হঠাৎ করেই আমার জামাই কোত্থেকে এসে বললো, “চলো তামান্না আজকে ঈদের শপিং করতে যাবো।” ওর এমন কথায় একটু অবাকই হলাম! জামাই আমাকে সচরাচর কোথাও ঘুরতে নিয়ে যায়না। শপিং করা তো দূরের কথা! তবে; “মাঝে মাঝে দরকার হলে অনলাইন থেকে শপিং করে দেয়। হাজারবার বলার পরে, এলাকার ফুচকার দোকানে নিয়ে বলে ফুচকা খাও, কিছুক্ষণ রিক্সায় মুক্ত বাতাসে ঘুরো আর গাড়ি দিয়ে মাঝে মাঝে লং জার্নি, ব্যাস্! এতটুকুই।” সেই মানুষটি আজ নিজের মুখেই আমাকে শপিং করতে যাওয়ার জন্যে বলতেছে। ওর কথার উত্তরে বললাম,
-“আজ তোমার অফিস এতো তাড়াতাড়ি শেষ?” রাসেল (জামাই) বললো,
-‘হ্যাঁ’ শপিং করার কথা বলে স্যারের কাছ থেকে ছুটি নিয়ে আসলাম।
-তাহলে আজ আর অফিসে যাওয়া হচ্ছেনা?
-একদমই না!
আমিও আর কিছু বলিনি। ‘না’ও করিনি। যেহেতু ঈদ খুব কাছে চলে এসেছে। নিজের জন্যে আর অন্য(শশুর শাশুড়ী) কারো জন্যে আমার পক্ষ থেকে কিছুই কিনা হয়নি। রেডি হয়ে দু’জনেই গাড়ি নিয়ে বের হলাম। পথের মধ্যে রাসেল আমাকে জিজ্ঞেস করলো;
-“তামান্না আজকে কোন মার্কেটে যাবা?”
-চলো আজকে আমরা নিউমার্কেট যাবো!
-সেখানে তো ‘এসি’ নেই! রোজা রেখে গরমে থাকতে পারবা?
-তো কি হয়েছে? পারবোনা কেনো? এসি ছাড়া কি সেখানে রোজাদার কেউ যায়না? কেনাকাটা করেনা?
-আচ্ছা ঠিক আছে। কি কি কিনবা শুনি?
যদিও বাহিরের থেকে নতুন নতুন ডিজাইনের বোরকা ছাড়া তেমন কিছু কেনা হয়না। কারণ, আমি বোরকা ছাড়া কখনোই বাহিরে বের হইনা। নতুন জামা পড়ে বাসায় থাকি! এতেই আমি অনেক শান্তি পাই! আমার রুপ, গুণ সবকিছু আমার স্বামীর জন্যে পর-পুরুষকে দেখানোর জন্যে না। এরপরেও বললাম…
-তুমি যা যা কিনে দিবে সেগুলোই কিনবো!
-কসমেটিকস এর দোকানে যাওয়া যাবেনা।
-কেনো?
-কারণ, সময় বেশি নেই। বাসায় এসে আসর নামাজ পড়বো এবং ইফতার করবো।
-খোঁটা দিয়ে কথা বলো কেনো?
-খোঁটা বলছো কেনো? ওসব দোকানে গেলে তো একটু দেরি হবেই। তাছাড়া এখন বেলা তিনটা বাজে।
-তাহলে আমি কসমেটিকস কিনবো কবে?
-ওটা কেনার জন্যে অন্য আরেকদিন বাজেট করা হবে।
একথা শুনে খুব খুশী হলাম। আরেকদিন ও আমাকে বাহিরে নিয়ে আসবে। ওর কাঁদে মাথা রেখে বাহিরের পরিবেশটাকে উপভোগ করবো। একটা রেষ্টুরেন্টে বসে ইফতার করবো। ভাবতেই কেমন কেমন লাগে। কিন্তু ইফতারতো সে কোনোদিন বাহিরে করায়নি। আর করাবেওনা। ‘ধুর’ আবোলতাবোল ভাবতেছি। হঠাৎ করেই গাড়ি ব্রেক করলো। ভয় পেয়ে গেলাম। সামনে শাহবাগ মোড়ের সিগনাল! অনেকগুলো গাড়ি চারপাশের রাস্তায় গাড়িতে পরিপূর্ণ হয়ে আছে। মানুষ হাটবে, সেই জায়গাটুকুও নেই।
ধুলাবালির এই শহরে, যানজট নতুন কিছু নয়। অপেক্ষা করতে লাগলাম। তখনই চোখে পড়ার মত একটা দৃশ্য দেখলাম;- ৭-৮ বছরের একটা মেয়ে। খালি পায়ে! খালি গায়ে! ময়লাযুক্ত একটা পায়জামা পরে, কয়েকটা গাড়ির কাছে গিয়ে হাত পেতে কিছু চাইলো! কিন্তু যতটুকু বুঝলাম মেয়েটির স্বরধ্বনি কারো বোধে একটুও নাড়া দেয়নি। হঠাৎ মেয়েটি জাতীয় পতাকাবাহী একটা গাড়ির সামনে হাত পেতে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে ছিলো। গ্লাস খুলে কেউ একজন মেয়েটিকে লাঠি দিয়ে মারতে চাইলো। ততক্ষণে মেয়েটা জায়গাটা ত্যাগ করে। যদিও ভিআইপি ছাড়া তেমন কারো গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে চলার নিয়ম নেই! রাসেলকে বললাম,
-দেখতো মেয়েটিকে কিভাবে সবাই ফেরত দিচ্ছে! করুনা জাগালোনা কারো মনে! আচ্ছা দিনশেষে এরা কোথায় যায়? কি করে? উত্তরে রাসেল বললো,
-এরা বস্তিতে থাকে। সারাদিন ভিক্ষা করে যা টাকা পায় তা দিয়েই কোনোরকমে ওদের দিন পার হয়!
-আচ্ছা এদের মা-বাবা নেই?
-থাকলেও অনেক বাবা-মা ওদের খোঁজখবর নেয়না!
-খোঁজখবর নেয়না কেনো?
-অনেকের বাবা তাদেরকে ছেড়ে গিয়ে নতুন বিয়ে করে।
অনেকের মা জীবন বাঁচানোর তাগিদে এদের ছেড়ে অন্য কারো গলায় জুলিয়ে পড়ে। নয়তো এদের মা অথবা বাবা অসুস্থ। ভিক্ষা করে তাদের ঔষধের কেনার টাকা জোগাড় করে।
-দেখো, ওই মেয়েটা আমাদের গাড়ির দিকে আসতেছে!
-“হুমম, আজকে সকালেও অফিসে যাওয়ার সময় একটা ছেলেকে ৫০০ টাকার একটা নতুন নোট দিয়েছি।
তার বাবা নাকি রোডে এক্সিডেন্ট হয়েছে। মাঝে মাঝে দেই। আমাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো আমরা মানুষ। ওরাও তো আমাদের মতো মানুষ। আমাদের মত ১০ জনের সহযোগিতায় ওদের মুখে দুমুঠো ভাত জুটে। তাই কখনো ওরা হাত পাতলে না করিনা। সাধ্যমত দেয়ার চেষ্টা করি।” ওর কথা শুনে নিস্তব্ধ হয়ে গেলাম। চোখের কোনে পানি চলে আসলো। একটা মানুষ এতোটা ভালো মনের হয় কি করে? আল্লাহ কাছে লাখ-লাখ শুকরিয়া, নেয়ামত হিসেবে ওর মত একটা জীবনসঙ্গী আমাকে দান করেছেন বলে। এবার মেয়েটি আমাদের গাড়ির গ্লাসের উপর এসে হাত পেতে কি যেনো বলতে লাগলো! গ্লাস খুলে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলাম ;
-কিছু বলতেছো? করুন, কাতর, কোমল শব্দে বললো; (মেয়েটি তার আঞ্চলিক ভাষায় বলেছে। পাঠকদের সুবিধার্থে শুদ্ধ ভাষায় উচ্চারণ লিখলাম)
– আপা আমারে কয়েকটা টাকস দিবেন? খানিক্ষন নিরীক্ষণ করে জানার জন্যেই বললাম;
-কেনো দিবো? আর টাকা দিয়ে তুমি কি করবে?
-আপা ময়লা কাপড় ধোয়ার জন্যে একটা সাবান কিনবো। সামনেতো ঈদ।
-তোমার নাম কি?
-আয়েশা।
-কি করো? ততক্ষণে সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে। মেয়েটির পুরো কথা শুনার জন্যে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠালাম। গাড়িতে উঠার পর!
-আচ্ছা তুমি থাকো কোথায়?
-তেজগাঁও তেজতুরি রেললাইনের বস্তিতে।
-পড়ালেখা করোনা?
-নুন আনতেই পান্তা পুরায় আবার করবো পড়ালেখা। কতদিন হলো পেট ভরে খেতে পারিনা।
-তোমাদের বস্তিতে আর কে কে থাকেন?
-অসুস্থ মা, আর ছোট একটা ভাই।
-তোমার বাবা নেই?
-বুঝ হওয়ারপর কোনোদিন বাবারে দেখিনি। মাকে জিজ্ঞেস করলে মা বলে, বাবা নাকি মারা গেছে।
-ভিক্ষা করে একদিনে কত টাকা পাও?
-কোনোদিন ১৫০-২০০ পাই। আবার কোনোদিন ২০-৩০ টাকা পাই।
-সকাল থেকে কিছু খেয়েছো?
-সকালে একটা বাসি (ডেট অভার) রুটি আর এক গ্লাস পানি খেয়েছি। আর এখনো রাতের খাবার জোগার করতে পারিনি। মেয়েটির জীবন সংগ্রামের কথা আমার ভিতরকে নাড়িয়ে দিয়েছে! নিজের চোখে দেখার ইচ্ছে হলো….
-তোমাদের বস্তিতে আমাদের নিয়ে যাবে?
-কি যে বলেন না আপা। আপনাদের বসতে দিবো কোথায়?
-বসতে যাবোনা। শুধু তোমাদের উপভোগ করা জীবনটা একটু দেখতে যাবো। তৎক্ষনাৎ রাসেলকে বললাম; চলো তেজগাঁও যাবো। উত্তরে রাসেল বললো;
-কেনো শপিং করবানা?
-জীবনেতো অনেক শপিং করলাম। আজ নায় হয় শপিং করার সময় এদের পিছনে ব্যায় করি।
কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে রাসেল বললো, আমি চেয়েছিলাম তুমি একথাটাই বলো। ধন্যবাদ তোমাকে। চলো আমারও দেখার খুব ইচ্ছে। চলে গেলাম তেজগাঁওয়ের তেজতুরি বাজারের বস্তিতে। রেললাইনের দু’পাশে হাজার হাজার মানুষের বসবাস। এদেরকে দেখার মত কেউ নেই। মনে হয় এরা সবাই স্বপ্ন ধূসর জগতে জন্ম নেয়া মানব। ‘আহা’ এসবই আল্লাহর লিলা খেলা! আমাদের দেশে টাকাওয়ালা লোকের অভাব নেই। আচ্ছা অধিক টাকা পয়সার মালিক হলে কি সবার মনুষ্যত্ব বিকৃত হয়ে যায়? এতো টাকা দিয়ে কি হবে?
মারা গেলে এসব টাকা খাবে কে? আল্লাহতো কাউকে দিয়ে পরিক্ষা করে, আবার কারো থেকে নিয়েও। ভাবতে ভাবতে ওদের ঘরে গেলাম। চারপশে বাশের চিলের বেড়া। উপরে দুটো টিন, যার মধ্যে ২০-৩০ ফুটা আছে। ঘরের ভিতর একটা চকি। তার উপর একটা পাতলা ছেড়া খেঁতা। তার উপর শুয়ে আঁচেন একজন মহিলা। চকির নিচে একটা প্লেট দু’টো খালি ভাতের পাতিল। আমাকে দেখে উনি উঠতে চাইলেন। “উঠতে হবেনা” বলে শুয়ে থাকতে বললাম। রোগা শরীর। বয়সও বেশি হয়নি। সর্বোচ্চ ৩০-৩৫ বছর বয়স হবে। যেই বয়সে সন্তানদের শিক্ষিত মানুষ করার কথা, সেই বয়সে ওনি সন্তানদের ভিক্ষা করতে পাঠান। একজন মা কতটুকু অসহায় আর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে এমনটা করতে পারেন? তা আমার জানা নেই। ওই মাকে প্রশ্ন করলাম;-
-আন্টি আপনি কথা বলতে পারবেন?
-কথা বলার শক্তি আছে মা। এখনো মরিনি। তুমি কে মা? এখানে কেনো এসেছো? (যদিও কথাগুলো ওনি ওনার আঞ্চলিক ভাষায় বলেছেন। কিন্তু পাঠকদের সুবিধার্থে শুদ্ধ ভাষায় উচ্চারণ লিখলাম।)
-আন্টি আমি একটা সাধারণ মেয়ে। আপনার মেয়ে আয়েশার সাথে শাহবাগে দেখা হয়েছে। আপনি নাকি অসুস্থ, তাই আপনাকে দেখতে এসেছি। আপনার কি হয়েছে?
-“রোজার আগে ইট ভাঙতে গিয়ে হাতে ব্যথা পাই। এখনো সুস্থ হইনি। সুস্থ হবোই’বা কি করে ঠিকমতো ঔষধ খেতে পািনা। একদিন খেলে তিনদিন না খেয়ে থাকতে হয়।”
-আজকে রোজা রেখেছেন?
-‘হ্যাঁ’ মা রোজা রেখেছি। আমাদের তো সারাবছরই রোজার মত কাটে! আনতে পারলে খাই না পারলে উপবাস থেকেই দিনটা কাটাই।
-আন্টি আংকেল কোথায়?
-আমিও জানিনা মা। ৬ বছর আগে আমার এই ছেলে পেটে থাকতে আমাকে বাসস্ট্যান্ডে রেখে ‘আসি’ বলে চলে গেলো। আর ফিরে আসেনি। এখন পর্যন্ত কোনো খোঁজখবরও নেয়নি। কথাগুলো শুনে খুব ইমোশনাল হয়ে গেলাম। কি বলে সান্ত্বনা দিবো খুজে পাচ্ছিনা। মানুষের জীবনটা বড়ই অদ্ভুত তাই না?
-মা তুমি কান্না করতেছো যে! আমি তোমায় খারাপ কিছু বলেছি?
কখন যে চোখের কোনো পানি এসেছে বুঝতেই পারিনি। আছরের নামাযের সময় হয়েছে। বাহিরে মুয়াজ্জিনের আজান শোনা যাচ্ছে। অযু করে ওনার ভাঙ্গা ঘরেই নামাজে দাড়িয়ে গেলাম। নামাজ শেষে বাহিরে এসে দেখি রাসেল নেই। ফোন দিলাম ফোন ধরেনি! ভাবলাম হয়তো পুরো বস্তিটা ঘুরে বেড়াচ্ছে। না হয় নামাজে গেছে। বস্তির অন্য একটা ঘরে গেলাম। দেখি, একজন মহিলা চিড়া বিজাচ্ছে। প্রশ্ন করলাম;- আন্টি আমার নাম তামান্না। থাকি ধানমন্ডি ২৭ নাম্বার। এখানে ঘুরতে এলাম। তো আজকে ইফতারি কি কি করেছেন?
-চিড়া বিজিয়েছি মা। লবন আর চিনি মিশিয়ে ইফতারের সময় খাবো।
-সারাদিন রোজা রেখে এগুলো খেতে পারবেন?
-কষ্ট হয়। কি করবো বলো? অভ্যাসও হয়ে গেছে।
ভাবলাম আহা এরকম মানুষও আছে? আর আমাদের ইফতারে আমরা কত কিছুই না করে থাকি। বাহিরে এসে দেখি আরকেটা ঘরে একজন মা তার সন্তানকে খুব আদর করে খাওয়াচ্ছে। খোজ নিয়ে জানতে পারলাম, ওনার স্বামী ও নাকি ওনাকে রেখে দেশান্তরি হয়েছে। মায়েরা তো এমনই। সন্তানের সুখের জন্যে নিজের জীবনটাকে বিসর্জন দিতে বিন্দু পরিমান অনুশোচনাবোধ করেন না! ২০-৩০টা ছোট ছেলেদের নিয়ে হাসিমুখে রাসেল কোত্থেকে যেনো আসতেছে। সবার মাথায় টুপি। ওই দৃশ্যটা আমার কাছে এতো ভালো লেগেছে যা কাউকে বলে আর লিখে প্রকাশ করতে পারবোনা।
আমার কাছে এসে বললো;-
-নামাজ পড়েছো?
-হুমম পড়েছি। এদের নিয়ে নিশ্চয়ই মসজিদে গিয়ে তুমিও নামাজ পড়েছো?
-তুমি ঠিক ধরেছো। সবাইকে টুপি কিনে দিয়েছি। এই শুনো আজকে এদের সাথে ইফতার করলে কেমন হয়?
-কেমন হবে আবার? আমিতো এদের সাথে ইফতার করার জন্যেই এখানে এসেছি!
-তুমি এতো ভালো কেনো বউ?
-হইছে হইছে আর পাম দিতে হবেনা। এদের সবাইকে নিয়ে ইফতার কিনে আনো।
বাজার থেকেনরাসেল সবার জন্যে ইফতার নিয়ে আসে। রাসেল ছোট বাচ্চাদের নিয়ে বাহিরে, আর আমি মায়েদের নিয়ে একটা ঘরে ইফতার করি। ওদের খাওয়ার দৃশ্য দেখে মনে মনে ভাবলাম, অনেকদিন পরে মনে হয় তৃপ্তিমত খেতে পেরেছে। ওদের মধ্যে কেউ এতিম, কেউ নিঃস্ব, কেউ মিসকিন আবার কেউ প্রতিবন্ধী আছে। এদের সাথে কাটানো ইফতারের মূহুর্তটা আমি আমার জীবনের শেষ সন্ধিক্ষণেও ভুলতে পারবোনা। নামাজ পড়ে আজ খুব শান্তি লাগতেছে। ইফতারের পর নামাজ পড়ে রাসেলকে ডাক দিয়ে বললাম;-
-চলো এইবার শপিং করতে যাবো?
-তুমি না বলেছো শপিং করবেনা! তাহলে এখন আবার?
-আরে আমি কি আমার জন্যে করবো নাকি? এখানে যত মায়েরা আর ছেলে-মেয়ে আছে সবার জন্যে শপিং করবো।
-ক্যাশ তো তেমন নেই। ব্যাংকও এখন বন্ধ কি করা যায়?
তাৎক্ষণিক বাবাকে ফোন করে সবকথা খুলে বললাম। বাবার কাছে যা চেয়েছি খুশী হয়ে বাবা তার ছেয়ে ৫০০০ টাকা বেশি দিয়েছেন। যদিও ১৫ রমজানের পর বাবা পাড়া-প্রতিবেশিদের জন্যে ইফতার সামগ্রী সাথে কিছু লুঙ্গী-শাড়ী পাঠিয়েছেন।
টাকা তুলে সব বাচ্চাদের ফার্মগেটের একটা মার্কেটে নিয়ে গেলাম। রাসেল বাচ্চাদের জন্যে আর আমি মা আর বাবাদের জন্য প্রয়োজনমতো শপিং করলাম। এক দোকানদার খুশী হয়ে বললো;- আমার দোকানের বয়স আজ ৮ বছর। এমন দৃশ্য এই প্রথম দেখলাম। এতোদিন তো ব্যাবসা করলাম আজ এদের জন্যেই ক্রয়মূল্যে দিলাম। আর মহিলাগনের স্বামীর জন্যে এই নেন ১০ পাঞ্জাবি আমার পক্ষ থেকে। দোয়া করবেন। আপনারা ভালো থাকুন। আল্লাহ আপনাদের সহায় হোক। দোকানমালিকের কথা শুনে আমি অবাক হলাম। এই পৃথিবীতে এখনো ভালো মানুষ আছে। সব ব্যাবসায়ীরা ডাকাতি করেনা কথাটির প্রমাণ আবারও পেলাম।
শপিং করে বস্তিতে আসলাম। ৬০ জন মহিলাকে শাড়ি আর যাদের স্বামী আছে তাদের স্বামীর জন্যে পাঞ্জাবি আর লুঙ্গী দিলাম। ওনাদের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম;- ওনারা আমাকে ধন্যবাদ দিবে সেই ভাষাও হারিয়ে ফেলেছে। শাড়ী দেয়ার সময় অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তিতে আত্মহারা হয়ে একজন মহিলা আমাকে ধরে কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। আমিও কাঁদলাম। এই কান্না দুঃখের নয়। সুখের কান্না। রাসেল ওইদিকে বাচ্চাদের সাথে দুষ্টামী করতেছে। ছবি তুলতেছে। মনে হলো আল্লাহ আমার জীবনে রাসেলকে শ্রেষ্ঠ নেয়ামত হিসেবে দান করেছেন। ওর জন্যেই আজ এতোগুলা মানুষের হাসিমুখ একসাথে দেখতেছি।
আয়েশা মেয়েটা যার জন্যে এখানে আসা। তার মায়ের ঔষধ আর খাবার কেনার জন্যে কিছু টাকা দিলাম। তাদের দায়িত্ব আমি নিলাম। যেকোন প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্যে নাম্বার দিয়ে আসলাম। বাচ্চাদের ঈদের কিছু বকশিস দিলাম। “সময় পেলে ঈদের দিনও আসতে পারি আর প্রতি মাসে একবার এসে দেখে যাবো বলে, ওই জায়গাটা ত্যাগ করে চলে আসি।” বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজে দাড়িয়ে গেলাম। রাসেলের জন্যে মহান প্রভুর দরবারে দোয়া করতে লাগলাম। আল্লাহ যেনো আমাকে আর ওকে দ্বীনের পথে কবুল করেন।
(প্রিয় দ্বীনি ভাই ও বোনেরা, হাতের পাঁচটা আঙ্গুল যেমন সমান নয়, ঠিক সব মানুষও এক নয়। সবাইকে কখনো এক পাল্লায় মাপতে যাবেননা। মূল কথা হলো, রমজান মাস তো প্রায়ই শেষের দিকে! আল্লাহর পথে ঠিকমত চলতে পেরেছি? ঠিকমতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে পেরেছি? মা-বাবার খেদমত করতে পেরেছি? পাড়াপ্রতিবেশিদের হক আদায় করতে পেরেছি? কখনো নিজেকে প্রশ্নগুলো করেছেন? জীবনটা তো ক্ষনিকের। যেকোন সময় আমি আপনি মারা যাবো! কি জবাব দেবো মহান রবের দরবারে? ভেবেছেন কখনো? আসুন আমরা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই। তওবা করি! আমাদের সাধ্যানুযায়ী চারপাশের সুবিধাবঞ্চিত অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াই। আমরা ৫০-৬০ জনকে ইফতার করিয়েছি বলে আপনারও করাতে হবে, তা কিন্তু নয়! আপনি খেয়াল করে দেখেন, আপনার পাশের ঘরের মানুষগুলো ঠিক মতো খাবার খেতে পারে নাকি।
আমরা ৯০-১০০ জনকে জামা দিয়েছি বলে আপনি দিতে পারবেননা? দেয়ার মত সাধ্য নাই? দরকার নেই তো দেয়ার! আপনার পাশের বাড়ির কোনো এতিম ছেলেকে একটি ৫০ টাকার গেঞ্জি কিনে দেয়ার মতো সামর্থ্য’তো আপনার আছে! তাহলে কিনে দিন। আপনার একটি গেঞ্জি পেয়ে যে হাসিটা দিবে দেখবেন পৃথিবীর সবকিছু পেয়েও, ওই হাসির মত আনন্দ কোথাও পাবেননা! আসুন সবার সাথে ঈদের আনন্দটা ভাগাভাগি করে নেই। মনে রাখবেন নিজের ঘর অন্ধকার রেখে, অন্যের ঘরে বাতি দিতে যাবেন না। সবার আগে মা-বাবার হক আদায় করুন। “জয় হোক মানবতার। শেয়ার হোক ঈদের আনন্দ অসহায় মানুষদের সাথে।”) ধন্যবাদ ভালো থাকুন। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ হাফেজ।