টিউশনির খাতিরে রোজ এই বাড়িতে আসা।নবম শ্রেণির একটা মেয়েকে পড়াই।বেশ শান্ত স্বভাবের মেয়েটা, নাম মীরা। কম বয়সের কিন্তু যথেষ্ট ম্যাচিউরিটি মেয়েটার মাঝে বিদ্যমান।স্বাস্থ্য ভালো,আমার সমানই বা একটু বেশি লম্বা হবে।অর্থাৎ সব দিক থেকে পরিপাটি একটা মেয়ে,ভীষণ মেধাবী বটে।তাই পড়াতে বেশ ভালোই লাগতো।তাছাড়া সম্মানী যেটা পেতাম সেটা বাকি দুইটা টিউশনির সম্মানী থেকেও বেশি।যার মূল্য আমার কাছে অসীম ! কারণ এই টিউশনির টাকা দিয়ে নিজে চলি সাথে যতটুকু সম্ভব মায়ের হাতে তুলে দেই। আমি অনার্স ৩য় বর্ষের একজন ছাত্রী।সাধারণ ঘরের খুব সাধারণ একটা মেয়ে।টাকার প্রয়োজনে বাড়ি থেকে এক কিলো হেঁটে এসে এই টিউশনিটা করা। ইদানিং আঙ্কেল,অর্থাৎ মীরার বাবা মীরার পড়া নিয়ে প্রায় ১০-১৫ মিনিট আমার সাথে কথা বলে।ব্যাপারটা প্রথমে ঠিক মনে হলেও এখন আমার কাছে ভীষণ বিরক্তিকর একটা বিষয় মনে হয়।
কারণ তিনি যখন আমার সাথে কথা বলেন তখন মীরাকে বিভিন্ন অজুহাতে রুমের বাইরে বের করে দেন।মীরার মা, অর্থাৎ আন্টি প্রায় অসুস্থ থাকে,সেক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় তিনি হাসপাতালে ভর্তি থাকেন।আন্টি থাকলে হয়তো এমনটা করার সাহস পেতো না আঙ্কেল, আর আমিও টিউশনিটা মন দিয়ে করতে পারতাম। আঙ্কেল যে শুধু মীরার ব্যাপারে কথা বলেন তা নয়,উনি নানাভাবে আমার কাছে ঘেঁষতে চাইতেন।সেটা উনার দৃষ্টিকটু চাহনি বা কথার ধরণ দেখে ঠিক উপলব্দি করতে পারতাম।
মাঝে মাঝে ভাবতে বাধ্য হই যে,একজন ব্যক্তির মানসিকতা কতটা জঘন্য হলে ঐ ব্যক্তি নিজের অসুস্থ স্ত্রীকে হাসপাতালে রেখে নিজের মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে এভাবে হ্যারেজম্যান্ট করতে পারে তা স্বয়ং বিধাতা জানেন।
জানিনা, এই মুহূর্তে আমার কি করা উচিৎ ? এদিকে আমার সেমিস্টার ফাইনাল,সেমিস্টার ফর্মালিটি ফিল আপ করতে টাকার প্রয়োজন।নিজের পরিবারের অবস্থাও খুব একটা ভালো না।এতগুলো টাকা মা কোথায় পাবেন !যদি টিউশনি ছেড়ে দেই তবে ভীষণ চাপে পড়ে যেতে হবে।এইসব ভাবনায় টিউশনিটাও ছাড়তে পারছি না।তাছাড়া ডিসেম্বরে মীরার ফাইনাল পরীক্ষা, এখন হুট করে টিউশনিটা ছাড়াও যাবে না।আর ছাড়তে হলেও জোরালো কারণ দেখাতে হবে,তাছাড়া আঙ্কেলের ব্যাপারটা আমি কিভাবে মীরাকে বলবো?এসব ভেবে ভেবে আমি ভীষণ ডিপ্রেশড হয়ে যাচ্ছিলাম।
সেদিন মীরাকে পড়াতে যাওয়ার পর আঙ্কেল আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলছেন,আমার বেতনটা তিনি দ্বিগুণ করতে ইচ্ছুক, যদি আমি সেটা চাই।উনি আসলে কি বলতে চাচ্ছেন সেটা আমি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি।আমি আঙ্কেলকে বেশ ভদ্রভাবে নিষেধ করেছি। কি করে ব্যাপারটা শেষ করবো মাথায় আসছে না।কিন্তু এর একটা শেষ থাকা দরকার।আঙ্কেল নামের অভদ্র লোকটাকে আমি হয়তো প্রতিবাদ না করে ভীষণভাবে প্রশ্রয় দিচ্ছি ! এর একটা কিছু করা দরকার । পরেরদিন টিউশনিতে গিয়ে মীরাকে বললাম,
–আজ তুমি আমার সিটে বসো এবং আমি তোমার সিটে বসবো।
ব্যাপারটা মীরা বুঝতে পারেনি।যখন দেখলাম আঙ্কেল আসছে ঠিক তখনি আমি ওয়াশরুমে চলে গেলাম।আর মীরাকে আমার সিটে বিপরীত মুখ করে বসিয়ে গেলাম। প্রায় ৩০মিনিট পর ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ওদের বাবা মেয়েকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম,যদিও আঙ্কেল মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছেন। আর উনার সামনে মীরা।আমি ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পেরে বেরোতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনি মীরা আমার হাত ধরে বললো,
–আপু আমি লজ্জিত, তোমার মত একজন টিচার পেয়ে। আমি মীরার কথা শুনে নার্ভাস হয়ে ওকে দেখছি।চিন্তা করছি, আমি কি আসলেই কোনো অপরাধ করেছি, যার জন্য মীরা লজ্জিত !
–তুমি কেমন টিচার বলো তো? এত বড় অপরাধ তুমি কিভাবে দিনের পর দিন সহ্য করছো?বা প্রতিবাদ কেন করলে না? স্যরি বাবা, আমাকে বলতেই হবে।মীরা ওর বাবার নিচু মাথার দিকে তাকিয়ে অনেক কথা বললো। আমি মীরার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম ,
–মীরা, আমি প্রতিবাদ ঠিকই করেছি তবে সেটা তোমার মধ্যে দিয়ে।তার জন্য আমাকে ক্ষমা করো।কারণ আমি তোমাকে ব্যবহার করেছি এই সমস্যা সমাধানের জন্য।যদি আন্টি থাকতো তাহলে হয়তো এমনটা করতে হতো না।
–তুমি আমাকে ক্ষমা করো আপু।আমি ভাবতেই পারিনি তুমি এতটা অপমান সহ্য করে রোজ আমাকে পড়াতে আসতে।ভাববো কিভাবে বলো,একজন বাবা সম্পর্কে একটা মেয়ে এগুলা ভাবতে পারে ? তবে তুমি আমাকে ব্যবহার করোনি বরং কিভাবে একটা সমস্যা সমাধান করা যায় সেটা শিখিয়ে দিয়েছো।
আমি মীরাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিলাম।তবে মীরাদের বাড়ি থেকে আসার আগে আঙ্কেলকে কেবল একটাই কথা বলে আসছি আর সেটা হলো, একটা মেয়েকে কেবল মেয়ে নয়, একজন মানুষ ভাবতে শিখুন। সেদিনের পর থেকে আঙ্কেলের মুখোমুখি আর কখনোই হইনি। টিউশনিটাও শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলাম,অবশ্যই সেটা মাথা উঁচু করে।এটাই আমাদের মধ্যবিত্তদের অহংকার বলা চলে। হ্যাঁ, আমাদের টাকার প্রয়োজন, তবে আত্মসম্মান বিলিয়ে দিয়ে নয়।আত্মসম্মানটাই হলো সবথেকে বড়।