সেই সকাল থেকে সেজেই যাচ্ছে সুমি, আজ ঈদের দিন বলে কথা! কিন্তু তা না, সুমি সাজে ভিন্ন কারণে। “কেন এত সাজ?” কেউ জিজ্ঞেস করলে সুমি একটু হেসে তার জবাব দেয়
~আমার অপেক্ষার অবসান হবে। আজ বিকেলেই সে আসবে, তার জন্যই আমার এত সাজ। কিন্তু “কে আসবে?” এর প্রতিউত্তর আজো সবার অজানা! অবশেষে দুপুরবেলা সে বের হতে হতে বলল
~শাড়ি পড়তে যত জ্বালা! আমি শাড়ি খুব একটা ভালো পড়তে পারিনা। কিন্তু কি করার, আমার সাহেব বলেন আমাকে শাড়িতেই সুন্দর লাগে। তাই তার ইচ্ছে পূরণের জন্য সব করতে পারি।
সুমির চোখেমুখে হাসি ভর করে আছে, ভারী মেকআপের ছিটেফোঁটাও নেই। চোখে লেপ্টিয়ে ঘন কাজল লাগিয়েছে। দূর থেকে মনে হবে অদ্ভুত মায়াবী একটা চেহারা আর কাছে এলে মনে হবে কত রাত নিদ্রাহীনতায় ভুগছে ওই চোখজোড়া, চোখের নিচে কালচে দাগ আর কাজল মিশে একাকার! হাতে রঙবেরঙের চুড়ি। এত ডজন চুড়ির সবটা তো হাতে দেয়া যাবেনা তাই একেক রঙের চুড়ির ডজন থেকে একজোড়া করে চুড়ি পড়েছে সে। দূর থেকে মনে হবে রঙধনুর সব রঙ তার হাতে এসে জড় হয়েছে আর কাছে গেলে মনে হবে চুড়ির রঙটাই ধূসর, শুভ্র তার হাতের গঠন।
নাকে এইচডি পাথরে সোনার ছোঁয়ায় একটা নাকফুল, দূর থেকে মনে হবে নাকে তাহার রত্নের ঝিকিমিকি আর কানে সোনালি ঝুমকো দুলছে। গলায় জড়োয়ার হার, যা ফাঁসের মত গেড়ে আছে তার গলায় আলিঙ্গন করে। পরনে বাসন্তী রঙের শাড়ি আর খোঁপায় গুজা এক গুচ্ছ বুনোফুল, কি অপরূপ লাগছে মেয়েটাকে! তড়িঘড়ি করে সে বেরিয়ে পড়লো। রিক্সা করে ছায়ানীড়ের পথটা ধরে ২৬ নাম্বার রাস্তাটায় গিয়ে সোজা বা’দিকে যে খোলামেলা একটা স্থান আছে সেখানে গিয়ে, একটা গাছের নিচে বসলো। সময় খেয়াল করে আনন্দিত হলো সুমি, টার্গেট করা সময়ের এক ঘণ্টা আগে এসে পৌঁছিয়েছে এই ভেবে! সুমির জন্য কাউকে এসে মিনিটের পর মিনিট অপেক্ষা করতে হবেনা বরং সুমিই তার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি ঘণ্টার পর ঘণ্টা! সুমি ভার্সিটিতে পড়ুয়া ছাত্রী। আজ এই জায়গায় সে সাবিতের জন্য অপেক্ষা করছে। সাবিত খুব ভালো, অনেক ভালোবাসে ওকে। কলেজ লাইফ থেকে ওদের ভালবাসার পর্বের সূচনা।
কোনো এক দুপুরে কলেজ ছুটির পর আচমকা পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে সাবিতের মনে ধরে যায় সুমিকে। একই পথে বাসা দুজনের। সেদিন সুমি ঐ ২৬নাম্বার রোড়টা ধরে হাঁটতেছিল। হঠাৎ কে যেন তার চুলে টান দিয়ে চলে গেলো।
~অসভ্য, বেয়াদব, ফাজিল কোথাকার। চুল টানার মত সাহসী কাজ করবিই যখন পালালি কেন? সাহস থাকে তো সামনে আয়। থাপ্পড় দিয়ে তোর অসভ্যতামি দৌঁড়াবো। সাবিত উল্টো দিকে দৌঁড়াতেই থাকে, পিছন ফিরে তাকায় না। সুমির রাগের গরগর করে বলতে থাকা কথাগুলো সাবিতের ভালোই লাগছে, মুচকি মুচকি হাসছে সে। দুদিন পর আবার সে রাস্তায়.. সুমি হেঁটে যাচ্ছে আনমনে, বাতাসে উড়োউড়ো তার ওড়না! সাবিত দৌঁড়ে তাকে ক্রস করতে গিয়ে সেই ওড়নার স্পর্শ পায়। সামনে দিকে হেসে অগ্রসর হয় একটু এগিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে বলে
~অসভ্য, বেয়াদব, ফাজিল কোথাকার। ওড়না দিয়ে ছেলে ধরার ধান্ধা, নিজের জিনিস নিজে সামলাইতে পারেনা।
সুমির বুঝতে বাকি রইলো না ঐদিনের জন্য ওকে ভেঙচি কাটছে। রাগে সুমি বিড়বিড় করতে লাগল আর সাবিত জিহ্বা বের করে ভেঙচি কেটে চলে গেলো। তারপর দিন সাতেক পর, সে একটা দোকান থেকে ফোন লোড নিছিলো। দোকানদারকে ভুলিয়ে-বালিয়ে তার থেকে সুমির নাম্বারটা জোগাড় করলো সাবিত। গভীর রাত, হয়তো সুমি ঘুমিয়ে পড়েছে! দুষ্টুবুদ্ধি করে সাবিত টানা ছোট করে করে ১০৯টা কল দিলো সুমিকে। শেষে একটা এসএমএস দিলো
~আমার আগে ঘুমিয়ে পড়েছ, সোনা? ওয়াজ মিসিং ইউ! সকালে যখন সুমি এইরকম মেসেজ দেখতে পায় তখন কল ব্যাক করে সাবিতকে। সাবিত ভয়ে দোয়াদরুদ পাঠ করছে, না জানি তার কপালে আজ কোন ক্যাটাগরির অসহনীয় বকাঝকা আছে! তবু কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করে সাবিত
~হ্যালো…
~হ্যালো, বাবু
~বাবু?! কে কার বাবু! (সাবিত রীতিমত অবাক হলো, সুমি হঠাৎ জান বলল কেন!)
~তুমি আমার বাবু! আসলে জান কাল রাতে ঘুমিয়ে গেছিতো তাই তোমার ফোন পিক করতে পারিনি।
~সরি আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে, আমি আপনাকে ফোন দিইনি।
~ভালো করে দেখো, জান!
~আসলে আমি আমার প্রেমিকাকে টেক্সট করছিলাম। ভুলে আপনার কাছে চলে গেছে। আর জান ডাকবেননা প্লিজ, আমার লজ্জা করে।
~বদমাশ, তোরে জান ডাকব কেন? তোর জান আমি বের করব। খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই, মেয়েমানুষকে ডিস্টার্ব করিস।
আর হ্যাঁ, কাইন্ডলি চোখের ডাক্তারটা দেখাইস নিস। টাকা না থাকলে আমার থেকে নিয়ে যাইস। নাহয় আজ ভুলে তোর প্রেমিকারে টেক্সট করতে গিয়ে আমায় করছিস কাল হয়তো ভুলে তোর মায়ের কাছে পাঠাই দিবি। ফোনটা কেটে গেলো, সাবিত থ্ হয়ে শুনছিল। কিছু বলেনি। এত সুন্দর করে কেউ শাসাতে পারে তার জানা ছিলোনা! এভাবে কিছুদিন কেটে গেল। সাবিত সব বেশি বেশি হচ্ছে ভেবে এসব খুনসুটি বন্ধ করে ভালো হয়ে গেল। ১১দিন পরে সুমিই মেসেজ করলো
~সরি..
~কেন?
~ইচ্ছে হইছে দিছি। রাখলে রাখেন, না রাখলে ফেরত দেন।
~হাহা!
সেদিন থেকে গল্পের মোডটা পাল্টে যায়। শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের। ছোট ছোট খুনসুটি থেকে জন্ম হয় পবিত্র ভালবাসার। এভাবে কেটে যায় ২টা বছর! এসব ভাবতে ভাবতে আজকের সময়ে উপস্থিত সুমি। সবকিছু এখনো রঙিন। আজ সাবিতের আসার কথা, সুমি এখনও অপেক্ষারত। আজ ৩টা বছর ধরে ঠিক এইদিন, এইসময়ে সে অপেক্ষারত। কিন্তু সাবিত আসেনা তার অপেক্ষার অবসান ঘটাতে। সাবিত বছর তিনেক আগেই এইদিনে মোটরবাইক এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল কিন্তু প্রতীক্ষায় আজো সুমি। শেষ কথা হয়েছিল কোনো এক ২৫তম রমজানের সকালবেলায়। দুজন দুজনের হাতে গুঁজে দিয়েছিল প্যাকেট দুটো! দুজন দুজনকে গিফট করেছিল, ঈদের দিন সেসব পড়ে বিকেলবেলা ঠিক এই জায়গাটায় দেখা করবে বলে মনস্থির করেছিল। কিন্তু সেদিনই ছিল সাবিত আর সুমির শেষ দেখা!
আজ সাবিতের মেহেরুন কালারের উপর সোনালি কারুকাজের পাঞ্জাবিটা পড়ে, চুলগুলো এলোমেলো করে, মুখে একরাশ হাসি নিয়ে এগিয়ে এসে সুমির হাতটি ধরার কথা। সুমির হাতে হাত রেখে আরেকটু চাপ দিয়ে ভালবাসি বলার কথা। সুমির সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আজ তাকে সাবিতের বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা! কিন্তু সাবিত আর আসবেনা ফিরে, আসবেনা সুমির কাছে। তবুও সুমি অপেক্ষারত আছে, থাকবে অনন্তকাল। কিছু অপেক্ষাতে কষ্ট নেই, আছে কিছু সুখকর স্মৃতি আঁকড়ে রেখে ভালো থাকার আনন্দ! আর কিছু অপেক্ষার অবসান না হওয়াই ভালো!