটি করে নিজেই একটা ফোন কিনে ফেলি৷ তারপর লুকিয়ে-লুকিয় রাতে ঘুমানোর সময় কাঁথার নিচে গিয়ে দেখতাম। তারপর কী হলো?
আস্তে-আস্তে আমার নেশায় পরিণত হয়ে গেল ব্যাপারটা। দিনের বেলায় কোনো স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারতাম না, চোখে খালি ঐ দৃশ্যগুলো ভাসতো। আপনি তো মোটামুটি একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন– হ্যাঁ। একসময় আমি খুব ব্রাইট স্টুডেন্ট ছিলাম। আস্তে-আস্তে অধপতন শুরু। বাসায় থাকায় স্কুল-কলেজের রেজাল্টটা কোনোরকমে পার পেয়ে যায়। এরপর ভার্সিটি, হল-মেস লাইফ শুরু। স্বাধীন জীবন! হুম কারো সাথে মিশতাম না। তেমন বন্ধু-বান্ধব ছিল না। ক্লাস-টাশও করতাম না তেমন। সারাদিন রুমে পড়ে থাকতাম। সন্ধ্যায় দুইটা টিউশনি করাতাম। এরপর, বের হলেন কিভাবে এখান থেকে?
কিভাবে হলাম তা ঠিক নিজেও জানি না। আমার একটা স্টুডেন্ট পড়াশোনা করতো না, বাবামায়ের কথা শুনত না, নেশাপানি করতো। একদিন তাকে বুঝাচ্ছিলাম— এইযে পড়াশোনা করো না, উল্টাপাল্টা এইটা-ঐটা করো, এখন না-হয় করছো, পাঁচ-দশ বছর পর কী হবে? মা-বাবাকে কে দেখবে? জানি না আমার নিজের কথাটাই কিভাবে যেন চট করে আমার নিজের মনে লেগে গেল! স্টুডেন্টকে বলা কথাগুলায় নিজে-নিজে ভাবতে লাগালাম। আমিও তো নেশার ঘোরে আছি। আমার কী হবে? আমার বাবা-মা-কে কে দেখবে? টার্ণিং পয়েন্ট। হুম…সারারাত ঘুম হলো না। কী রকম একটা ঘোরে পড়ে গেলাম। ভাবতে থাকলাম। সারাটা দিনও গেল। পরেরদিন সকালে নতুনভাবে শুরু করলাম। খুব ভোরে উঠলাম, নামাজ পড়লাম। ফোন-ল্যাপটপ থেকে যতোটা পারা যায় দূরে থাকলাম। ঘরে থাকলাম না। মানুষের সাথে কথা বললাম। এরপর?
কয়েকদিন কেটে গেল। একটা স্টেবল অবস্থায় আসলো। ধূলো ঝেড়ে বই-টই বের করে আস্তে-আস্তে নাড়াচড়া শুরু করলাম। অনেকগুলো ব্যাকলগ, ক্রেডিট লস্ট! একটু-একটু করে সব সামলে নিলাম। দুই বছরের মধ্যে বের হয়ে গেলাম। ছোটখাটো একটা চাকুরি যোগাড় হয়ে গেল। বেতনের টাকা জমাতে লাগলাম— শেয়ার, বন্ড, ব্যাংক কোনজায়গায় কতো বেশী ইন্টারেস্ট খুঁজে-খুঁজে বের করলাম। বাহ্…বেশ। পাশাপাশি আরেকটা কাজ করে চলেছি। একসয় খুব ভালো ছবি আঁকতাম। আবার আঁকছি, শুধু নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্য। এরপর একান্ত বেখেয়ালে আঁকা ছবিগুলো থেকে যখন পুরস্কার আসলো, তখন বুঝলাম আমার আরো অনেককিছু করার আছে, দেয়ার আছে।
হ্যাঁ, অবশ্যই। এরপর একদিন জমানো সব টাকা, বন্ধু-বান্ধবের ধার, ব্যাংক লোন সব মিলিয়ে ব্যবসায় নেমে গেলাম। এগ্রিকালচার ফার্ম আর রেস্টুরেন্টের ব্যবসা। নিজের ফার্মের টাটকা মাছ-মাংস-শাক-সবজি বলে সাড়াও পাওয়া গেল বেশ। দাম একটু বেশী হলেও মানুষের ভীড় সবসময়। পাঁচ বছর দিনরাত খেটে একটা জায়গায় চলে আসলাম। পায়ের তলায় শক্ত মাটি হলো। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বর্ষ সেরা কৃষি উদ্যাোগক্তা হিসেবে পুরস্কারও পেলাম গেল বছর। বাহ…চমৎকার। আচ্ছা আপনাকে দেখে তো সম্পূর্ণ সুস্থ মনে হচ্ছে। তাহলে আমার কাছে, মানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে এলেন যে?
এমনি। গল্প করতে। মনে হলো আমার এই ইউটার্নের গল্পটা কারো জানা দরকার। আপনার তো এমন অনেক রোগী আছে, কাজে লাগবে। হুম..তা লাগবে। স্যার, আজ উঠি। আরেকদিন আসবো গল্প করতে। আর এইটা আমার বিয়ের কার্ড, আগামী শুক্রবার বিয়ে। আপনি এলে সত্যিই খুশি হবো।
আমার সামনের টেবিলে একটা রঙিন কার্ড জ্বলজ্বল করছে। তারচেয়েও বেশী জ্বলজ্বল করছে চেয়ার ছেড়ে উঠে যাওয়া মানুষটা। এই মানুষগুলাই আসল নায়ক। বাস্তব জীবনের নায়ক। এরা যখন রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায় তখন ব্যাকগ্রাউন্ডে কোনো মিউজিক থাকে না, তারপরেও ভায়োলিনের আশ্চর্য সুর শুনা যায়। আশেপাশে কোনো বাগান থাকে না, তবুও গোলাপের ঘ্রাণ পাওয়া যায়।