দুঃখ সুখের খেলা

দুঃখ সুখের খেলা

আমার বাবা মায়ের যখন বিচ্ছেদ হয়, তখন আমার বয়স এগারো বছর। বিচ্ছেদের পিছনে আমার অর্ধেক হাত ছিলো। কারন আমি চাইলেই বিচ্ছেদ টা আটকাতে পারতাম। কিন্তু আমি আমার বাবাকেও খুব ভালোবাসি তাই আর আটকাই নি। বিচ্ছেদের কারন আমার মায়ের অবৈধ সম্পর্ক। কোন সন্তানই তার মাকে পরপুরুষের সাথে আপত্তি কর অবস্থায় মেনে নিতে পারবে?? আপনিই বলুন?? আমি তখন ক্লাস ফোর এ পড়ি। স্কুল থেকে ফিরে সরাসরি ঘরে ঢুকে যাই। আর তখনই। আমায় দেখে মা আর ওই লোকটি দুজনেই চমকে গিয়েছিলো। লোকটি আমার বাবার বন্ধু ছিলো। তারা একসাথেই মাছের ব্যবসা করতো।

মা বলেছিলো “আমি যদি তাদের কির্তি গুলো কাউকে না বলি, তবে সব আগের মত থাকবে। আমি আমার মাকে কাছে পাবো। আর যদি বলে দেই। মা আমাকে মারবে তো মারবে আর আমাকে রেখে চলে যাবে। আমি প্রথম কয়েকদিন চুপ ছিলাম। কিন্তু আমি আমার বাবাকে ঠকাতে চাইনি তাই সব বলে দিয়েছিলাম। তারপর বিচ্ছেদ হলো তাদের। সেই থেকেই বাবা পরিবর্তন হয়ে যায়। তার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। ব্যবসায় লস খেলো। শুরু করলো দিন মজুরের কাজ। আমার লেখাপড়া ও শেষ হয়ে গেলো।

আমার বড় কাকা ভাবলেন আমাদের পরিবারে একজন মহিলা দরকার। তাই বাবাকে আবার ও বিয়ে দেওয়া হলো। আমি নতুন মা পেলাম। নতুন মা আমাকে খুব ভালোবাসতেন। আমার ও বাবার খুব খেয়াল রাখতেন। বাবা আবারও আগের মত হতে লাগলেন। আবার ও সেই হাসি খুশি বাবাকে ফিরে পেলাম। আমার নতুন নানা বাড়ি থেকে কিছু টাকা এনে এবং বড় কাকার থেকে কিছু নিয়ে বাবা একটা দোকান দিলেন।

এর মধ্যে আমি এগারো পেরিয়ে বারোতে পা দিলাম। নতুন মা বাবাকে বললেন “ইমদাদ কে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন”
বাবা বললেন “হুম ঠিকই বলছো, সামনের সপ্তাহেই করিয়ে দিবো” আমাকে আবার ও স্কুলে ভর্তি করানো হলো। আমি স্কুলে যেতে লাগলাম। বেশ ভালোই চলছিলো দিনগুলি। পঞ্চম শ্রেণী পাশ করলাম। ছষ্ঠ শ্রেনীতে ভর্তি হলাম।। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পরে দেখি বাড়ি কেউ নেই। পাশে বাসার কাকি জানালেন, মামুনি নাকি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পরলে আমার বাবাকে খবর দিয়ে আনা হয়, পরে বাবা মামুনিকে নিয়ে গ্রামের সাস্থ কেন্দ্রে নিয়ে যায়।

বাড়ির উঠনের পাশে একটা মাচা/বেঞ্চি পাতা ছিলো আমি সেখানে বসে তাদের ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি। অনেক্ষন পরে দেখি বাবা হাসি খুশি মুখে আসলেন, মামুনি ও লজ্জা মুখি। পড়ে যেটা বুঝেছিলাম আমার একটা ভাই/বোন হবে। আমি অনেক খুশিই হয়েছিলাম সেদিন। এরপর আমি যেটুকু সময় বাড়ি থাকতাম সবসময় মামুনির সাথে থাকতাম। তাকে সব কাজে সাহায্য করতাম। যখন ডেলিভারির নির্দিষ্ট সময় হলো মামুনিকে সাস্থ কেন্দ্রে নেয়া হলো। আমি সারাটা পথ মামুনির হাত ধরেছিলাম।

আমার একটা বোন হয়েছিলো, কিন্তু সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর আলো তাকে দেখতে দেয় নি। এটা আমার জন্য যতটা বেদনার ছিলো তার থেকে কষ্টের ছিলো যখন শুনলাম আমার মামুনিও নেই। সেদিন আমি ২য় বারের মত মা হারা হয়েছিলাম। বাবা আবার ও ভেঙে পড়লেন, আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়ে দোকান সামলাতে লাগলাম।

একদিন দোকান এর জন্য কিছু মালামাল নিতে বড় বাজারে যাই, তখন আমার নিজের বড় মামার সাথে দেখা হয়। আমাকে দেখে মামা জড়িয়ে ধরে কান্না করে তারপর ফোনে আমার মায়ের সাথে কথা বলায়। নিজের মায়ের সাথে অনেক দিন পর কথা বলতে পেরে খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। মামা জানায় আমার “মা” নাকি এখন তার নিজ বাড়িতে আছে। আমি জানি গিয়ে দেখা করে আসি। মামা আমার পকেটে একশত টাকার একটা নোট গুজে দিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে মায়ের নাম্বার টা দিয়ে গেলেন।

আমার মায়ের বাড়ি আমাদের গ্রাম এর তিন গ্রাম পরে। হেটে গেলে ২ ঘন্টা লাগে। আমি কাউকে না বলেই ঠিক করলাম মায়ের সাথে দেখা করবো। দুই দিন পরেই সকাল ১০ টার দিকে রওনা হলাম নানা বাড়ির উদ্দেশ্যে। ভাবলাম অযথা টাকা খরচ না করে হেটেই যাই । ১২ টার কিছু পর গিয়ে সেখানে পৌছালাম। বাড়ির ভিতর এলাহি কান্ড চলছিলো। মনে হচ্ছে কারো বিয়ে।

বড় মামাকে দেখলাম খুব ব্যাস্ত ভাবে ছুটাছুটি করতাছেন। আমি গিয়ে তাকে ডাক দিলাম। আমাকে দেখে মামা প্রথমে একটু হচকে গিয়েছিলেন। মামা আমার হাত ধরে তাদের ঘরে নিয়ে যায়। একটা প্লেটে কিছু খাবার দিয়ে বলে “চুপচাপ খেয়ে এখানে শুয়ে থাকবি, কোথাও যাবি না আমি না আসা পর্যন্ত” আমি মাথা নেড়ে হ্যা জানাতে মামা চলে যান। খাবার টা ওখানেই রেখে আমি বেড়িয়ে পরি মাকে খোজার উদ্দেশ্যে। আমি মায়ের ঘরটা চিনি তাই সেদিকে যেতে লাগলাম। কিছু একটার সাথে ধাক্কা লেগে এক মহিলার গায়ে শরবত পরে যায়।

মহিলা ক্ষিপ্ত হয়ে আমাকে একটা থাপ্পড় দিয়ে কিছু কটু কথা বলে, আমার জন্য ওনার চার হাজার টাকার শাড়ি নষ্ট হয়েছে। আমার বাবা মা তুলেও কিছু বলতে লাগলেন। আমাকে ঘিরে একটা ছোট খাটো ভীড় জমা হলো। অনেকেই আমার চেনা কিন্তু তারা হয়তো আমাকে চিনতে পারছে না । হঠাৎ ভীড় ঠেলে আমার মা আসলেন। ভাবটা এমন যেন আমাকে সে চিনেই না। ওই ভদ্র মহিলার কাছে মা ক্ষমা চাইলেন। মহিলা সম্ভবত বর পক্ষের কেউ। মা আমার হাত ধরে তার রুমে নিয়ে গেলেন। আমি তখন খেয়াল করলাম মায়ের পরনে বিয়ের শাড়ি আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না। মামা কেন আমায় তার ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি মাকে কিছু না বলে বের হয়ে গিয়েছিলাম।

সেই ঘটনার পর আর মায়ের সাথে কোনদিন দেখা বা ফোনেও কথা হয় নি। আমি নিয়মিত দোকান চালাতাম। একদিন আমার এক পুরানো সার আমায় বললেন আমি যেন আবার স্কুলে ভর্তি হই। বইয়ের খরচ সব তিনি দিবেন। আমাকে ক্লাস করতে হবে না। শুধু পরিক্ষা দিলেই হবে। আমি স্যারের কথা মত তাই করেছিলাম। অষ্টম শ্রেনীতে ভর্তি হলাম। স্যার বই দিলেন, সন্ধ্যা অবদি দোকান চালিয়ে রাতে বাড়ি গিয়ে বই পড়তাম। বাবার সেদিকে কোন প্রকার ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। সে মন চাইলে কাজ করতো নাহয় সারাদিন বাড়িতে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতো।

আমি বাজার করে বড় চাচির ঘরে দিতাম সে রান্না করে দিতো তাই খেতাম। এভাবে করে এস এস সি পাশ টাও করে ফেললাম। সারা দিন দোকান চালাই রাতে বাড়ি ফিরতাম।একদিন বাড়ি ফিরে দেখি বাড়িতে অনেক লোকজন, সবার মাঝে আমার বাবা আর তার সাথে আরেকজন মহিলা নববধু সাজে বসে আছেন। যেটা শুনলাম উনি আমার নতুন মা। ওনার আরো দুটি সন্তান আছে। মেয়েটা ১৩ বছরের আর ছেলেটা ১১ বছরের। আমি মনে মনে ভাবলাম যাক এবার অন্তত কাউকে মা বলে ডাকতে পারবো। সাথে দুইটা ভাই-বোন ও পেলাম।

কিন্তু আমার সব ধারনা পালটে গেলো ১৭ দিনের মাথায়, নতুন মা আমাকে উঠতে বসতে কথা শুনাতেন। আমি সকালে দোকানে যাই দুপুরে ফিরে দেখি ঘরে খাওয়ার জন্য কিছু নেই। প্রায় দিনই না খেয়ে থাকতে হয়। তার উপর নতুন ভাই বোন দুটি দোকানে গিয়ে যা ইচ্ছা নিয়ে আসে। কিন্তু বাড়িতে এসে বলে আমি ওদের কিছুই দেই না। বাবা ওদের কথায় আমার দোকানে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। সে দোকান চালাতে শুরু করে, আর আমায় দিন মজুরের কাজ করতে বলে।

বাবার কথা মত আমি তাই করতে লাগলাম। একদিন এক বড় ভাই জানালেন আমি যেন তার সাথে ঢাকাত গিয়ে তার দোকানে কাজ করি। ঢাকায় তার বড় এক দোকান আছে। কথাটা বাবাকে জানালে সে যেতে দিতে রাজি হলেও আমার যাতায়াত খরচা দেয় না। পরে সেই বড় ভাইয়ের থেকেই ধার নেই কিছু টাকা। পাড়ি জমাই ঢাকা শহরে। প্রথম প্রথম অসস্থি লাগলেও পরে মানিয়ে নিয়েছিলাম। সারাদিন দোকানে কাজ করতাম রাতে বড় ভাইয়ের ঠিক করে দেয়া একটা বস্তিতে থাকতাম। বেশ ভালোই চলছিলো।

একদিন বস্তিতে পুলিশ আসলো সব ঘর তল্লাসি করলো। আমার ঘরটাও করলো। আমার ঘর থেকে কয়েক পাতা লাল ট্যাবলেট পেলো। আমি জানতাম না ওই গুলা কি ছিলো। পুলিশ আমায় থানায় নিয়ে যায়। অনেক মারধর করে, অন্নান্য আসামিদের থেকে জানতে পারলাম ওই গুলা নেশা জাতিয় কিছু।

আমার ৩ বছরের সাজা হলো, সেই তিন বছরের অনেক কিছু শিখেছি জীবন কাকে বলে বুঝেছি। তিন বছর পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই ভাবলাম গ্রামেই ফিরে যাই। জেল থেকে বের হওয়ার সময় জেলার সাহেব পাঁচশত টাকা দিয়েছিলেন। সেটা নিয়েই গ্রামে রওনা হলাম। গ্রামে গিয়ে দেখলাম আমার জেলে যাওয়ার বেপারটা সবাই জানে। আমার বাবা আর ৩য় মা আমায় বাড়িতে যায়গা দিলেন না। গালাগালি করে বের করে দিলেন বাড়ি থেকে।

রাগে দুঃখে আবার ও সেই ব্যাস্ত নগরিতে রওনা হলাম। গিয়ে উঠলাম আবার সেই ঢাকা শহরে। কিন্তু ঢাকা শহরে কাজ পাওয়া মুখের কথা না, দিনে এদিক সেদিক ঘুরতে থাকি যদি একটা ভালো কাজ পাই। রাতে বেলা রাস্তার পাশে পড়ে থাকা রিকশা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি এসব এ ঘুমাতাম। চার দিন কেটে গেলো ঠিক মত খাওয়া হয় না। খেতাম ই বা কি করে? খাবারের পয়সাই তো ছিলো না। বিভিন্ন মসজিদে যেতাম, যদি মিলাদ হতো তবে কিছু খেতে পারতাম। এমন কি মন্দির পর্যন্ত যেতাম যদি ভালো প্রসাদ পাই।

একদিন হাটতে হাটতে কোথায় গেলাম বুঝতে পারলাম না। রাত কয়টা বাজে বুঝতে পারছিলাম। এশার আজান হয়েছিলো আরো অনেক আগে। একটা বড় গাছের নিচে বসে বসে ভাবছিলাম কি করা যায়। তখন দূরে দেখি এক লোক সাথে এক মহিলাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। লোকটাকে দেখেই মনে হচ্ছে খুব মাতাল। মহিলা তেমন কোন কথা বলছে না, শুধু “হাত ছাড় হাত ছাড়” বলছে। ভাবলাম মহিলা হয়তো বিপদে পড়েছে, তাই গিয়ে লোকটার হাত থেকে মহিলাকে ছাড়াতে চাইলাম।

আমি গ্রামের ছেলে, হাল চাষ করেছি, তার উপর জেলে পাথর ভাঙার কাজ করেছি। আমার হাত বেশ শক্ত, তাই দুই এক ঘুষি দিতেই লোকটা দৌড়ে পালালো। ভেবেছিলাম মহিলা খুশি হবে, কিন্তু উনি উলটো আমাকে ঝাড়তে লাগলেন। আর কাঁদো সুরে বললেন, ” হায় হায় কপাল, সারা দিনে একটা কাস্টমার পাইলাম তাও এই সালির বেটার লাইগা ছুইটা গেলো। ঐ ভাতারের পুত তুই অরে ভাগাইলি কেন??”

মহিলার বয়স টা ৪৫ থেকে ৫০ এর মধ্যে হবে। কিন্তু ওনার কথা কিছু বুঝলাম না। আমি জিজ্ঞেস করলাম “উনি না আপনাকে জোড় করছিলো” মহিলা জবাব না দিয়ে, আমার পা থেকে মাথা অবদি ভালো করে দেখলেন। তারপর বললেন, “এ শহরে নতুন মনে হইতাছে তরে..?? বাড়ি কই তর?” আমি আমার বাড়ির ঠিকানা, আর শুধু তৃতীয় মায়ের থেকে বেচে ঢাকা আসার কাহিনি ওনাকে বললাম। আমার কাহিনী শুনে উনি আফসোস করলেন। তারপর বললেন, “দেখ এটা ভদ্র লোকের শহর না, আমি চাইলে তরে আমার লগে নিতে পারি কাজ ও দিবার পারি, কিন্তু তোরে আমার কথা মতন চলতে হইবে ”

আমি রাজি হয়ে গেছিলাম সেদিন। কারন, আমার একটা থাকার যায়গা আর কাজের বড্ড দরকার ছিলো পেট চালানোর জন্য। আমি মহিল পিছু পিছু হাটতে লাগলাম, একটা চিপা গলি দিয়ে হাটছি। প্রত্যেক বাড়ির সামনে একজন করে মেয়ে অথবা মহিলা আছেই। যেই বাড়ির সামনেই যাই, সবাই হাত ধরে টানাটানি করে। জেলে থাকতে শুনেছি এই ধরনের যায়গাকে পতিতা পল্লি বলে, আমি কোন দিন ভাবতে পারিনি আমার থাকার যায়গা এখানে হবে। মহিলার দুই রুমের একটা ঘর, একটাই বিছানা অন্য রুমে এক পাশে টয়লেট অন্য পাশে রান্না করার যায়গা। আমাকে মাদুর পেতে নিচে থাকতে হবে।

মহিলা বলেছে, যতদিন না কাজ পায় আমি যেন ঘর থেকে না বের হই। আমিও ওনার কথার অবাধ্য হই না। উনি প্রতিদিন সকালে বের হন দুপুরে আসেন। রান্না করে দুজনে খাই তারপর আবার উনি চলে যেতেন, রাত দশটা এগারোটার পরে আসতেন। কোন কোন দিন বিকেলেই চলে আসতেন। এভাবে ৮ দিন কেটে গেলো। মহিলা আমায় একটা ব্যাংকে রাতে দারোয়ানি কাজ জোগাড় করে দিলেন মাসে আট হাজার টাকা বেতন। সেটা ছিলো আমার জন্য ঈদের খুশির মত, আমি সন্ধার পরে বের হতাম, ডিউটি শেষে আবার ফজরের পর পর চলে আসতাম।

মহিলার অনুমতি নিয়ে আমি তখন তাকে আম্মা বলে ডাকি, কিন্তু সে আমায় “ছোকরা” বলেই ডাকতেন। চাকরির ১৩ দিন হয়ে গেলো। এক দুপুরে আম্মা বেশ অসুস্থ অবস্থায় ঘরে আসলেন। ওনার অনেক রক্তপাত হচ্ছিলো। আমি আস্তে আস্তে আম্মাকে বিছানায় শুয়ে দিলাম। তারপর প্রায় তিন চার দিন আম্মা বেশ অসুস্থ ছিলেন। রাতে ডিউটি করতাম দিনে আম্মার সেবা করতাম। চতুর্থ দিন আম্মা আমায় বাবা বলে ডাক দিয়ে কাছে ডেকেছিলেন। আমি এক প্রকার দৌড়ে তার কাছে গিয়েছিলাম। আম্মা আস্তে আস্তে বলেছিলেন “বাবারে এখন তো ভালো চাকরি করিস, বেতন পেলে একটা ঘর ভাড়া নিতে পারবি না? তারপর সেখানে আমায় নিতে পারবি তো?”

আমি আম্মার একটা হাত বুকে নিয়ে বলেছিলাম “খুব পারবো আম্মা, খুব পারবো” আমি দিনে আম্মাকে রান্নায় সাহায্য করি, রাতে ডিউটি করি।সেই পল্লি থেকে অনেক দূরে একটা বাসা ঠিক করেছিলাম, বেতন পেলেই সেই বাসায় উঠবো। আম্মা সুস্থ হলেও আর ঐ কাজে যেতেন না। সারা দিন ঘরে বসে থাকতেন। প্রথম দিকে একবার আম্মাকে জিজ্ঞেস করেছিলা সে এই রাস্তায় কেন আসলো? আম্মা সেদিন আমায় দুইটা থাপ্পড় দিয়ে বলেছিলো “আর যদি কোন ওই প্রশ্ন করি আমি যেন আমার রাস্তা মাপি” তাই আর জিজ্ঞেস করিনি কোন দিন।

মাস প্রায় শেষের দিকে, আমি বেতনের অপেক্ষায় কবে বেতন দিবে কবে সেই নতুন বাড়ি যাবো আম্মাকে নিয়ে। এই সব ভাবতে ভাবতে ডিউটি শেষ করে পল্লিতে গেলাম। গিয়ে দেখি আম্মার ঘরে অনেক লোক, অত ভোরে আম্মার ঘরের সামনে ভিড় দেখে বেশ চিন্তিত হলাম। আমি সামনে যেতেই সবাই আমাকে বেধে ফেললো। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। কোন রকমে ভিতরে তাকিয়ে দেখি রক্তাক্ত অবস্থায় আম্মা মাটিয়ে পরে আছেন।

আমি ৩য় বারের মত মা হারা হলাম সেদিন। আমাকে জেলে দেওয়া হলো অভিযোগ একজন ৪৮ বছর বয়সী মহিলাকে ধর্ষণ করে হত্যা। আমি তাদেরকে অনেক বলেছিলাম আমি খুন করিনি, উনি আমার আম্মা হন। কিন্তু কেউ আমার কথা শুনলো না। আমার জেল হলো, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জেল। আট বছর জেলে থাকার পর, আমার ব্যবহার চলাফেরা, চালচলন দেখে জেলারের মায়া হলো। তাই সে আমার জামিনের ব্যবস্থা করলো। সামনের কাল ছাড়া পাবো ।।।

আমি একজন জেল পুলিশ, রাতে ডিউটি করি। প্রতিদিনের মত আজকেও ডিউটি করছি। সেল নাম্বার ৩১৫ তে আলো দেখে সেদিকে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি এক আসামি তার জীবনের গল্প বলতাছে, তাই শুনতে লাগলাম। আমি সহ অন্নান্য গার্ড রা ও এসে বসেছে গল্প শুনতে। বাস্তব জীবনের গল্প বলেই মনে হয় সবার আগ্রহ বেড়েছে। পাশে থেকে আরেক আসামি জিজ্ঞেস করলো, “জেল থেকে বের হইয়া কি করবেন?” সেই আসামি বললো, “জানিনা, তবে ভাবছি গ্রামে যাবো অনেক দিন মাকে দেখিনা, মায়ের হাসি দেখিনা, মাকে মা বলে ডাকাও হয় না । তাই যদি একবার দেখা পাই”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত