টুম্পা একটু আন্টিকে ডেকে দেওয়া যাবে’ অসময়ে আমাকে এভাবে দরজার সামনে দেখে আমার ছাত্রী কিছুটা কপাল কুচকালেও কিছু না বলে হনহনিয়ে ভিতরে চলে গেলো।আমাকে বসতে বলে। ইতস্ততভাবে কথাটা বলে ড্রইংরুমে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে রইলাম। ভাবছি আন্টি টাকাটা দিবে কি না।আর দিলে কি কি কিনবো? ভেবেছিলাম এইবারের টিউশনির টাকাটা পেলে একটা ফোন কিনবো। হাতে থাকা এগারোশত মডেলের নোকিয়া ফোনটার অবস্থা একদম নাজেহাল।
আমার বদলে অন্য কেউ হলে হয়তো এতোদিনে কবেই আশমানের দিকে ছুঁড়ে মেরে ফোনটার ইতি ঘটিয়ে দিতো। কিন্তু আমার মত মধ্যবিত্ত ছেলেদের মাথা ওতো গরম করতে গেলে হয় না,তাই হয়তো এখনো সেরে সুরে কোনোরকমে চালিয়ে নিচ্ছি। বেশকিছু দিন ধরে গ্রাম থেকে মা ফোন দিয়ে বলছে’,বাবা অনিক,হাতে কিছু টাকা থাকলে পাঠিয়ে দে।তোর ছোট ভাইটা রোজ কান্না করে ঈদের নতুন ড্রেস নেওয়ার জন্য। হাতে কিচ্ছু টাকা পয়সা নেই,যে ওকে নতুন জামা-কাপড় কিনে দিবো।
মায়ের প্রত্যুত্তরে কোনো জবাব না দিয়ে শুধু একরাশ হতাশাভরা নিঃস্বাস ছাড়তে থাকি আমি।কারণ আমার পকেট টাও যে একবারে শুন্যর খাতাতে।নিজের খাওয়া-দাওয়া আর লেখাপড়ার খরচ জোগাতে গিয়ে মাঝেমাঝে নিজেকেই অনেক সময় বিপাকে পড়ে যেতে হয়। এইতো গতমাসে বাসা ভাড়া না দিতে পারাতে বাড়িওয়ালা এসে ইচ্ছে মত বকে গেলো।কিন্তু অর্থের অনটনটা এমনভাবে গ্রাস করে নিয়েছে যে গায়ের কমল চামড়াটাও এখন গন্ডারের চামড়াতে পরিণত হয়ে গেছে। হয়তো সেই জন্য কেউ কটু কথা বা অপমান করার পরও হাসি মুখে মেনে নিতে পারি। আজকেও সকালে মা ফোন দিয়েছিলো। বলেছে ঢাকা থেকে ফেরার সময় ছোট ভাইটার জন্য অন্তত রাস্তার পাশ থেকে হলেও একটা জামা-প্যান্ট কিনে নিয়ে যাই। আর সেই জন্য টুম্পাদের বাসায় আসা। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই টুম্পার মা মানে আন্টি এসে বললো। “এই অসময়ে কোনো দরকার বাবা? কিছুটা লজ্জাভরেই বললাম।
-আন্টি মাস তো শেষের দিকে।এদিকে ঈদও চলে আসলো।এ মাসের বেতনটা যদি দিতেন খুব ভালো হতো।
-ওহ্ আচ্ছা এই কথা।
তা কত টাকা দিতে হবে বাবা? টাকার কথা শুনে অভাবের মাত্রাটা হুরহুর করে বেড়ে গেলো।ইচ্ছে করছে মুখের উপর ঠাস করে বলে দেয়,দশহাজার টাকা’। নিজেকে সংযত করে বললাম।
-এখনো তো মাস শেষ হয় নি,তবে আমি সামনে মাসে বেশি করে পড়িয়ে পুষিয়ে দিবো। তাই যদি একমাসের পুরো টাকাটা দিতেন খুব ভালো হতো।
-কিন্তু বাবা এইমূহুর্তে তো পুরো টাকাটা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।কিছুদিন আগে বললেও না হয় করা যেতো। গত চারদিন ধরে ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়ে অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। এদিকে তোমার আংকেলও এখনো ঈদ বোনাসটা পায় নি। তুমি চায়লে অর্ধেকটা নিতে পারো। মনে মনে কিছুটা রাগ হলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম।
-জ্বী আচ্ছা।
আন্টি হাসি মুখে ভিতরে গিয়ে অর্ধেক টাকাটা এসে হাতে ধরিয়ে দিলো। টাকাটা পেয়ে আন্টিদের বাসা থেকে চলে আসলাম। বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে নেতিয়ে যাওয়া দুটো একহাজার টাকার নোটের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভাবলাম। “আমাদের মত অভাগাদের কপালে বুঝি সবকিছুই জরাজীর্ণ হয়। ভেবেছিলাম পুরো টাকাটা পেলে ছোট ভাইটার সাথে সাথে মায়ের জন্য একটা নতুন শাড়ি কিনে নিয়ে যাবো। পকেটে থেকে মানিব্যাগটা বার করে টাকাগুলো রাখতে গিয়ে দেখলাম। ভিতরে আরো একশত টাকার দুটো নোট আছে। তারমানে মোট বাইশশত টাকা। রাস্তার পাশে একটা গাছের নিচে বসে বসে মনে মনে হিসাব কষছি,সবকিছু মিলিয়ে কত খরচ হতে পারে। বাড়ি যাওয়া আর ছোট ভাই’,মায়ের কাপড় দিয়ে মোট তিনহাজার টাকার মত খরচ হবে। তারমানে এখনো আটশত টাকা লাগবে। আরেকটা টিউশনির ছাত্রীর বাড়িতে ফোন দিয়ে বললাম।
-আন্টি অর্ধেক টাকাটা দিলেও খুব ভালো হতো।
ফোনের ওপাশ হতে আন্টি বিরক্তভরা কণ্ঠে বললো”,তোমাকে না বললাম ঈদের পরে টাকা দিবো।তোমাদের সমস্যা কি বুঝি না মাস শেষ হতে না হতেই ওতো টাকা টাকা করো কেন? আমি এখন ব্যস্ত আছি পরে কথা বলবো। ফোনের ভিতরে হৈ হুল্লোড় শুনে বুঝলাম আন্টিও ঈদ শপিং করতে গিছে। ফোনটা হাতে নিয়ে গাছের নিচে বসে বসে ভাবছি আর হিসাবের খাতাটা মেলানোর চেষ্টা করছি।ঈদটা মনে হয় শুধু টাকাওয়ালাদের জন্য। বসে থেকে আরো কয়েকজন ক্লাসমেটকে ফোন দিলাম। কিন্তু সবারই একই কথা,সবারই নাকি হাত খাট হয়ে গেছে টাকার অভাবে। উদাস মনে গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করছি,কিন্তু কি খুঁজছি নিজেও জানি না। দেখি হাতের মুঠোতে থাকা ফোনটা আবার বাঁজছে।মা ফোন দিয়েছে। হয়তো জিজ্ঞাসা করবে আমি বার হয়েছি কি না? ভাবতে ভাবতেই ফোনটা রিসিভ করলাম।
-হ্যাঁ মা।
-খোকা তুই কি বার হয়েছিস?
-এইতো মা বার হচ্ছি।
-ওহ্ তাড়াতাড়ি চলে আয় বাবা।আর ছোটুর জন্য কিছু কিনেছিস বাবা?ও বার বার জিজ্ঞাসা করছে।
-হ্যাঁ মা কিনেছি।সাথে তোমার জন্যও কিনেছি।
-আমার কিছু লাগবে না বাবা তুই তাড়াতাড়ি চলে আয়।
-আচ্ছা ঠিক আছে মা।
ফোনটা কেটে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। হাতে বেশিক্ষণ সময় নেই টাকাটা যেভাবেই হোক আমাকে ম্যানেজ করতে হবে। এদিক ওদিক তাকিয়েও কোনো উপায়ন্তর না দেখে মন খারাপ করে রাস্তার একপাশ হয়ে হাঁটছি। এমন সময় একজন মধ্যবয়স্ক লোক এসে হাতে চেপে ধরে কান্না করতে করতে বললো।
-বাবা খুব বিপদে পড়ে গেছি। নিজেও যে কম বিপদে আছি তাও নই।তবুও জিজ্ঞাসা করলাম।
-কি বিপদ আংকেল।
-আমার মেয়ের সিজারিং করাতে হবে।
জরুরি দুই ব্যাগ রক্ত লাগবে। এক ব্যাগ পেয়েছি আর এক ব্যাগ দু’ঘন্টা ধরে খুঁজছি পাচ্ছি না।তুমি একটু দেখো না বাবা।এই ঢাকা শহরে আমি কিচ্ছুই চিনি না। লোকটার অশ্রুশিক্ত চোখ দুটি দেখে ইচ্ছে করলেও তাকে এড়িয়ে যাওয়ার শক্তি হলো না আমার।
-আচ্ছা আংকেল আপনার মেয়ের রক্তের গ্রুপ কি?
-(O-)
-চলুন আমি দিবো।
আমারও একই রক্ত। লোকটা আমার কথা শুনে খুশিতে আরো একবার কেঁদে দিলো। লোকটার সাথে হাসপাতালে গিয়ে একব্যাগ রক্ত দিলাম। বিনিময়ে তার এতোবড় উপকার করার জন্য আমাকে একহাজার টাকার তিনটা কড়কড়ে নোট হাতে গুজে দিয়ে বললো।
-বাবা এইটা রাখো,ফলমূল কিনে খেও।
টাকাটা দেওয়ার সাথে সাথে হাতে নিয়ে নিলাম।লোকটা কি ভাবছে সেইটা নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই।
কারণ এই স্বার্থপরের শহরে কেউ কোনোকিছু বিনাস্বার্থে করে না,তো আমিই বা করতে যাবো কেন? টাকাটা পেয়ে একমূহুর্ত দেরি না করে সোজা একটা কাপড়ের দোকানে ঢুকে মা আর ছোট ভাইটার জন্য নতুন কাপড় কিনে নিয়ে গ্রামের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করে দিলাম। এরই মধ্যে মা বেশকয়েকবার ফোন দিয়েছে আমি কতদূর সেইটা জানার জন্য। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলে গ্রামের পথে নামলাম।গ্রামের মেঠো পথে এখনো মৃদু বাতাসে ধুলি উড়ে বেড়াচ্ছে। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে মৌড়ের একটা দোকান থেকে ঈদের কাঁচাবাজার আর টুকিটাকি জিনিস গুলো কিনে তারপর বাড়ি ফিরলাম। আমাকে দেখে মা খুশিতে কেঁদে ফেলে বললো।
-খোকা এসেছিস?
-হ্যাঁ মা।
-কি অবস্থা করেছিস শরিরের।
প্রতিটা মা তার সন্তানকে এইসব কথা বলে থাকে। আসলে সব মা চায় তার সন্তানটা সবসময় তার চোখের সামনেই থাকুক। একটু চোখের আঁড়াল হলেই হাজারো টেনশন আর চোখের পানিতে বালিশ ভিজিয়ে যে কত রাত কাটিয়ে দেয় নির্ঘুমে তার হিসেবে শুধু সেই জানে। আমার বাড়ি আসার খবর শুনে ছোট ভাইটা দৌড়ে এসে বললো।
-ভাইয়া আমার নতুন ড্রেস কোথায়? আদর করে গাল টেনে ধরে বললাম।
-এনেছি রে এনেছি।
ব্যাগের ভিতরে আছে। এমনিতে রোজা রেখেছি,তারউপরে আবার শরিরে রক্ত বার হয়েছে,আবার লম্বা জার্নি। সবকিছু মিলিয়ে শরিরটা একবারে নুইয়ে পড়তে চায়ছে। মাকে ব্যাপার টা বুঝতে না দিয়ে সোজা ঘরে চলে গিয়ে খাটের উপর ধপাশ করে বসে পড়লাম। রাতে ব্যাগ থেকে নতুন কাপড় গুলো বার করে মা আর ছোট ভাইটাকে দিয়ে বললাম।
-এগুলো তোমাদের জন্য।
-আমার জন্য আবার শাড়ি কিনতে গেলি কেন?(মা)
-মা তোমার ছেলে এখন বড় হয়েছে না। এখন যদি মাকে না দেয় তাহলে কখনো দিবো।
-হয়ছে আর পাকনামি করতে হবে না। মা একটু বকাবকি করলেও দেখলাম নতুন শাড়ি পেয়ে মা-ও বেশ খুশি হয়েছে। মা তার কাপড়টা হাতে নিয়ে বললো..
-খোকা তোর পাঞ্জাবীটা দেখা,দেখি কেমন? মায়ের কথা শুনে কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে তারপর ব্যাগের ভিতর থেকে একটা পাঞ্জাবী বার করে দেখলাম।
-নতুন পাঞ্জাবী এমন কেন?
-মা আজকে দুপুরের নামাজ পড়েছিলাম তো তাই এমন দেখাচ্ছে। মা আর কিছু না বলে চুপ থাকলো। ব্যাগের ভিতর থেকে এক এক করে ঈদের সদায়পত্র বার করে মায়ের হাতে দিলাম।
-মা এইখানে পনেরোশত টাকার মত আছে।
এইটা তুমি রাখো,আর এইগুলা ঈদের বাজার। মা কিছু না বলে জিনিস গুলো নিয়ে সোজা রুম থেকে বের হয়ে গেলো। রাতে খাবার খাওয়া শেষ করে ছোট ভাইটা জড়িয়ে ধরে বললো।
-ভাইয়া তুমি অনেক ভালো,মা পঁচা। তুমি যদি এবার আমার জন্য নতুন ড্রেস না আনতে তাহলে তোমার সাথে আর কথায় বলতাম না।
-তাই নাকি।
-হ্যাঁ,নতুন জামা-কাপড় আমার খুব পছন্দ হয়ছে। বলেই দৌড়ে পালিয়ে গেলো। আমি তাকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বললাম।
-আমরা গ্রামের মানুষ গুলো কত সহজ সরল।সামান্য কিছুতেই অনেক খুশি আমরা।
হয়তো এবার ঈদে টুম্পাদের মত ব্রান্ডের কাপড় বা দামি খাবার খেতে পারবো না। তবুও তো সামান্যতেই যেই খুশিটা আমার ছোট ভাই আর মায়ের মুখে দেখেছি এর থেকে বড় শান্তি আর কি হতে পারে। আমার সামন্যটাকা দিয়ে যে আমার পরিবারের মুখে হাসি ফুটাতে পেরেছি এতেই আমি খুশি। এবারের ঈদটা না হয় পুরান পাঞ্জাবী দিয়ে কাটিয়ে দিলাম। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই পাশে পড়ে থাকা ফোনটার দিকে তাকাতেই হেসে বললাম।
-ভেবেছিলাম এবার ঈদের পর তোকে ডিভোর্স দিবো।কিন্তু তোর ভাগ্যটা এতোই খারাপ যে আমার সঙ্গ আর ছাড়া হলো না।ব্যাপার না আরো একটা রাবার দিয়ে পেচিয়ে দিব্যি চালিয়ে নিবো তোকে। কি তাতে কি তোর রাগ হবে,নাকি অভিমান করে আবার কোনদিন বন্ধ হয়ে গিয়ে আর অন হবি না। এমন সময় ফোনটা ভ্রাইবেশন মোডে কেপে উঠলো ‘বুঝলাম সেও হয়তো এই অভাগার কাছেই প্রশান্তির নীড় খুঁজে পেয়েছে।
(বি.দ্র-ঈদ মানে খুশি ঈদ মানে আনন্দ।ঈদ যেমন বিত্তশালীদের আসে তেমনি গরিবদের ঘরেও আসে। পরিশেষে একটা কথাই বলবো,আপনি যেমন আপনার পরিবারে থাকা সবার জন্য ঈদের নতুন জামা-কাপড় কেনার তাগিদে উঠে পড়ে লেগেছেন। তেমনভাবে আপনার অধীনে কর্মরত মানুষ গুলিও আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আপনার দেওয়া সামান্য কিছু টাকা দিয়েই হয়তো সেই মানুষটা তার পরিবারের মানুষগুলোর মুখে হাসি ফুটাবে। হয়তো আপনার অঢেল টাকার ভিতরে সেই মানুষটার কয়েক হাজার টাকাগুলো অতি নগন্য।তবে সেই সামান্য কিছু টাকার ভিতরে একটা পরিবারের আনন্দ জড়িয়ে থাকে। নিজে ঈদের শপিং করার আগে আপনার অধিনে থাকা মানুষটাকেও তার বেতনের টাকাটা দিয়ে দিন। তাহলে সেও হয়তো হাসি-মুখে কোনএকদিন রাতের আঁধারে সামান্য কিছু কিনে নিয়ে তার প্রিয়মানুষটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলবে। “এইটা তোমার ঈদের গিফ্ট”)