প্রত্যাবর্তন

প্রত্যাবর্তন

তোমার বু‌কের ডানপা‌শে এ কাটা দাগটা কি‌সের? বাসর রা‌তেই ত‌নিমাকে প্রশ্নটা করে‌ছিল অভ্র। ত‌নিমা নি‌র্লিপ্ত ভা‌বেই উত্তর দেয়।

: ‌ব্রেস্ট টিউমার ছিল। ওটা সেই সার্জা‌রির দাগ।
–কবে হ‌য়ে‌ছিল?

খুব স্বাভা‌বিক প্রশ্ন। কিন্তু ত‌নিমার মাথার ম‌ধ্যে একট‌া সূক্ষ্ম ক্রোধ চিন‌চিন করে ও‌ঠে। মা প্রায়ই বল‌তেন, মে‌য়ে মানু‌ষের এত রাগ ভা‌লো নয়। ‌কিন্তু এই উপ‌দেশ মে‌নে চলার মে‌য়ে ত‌নিমা কোন‌দিনই ছিল না। তবু আজ সে আশ্চর্যরকম শান্ত।

: বছর তি‌নেক আ‌গে।
–ও আচ্ছা।

মু‌খে ও আচ্ছা বল‌লেও সে‌দিন অভ্রর চো‌খে লে‌গে থাকা একরাশ অ‌বিশ্বাস আর স‌ন্দেহ ত‌নিমার দৃ‌ষ্টি এড়ায়‌নি । একটু আ‌গেও যে মানুষটা তার ম‌ধ্যে ডু‌বে যা‌চ্ছিল সে যেন হঠাৎই স‌চেতন হ‌য়ে উঠল। রাত অ‌নেক হ‌য়ে‌ছে। সুতরাং আমা‌দের এখন ঘুমা‌নো উ‌চিত। ব‌লেই সে পাশ ফি‌রে শু‌য়ে পড়ল। ত‌নিমাও আর কথা বাড়ালো না। হঠাৎ ক‌রেই তার সেই রাগটা গভীর বেদনায় রূপ নিল। সেই বেদনার দু’চার ফোঁটা ঝ‌ড়েও পড়ল গাল বে‌য়ে।

অভ্র ত‌নিমা‌কে বিশ্বাস ক‌রে‌নি। কিন্তু স‌ত্যিই এসএস‌সি পরিক্ষার আ‌গে ওর ব্রেস্ট টিউমা‌রের সার্জা‌রিটা হ‌য়ে‌ছিল। এই সার্জা‌রির জন্য মে‌য়েটা টেস্ট প‌রিক্ষাটা পর্যন্ত দি‌তে পা‌রে‌নি। কিন্তু নেহা‌য়েৎ ভা‌লো ছাত্রী ছিলো ব‌লে স্কুল থে‌কে এসএস‌সি প‌রিক্ষায় অংশ নেয়ার সু‌যোগটা করে দি‌য়ে‌ছিল। কিন্তু ও ভে‌ঙে গি‌য়ে‌ছিলো। মন ভে‌ঙে গি‌য়ে‌ছিল আস‌লে। য‌দিও সার্জা‌রিটা খুব বড় কিছু ছিল না তবু ভয়ই ও‌কে কাবু ক‌রে ফে‌লে‌ছিল। পড়া‌লেখায় গ‌তি ফিরল না। এসএস‌সির রেজাল্টটাও আশানুরূপ হয়‌নি। তাই ঐ স্মৃ‌তিটা ত‌নিমা ম‌নে রাখ‌তে চায় না। তবু তার বাসর রা‌তের স্বপ্ন ভাঙ‌তে সে হা‌জির হ‌য়ে গেল। প‌রিবা‌রের পছ‌ন্দে শি‌ক্ষিত আর সুশীল একটা ছে‌লে‌কেই তো বি‌য়ে করে‌ছে ত‌নিমা। কিন্তু কেমন শি‌ক্ষিত সে যে একটা সার্জা‌রির দাগ চিন‌তে পা‌রে না? অন্য‌কিছু ভে‌বে ব‌সে আ‌ছে। থাক না! ‌বি‌য়ের দু’দিন বা‌দেই অভ্র কৌশ‌লে ত‌নিমার ফেসবুক আই‌ডির পাসওয়ার্ড চাইল।

–ত‌নিমা, তোমার এফ‌বি পাসওয়ার্ডটা ব‌লো তো। আমার সা‌থে এ্যাড দি‌য়ে দেই। ত‌নিমা ফেসবু‌কে খুব একটা অ্যাক‌টিভ নাহ্। কেবল বন্ধু‌দের সা‌থে যোগা‌যোগটা রাখার জন্য ফেসবুক ইউজ করা। ফোন ক‌রে আর ক’‌দিনই বা ও‌দের খোঁজ নেওয়া হয়। তারচেয়ে অবস‌রে ফ্রেন্ডস গ্রু‌পে অল্প বিস্তর চ্যা‌টিং, মনটা ভ‌রে যায়। কিন্তু তবুও সেটা তার ব্য‌ক্তিগত ব্যাপার। তাই সোজা সাপ্টা উত্তর দি‌য়ে দিলো।

: পাসওয়ার্ড কেন লাগ‌বে? তু‌মি রি‌কো‌য়েস্ট পা‌ঠি‌য়ে দাও। আ‌মি এক‌সেপ্ট ক‌রে নেব।

ত‌নিমার কথার প্রত্যুত্ত‌রে সে‌দিন অভ্রর মু‌খে এক রাশ অন্ধকার নে‌মে‌ছিল। ও গা‌য়ে মা‌খে‌নি। ছে‌লেটা এম‌নি‌তেই ফর্সা। ত‌নিমার চে‌য়ে বে‌শি সুন্দর দেখ‌তে। মুখ কা‌লো ক‌রে আ‌ছে ব‌লে সৌন্দ‌র্যে গ্রহন লে‌গে‌ছে যেন। থাক না!
‌বি‌য়ের সপ্তাহখা‌নেক প‌রে ত‌নিমার বন্ধুরা এ‌সে‌ছিল ওদের বাসায়। ও‌দের ম‌ধ্যে দু’জন ছে‌লে বন্ধু্ও ছিল। নাঈম আর রা‌শেদ। ত‌নিমার ছোট‌বেলার ফ্রেন্ড। কিন্তু ও‌দের দে‌খেই অভ্রর চো‌খে বির‌ক্তি ফু‌টে উঠল। বি‌য়ের এই ক’‌দি‌নের ম‌ধ্যেই ত‌নিমা ওর চো‌খের ভাষা পড়‌তে শি‌খে গে‌ছে। স্বামীর সা‌থে এইটুকই মাত্র হৃদ্যতা তার! বন্ধু‌দের সা‌থে বহুক্ষন আড্ডা চলল। অভ্রও সবার সা‌থে ব‌সে ছিল। কিন্তু আড্ডায় ওর উপ‌স্থি‌তি বা আগ্রহ কোনটাই ছিল না। যেন অ‌নেকটা বাধ্য হ‌য়েই ব‌সে আছে। বউ‌কে পাহারা দি‌চ্ছে যেন! রা‌তে খাওয়ার পর ওরা চ‌লে গে‌লে অভ্র কথাটা ব‌লেই ফেলল।

–‌তোমার ছে‌লে ফ্রেন্ডও আ‌ছে দেখ‌ছি!

ক‌ন্ঠে স্পষ্ট বিদ্রুপ। কিন্তু ত‌নিমা একটুও ঘাবড়ালো না। মে‌য়েটা কেমন যেন শক্ত ধাতু‌তে গড়া। অভ্র যে কিছু একটা বল‌বে তার জন্য সে তৈ‌রি হ‌য়েই ছিল। তাই ধী‌রে সু‌স্থে জবাব দিল।

: হুম। দেখছই তো।
–‌তোমার কোন বান্ধবীর বয়‌ফ্রেন্ড?
: নাহ্। ওরা আমারই ফ্রেন্ড।
–খুব ঘ‌নিষ্ঠ বন্ধুত্ব?
: দীর্ঘ‌দি‌নের বন্ধুত্ব।
–আচ্ছা।

‌সে‌দিন রা‌তে প‌তি‌দেব কেবল পাশ ফি‌রে শু‌য়েই ক্ষান্ত হ‌লেন না। তাদের মাঝখা‌নে একটা কোল বা‌লিশও স্থান পেল। ত‌নিমা আবারও অবাক হয়। একটা শি‌ক্ষিত লো‌কের মন কি ক‌রে এতটা সংকীর্ন হ‌তে পা‌রে। অবশ্য এসব ভে‌বে কোন লাভ নেই। বাবা মার পছ‌ন্দে বি‌য়ে করল। তারা নিশ্চয়ই ভুল কর‌তে পা‌রেন না। তনিমার জন্য হয়ত এই ছে‌লেটাই পার‌ফেক্ট। একটু স‌ন্দেহপ্রবন। তো কি হ‌য়ে‌ছে? থাক না!

ঘটনাগু‌লো খুব দ্রুত ঘট‌ছিল। সময়ও যেন তার সা‌থে পাল্লা দি‌য়ে হার‌তে রা‌জি নয়। দেখ‌তে দেখ‌তে অভ্র ত‌নিমার বিবা‌হিত জীব‌নের পাঁচ‌টি বছর অ‌তিক্রান্ত হ‌য়ে গেল। এই পাঁচ বছ‌রের স্মৃ‌তি বল‌তে তা‌‌দের ম‌ধ্যের আরও কিছু অ‌প্রিয় ঘটনা। স‌ন্দেহ আর অ‌বিশ্বাস অভ্রর অন্ত‌রে এ‌কেবা‌রে গেঁ‌থে গি‌য়ে‌ছিল। তবুও সব কিছুর প‌রে থাক না ব‌লে ব‌লেই ত‌নিমা অভ্রর সা‌থে থে‌কে গি‌য়ে‌ছিল। সব দু:খ কষ্ট‌কে অবজ্ঞা আর অব‌হেলা করার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল মে‌য়েটার। জীবনটা মসৃন না হ‌লেও সংসারটা চল‌ছিল। হয়ত আরও ক‌য়েক বছর এভা‌বেই চলতে পার‌তো য‌দি না সে এ‌সে পড়ত। যার আগমন ঘ‌টে‌ছিল অনাড়ম্বর ভা‌বে কিন্তু ত‌নিমার জীবনটা‌কে সম্পূর্ন উ‌ল্টে দি‌য়ে‌ছিল।

সে‌দিন অভ্র অ‌ফি‌সে চ‌লে যাওয়ার পর ত‌নিমা কি‌চে‌নে ব্যস্ত ছিল। হঠাৎ ক‌লিং‌বে‌লের শ‌ব্দে কিছুটা চম‌কেই ও‌ঠে। এখন তো কারও আসার কথা নয়। তবু অ‌নি‌শ্চিত পদ‌ক্ষে‌পে এ‌গি‌য়ে যায় দরজার দি‌কে। অভ্র ফি‌রে এ‌লো না‌তো? আজ এত তাড়াতা‌ড়ি অ‌ফিস ছু‌টি হ‌য়ে গেল? ‌কোন দুর্ঘটনা নয়‌তো? ভাব‌তেই পদ‌ক্ষেপ দ্রুততর হয় ত‌নিমার। এক ছা‌দের নি‌চে থাক‌তে থাক‌তে আজকাল মানুষটার প্র‌তি খুব মায়া প‌ড়ে গে‌ছে ওর। ত‌বে কি এর নাম ভা‌লোবাসা? বি‌য়ের পাঁচ বছর পর স্বা‌মির প্রে‌মে প‌ড়ে‌ছে সে? দ্রুতই এসব এ‌লো‌মে‌লো ভাবনা খে‌লে যায় ত‌নিমার মাথায়। দু‌শ্চিন্তা আরও গাঢ় হয়। কিন্তু এক রাশ উৎকন্ঠা নি‌য়ে দরজা ‌খোলার সা‌থে সা‌থে ভূত দেখার মত চম‌কে ও‌ঠে মে‌য়েটা। সহসা কোন কথা বের হয় না মুখ দি‌য়ে। এক জোড়া বি‌স্ফো‌রিত চোখের সা‌থে সংঘর্ষ হয় আ‌রেক জোড়া চো‌খের। নিরুত্তাপ আর শীতল সেই চোখ দু‌টি। এক রাশ বিষন্নতা যেন ভর ক‌রে আ‌ছে সে দৃ‌ষ্টি‌তে..

: ভয় পে‌লে না‌কি? ‌সেই কন্ঠস্বর। এক সময় যা প্রা‌নে দোলা দি‌য়ে যেত। অথচ আজ সেই কন্ঠ শু‌নে সত্যি ভী‌তির সঞ্চার হয়। না ভয় পে‌লে চল‌বে না। নি‌জে‌কে দ্রুত সাম‌লে নেয় ত‌নিমা।

–ভ‌য়ের কি আ‌ছে। আসুন ভেত‌রে আসুন।

দরজা থে‌কে স‌রে দাঁ‌ড়ি‌য়ে সা‌মিন‌ ভাই‌কে ভেত‌রে আসার পথ ক‌রে দেয়। সা‌মি‌ন ভাই‌য়ের ঠোঁ‌টে খেলা কর‌ছিল অদ্ভুত এক হা‌সি। তার অর্থ ত‌নিমা সে‌দিন বুঝ‌তে পা‌রে‌নি। বস্তুত সা‌মিন‌ ভাই‌কে বোঝা ত‌নিমার জন্য কখ‌নোই সহজ ছিল না। পাঁচ বছর আ‌গেও নয় আর আজ‌কেও নয়। ত‌নিমার ঘ‌রের প্র‌তিটা কোন ঘু‌রে ঘু‌রে দে‌খেন সা‌মিন ভাই। বা‌কি থা‌কে না কি‌চেনটাও। ত‌নিমা কেবল নির‌বে অনুসরন ক‌রে। সা‌মি‌নের ঠোঁ‌টে ঝু‌লে থাকা অলস হা‌সিটা আরও দীর্ঘা‌য়িত হয়।

: বাহ্, বেশ তো সংসার করছ। এ‌কেবা‌রে পাক্কা গৃহিনী।
–হ্যাঁ।
: এত তাড়াতা‌ড়ি গু‌ছি‌য়ে নে‌বে ভা‌বি‌নি।
–অ‌গোছা‌লো ছিলাম ক‌বে? সা‌মিন যেন একটু চম‌কে ও‌ঠে।
: ওহ, তাই‌তো। আমারই ভুল, স্য‌রি! তু‌মি বরাবরই বেশ গোছা‌নো।
–পাঁচ বছর অ‌নেক সময়।
: হুম।
–দেখা শেষ হ‌য়ে‌ছে আপনার?
: ‌কি?
–ঘর?
: ও হ্যাঁ। হ‌য়ে‌ছে।
–ত‌বে বসুন গি‌য়ে। আ‌মি চা নি‌য়ে আস‌ছি। ত‌নিমা আবারও কি‌চে‌নে পা বাড়ায়। সা‌মিন পেছন থে‌কে ব‌লে ও‌ঠে,
: তাড়াতা‌ড়ি এ‌সো কিন্তু। ‌তোমার ব‌রের আসার সময় হ‌য়ে যা‌চ্ছে। ত‌নিমা থম‌কে দাঁড়ায়।
–‌খোঁজ খবর সব নি‌য়েই এসে‌ছেন দেখ‌ছি!
: গো‌য়েন্দা‌গি‌রির অভ্যাসটা এখ‌নো ছাড়‌তে পা‌রি‌নি যে!

ত‌নিমা এ কথার কোন জবাব দেয় ন‌া। অক‌ম্পিত পা‌য়ে কি‌চে‌নে চ‌লে যায়। সা‌মিনও সোফায় ব‌সে একটা সিগা‌রেট ধরায়। ত‌নিমা চা নি‌য়ে ফি‌রে আ‌সে। কি সহজ স্বাভা‌বিক তার আচরন। সেই এক মুহূ‌র্তের চম‌কে ওঠাটা বাদ দি‌লে তার ম‌ধ্যে আর কোন জড়তা নেই। তা‌কে দেখ‌লে ম‌নেই হয় না সে তার পাঁচ বছ‌রের পুর‌নো প্রে‌মিক‌কে চা বা‌নি‌য়ে খাওয়া‌চ্ছে। অবশ্য সা‌মিন‌কে প্রে‌মিক বলা যায় কিনা সেটা নি‌য়ে ত‌নিমার য‌থেষ্ট স‌ন্দেহ আ‌ছে। ভা‌লোবাসাটা ছিল এক তরফা। কেবল ত‌নিমার দিক থে‌কেই।

সা‌মিন ভাই তখন ক্যাম্পা‌সে নাম করা অ‌ভি‌নেতা। নাটক থি‌য়েটার এসব নি‌য়েই তার মহা ব্যস্ততা। কিন্তু শুধু ক্যাম্পা‌সে সীমাবদ্ধ থাক‌লেই চল‌বে না। তা‌কে আরও উন্ন‌তি কর‌তে হ‌বে। টি‌ভি নাট‌কের জন্য বি‌ভিন্ন জায়গায় অ‌ডিশন দি‌চ্ছেন। মোট কথা অ‌ভিন‌য়ে একটা চমৎকার ক্যা‌রিয়ার গড়ার জন্য নি‌বে‌দিত প্রান। সুতরাং ফালতু প্রেম ভা‌লোবাসায় জ‌ড়ি‌য়ে পড়ে তারু‌ন্যের প্রানশ‌ক্তি হা‌রি‌য়ে ফেলার কোন প্রশ্নই ও‌ঠে না। অ‌ভিনয়ই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান আর একমাত্র সাধনা। নারীর প্রেম ভা‌লোবাসা তা‌র কা‌ছে তুচ্ছ। মে‌য়েরা জীব‌নে আ‌সেই সর্বনাশ কর‌তে। দেখা গেল প্রে‌মের জন্য যে ছে‌লেটা নি‌জের ক্যা‌রিয়ার বিসর্জন দিল কিছু‌দিন প‌রে সেই প্রেমিকাই তা‌কে ধোঁকা দে‌বে।

তার চে‌য়ে একবার প্র‌তি‌ষ্ঠিত হ‌য়ে নেই। তারপর কত মে‌য়ে আস‌বে যা‌বে। হুহ্। অন্তত সা‌মিন ভাই‌য়ের এটাই ধারনা ছিল। কিন্তু অ‌ভিনয় তা‌কে কি দি‌য়ে‌ছে। আজ পর্যন্ত তো তা‌কে কোন নাটক সি‌নেমায় দেখা গেল না। ত‌নিমা অজা‌ন্তেই ঠোঁট বাঁকায়। এই মানুষটা‌কে দেখে সবসময়ই সাদা সি‌ধে হা‌সি খু‌শি ম‌নে হত। কিন্তু ত‌নিমা বিশ্বাস করত সা‌মিন ভাই প্রচন্ড অহংকারী। নয়‌তো কি? একটু ভা‌লোবাস‌লে কি হয়? সা‌মিন ভাই কেন সব সময় এমন অধরাই থে‌কে যান? দীর্ঘশ্বাসগু‌লো বু‌কেই আট‌কে থা‌কে। থাক না! তবু ত‌নিমা তা‌কেই ভা‌লো‌বে‌সে‌ছে। সেটা তার একান্ত ব্য‌ক্তিগত ব্যাপার। ওইসব স্মৃ‌তি ম‌নে ক‌রে ক্যাম্পা‌সের বড় ভাই‌য়ের সা‌থে এত‌দিন প‌রের সাক্ষাতটা মা‌টি করার প্রশ্নই ও‌ঠে না। সা‌মিন ভাই একবার চা‌য়ে চুমুক ‌দি‌য়ে আবারও সিগা‌রে‌টের ‌ধোঁয়ায় হা‌রি‌য়ে গে‌লেন। ত‌নিমা অবাক হ‌য়ে দে‌খে।

পাঁচ বছ‌রে এই মানুষটার কোন প‌রিবর্তন ঘ‌টে‌নি। এ‌কেবা‌রে সেই আগে‌রই মত। ম‌নে হয় এই তো সেদিনও সা‌মিন ভাই তার বন্ধু‌দের নি‌য়ে ক্যা‌ন্টি‌নে চা সিগা‌রেট খা‌চ্ছি‌লেন। ছাত্রজীবন থে‌কেই সা‌মিন ভাই প্রচুর ধুমপান কর‌তেন। ধোঁয়ায় ভ‌রি‌য়ে রাখ‌তেন চারপাশ। সে ধোঁয়‌াশা অ‌তিক্রম ক‌রে তা‌কে ছোঁয়ার সাধ্য ত‌নিমার ছিল না। তাই দূর থে‌কেই তা‌কি‌য়ে তাকি‌য়ে ‌দেখত। ক্যাম্পা‌সে সা‌মিন ভাই ছি‌লেন প‌রি‌চিত মুখ। শুধু অ‌ভিন‌য়ের জন্য না। কোন ছাত্রের হয়ত হ‌লে সিট দরকার, কেউ হয়ত সে‌মিস্টার ফি দি‌তে পার‌লো না, কোন ছে‌লে হয়ত ক্যাম্পা‌সে মে‌য়ে‌দের উত্ত্যক্ত কর‌ছে এমন সব সমস্যা সমাধা‌নে সা‌মিন ভাই‌ সর্বদা হা‌জির। কত দি‌কেই না খেয়াল রাখ‌তেন তি‌নি! শুধু্ একটা মে‌য়ে যে তার জন্য পাগলপ্রায় সে‌দি‌কেই তার দৃ‌ষ্টি পড়ত না। আস‌লে এত সব কা‌জের ম‌ধ্যে সময় কোথায় তার? এমন‌কি বি‌য়ের দিন ত‌নিমা নি‌জে গি‌য়ে তা‌কে কার্ড দি‌য়ে আসল। কবুল বলার আগ পর্যন্ত ওর ম‌নে আশা ছিল যে সা‌মিন ভাই নিশ্চয়ই আস‌বেন।

কে জা‌নে ত‌নিমার বি‌য়ে হ‌য়ে যা‌চ্ছে দে‌খে হয়ত তার ভা‌লোবাসা জে‌গে উঠ‌বে। ত‌নিমা সবার আড়া‌লে একটা ছোট ব্যাগও গু‌ছি‌য়ে রে‌খে‌ছিল। য‌দি সা‌মিন ভাই একবার ব‌লেন,” চ‌লো, পা‌লি‌য়ে যাই” সাতপাঁচ না ভে‌বেই তনিমা প‌থে নাম‌বে। একটুও সময় নষ্ট কর‌বে না। তাই সব প্রস্তু‌তি নেওয়‌াই ছিল। কিন্তু সা‌মিন ভাই এলেন না।তার হয়ত কোন কাজ প‌ড়ে গি‌য়ে‌ছিল। তারপর ত‌নিমা আর পেছন ফি‌রে তাকায়‌নি। সব কিছ‌ু ভু‌লে অভ্র‌কে বি‌য়ে ক‌রে‌ছে। অবশ্যই বাবা মার পছ‌ন্দে। প্র‌তি‌নিয়ত এই সংসারটা রক্ষার জন্য তা‌কে আ‌পোষ কর‌তে হ‌চ্ছে। কিন্তু যখনই তার ম‌নে হ‌লো সফলতা ধরা দে‌বে তখনই দৃশ্যপ‌টে সা‌মিন ভাই‌য়ের আ‌বির্ভাব। এত‌দিন প‌রে আজ কি ত‌বে তার সময় হ‌লো? পাঁচ বছর পর তি‌নি ত‌নিমার খবর নি‌তে এ‌সে‌ছেন। কিন্তু কেন?

: আ‌মি তাহ‌লে আজ উঠি। ত‌নিমা নি‌জের চিন্তায় এতটাই ডু‌বে ছিল যে সা‌মিন ভাই কখন উ‌ঠে দাঁ‌ড়ি‌য়ে‌ছেন টেরই পায় নি। ব্যস্ত হ‌য়ে ব‌লে উঠল।

–‌সে‌কি! চ‌লে যা‌চ্ছেন যে। দুপু‌রে খে‌য়ে যান।
: আ‌মি তো জানতাম অভ্র সা‌হেব দুপু‌রে বাসায় খে‌তে আ‌সেন।

সা‌মিন ভাই‌য়ের ঠোঁ‌টে দুষ্টু‌মির হা‌সি। ত‌নিমার ম‌ধ্যে হঠাৎ একটা পাগলামী মাথাচাড়া দি‌য়ে উঠল। একবার ই‌চ্ছে কর‌ছিল ব‌লে, অভ্র আস‌লে আস‌বে। তা‌তে দোষ তো কিছু নেই। ‌কিন্তু কথাটা আর বলা হল না। অভ্র যে বিষয়টা স্বাভা‌বিকভা‌বে নে‌বে না তা ত‌নিমার থে‌কে ভা‌লো আর কে জানে। সা‌মিন ভাই চ‌লে গে‌লে ত‌নিমা আবার রান্নায় ব্যস্ত হ‌য়ে প‌ড়ে। সা‌মিন ভাই কেন এ‌সে‌ছি‌লেন সেটা আর জি‌জ্ঞেস করা হ‌লো না। অবশ্য ত‌নিমা তা নি‌য়ে মো‌টেও চি‌ন্তিত না। সে জা‌নে সা‌মিন ভাই আবার আস‌বেন। তি‌নি প‌রের দিন এ‌লেন। তার প‌রের দিনও এ‌লেন। এভা‌বে তার আসা যাওয়া চলতেই থাকল। কিন্তু ত‌নিমা এখ‌নো জি‌জ্ঞেস কর‌তে পা‌রে‌নি সা‌মিন ভাই কেন আ‌সেন। তার সা‌থে কখ‌নোই ত‌নিমার দু’চারটার বে‌শি কথা হয় না।

তি‌নি আ‌সেন, সিগা‌রে‌টের সা‌থে চা খান। ঘ‌ড়ির কাঁটা মে‌পে ঠিক অভ্রর আসার আগ মুহূ‌র্তে চ‌লে যান। কিন্তু কদা‌চিৎ দু’এক‌দিন যখন সময়জ্ঞান হা‌রি‌য়ে যায় তখন অভ্রর সা‌থে অনাকা‌ঙ্খিত দেখা হ‌য়েই যায় সা‌মিন ভাই‌য়ের। ত‌নিমা তা‌কে ভা‌র্সি‌টির বড় ভাই ব‌লে প‌রিচয় ক‌রি‌য়ে দেয়। অভ্র খুব একটা আগ্রহ দেখায় না। শুধু তার চো‌খটা জ্ব‌লে ও‌ঠে। তাও কিছু সম‌য়ের জন্য মাত্র। এটা‌কে স‌ন্দেহ বল‌লে ভুল হ‌বে। ঈর্ষা হ‌লেও হ‌তে পা‌রে। যাই‌হোক বেশ ক‌য়েক সপ্তাহ এভা‌বেই চলল। এখন আর ত‌নিমার ম‌নে কোন প্রশ্ন জা‌গে না। কারন সে জা‌নে সা‌মিন ভাই কেন আ‌সেন। এ জন্যই তা‌কে আর সহ্য হয় না। সে ভা‌বে এটা‌কেই কি পরকীয়া ব‌লে? নাহ্ সেরকমও নয়। ত‌বে কিরকম? ‌দ্বিধায় প‌ড়ে যায় ত‌নিম‌া। তার জীব‌নের সব‌কিছুই এত অস্পূর্ন কেন? জীব‌নের প্রথম প্রেম তার কা‌ছে ধরা দিল না। বিবা‌হিত জীব‌নেও পূর্নতা নেই। আর এখন সা‌মিন ভাই‌য়ের এই প্রত্যাবর্তন, মা‌নে কি এ স‌বের? কি কর‌বে সে? কার হাত ধর‌বে আর কার হাত ছাড়‌বে? দ্বিধা আর দ্বিধা। সর্বত্রই দ্বিধার দেয়াল।

আজকাল রাগী আর স‌ন্দেহপ্রবন মানুষটাও কেমন চুপ হ‌য়ে গে‌ছে। কথায় কথায় ত‌নিমার দোষ ধ‌রে না। স‌ন্দেহ ক‌রে না। ত‌নিমার অবাধ্য ক্রোধটা হঠাৎ হঠাৎ আবার মাথাচাড়া দি‌য়ে ও‌ঠে। অভ্র কেন এখন আর তা‌কে আ‌গের মত কেয়ার ক‌রে না? কেয়ার!! ত‌নিমা নি‌জের এ‌লো‌মে‌লো ভাবনায় নি‌জেই চম‌কে ও‌ঠে। মন কত অবাধ্য হয়। কত দ্রুত বদ‌লে যায়। অভ্রর স‌ন্দেহ, অভ্রর অ‌বিশ্বাস আর রূঢ় ব্যবহারগু‌লো‌তেই আজ ত‌নিমার মন কেয়ার তকমা এ‌টে দিল। আর যে মানুষটা‌কে এক‌দিন সে মনপ্রান দি‌য়ে চাইত আজ যখন সে তারই দ্বা‌রে উপ‌স্থিত তখনই তা‌তে অতৃ‌প্তি ধ‌রে গে‌লো। আচ্ছা অভ্র কি জা‌নে না যে তার অনুপ‌স্থি‌তি‌তে একটা বাই‌রের লোকের সা‌থে ঘ‌রের বউ‌য়ের সময় কাটা‌নোটা অভদ্রতা? হোক সেটা এক কাপ চায়ের ব্যাপার। তবুও তো অন্যায়। অভ্রর কি উ‌চিত না ত‌নিমাকে দু‌টো থাপ্পর মে‌রে ওই সা‌মিন‌কে আস‌তে নি‌ষেধ ক‌রে দেওয়া? ত‌নিমা কেবলই ভা‌বে। ভাবনায় ভাবনায় দিন কে‌টে যায়। একটা চাপা আশংকা সৃ‌ষ্টি হয় ম‌নে। এই হয়ত অভ্র কিছু ব‌লে বস‌বে। কিন্তু অভ্র কিছুই ব‌লে না। দু‌শ্চিন্তায় ঘুম আ‌সে না চো‌খে। মাঝরা‌তে ঘুম ভে‌ঙে গে‌লে পা‌শে তা‌কি‌য়ে দে‌খে অভ্র নেই। আজকাল প্রায়ই সে বারান্দায় পায়চারী ক‌রে রাত কাটায়। ত‌নিমা দে‌খেও না দেখার ভান ক‌রে। কিন্তু আজ আর স‌য়ে থাক‌তে পা‌রে না। সেও উ‌ঠে বারান্দায় চ‌লে যায়।

–অভ্র? অভ্র চম‌কে তাকায়।
: এ‌কি! তু‌মি এত রা‌তে বারান্দায়? ঘু‌মোও‌নি –কেন?
–আ‌গে ব‌লো তু‌মি কেন জে‌গে আছ?
: এম‌নি। ঘুম আস‌ছে না।
–তু‌মি আমার সা‌থে এমন কেন করছ, অভ্র?
: আ‌মি আবার কি করলাম? অ‌ভিমা‌নে ত‌নিমার কন্ঠ রোধ হ‌য়ে আ‌সে। সে আর কান্না ধ‌রে রাখ‌তে পা‌রে না।

–তু‌মি আমা‌কে আ‌গের মত কেন শাসন ক‌রো না, কেন জবাব‌দি‌হি ক‌রো না?
হঠাৎ একটা দীর্ঘশ্বা‌সের শ‌ব্দে ত‌নিমা চম‌কে ও‌ঠে। অন্ধকা‌রেও সে উপল‌ব্ধি ক‌রে অভ্রর মু‌খে বেদনা ফু‌টে উ‌ঠে‌ছে।

: তু‌মি আমার সা‌থে ভা‌লো নেই। তাইনা, ত‌নিমা? অবশ্য এটা আমারই অক্ষমতা। তোমা‌কে আ‌মি ভা‌লো রাখ‌তে ব্যর্থ হ‌য়ে‌ছি।

–এ কথা কেন বলছ?
: এটাই তো স‌ত্যি। আ‌মি তোমা‌কে বহুবার মি‌থ্যে স‌ন্দেহ ক‌রে‌ছি। কষ্ট দি‌য়ে‌ছি। তবু তু‌মি সব সহ্য ক‌রেছ। কিন্তু আর কত?

–মা‌নে কি? কি বল‌তেও চাও তু‌মি? অভ্র মৌন থা‌কে। যেন কি বল‌বে সেটা ম‌নে ম‌নে ঠিক ক‌রে নেয়। কিন্তু ত‌নিমা আর অ‌পেক্ষা কর‌তে পা‌রে না। এবার সব জড়তা কা‌টি‌য়ে ত‌নিমা আসল কথাট‌া ব‌লেই ফেলল,

–সা‌মিন ভাই‌কে নি‌য়ে তু‌মি যে আমায় স‌ন্দেহ ক‌রো সেটা সরাস‌রি বল‌লেই পা‌রো। এ‌তো ভ‌নিতা করার কি দরকার? তোমার তো এটাই ধারনা যে ‌তোমার অনুপ‌স্থি‌তি‌তে সা‌মিন ভাই‌য়ের সা‌থে আমা..

: ‌ছিঃ! ত‌নিমা, এসব তু‌মি কি বলছ?অভ্র ত‌নিমা‌কে কথা শেষ কর‌তে দেয় না।

: এ রকম কিছুই নয়। আ‌মি এক সময় তোমা‌কে স‌ন্দেহ করতাম। কিন্তু সেটা আমার অন্যায় ছিল। আর এই কথাটাই আ‌মি এত‌দিন ধ‌রে ভাব‌ছি। কিভা‌বে ক্ষমা চাই‌বো তোমার কা‌ছে। সা‌মিন ভাই‌কে নি‌য়ে আমার কোন সমস্যা নেই। বরং তি‌নি আমার উপকারই ক‌রে‌ছেন। আ‌মি তার জন্যই তোমার আর আমার সম্পর্কটা নি‌য়ে দ্বিতীয়বার ভে‌বে দেখার অবকাশ পে‌য়ে‌ছি। আ‌মি আর নতুন কোন অন্যায় কর‌তে চাই না, ত‌নিমা।

–তাহ‌লে কি কর‌তে চাও তু‌মি?
: I’m sorry, Tanima..

সব‌কিছুর জন্য। আজ থে‌কে তু‌মি তোমার যে‌কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য স্বাধীন। আ‌মি তোমা‌কে বাধ্য করব না। তু‌মি নিশ্চয়ই বুঝ‌তে পারছ আ‌মি কি বল‌ছি? অভ্র তা‌কে মু‌ক্তি দি‌তে চায়। তনিমা বুঝ‌তে পা‌রে। কিন্তু অভ্র তা‌কে যেটা বোঝা‌তে চে‌য়ে‌ছিল তার সম্পূর্ন বিপরীত ভাবনাই ত‌ার মন‌কে আচ্ছন্ন ক‌রে রা‌খে। সে অনুভব ক‌রে তার সাম‌নে দাঁ‌ড়ি‌য়ে থাকা এই মানুষটার ম‌ধ্যে হয়ত অ‌নেক ভুল ত্রু‌টি আ‌ছে। কিন্তু সেও তো ধোঁয়া তুলসী পাতা নয়। সা‌মিন ভাই‌কে প্রশ্রয় দেওয়া তার মো‌টেই উ‌চিত হয়‌নি। কারন সে এখন অভ্রর স্ত্রী। এই মুহূ‌র্তে ত‌নিমার জীব‌নে এই ভু‌লে ভরা মানুষটাই সব থে‌কে বে‌শি গুরুত্বপূর্ন।

ও‌কে ছাড়া স‌ত্যিই চল‌বে না। ত‌নিমার কান্না আরও প্রবল স্রো‌তে নে‌মে আ‌সে। ভা‌সি‌য়ে নেয় দূরত্বের বাঁধ। হঠাৎ ক‌রেই সব মান অ‌ভিমান ভু‌লে অ‌বিশ্বাস আর স‌ন্দে‌হের উ‌র্ধ্বে উ‌ঠে অভ্র-ত‌নিমা নি‌জে‌দের খুব কাছাকা‌ছি আ‌বিষ্কার ক‌রে। অভ্রর চো‌খ থে‌কেও দু’‌ফোঁটা জল গ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে। ভা‌গ্যিস ত‌নিমা দে‌খে‌নি। বারান্দার অন্ধকার তা‌কে বাঁ‌চি‌য়ে দিল।পর‌দিন সকা‌লে অভ্র অ‌ফি‌সে চ‌লে যাবার পর ত‌নিমা অ‌পেক্ষা কর‌তে থা‌কে। কখন আস‌বেন সা‌মিন ভাই। যথাসম‌য়ে সা‌মিন ভাই এ‌লেন। ত‌নিমা তা‌কে চা‌য়ের কাপটা বা‌রি‌য়ে দি‌লো। সা‌মিন ভাই সিগা‌রেটট‌া ঠোঁ‌টে ঝু‌লি‌য়ে লাইটারটা হা‌তে নি‌লেন। ত‌নিমা এতক্ষন ম‌নো‌যোগ সহকা‌রে তা‌কি‌য়ে ছিল। এবার সে কথা ব‌লে।

–আজ‌কে স্মোক না কর‌লেই নয়? কথাটা অনু‌রো‌ধের। কিন্তু ত‌নিমার চোখ আর ক‌ন্ঠে যেটাই ফু‌টে উঠুক না কেন সেটা অনু‌রোধ নয় মো‌টেই। সা‌মিন ভাই সিগা‌রেটটা আবার প‌কে‌টে রে‌খে দি‌লেন।

–আপনার সা‌থে আমার কিছু কথা আ‌ছে। কিন্তু প্র‌তি‌দিনই সিগা‌রে‌টের ধোঁয়ায় আ‌পনার পৃ‌থিবী আলাদা হ‌য়ে যায় ব‌লেই আর বলা হ‌য়ে ও‌ঠে না।
: আজ ব‌লো ত‌বে। কি কথা বল‌তে চাও..

–আপনার কি ফি‌রে না আস‌লে চলত না? আমার জীব‌নে আপনার প্রত্যাবর্তনটা কি খুব জরু‌রি ছিল?
‌নি‌জের এমন সরাস‌রি রুঢ় প্র‌শ্নে ত‌নিমা একটু ল‌জ্জিত হয়। সাম‌লে নি‌য়ে অ‌পেক্ষাকৃত নরম স্ব‌রে কথা ব‌লে। কিন্তু তা‌তে ক‌ন্ঠের দৃঢ়তা একটুও ক‌মে না।

–সা‌মিন ভাই, আপ‌নি এত দিন প‌রে কোথা থে‌কে এ‌সে‌ছেন, কি উ‌দ্দে‌শ্যে এ‌সে‌ছেন আ‌মি জা‌নি না। আমা‌কে কিভা‌বে খুঁজে পে‌য়ে‌ছেন কিংবা আপনার কিছু বলার আ‌ছে কিনা এ সম্প‌র্কেও আমার কোন জিজ্ঞাসা নেই। আমার কেবল একটাই অনু‌রোধ আপ‌নি দয়া ক‌রে আর কখ‌নো আমা‌দের বাসায় আস‌বেন না। কথাগু‌লো এক নিঃশ্বা‌সে ব‌লেই ত‌নিমা সামিন ভাই‌য়ের প্র‌তি‌ক্রিয়ার জন্য অ‌পেক্ষা ক‌রে। সা‌মিন ভাই শুষ্ক একটা হা‌সি দি‌য়ে বল‌লেন,

: ‌বেশ তো! তাই হ‌বে,ত‌নিমা। উ‌ঠে দাঁড়া‌লেন। তি‌নি এখনই চ‌লে যা‌বেন। বড্ড ত‌ড়িৎকর্মা লোক ব‌টে! ত‌নিমাও বাঁধ‌া দিল না। দরজা পর্যন্ত গি‌য়ে একবার পেছন ফি‌রে দাঁড়া‌লেন সা‌মিন ভাই।
: ভা‌লো থে‌কো,ত‌নিমা।

ত‌নিমা কা‌ঠের পুতু‌লের মত ঠাঁয় দাঁ‌ড়ি‌য়ে থা‌কে। কোন উত্তর দেওয়ার প্র‌য়োজন বোধ ক‌রে না। তার নীরবতাই প্রমান ক‌রে সে ভা‌লো থাক‌বে। সা‌মিন ভাই চ‌লে গে‌লে ত‌নিমা সশ‌ব্দে দরজা লাগায়। হাঁফ ছে‌ড়ে বাঁচল যেন! দ্রুত কিচে‌নে চ‌লে যায়। আজ সে অভ্রর প্রিয় মাগুর মা‌ছের ঝোল রান্না কর‌বে। মুহূর্তক‌য়েক প‌রে রান্নায় এতটাই ব্যস্ত হ‌য়ে যায় যে একটু আ‌গের ঘটনা তার আর ম‌নেই থা‌কে না।

কিন্তু ত‌নিমা কখ‌নোই জান‌তে পার‌বে না যে তার জীব‌নে এই সা‌মিন ভাই‌য়ের হঠাৎ প্রত্যাবর্তন কোন কাকতালীয় ঘটনা ‌ছিল না। ক্যাম্পা‌সে এই মে‌য়েটা তার পিছ‌নে খুব ঘুরঘুর করত। সা‌মিন ভাই পাত্তা দেন‌নি। প্রেম ভা‌লোবাসা করার লোক তি‌নি নন। যখন শুন‌লেন মে‌য়েটার বি‌য়ে হ‌য়ে যা‌চ্ছে বেশ ঘাম দি‌য়েই জ্বর ছে‌ড়ে‌ছিল তার। ঝা‌মেলা বিদায় হ‌য়ে‌ছে ভে‌বে সে‌দিন গর‌মের ম‌ধ্যেও কম্বল মু‌ড়ি দি‌য়ে বেশ লম্বা ঘুম দি‌য়ে‌ছি‌লেন। তাই আর ‌বি‌য়ের দাওয়াতটা খাওয়া হল না। এরপর নানা ব্যস্ততায় ত‌নিমা‌কে তি‌নি ভু‌লেই গি‌য়ে‌ছি‌লেন। কিন্তু হঠাৎ এক‌দিন নাঈ‌মের সা‌থে দেখা হ‌য়ে গেল।

এই নাঈম ত‌নিমার কা‌ছের ফ্রেন্ড‌দের একজন যারা ত‌নিমা‌কে খুব ভা‌লো ক‌রে জানত। দেখ‌তে দেখ‌তে ভা‌র্সি‌টির ছোট ভাই‌য়ের সা‌থে গল্প জ‌মে ও‌ঠে সা‌মিন ভাই‌য়ের। নানা কথায় ত‌নিমার প্রসঙ্গও চ‌লে এল। কারন ত‌নিমা যে সা‌মিন ভাই‌কে পছন্দ করত এটা ক্যাম্পা‌সের প্রায় সবাই জানত। আর এই নাঈম ছে‌লেটা স‌ত্যিই ত‌নিমার খুব ভা‌লো বন্ধু ছিল। ওর ম‌নে একটা সূক্ষ্ম ক্ষোভও ছিল। প্রিয় বান্ধবীর ভা‌লো না থাকার জন্য নাঈম ম‌নে ম‌নে সা‌মিন ভাই‌কেই দায়ী করত। সা‌মিন ভাই ফি‌রি‌য়ে না দি‌লে নিশ্চয়ই ত‌নিমার জীবনটা অন্যরকম হত। তাই সু‌যোগ পে‌য়ে ত‌নিমার সংসা‌রের আ‌দ্যোপান্ত সব ব‌লে দিল। এ‌তে প‌রোক্ষভা‌বে যে সা‌মিন ভাই নি‌জেই দায়ী সেটাও ইশারা ই‌ঙ্গি‌তে বোঝা‌তে বাদ রাখল না। বাস্ত‌বে ত‌নিমার অশা‌ন্তির সা‌থে তার আ‌দৌ কোন সম্পর্ক আ‌ছে কিনা সেটা নি‌শ্চিত না হ‌য়েও সেই‌দিনই সা‌মিন ভাই সিদ্ধান্ত নি‌লেন যে তার কিছু করা উ‌চিত। কিন্তু কি করা উ‌চিত তাও আবার মাথায় এল না। তারপর কোন কিছু না ভে‌বেই তি‌নি নাটকীয় ভা‌বে ত‌নিমার জীব‌নে ঢু‌কে গে‌লেন।

অবশ্য তার বিশ্বাস ছিল এ প্রত্যাবর্তনে অভ্র-ত‌নিমার জীব‌নে কিছু একট‌া প‌রিবর্তন তো আস‌বেই। তা‌দের দু’জ‌নের জন্যই একটা শক দরকার। যা‌তে ও‌দের সুপ্ত ভা‌লোবাসা জে‌গে ও‌ঠে। তার ধারনাই স‌ত্যি হ‌য়ে‌ছে। অভ্রর ম‌নে এবার আর স‌ন্দেহ নয় বরং ঈর্ষা থে‌কে ভা‌লোবাসার সৃ‌ষ্টি হ‌য়ে‌ছে। আর ত‌নিমার ম‌নের কো‌নে যে সা‌মিন ভাই অ‌দ্বিতীয় ছি‌লেন, যার কার‌নে ত‌নিমা অভ্র‌কে ভা‌লোবাস‌তে চে‌য়েও পা‌রে‌নি। সেই সা‌মিন ভাই‌য়ের প্রত্যাবর্তন তার সব দ্বিধা দূর ক‌রে দি‌য়ে‌ছে। সা‌মিন ভাই‌ নিখুঁত অ‌ভিনয় ক‌রে‌ছেন। তি‌নি যতই ত‌নিমার প্র‌তি আগ্রহ দে‌খি‌য়ে‌ছেন ত‌নিমা ততই তার স্বামী‌কে ভা‌লোবাস‌তে পে‌রে‌ছে। অভ্র-ত‌নিমার মাঝখা‌নের দেয়ালটা ভে‌ঙে দি‌য়েছেন তি‌নি। আজ আর তা‌কে ত‌নিমার কোন প্র‌য়োজন নেই। সেটা ত‌নিমা বু‌ঝি‌য়েই দি‌য়ে‌ছে।

সা‌মিন ভাই শেষ একবার পেছন ফি‌রে তাকা‌লেন। স‌ন্দেহ নেই চমৎকার অ‌ভিনয় ক‌রে‌ছেন তি‌নি। য‌দিও বাস্তব জীব‌নে অ‌ভিনয় তা‌কে কিছুই দেয় নি। বরং অ‌ভিন‌য়ের জন্য অ‌নেক কিছু তি‌নি ত্যাগ ক‌রে‌ছেন। এত চেষ্টা ক‌রেও তি‌নি ক্যা‌রিয়ার গড়‌তে পা‌রেন‌নি। তবু এখনও চেষ্টা চা‌লি‌য়ে যা‌চ্ছেন। তি‌নি একজন ফ্লপ অ‌ভি‌নেতা। কিন্তু অ‌ভিনয়টা তার র‌ক্তে। তাই ত‌নিমার সা‌থে অ‌ভিন‌য়ে এবার বোধহয় একটু বে‌শিই চ‌রি‌ত্রে ঢু‌কে গি‌য়ে‌ছি‌লেন। নাহ‌লে তার বু‌কের ম‌ধ্যে চিনচি‌নে ব্যথা অনুভব হ‌চ্ছে কেন? চোখ দু‌টোই বা জ্বালা কর‌ছে কেন? তি‌নি আবার প্রে‌মে প‌ড়ে গে‌লেন না‌তো? আ‌রেহ্ ধুরর! প্রেম ভা‌লোবাসা সা‌মিন ভাই‌য়ের জন্য না। তি‌নি সব কিছু ঝে‌ড়ে ফে‌লে নি‌জের জীব‌নের প‌থে দ্রুত পা‌য়ে হাঁটা শুরু কর‌লেন। যেন তার কত তাড়া! পাশ থে‌কে একটা খা‌লি রিকশা যা‌চ্ছিল। রিকশাওয়ালা ডে‌কে উঠল, মামা কই যাই‌বেন? কিন্তু সা‌মিন ভাই শু‌নেও শুন‌লেন না। তার কোন গন্তব্য নেই।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত