সকালে চা দিতে গিয়ে আমার হাসবেন্ড ইফতি আমার দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। কাগজটা দেখে আন্দাজ করতে পারছি এটা কি হতে পারে। ইফতি ভনিতা ছেড়ে বলল,
– সাইন করে দেও
– তা কখন বেড়িয়ে যাবো?
– সেটা তোমার ব্যাপার তবে আজ হলেই ভালো হয়।
– ঠিক আছে।
আমাদের বিয়ের ৫ বছর হলো। এই পাঁচ বছর এই বন্দিশালায় কিভাবে থেকেছি তা আমি জানি। বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়েছিল। আমি তখন অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। হুট করেই বিয়েটা ঠিক করে বাবা। আমাকে যখন বলেছিলেন আমি কোনো প্রতিবাদ করি নি। বাবা-মা এর ভালো মেয়ে হতে চেয়েছিলাম। বিয়ের আগে বাবা বলেছিলেন,
– মা রে অনেক ভালো ছেলে, বেশ ইনকাম তোর খেয়াল রাখবে। কষ্ট পেতে দিবে না।
আমার বাবা ছা পোসা মানুষ, চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত। মা-বাবা দুজনের ধারণা ছিল বাবা রিটায়ার্ড করলে আমার জন্য ভালো পাত্র পাওয়া যাবে না। তাই এই সুযোগ ছাড়লেন না। বিয়েটা হয়ে গেলো। ইফতি একজন উচ্চশিক্ষিত ছেলে, ভালো মাইনের চাকরি, দেখতে ভালো আর কি চাই একটা মেয়ের। বিয়ের প্রথমে আমার আদর আপ্পায়নের কোনো কমতি ছিল না। আমার শ্বশুর বাড়ি আবার কোনো যৌতুকে বিশ্বাস করেন না, তবে মেয়ের সুবিধার্তে উপঢৌকন নিতে দোষ নেই। হোক না তা দামি ফ্রিজ কিংবা ওয়াশিং মেশিন বা এসি। বাবাকে আমার সুবিধার্তে একটা বড় লিস্টি ধরিয়ে দিলেন। আমার মানা করা স্বত্তেও বাবা অনেকটা ধার দেনা করেই লিস্টির উপঢৌকন গুলা কিনে দিলেন। আমার প্রশ্ন তাদের ছেলের মাইনে তো খারাপ নয় তবে বাবার কাছে এভাবে নেয়ার কি মানে?
বিয়ের পর আমার পড়ালেখা প্রায় বন্ধ। কারন আমার শ্বাশুড়ি মার ধারণা মেয়েদের এতো পড়ে কি হবে!! সে তো সংসার আর বাচ্চা-কাচ্চাই সামলাবে। তাতে এই পড়াই যথেষ্ট। আমি এবারও কোনো প্রতিবাদ করি নি। আমার সংসার খারাপ তো যাচ্ছিলো না। সকাল থেকে সবার ফরমায়েশ পূরণ করে রাতে বরের মনোরঞ্জন করা, যাকে বরের ভালোবাসা বলে। এভাবেই দিন চলছিল, আমারো কোনো অভিযোগ ছিল। কিন্তু কেউ কোনোদিন আমি কেমন আছি বা আমার কি কিছু চাই বা আমার দিন কেমন যাচ্ছে তা জিজ্ঞাসা করতো না। আমার হাসবেন্ড তার দিন কেমন যাচ্ছে তা জানাতে ভুলতো না,কিন্তু আমার কথা জিজ্ঞেস করাটা প্রয়োজন মনে করতো না।
প্রথম একবছর ভালোই চলছিল কিন্তু বিপত্তি অন্য জায়গায় হল, আমার বাবার পক্ষে আমাকে নতুন করে কিছুই দেয়ার সামর্থ্য নেই। আমার শ্বাশুড়ি মার তাই কথায় কথায় খোটা দেয়াটা একটা দৈনন্দিন কাজ হয়ে গেছিল। আমার বরও আমাকে ছেড়ে কথা বলে না, আমার তখন সব কাজেই কেমন যেন খুঁদ। এবার ও কোন প্রতিবাদ করতে পারি নি। আমার গা এ যেন গন্ডারের চামড়া, কিচ্ছু যায় আসছে না।
একদিন ইফতির কলিগদের আমাদের বাসায় দাওয়াত ছিলো। সারাদিন তাদের খাবার দাবারের খেয়াল করতে যেয়ে আমার নিজের দিকে খেয়াল করি নি। আমার পোশাক খুবই সাধারণ ছিল। ইফতির হাই ক্লাস সোসাইটিতে যা যায় না। যখন তারা ওকে ওর ওয়াইফের কথা জিজ্ঞেস করলো সুন্দর বলে দিল,
– ও ওর বাবার বাসায়,ওর বাবা একটু অসুস্থ।
আমি হতবাক, কি বলা উচিৎ ছিল আমার জানা নেই। আমি সেদিন ও প্রতিবাদ করি নি।রাতে ইফতিকে যখন জিজ্ঞেস করলাম কেন এমনটা করলো, উত্তরে শুনলাম আমি নাকি একটা আনকালচার্ড মেয়ে,আমাকে পরিচয় করিয়ে নিজেকে ছোট করতে চায় নি, অথচ এই লোকটার জন্য আমি সকাল থেকে এত খাটাখাটুনি করেছি। আমার ননদের যখন বিয়ে তখন আমাকে আমার শ্বাশুড়ি তাচ্ছিল্যের সাথে বললেন,
– তোমার বাবা পারেন ও বাপু, মেয়ের শ্বশুর বাড়ির সাথে স্ট্যাটাস কিভাবে মানিয়ে চলতে হয়,তাও কি এই বয়সে শিখিয়ে দিতে হবে।
– বাবা তো চাকরি করেন না মা, এই পেনশনের টাকায় যা পেরেছেন এনেছেন।
আমার নম্র গলায় করা প্রতিবাদ যেন শ্বাশুড়ি মার পছন্দ হলো না। অকথ্য ভাষায় কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। তাতেও তিনি থেমে যান নি, ইফতিকে বলে শালিসি বসালেন যে আমি তার সাথে বেয়াদবি করেছি। ইফতি বিনা কারনে আমাকে মায়ের কাছে ক্ষমা চাওয়ালো। আমি প্রতিবাদ না করে ক্ষমাও চাইলাম, গুরুজন ক্ষতি তো নেই ক্ষমা চাইতে।
সংসার চলছিল ঠিকই তবে ইফতি কেন জানে রোজ রাতে দেরী করে বাড়ি আসতো। খেয়ে আসতো বেশিরভাগ। আমি জিজ্ঞেস করলে তার সোজা মুখে উত্তর পাওয়া যেত না। রাতে বারান্দায় ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতো। ঘুমানোর সময় আমার পাশে তাকে পাওয়া বিরল। একদিন মায়ের রুমে যখন সে কথা বলছিল,তখন তার মোবাইলে ফোন আসে। অনেকবার বাজছিল আর কেটে যাচ্ছিল। তাই না পারতে আমি ধরেছিলাম। ফোনের অপাশে গলাটা শুনে আর কিছু কথা শুনে আমার বুঝা হয়ে গেলো এই মানুষটি আর আমাতে সীমাবদ্ধ নয়। আমার হাতে নিজের ফোন দেখে ইফতির মেজাজ বিগড়ে গেলো। আমার গালে চড় মারতেও সে আপত্তি করলো না। আমি সেদিন ও প্রতিবাদ করি নি।
নাতি নাতনির মুখ দেখবেন বলে আমার শ্বাশুড়ি মার আবদার বেড়েই যাচ্ছিল। আমি তো তাকে বুঝাতে পারছি না যে আপনার ছেলেই আমার নয়, আমি কিভাবে তার সন্তানের মা হব। আমাকে বাজা, বন্ধা মেয়েছেলে ইত্যাদি বলে সব সময় কথা শুনাতে থামতেন না। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতাম, প্রতিবাদ তখনও করি নি।
কিছুদিনের মধ্যে আমার বরের বিরক্তির কারন হয়ে গেলাম, আমাকে তার যেন দু চোখে সহ্য হচ্ছে না। আমাকে নানা ভাবে বুঝাচ্ছে যাতে আমি তাকে ছেড়ে দেই, কিন্তু আমি কি করবো, মাটিতে দাঁত চেপে পড়ে রইলাম। ইফতিকে এই পরিবর্তনের কারন জিজ্ঞাসা করবো না,লাভ নেই।
শ্বাশুড়ি মার সাথে কয়েকদিন ধরে আলাপ আলোচনার পর এই ডিসিশন নিয়েছে হয়তো। আজ আমার কাছ থেকে ডিভোর্স চাইসে,কারন আমি তাকে সুখী করতে পারছি না। আমি সাইন করে দিলেই সে মুক্ত, সাথে আমিও। আমি আজও কোনো প্রতিবাদ করবো না, আমি বরাবরই শিরদাঁড়াবিহীন একজন নারী। প্রতিবাদ আমি করি নি,করাটা হয়তো আমার দ্বারা হবে ও না। মা-বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন তাদের নাম না ডুবাই, তাই করেছি। আমি প্রতিবাদ করি নি,হয়তো তাই আজ আমার এই পরিস্থিতি বা পরিণতি। আমি সাইন করে,নিজের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। আমার গন্তব্য অজানা, বাবা-মার কাছে গিয়ে তাদের লজ্জার কারন হতে দিতে পারবো না। তাই আমি নিজের পথটা নিজেই খুঁজছি। আমি শহরের রাস্তায় হেটে যাচ্ছি, অজানায়। জানি না কোথায় যেয়ে এই পথ থামবে।