বাস্তবতা

বাস্তবতা

বাচ্চাকে কোচিং ক্লাসে ঢুকিয়ে দুই বন্ধু রাস্তার পাশে চায়ের অর্ডার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ এক পুলিশ এসে চায়ের অর্ডার দিয়ে বলল, “এই আমার জন্য বেশি করে দুধ চিনি দিয়ে একটা চা দে।” ছেলেটি আমাদের চা বানাচ্ছে আমরা আগে চায়ের অর্ডার দিয়েছি তাই সে আমাদের দু’জনকে আগে চা দিয়েছে। ওমা পুলিশ জোরে একটা থাপ্পর দিলো ছেলেটাকে কেন তাকে আগে চা দেয়নি। আমরা দু’জন ইয়ংম্যান আমাদেরও রাগ উঠে গেলো অন্যায় দেখে। আমিতো চা’টা ইচ্ছে করে পুলিশের ড্রেসে ফেলে দিয়েছি। তারপর আমার বন্ধু উনার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “মারলেন কেন ছেলেটাকে? এটা কি আপনার সম্পত্তি?”

অনেক লোক জমা হয়ে গেল, পাবলিক প্লেস বলে কথা। কয়েকজন মিলে কিল ঘুষিও দিয়েছে পুলিশটাকে। সবাই বিরাট ক্ষেপে যায় পুলিশের উপর কারণ পুলিশ এখানে ডিউটি করতে এসে চা খাচ্ছে। অন্যদিকে ট্রাফিক জ্যামে শত শত গাড়ি আটকে আছে সেদিকে উনার খেয়াল নেই। কিছুটা রাগে, হুংকার করতে করতে উনি হঠাৎ কি মনে করে যেন ফোন করেছেন থানায়। হয়তো আমাদেরকে থানায় নিয়ে যাবে, নয়তো গরীব ছেলেটার দোকান এখান থেকে উঠিয়ে দিবে। ভাবছি কী করা যায়। থানায় আমার এক বন্ধু এস আই পদে জয়েন্ট করেছে। ওকে আমিও ফোন করে এখানে আসতে বলেছি। বেচারী পুলিশ রাগে ফুসছে আর আমাদের দিকে বারবার তাকাচ্ছে। পুলিশের গাড়ি আসতে দেখে আশে পাশের ভিড় কিছুটা হালকা হল। দেখলাম গাড়ি থেকে আমার বন্ধু আসিফ নেমে আসছে। আমার জন্য নয় চা ওয়ালা ছেলেটার জন্য খারাপ লাগছে। পিচ্ছি একটা ছেলে কত কষ্ট করে হয়তো সংসার চালায় তা কি আমরা কেউ বুঝতে চেষ্টা করি? না জানার চেষ্টা করি?

আসিফ এসেই ট্রাফিক পুলিশকে জিজ্ঞেস করলো আপনি রাস্তা ছেড়ে এখানে কেন? শত শত গাড়ি জ্যামে আটকা আপনি দায়িত্ব পালন না করে এখানে কী করছেন? “স্যার আসলে খুব মাথা ব্যথা করছিল, তাই চা খেতে এসেছিলাম।” আমি সব ঘটনা বলে দিলাম তারপর ছোট্ট ছেলেটা কান্না করতে করতে বলতে লাগল, “স্যার আমি এখানে দোকানদারি করি বলে উনি প্রতিদিন আমার থেকে ফ্রিতে চা খান আর পঞ্চাশ টাকা করে নিয়ে যান। আজ চা বানাতে একটু দেরি হয়েছে তাই মেরেছেন। আমার ঘরে পঙ্গু বাবা, মা মানুষের বাসায় কাজ করে। আমরা ছয় ভাই বোন সবাই ছোট ছোট স্যার।”

ছেলেটির কথা শুনে আসিফ প্রথমে ঐ পুলিশকে বকা দিল। তারপর ছেলেটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিল।
মানবতা আজ কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে বলুন? সরকারি চাকুরি কত টাকা বেতন পায়, আর গাড়ির লাইসেন্স না থাকায় কত টাকা ডেইলি ঘুষ খাচ্ছে তার কোনো লিমিট নেই। ওদের কী খারাপ লাগেনা ছোট বাচ্চা থেকে টাকা নেয়? আসিফ বলল, “দোস্ত তুই না থাকলে হয়ত এই ছেলেটি আরো টাকা দিয়েই যেত নার হয় মাইর খেতো। চিন্তা করিস না আমি ওর বেতন থেকে গুণে গুণে যত টাকা নিয়েছে তার ডাবল ছেলেটিকে দিয়ে দিব। আর সাজা তো আইনে যা আছে তা পাবেন।” সব মিটমাট করে দিয়ে আসিফ চলে গেলো। ছেলেটি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “আঙ্কেল আপনি খুব ভালো মানুষ। আপনার জন্য আমি চিরতরে ঐ পুলিশের হাত থেকে মুক্তি পেলাম।”

আমি ওকে চায়ের বিল দিয়ে আরো একশত টাবা বখশিস দিলাম। ও নিতে চায়নি তবু জোর করে দিলাম আর আমার কার্ডটা দিয়ে বললাম কোনো সমস্যা হলে আমাকে জানাস। তারপর কোচিং থেকে বাচ্চা নিয়ে বাসায় ফিরছি হঠাৎ দেখি একটা রিকশা থেকে একটা মহিলা মেইন রাস্তার উপরে পড়ে গেলো। অনেকটা দূর চলন্ত রিকশা থেকে উঁকি দিয়ে দেখছি। মহিলার আশেপাশে প্যান্ট শার্ট পড়া কত ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন কেউ উনাকে তুলছেন না। প্রায় দুইশত গজ দূর থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে লুঙ্গী পড়া দুইজন ভদ্রলোক মাথায় গামছা বাঁধা অবস্থায় মহিলাকে কোলে করে রাস্তার পাশে নিয়ে শুইয়ে দিলেন। আমি তো অবাক তাহলে বলুন কে ভদ্রলোক? যাদের হৃদয় পরের জন্য কাঁদে, উপকার করে তরাই ভদ্রলোক। তাদের লেখাপড়া নেই তবুও কত সুন্দর শিক্ষা, চরিত্রে নৈতিকতা ফুটে উঠেছে।

আমাদের সমাজ সার্টিফিকেটের শিক্ষায় মূল্যায়ন করে। অথচ কাজে কর্মে গিয়ে দেখুন আসল শিক্ষায় মেরুদন্ড ক’জনের সোজা আছে? আমরা রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কত বৃদ্ধ, অন্ধ দেখি। তাদের একটু সাহায্য করলে, মমতা দেখালে, রাস্তা পারাপারে সহায়তা করলে ব্যক্তিত্ব কমবে না বরং বাড়বে। বাসায় গিয়ে মনটা খচখচ করছে মহিলাটা কেমন আছেন? উনার আত্মীয় স্বজন কেউ এসেছেন কি না আল্লাহ জানে। আমরা ভাড়া থাকি সাত আটটা ফ্যামিলি একটা বিল্ডিংয়ে। কিছুক্ষণ পর পাশের বাসায় চিৎকার শুনে এগিয়ে গেলাম। ওরা বলতেছে কে যেন ফোন করে বলল পাশের বাসার ভাবী রিকশা থেকে পড়ে গিয়েছেন। এখন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। আমার চোখে সেইসেই দৃশ্যটা ভেসে ওঠে। আমি মাত্র মুখে পানি নিছি। শার্টটা গায়ে দিয়ে আবার উনাদের সাথে হাসপাতাল চলে গেলাম।হাসপাতালে গিয়ে দেখি অক্সিজেন দেয়া মুখে, খুব খারাপ অবস্থা।

রক্ত লাগবে, সবাই মিলে চেষ্টা করছি রক্ত জোগাড় করার জন্য। ডাক্তার বললেন A+ রক্ত লাগবে। আমারো একই রক্ত, সারাদিন এক ঝামেলা সেরে এসেছি শরীরটা ক্লান্ত লাগছে। ভাবীর বাচ্চাদের চিৎকার আর সহ্য হচ্ছেনা তাই নিজেই শুয়ে পড়লাম রক্ত দিতে। পাশাপাশি বেড-এ শুয়ে ভাবীকে রক্ত দিচ্ছি, হঠাৎ উনি দুইটা মোচড় দিয়েই নিথর হয়ে গেলেন। বলুন এটা সহ্য করা যায়? এইমাত্র কিছুক্ষণ আগেও উনি জীবিত ছিলেন। ডাক্তার এসে বললেন, “আমি দূঃখিত বাঁচাতে পারলাম না।”
বাচ্চাদের কান্নায় হাসপাতাল অঙ্গন ভারী হয়ে উঠেছে। একটা ছেলে রাজশাহী ভার্সিটিতে পড়ে আর দু’টো থ্রি, ফোরে পড়ে। উনার স্বামী ঢাকা চাকুরী করেন। খবর দেয়া হয়েছে ভাবী অসুস্থ।

বাসায় বড় কেউ নেই। আমরা দু’চার জন ভাড়াটিয়া সাথে এসেছি। আমার পা যেন নড়ছে না কী করবো বুঝতে পারছি না। ছেলের সাথে ফোন করে বললাম তোমার কোনো বন্ধু পাশে থাকলে তাকে ফোনটা দাও। প্রথমে চাপাচাপি করে বলে, “কি হয়েছে আমাকে বলেন।” পরে আমার ধমকে বন্ধুকে ফোনটা দিয়েছে। ওর বন্ধুকে বললাম খুব সুন্দর করে যেন ঘুছিয়ে অন্য কিছু বলে নোবেলকে নিয়ে বাসায় আসে। কিছু বুঝতে না পেরে ডাক্তারকে বললাম স্যার উনার হাজব্যান্ড আর ছেলে অনেক দূরে থাকে। উনারা আসার আগ পর্যন্ত যদি লাশটা রাখার ব্যবস্থা করেন তাহলে কৃতজ্ঞ থাকব। তারপর ডাক্তার অনেক ভেবে লাশটা উনাদের হেফাজতে রাখেন।

আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি বাচ্চা দু’টোকে নিয়ে বাসায় চলে আসি। ওদের চিৎকারে আকাশ বাতাস মনে হয় কেঁপে উঠছে। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা ভাবী দুনিয়াতে নেই। সত্যি আমি হতবাক, নিঃশ্বাসের বিশ্বাস নেই। বাস্ববতা বড়ই কঠিন, মেনে নেয়া যায় না তবুও মেনে নিতে হয়। আজ থেকে ওরা এতিম, মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হবে চিরদিন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত