বার বার কেনো বলো ফ্রিজ খুলতে? একবারে সব বলতে পারো না? ” তুহিন অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি লুকাতে বৃথা চেষ্টা করে বলে, “কাকি আগে নিলে তো, বরফ গলে যেতো বোতলের। তখন ইফতারের সময় ঠান্ডা পানি খেতে পারতাম না।”
রুজিনা মুখটা বাঁকিয়ে বলে, “এত ঠান্ডা পানি খাওয়ার ইচ্ছে থাকলে। তোমার আম্মাকে বলো ফ্রিজ কিনে দিতে। অন্যের ফ্রিজে আর কতো মাছ,মাংস, ঠান্ডা পানি রেখে খাবে? নাহলে তোমার আম্মারে বলবে, কলসির বাইরে কাপড় ভিজিয়ে রাখতে। এতে পানি ঠান্ডা থাকে। তখন গোগ্রাসে ঠান্ডা পানি খেয়ো।” তুহিন মিথ্যা অশ্রু লুকানোর চেষ্টা করে দৌড়ে চলে যায় ঘরে বরফের ঠান্ডা বোতলটা নিয়ে। তার চাচি রুজিনা প্রায়শই এইরকম খোঁচা দিয়ে কথা বলে তুহিনকে আর তুহিনের মা কে। তুহিনের মা বড় বউ হওয়ার সুবাদে ছোটো দেবরের বউয়ের সব কথা শুনেও কিছু বলে না। ভাবে ঝগড়া করে কি লাভ? নিজেরা ঝগড়া করলে প্রতিবেশীরা খারাপ বলবে।
সুলতানা চুলায় বসানো কড়াইয়ের গরম তেলে আলুর চপটা ছাড়তে ছাড়তে খেয়াল করে, তুহিন বাম হাত দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরে ঢুকছে। সুলতানার বুঝতে আর বাকি থাকে না, তুহিন কে রুজিনা কিছু বলেছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া তুহিন অনেক লাজুক আর অভিমানী প্রকৃতির। কেউ কিছু বললেই তার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার নিজের অজান্তেই। এইগুলো ভাবতে ভাবতেই কড়াই থেকে গরম তেলের ছিটা এসে হাতে লাগে সুলতানার। সাথে সাথে অসহ্য যন্ত্রণা করতে থাকে তার হাতে। পাশে থাকা পানি ভরা বালতিতে হাত টা ঢুকিয়ে দেয় সুলতানা। তৎক্ষণাৎ অনেকটা ঠান্ডা লাগে তেলের ছিটা লাগা জায়গাটা। পানি থেকে হাত উঠিয়ে আচঁলে হাতটা মুছে ঘরে যেয়ে ছেলের পাশে বসে সুলতানা। তুহিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে। সুলতানা মাথায় হাত রাখতেই তুহিন তার মা কে জড়িয়ে জোরে জোরে কেঁদে ফেলে।
সুলতানা বলে, “ছোট কাকি কিছু বলেছে?” তুহিন মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় বলেছে। “শোন তুহিন তুই বড় হচ্ছিস না? এত ছোট ছোট কথায় মন খারাপ করতে হয়না। আরে তুই তো ব্যাটা ছেলে। আর ব্যাটা ছেলেদের কাদঁতে নাই,তাদের মনকে হতে হয় পাথরের মতো শক্ত। নাহলে বউকে শাসন করবি কীভাবেরে বাপ?” তুহিন ফিক করে হেসে দিয়ে লাজুক মুখে বলে, “আমি বিয়ে করবো না যাও।”
সুলতানা হাসতে হাসতে বলে, “আচ্ছা করিস না বিয়ে যা। কাকি কি ফ্রিজ নিয়ে কিছু বলেছে? তুই কি ফ্রিজ ধরতে গিয়েছিলি? তোকে না বলেছি ওদের ফ্রিজ ধরবি না। নষ্ট হয়ে গেলে আমরা কিনে দিবো কি করে? ” তুহিন বিরসমুখে বলে, “ধরলেই কি ফ্রিজ নষ্ট হয়ে যায়? আর আমি ফ্রিজ ধরি নাই। কাকিকে বলেছি ঠান্ডা পানির বোতলটা দিতে। কাকি বলেছে আগে কেনো বলিনি? এতবার ফ্রিজ খুলতে পারবো না। হয় আমাদের ফ্রিজ কিনে দিতে না হয় কলসির গায়ে কাপড় ভিজিয়ে রেখে দিতে এতে পানি ঠান্ডা থাকে।”
কথাগুলো শুনে সুলতানার বুকটা হুহু করে উঠে। আজ ফ্রিজ নেই বলে এই কথা শুনতে হয়। রোজা রেখে তুহিনটা ঠান্ডা পানির জন্য হাহুতাশ করে। এইজন্য এক বোতল পানি রেখে আসে। এই দেবরের জন্য কি না সাহায্য করেছে সুলতানা। তুহিনের বাবার অমত স্বত্তেও সুলতানার সব গয়না বিক্রি করে বেকার দেবরকে বিদেশ পাঠিয়েছে। বিদেশ যাওয়ার বছরখানিকের মাথায় বিয়ে করে ফেললো পাশের গ্রামের রুজিনা কে। ভালো টাকা আয় করে আনিস। ঘরে কোনো কিছুর কমতি নেই কিন্তু সুলতানার গয়না বেঁচার টাকা এখনো পরিশোধ করেনি আনিস। দিন এনে দিন খায় সুলতানারা। তুহিনের বাবা রেজোয়ান দিন মজুর হওয়ায় অত টাকার মালিক ও না। যে একটা নতুন ফ্রিজ কিনবে।
সুলতানা দৌড়ে চলে যায় চুলার পাড়ে।
“আম্মা এইটা আমাদের ফ্রিজ? আল্লাহ্ কতো সুন্দর।” সুলতানা ছেলের পাগলামি দেখে আঁচল মুখে গুজে হেসে দেয়। ছোটো সাইজের একটা পুরান ফ্রিজ কিনেছে সুলতানা। পাশের বাড়ির রাহেলা ভাবির ভাইয়ের ফ্রিজ। ৩০০০ টাকায় কিনেছে সুলতানা। যাতে তুহিন আর মন খারাপ না করে। তুহিন আবারো বলে উঠে, “আম্মা আমি এইবার থেকে স্কুলে বরফ পানির বোতল নিয়ে যাবো বলে দিলাম। ” তুহিনের চোখ দুটি চিকচিক করে উঠে খুশিতে। বন্ধুতের থেকে একটু ঠান্ডা পানি খেতে চাইলে বলতো, বাসা থেকে নিয়ে আসতে পারিস না? এখন আর কেউ বলতে পারবে না। উঠোনে দাঁড়িয়ে রুজিনা বিড়বিড় করে বলে উঠে, “এহ,পুরান ফ্রিজ নিয়ে কত তামাশা। কয়দিন টিকে দেখুম নে। ”
সমাপ্ত