সোহেল এর বয়স কত হবে, এই দশ বছর। আর সারিজা’র আট।
দু’জনই মুখ নীচু করে ভাত খাচ্ছে। কারণ, পাশে বাবাও আছেন। তারা আজ বেশি ভদ্র। শুক্রবার তাই আজ সবাই একসাথে। অন্যদিন দুই ভাই বোন ঝগড়া ঝাটি, চিল্লাচিল্লি করে। মাংসের বড় টুকরোটা সোহেলের পাতে চায় সবসময়।
রান্নাঘরের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছে তারা। মা মাটির চুলার পাশে বসা। তরকারি চুলার উপর গরমের তাপে রাখা। ডেকচির নীচে একটা ভাঙা টিনে’র থালা। যাতে করে ডেকচির খাবার পুড়ে না যায়।
হঠাৎ পিতা মহাশয় ডিমসহ প্লেট রান্না ঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ছুঁড়ে মারেন। ভাত পাত থেকে উঠে মায়ের চুল ধরে টান মারেন আর মুখে সজোরে এক থাপ্পড়। থাপ্পড় দিয়ে আবার স্বাভাবিকভাবেই খেতে বসেন।
-আমি কি করছি, কি করছি …
কেঁদে কেঁদে জানতে চান মা জোবাইদা।
-আন্ধি, ডিমে কালো ঐসব কি ছিলো?
-শুকনো খের (ঘাস) চুলায় দিয়ে রান্না, হয়তো ধোয়া’র সাথে উড়ে পড়ছে ।
-জানি জানি, তো দেখে দিবেনা?
-আরেকটা ডিম করে দিই?
নিজের দোষ আছে দেখে জোবাইদাও স্বাভাবিক হয়।।
-না, মেজাজ খারাপ হয়েছে ঐ ডিম দেখে..আর খাবোনা।
সোহেল সারিজা চুপচাপ খেয়ে উঠে। এসব প্রতিদিনের ঘটনা। কখনো বাবা পানির গ্লাস ছুঁড়ে মারেন, কখনো ভাতের প্লেট। আজ ডিমের প্লেট। বিচলিত হবার কিছু নাই। এরপরও সারিজা’র বুক ধ্বকধ্বক করে।
“তাকেও কি বড় হলে স্বামী’র হাতে মার খেতে হবে ছোট খাটো ভুলের জন্য!!”
ছোট মেয়েটির মাথায় স্বামী মানে বাপের মত বদরাগী কেউ। তবে বাবা তাদের মারেন না, তবুও ভয় করে সারিজা’র।
আর সোহেল ভাবে, বড় হলে সেও তার বউকে মারবে!
এদিকে জোবাইদা এতো সাবধানে থেকেও কখনোই স্বামীর মন মতো কাজ করতে পারেনা। বাসন পত্র ধোয়ার পানি পুকুর থেকে আনতে হয় আর খাবার পানি আনতে হয় কল থেকে। কলে’র পানি দুই তিন ঘন্টা পুরনো হলেই কেমন ঘোলাটে হয়ে যায়। কখনো সোহেলের আব্বা পানি চাওয়া মাত্র কলসী থেকে পানি দিতে গেলে, যদি ঘোলাটে দেখে …গ্লাস শুদ্ধ পানি ছুঁড়ে মেরে ঘর নষ্ট করবে। কাঁচের গ্লাস হলে গ্লাসটাও ভাঙে । তাই জোবাইদা বুদ্ধি করে সিলভার গ্লাসে পানি দেয়, ঘর নষ্ট হলেও গ্লাস ভাঙেনা।
সে তার মুখে একটা থাপ্পড় সইতে পারে, গ্লাস ভাঙা না মনে হয়। তারও অবশ্য কারণ আছে। একবার হাতের তালুতে কাঁচ ঢুকে অনেক কষ্ট পেয়েছে, ডাক্তার পর্যন্ত আনতে হয়েছিলো। থাপ্পড়ের ব্যাথা পাঁচ মিনিট পর চলে যায়, কাঁচ ঢুকার ব্যাথা মাসের উপর সইতে হয়েছে।
ছেলের বাপের স্বভাব পরিবর্তন করা সম্ভব না হলেও সে তো সাবধানে থাকতে পারে…ভাবে জোবাইদা।
আর সোহেলের পিতামহাশয় লিয়াকত আলি, একমাত্র পুত্র সন্তান তার বাবা মায়ের। তার পিতা গত হয়েছেন ছোটকালেই, কিছুদিন আগে মাও। অনেক আদরে সোহাগে পালন হয়েছেন তিনি। টাকা পয়সাও বাপে যা রেখে গেছে, তাতে কোন রকমে চলে যাচ্ছে। একটা দোকান আছে সদরে, মাসে মাসে ভাড়া আসে। জমি বর্গা চাষীদের কাছে, সময় মতো ধান আর শুকনো খেরও দিয়ে যায়। তাই নিজের তেমন গরজ নাই টাকা পয়সা কামাবার বা বাড়াবার। টাকা আসছে যখন কাজ করে লাভ কি? ভাবে, ছেলে বড় হলে টাকা কামাবে!
আর সোহেল ভাবে, বাবা কাজ করেন না, বড় হলে আমিও কাজ করবোনা। কত্ত মজা বসে বসে বাপের মতো খাবো আর বউ দোষ করলে মার লাগাবো।
সারিজা,এখনই পড়া লেখায় তুখোড়। ক্লাস থ্রিতে পড়ে, রোল নাম্বার এক। ও মায়ের কাজেও সাহায্য করতে আসে। বাপ পানি চাইলে গ্লাস হাতে এক দৌড় দেয়। ছোট্ট দু’হাতে কল চেপে বাপকে তাজা পানি দিয়ে আসে।
সে এখন থেকেই সব পারফেক্ট করার চেষ্টা করছে। সে বড় হয়ে কোনো ভুল করে মার খেতে চায় না।
বিশ বছর পর,
সারিজা’র বিয়ে হয়ে যায় । স্বামীর সাথে সে দেশের বাইরে থাকে, কাজও করে সেখানে। মাঝে মধ্যে মা বাবার জন্য টাকাও পাঠায় কিছু। সে সুখে আছে। তার স্বামী ছোট খাটো ভুল ত্রুটিতে তাকে বকেনা বরং কাজে সাহায্য করতে আসে। তখন সুখে ওর চোখে জল এসে যায়। মায়ের জন্য নতুন করে তার বুকে ব্যথা হয়।
সোহেলে’র জন্য মেয়ে দেখা চলছে। সে ভালো কোনো কাজ পায়নি। আপাতত: একটা স্কুলের কেরানী’র কাজ করছে, অল্প বেতন। আগের মতো ঘরে মোটামুটি চলে যায়, সে অবস্থা নেই। দুর্মূল্যের এই দিনে নুন আনতে পান্তা ফুরায়।
একটা মেয়ের খবর পাওয়া গেছে অবস্থাসম্পন্ন ঘরের। তবে মেয়ের গায়ের রঙ ময়লা। তাই সাথে ফুল ফার্নিচার দিয়ে ঘর সাজিয়ে দিবে, নগদ দুই লাখ টাকাও।
এতো সুন্দর প্রস্তাব! মেয়ে কালো হলেই দেখি ভালো ! প্রস্তাব লুফে নেন লিয়াকত সাহেব আর সোহেল।
বিয়ে হয়, বিয়ের খাবার দাবার, মেয়ে সাজানো সব মেয়ের পরিবার করে। তারা উল্টো টাকা দিয়ে, কালো মেয়েটা বিক্রি করতে পেরেই যেনো খুশি। টাকা কোনো ব্যাপার না।
জোবাইদা ভাবে, আরেক দ্বিতীয় জোবাইদা’র আগমন হলো, বেচারীর কপালে দুঃখ আছে।
আসলেই তাই।
কোরবানির ঈদ আসে। সোহেল আর তার বাপের সামর্থ্য নাই গরু কিনবে। তাই তারা ঘরের গরু, মনুষ্যত্বের গলা কাটে, জবাই করে।
কোরবানির তিনদিন আগেও বউয়ের বাড়ি থেকে গরু আসেনা। সোহেল চিন্তাগ্রস্থ, এতো দেরি দেখে। বউকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয় গরু কেনার টাকা আনতে।
আমি দূর দর্শক, গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলি,
“কন্যা ….
বাপের বাড়ির পথে নয়, তুমি আইনের বাড়ির পথে যাও…
তুমি ন্যায় পাবে,
তুমি কালো, এটা তোমার অপরাধ নয়।”
কালো মেয়ে শুনতে পায়না। আমার স্বর তার কাছে পৌঁছায়না।
সে বলির পাঠা, হাতে রশি ধরে গরু নিয়েই ফিরে আসে। আর সোহেলের হাতে কন্যা পাঠা’র রশি। সে গর্বের হাসি হাসে,
কালো মেয়ে বিয়ে করার এই তো ফায়দা…..
পুনশ্চ: সব পুরুষই লিয়াকত আলি বা সোহেল কিংবা বউয়ের পিতা’র মন মানসিকতার নয়। সারিজা’র স্বামীর মতো ভালো মনেরও আছেন। সব কালো মেয়ের বাবাও কিন্তু এক নয়। অনেকেই সন্তানকে সুশিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করেন। আর সমাজ এমন বাবাকেই প্রত্যাশা করে।।
২৭.০৪.১৭