কালচে রাঙ্গা পেন্ডুলাম

কালচে রাঙ্গা পেন্ডুলাম

ভর সন্ধ্যায় আমার স্ত্রী আমার বৃদ্ধ বাবাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়ার দু ঘণ্টার মধ্যে ওকে ডিভোর্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে গেলো। কোমরে ব্যাথা পেয়ে বাবা খাটে আধশোয়া হয়ে পিটপিট চোখে চেয়ে থাকলেন। যেন চেয়ে থাকা ছাড়া আপাতত তাঁর আর কিছু করার নেই। তাঁর পাশে বসে ঝাড়া দুই ঘণ্টা পারিবারিক সভা চলল। আমার বড় দুই ভাই-চাচা-মামা-খালু-ফুপা কেউ বাদ নেই আসতে।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বংশের ময়মুরুব্বিদের উপরে কথা বলার দুঃসাহস আমার কোন কালেই ছিল না। আমি এক পাশে কিছুক্ষণ মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে থেকে বের হয়ে এসেছি। মিলির বাবা অর্থাৎ আমার শ্বশুরও ছিলেন সভায়। তাঁর কোন কথা-ই যে পাত্তা দেয়া হয়নি তা তাঁর বিদায় বেলার অসহায় দৃষ্টিই বলে দিচ্ছিল। ভীষণ নিরীহ গোছের আমার শ্বশুর মহাশয় সম্ভবত বলার মত তেমন কিছু খুঁজে পাননি। পাবেন কী করে? গত তিন মাসে ঘরের অর্ধেক কাঁচের জিনিষপত্র নাই হয়ে গেছে। মিলির হাতে এ বাড়ীর কম-বেশি সবাই লাঞ্ছিত হয়েছে। মায়ের কপালের কালো দাগটা এখনও মিলিয়ে যায়নি। আজও মিলি কী একটা বিষয়ে রাগ করে কাঁচি দিয়ে নিজের চুল কাটতে বসেছিল। বাবা বাধা দিতে এসেই আচমকা ধাক্কা খেয়ে বসলেন। এ যে ভীষণ বেয়াদবি! ছোট বোন ওর স্বামী নিয়ে উপস্থিত হয়েই ঘোষণা দিয়েছে, এই পাগল-ছাগল মেয়েকে আমি এতদিন ভাবি হিসেবে মেনে নিছিলাম কেবল আমার মরা বোনটার কথা মনে করে। আমার জোড়ের বোন মনে করতাম। বাট এনাফ ইজ এনাফ!

আমিও কম যাইনি। কষে থাপ্পড় লাগিয়েছি মিলির গালে। ভেবেছিলাম ওর জিদ আরও বেড়ে যাবে। অথচ কী আশ্চর্য! থাপ্পড় খেয়ে মিলি ভয়ানক শান্ত হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকলো আমার দিকে। পরে এক পা দু পা করে বেডরুমে চলে গেলো। একটা টু শব্দ করলো না। এইতো মাত্র সেদিনকার কথা। বড়জোর বছর ছয়েক হবে। অসম্ভব লক্ষ্মী একটা মেয়ে বিয়ের আগে তার হবু স্বামীকে ঠাট্টা করে বলেছিল, আমার মাঝেমধ্যে খুব ভয় করে, জানো? শুনেছি অনেক পুরুষ নাকি বউয়ের গায়ে হাত তোলে। তোমার সে রকম কোন ইচ্ছা আছে নাকি? হিহিহি।
এমন অদ্ভুত কথায় হবু স্বামীটি রেগে গিয়েছিল। এসব কী ধরনের কথা! ছিঃ!

মেয়েটি হবু স্বামীর হাত জড়ো করে ধরে বলেছিল, তোমাকে অনেক ভালোবাসি। আমার তো মা নেই। তোমার বুক থেকে আমার আশ্রয় কখনও কেড়ে নিও না, হুম? হবু স্বামী পুরুষটি প্রচণ্ড জোরে বুকে চেপে ধরে কথা দিয়েছিল মেয়েটিকে। স্বপ্নময় সেই দম্পতী অন্য কেউ নয়। আমি আর মিলি! অথচ কোথা থেকে কী হয়ে গেলো। আজ কত সহজে ওর গায়ে হাত তুলে ফেলেছি! সবাই যে যেভাবে পারছে মিলিকে অপমান করছে। আমি সব-ই নীরব সমর্থন করে যাচ্ছি। নাহ! এভাবে আর কত?

লজ্জার মাথা খেয়ে পারিবারিক সভায় জানালাম, আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে আলাদা থাকব। প্রয়োজনে অনেক দূরে কোথাও চলে যাব। ডিভোর্স আমার পক্ষে সম্ভব না। ধিক্কার উঠল আমার নামে। আমার এক চাচা তো বলেই ফেললেন আমি নাকি বংশের কুলাঙ্গার। যেমন-তেমন কুলাঙ্গার না। অতি নিম্ন শ্রেণীর বউয়ের পাছা চাটা কুলাঙ্গার। পিক-আপ ভাড়া করা হয়ে গেছে। সকাল হতেই চলে আসার কথা। আমার আর মিলির সামান্য যা কিছু ছিল তা গুছিয়ে নিতে খুব একটা বেগ পেতে হলো না। বাড়ীর সবাই রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। তাঁদের চোখে আমার মত এমন কাপুরুষ সন্তান এই বংশে আর একটিও নেই।

সারারাত আর ঘুম হলো না আমার। মিলি কেমন আলুথালু চুল ছড়িয়ে বাচ্চাদের মত গুটিসুটি মেরে ঘুমুচ্ছে। শেষ রাতের দিকে একবার চোখ মেলে তাকিয়ে বলেছে, আচ্ছা তুমি কি আজও অফিস থেকে ফেরার পথে উল কিনে আনতে ভুলে গেছিলা? আব্বা-আম্মার সোয়েটারটা এখনও শেষ করতে পারলাম না। শীত এসে যাচ্ছে কিন্তু!
আমি মিলির কথায় কোন উত্তর দেইনি। ওর মুখটা এখনও কেমন লাল হয়ে আছে। ভাল করে দেখলে আঙ্গুলের দাগগুলো এখনও গুণে বের করা যায়। এর চেয়ে শতগুণ দাগ যে আমার পাঁজর জুড়েও রয়েছে! সেই দাগ আমি দেখাবো এমন মানুষ কই!

মিলি বেশীক্ষণ জেগে থাকতে পারেনি। পুরনো ওষুধ আবারও শুরু করা হয়েছে। একটু আগে বেশ এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলো। এখন বৃষ্টি নেই। জানালা খুলে দিয়েছি। বাইরে থেকে হূহূ করে ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাটকা লাগছে আমার অবশ শরীরের প্রতিটা লোমকূপে। বাইরের আলোআঁধারিতে বাড়ীর সীমানার শেষ প্রান্তে থাকা ড্রেনটা দেখা যাচ্ছে। দু বছর আগের এক ভরা বরষায় এই ড্রেনেই মাত্র দেড় বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। শিশুটি আমার। শিশুটি মিলির। মিলির ধারনা, ওর অসতর্কতা-ই আমাদের কোল-ভরা বাবুটির মৃত্যু ডেকে এনেছিল।

সময়ের আবর্তে অনেকেই এটাকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিলেও শিশুটির মা হঠাৎ পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার নামের এক কঠিন মানসিক ব্যাধির কবলে পড়ে গেলো। ব্যাধির ভয়াবহতা যে এই পর্যায়ে গড়াতে পারে তা কে জানত? অনেক ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এখনও চলছে চিকিৎসা। তবু দুদিন পরপর এমন অসামাজিক আচরণকে ক্ষমার অযোগ্য উপদ্রব হিসেবেই সবাই দেখছে এখন। তাঁদের ছেলে তো জলে ভেসে আসেনি যে মানসিক বিকারগ্রস্ত বউ নিয়ে অনিশ্চিতকাল ধরে পড়ে থাকবে! অভাগার চোখ নাকি সাগরের জলও শুষে নেয়। অদ্ভুত কারণে মিলির গর্ভে নতুন বাচ্চার ভ্রুণ দাঁড়াচ্ছে না। এটা সম্ভব হলে কিছু একটা হলেও হয়ত হতে পারতো। এ নিয়েও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ইনিয়েবিনিয়ে কথা কম শুনতে হয়নি।

কিন্তু আমার কী করার আছে? জীবন-মরণের যে গাটছড়া ভীষণ বেগবান এক স্বপ্ন নিয়ে একসাথে বেঁধেছিলাম তা থেকে সরে যাওয়া অন্তত এই জন্মে সম্ভব নয়। সবার সব ক্ষমতা থাকে না। আমারও নেই। সমাজের ভাষায় আমার স্ত্রী পাগল অথবা সেরকম কিছু। আমি না হয় বাকী জীবনটা পাগলের স্বামী হয়েই থাকলাম! তবু আমি শেষ চেষ্টা করে যাব। যেই হাতে ওকে আঘাত করেছি, সেই হাতে ওর ব্যাথায় প্রলেপ দিয়ে যাব। হ্যাঁ, আমাকে সমাজ যে নামে ডাকে – ডাকুক! সুবহেসাদিকের পর মা ফজরের নামাজ শেষে দরজায় উঁকি দিলেন। দরজা খোলাই ছিল। আমাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, মিলি কী করছে রে? বললাম, ঘুম।

– তোর মনে আছে তোর বড় আপুর কথা?
– আবছায়া মনে আছে।
– ও বেঁচে থাকলে এতদিন বাচ্চাকাচ্চার মা হয়ে যেত।

গত রাতেও ওকে স্বপ্ন দেখলাম। মুখটা কেমন বিষণ্ণ। মা একটু দম নিলেন। আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, তোদের পিক-আপ-এ আমার জন্যও একটা জায়গা রাখিস। মা হয়ে জন্মানো অনেক কষ্ট রে খোকা!

মা কাঁদছেন। আমার ভেতরে কোথায় যেন করুণ বাঁশি বেজে চলেছে অনবরত। থামছে না। পৃথিবীর সব মায়ের নাড়ীর সাথে সন্তানের এই বাঁশির আজন্ম সংযোগ। আমার মা, আমার সন্তানের মা, অথবা অন্যকোন মা। অবিচ্ছেদ্য বাঁশি বাজতেই থাকে। বাঁশি থামবে না। কখনও থামে না!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত