“দরজার ওপাশে কেউ একজন থাকে। মাঝে মাঝে আসে। দরজা ধাক্কায়, দরজা খোলার জন্যে মিনতি করে, কান্না করে, চিৎকার করে তারপর রেগে হুংকার করতে করতে চলে যায়।” আমি মিনা আপার মুখের দিকে তাকাই। তার চোখে রাজ্যের ভয়। চোখের নিচে কালো দাগ পরে গেছে। তার দৃষ্টি আমার দিকে। অথচ আমাকে সে দেখছে না। তার চোখে ভাসছে ভয়াবহ কোনো স্মৃতি। বুঝতে পারি, ঘটনা সিরিয়াস। আমি ভরসা দেয়ার জন্যে বলি, “দরজার ওপাশে তো স্টোর রুম। আচ্ছা, তুমি দাড়াও, আমি এক্ষুনি ওখানে যেয়ে দেখছি কেউ আছে কিনা।”
এরকম ঘটনার সাথে আমরা সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছি৷ দুলাভাই এর মৃত্যুর পর থেকে প্রতিদিন মাঝ রাতেই আপার চিৎকার শোনা যায়। চিৎকার শুনে আগে সবাই দৌড়ে আসত। এখন আর কেউ আসে না। আমারো আসতে ভাল লাগে না। তবুও আসি। স্বান্তনা দিয়ে দুই একটা কথা বলি। স্টোর রুমটা ভালো করে ঘুরে দেখি। আপা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, কিছু পেলি হাসিব? আমি মাথা নাড়াই। আপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
প্রথম প্রথম বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করতাম। বলতাম, আপা, কেউ দরজা ধাক্কায় না। সবই তোমার মনের ভুল। তুমি গর্ভবতী। এই সময়ে এরকম ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। আপা পাল্টা যুক্তি দেয়। আমি বলি, আচ্ছা, মানলাম কেউ সত্যিই আসে, দরজা ধাক্কায়। কিন্তু ভেবে দেখ, সে শুধুই দরজা ধাক্কায়, ভেতরে তো আসতে পারে না। তাহলে ভয় কোথায়? দরজা খুলবে না, তাহলেই তো মিটে গেল। আপা কাঁদতে কাঁদতে বলে, সে এখন দুর্বল। কিন্তু তার শক্তি ধিরে ধিরে বাড়ছে। খুব তাড়াতাড়ি সে দরজা ভেংগে ভেতরে ঢুকবে।
__তুমি কিভাবে জানলে?
__সে আমাকে বলেছে।
আমার মন খারাপ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। তারপর চলে আসি। মনে মনে ভাবি, কারো জীবনেই সুখ চিরস্থায়ী হয় না। ৬ বছর আগে মিনা আপার বিয়ে হয়েছিল নিয়াজ ভাইয়ের সাথে। মিনা আপা যখন শ্বশুর বাড়ি থেকে এই বাসায় আসত,তখন সারাক্ষণ শ্বশুর শ্বাশুড়ির কথা বলত। শিরিন ইয়ার্কি করে বলত, শুধু কি শ্বশুর শ্বাশুরিই তোমায় ভালবাসে? নিয়াজ ভাইয়া বুঝি ভালবাসে না? মিনা আপা লজ্জ্বায় লাল হয়ে যেত। আমি আর শিরিন শুধু হাসতাম।
শিরিন আমার চাচাত বোন। আমার চেয়ে খুব সম্ভব ৩ মাসের ছোট। আমার শৈশব কেটেছে শিরিনের হাসি দেখতে দেখতে। মেয়েটা উজ্জ্বল শ্যামলা। ওর সব সৌন্দর্য লুকিয়ে ছিল ওর হাসির মাঝে। ও যখন হাসত, মনে হত পুরো জগৎটা আলোকিত হয়ে গেছে। শিরিন হয়ত ব্যাপারটা জানত। তাই সারাদিন কারণে অকারণে হাসতো আশেপাশের মানুষকে মুগ্ধ করার জন্য এবং সফলও হত। ও যেখানেই যেত, সেখানেই একদল মুগ্ধ মৌমাছি জুটে যেত। জানি না কেন, আমার খুব খারাপ লাগত। শিরিন বোধহয় এটা বুঝত। হাসতে হাসতে বলত, ভয় নেই রে, কেউ পাত্তা পাবে না!
সেই শিরিন এখন আর হাসেনা। হাসলেও আর আগের মত মায়াবি লাগে না। বরং কষ্ট লাগে, বড় কিছু একটা হাড়ানোর কষ্ট। তবে এ কষ্ট আমার সয়ে গেছে। শিরিনের স্বামী মাঝে মাঝেই ফোন দিয়ে দাওয়াত করে ওদের ওখানে বেড়াতে যাওয়ার জন্য। আমি অজুহাত খুঁজি।
আজ আমার অফিস নেই। যেদিন অফিস থাকে না, সেদিন আমি সারাক্ষণ মিনা আপার কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করি। ইচ্ছে করে এমন কিছু করতে, যা আপাকে মুহুর্তেই খুশি করে দেবে। বলতে ইচ্ছে করে, আপা, কেউ তোমার পাশে থাকুক আর না থাকুক, তোমার ছোট ভাই তোমার সাথে আছে। কিন্তু বলতে পারি না। বলার মত অবস্থাও আর নেই। এখন আর আগের মতো গভীর রাতে আপার চিৎকারে কারো ঘুমে ব্যাঘাত ঘটেনা।
আমি রাতে সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরতাম, ভোরে ঘুম ভাংতো। ভেবেছিলাম, আপার সমস্যা বোধহয় মিটে গেছে। সমস্যা মিটেছে, এতেই আমি খুশি ছিলাম। তাই ওই বিষয়ে আর আপাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনি। আপাও সারাদিন ঘুমায়। আগের দিন গুলোতে রাতে ঘুম হয়নি, তাই এখন কভার হচ্ছে হয়ত। সবাই স্বাভাবিক। শুধু কাজের মেয়েটা মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে বলে, বড় আফারে জ্বীনে ধরিছে। আমি বলি, এ কথা বলার কারণ কি? সে বলে, রাইত্তের বেলা কার সাথ যেনি কথা কয়। আমি কাজের মেয়ের কথা কানে তুলিনি। বরং ওকে শ্বাসিয়ে দেই যেন বাবা মায়ের কানে এসব না দেয়। শুধু শুধু চিন্তা করবে।
গতকাল মাঝরাতে ঘুম ভেংগে গেল। পানি পিপাসা হওয়ায় ডায়নিং রুমের দিকে গেলাম। এখনো বর্ষা আসেনি। তবুও সেদিন সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে, তখন রাতেও হচ্ছিলো। বৃষ্টির ঝুম ঝুম শব্দ হচ্ছে। আমি পানি খেলাম। ঝুম ঝুম শব্দের পাশাপাশি একটা ফিস ফিস শব্দও পাচ্ছিলাম। শব্দটা আসছিল মিনা আপার ঘর থেকে। আমি মিনা আপার ঘরে গেলাম।
ঘর অন্ধকার ছিল। ঘরে ঢুকতেই ফিস ফিস শব্দ থেমে গেল। অন্ধকারের মাঝেও আমি অনুভব করতে পারলাম আপা মেঝেতে বসে আছে। ঘরের সব জানালা দরজা খোলা। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ঝাপ্টা আসছে। আমি দ্রুত জানালা বন্ধ করতে যাব, এমন সময় মিনা আপার কন্ঠস্বর কানে এল। আপা ঠান্ডা গলায় বলল, হাসিব, অন্যের ঘরে ঢুকতে গেলে অনুমতি নিয়ে ঢুকতে হয়। আমি আমতা আমতা করে বললাম, আপা, তোমার ঘরে আমি আসতে পারব না? মিনা আপা রাগি গলায় বলল, না পারবি না। আমি একা থাকলে একটা কথা ছিল। যখন দেখতেই পাচ্ছিস, তোর দুলাভাই আর আমি ঘরে, তখন এই মাঝ রাতে কেন তুই হুট করে ঢুকবি? তোর বুদ্ধি হবে কবে? আমি চমকালাম। দ্রুত ঘরে আলো জ্বালালাম। দেখলাম, আপা ঘরের মাঝখানে মেঝেতে একা একা বসে আছে। বললাম, দুলাভাই? কোথায় দুলাভাই?
আপা প্রায় চিৎকার করে বলল, আলো জ্বালালি কেন? আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। মিনা আপা কাঁদতে শুরু করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, আলো জ্বালালেই ও চলে যায় আমি বললাম, কে? আপা অনর্থক জোর দিয়ে বলল, তোর দুলাভাই। অজানা আশংকায় আমার মন মুষড়ে পড়ছিল। মিনতি করে বললাম, আপা, চলে গেলে যাক। একটা রাতই তো। চল আমরা আজ গল্প করে রাতটা পার করে দেই, কি বলো? যখন আমি ছোট ছিলাম, তখন তুমি আমাকে কত গল্প শুনাতে, মনে আছে তোমার? আপা রাজি হল।
মিনা আপার মন হুট করেই ভালো হয়ে গেল। বাচ্চাদের মত করে হাসতে হাসতে কথা বলতে লাগল। বলল, জানিস হাসিব, আগে যে দরজা ধাক্কাতো, সে আর কেউ নয়, তোর দুলাভাই। আমি শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলাম। তোরা ডাক্তার কবিরাজ দেখিয়ে কি কান্ড! তোর দুলাভাই আমাকে বলেছে কালকের দিন বাদে পরের দিন আমাকে নিয়ে যাবে আমি কি বলব কিছু বুঝতে পারছিলাম না। আপা শুধু একটু পর পর ঝাঁকুনি দিয়ে বলছিল, কিরে তুই বাচ্চাদের মত কাঁদছিস কেন? সকাল থেকেই আপার ব্যাথা শুরু হল। মা বলল, ডেলিভারির সময় হয়ে গেছে। আপাকে হাসপাতালের নেওয়া হল। সবাই খুশি, নতুন মুখ আসতে চলেছে। বাবা তার বিশাল নোট খাতাটা ভরে ফেলেছে বিভিন্ন নামে। আমাকে এসে বলল, ছেলে হলে নাম রাখব এইটা, মেয়ে হলে অইটা।
ওইদিন রাত আটটা নাগাদ আপা ফুটফুটে একটা কন্যা শিশুর জন্ম দিল। কিন্তু তার পর থেকেই আপা বেহুশ। শেষরাতে নার্স এসে বলল, আপা মারা গেছে। আমি জানতাম এমনটা হবে। বাবা কাঁদতে কাঁদতে বলল, মিনার মেয়েটা অভাগা। জন্মের আগেই বাবাকে হাড়িয়েছে আর জন্মের সময়ই মাকে হাড়ালো। ওর নাম হবে অশ্রু। আমি আমার ভাগ্নিকে কোলে নিলাম। একদম আপার মতই হয়েছে। আমি ওর মাথায় আলতো করে চুমু দিয়ে বললাম, ওর নাম অশ্রু হোক, আর যাই হোক, ওকে আমি কখনো কাঁদতে দেব না।