আঁধারে

আঁধারে

তরুর রুমের দরজাটা বন্ধ। তবুও বিশাল ডুপ্লেক্স বাড়ির নিচতলা ছাড়িয়ে উপরেও তাহার কান্না শোনা যাচ্ছে।
বাবা জোরে জোরে মারছেন তাহাকে। অসহ্য লাগছে তরুর। তাহার স্কুল ছুটি হয় দুপুর দেড়টায়। বাসায় ঢুকে দুটো বাজে। আজকে ঠিক দুটো বেজে পনেরো মিনিটেও যখন মেয়েটা এলোনা,ঠিক তখনি ঘর থেকে বের হয়ে গেছেন বাবা। তাহার খোঁজ নিতে যান নি। গাছের ডাল খুঁজতে গিয়েছিলেন। কোথা থেকে যেন একটা বিলম্ব গাছের ডাল খুঁজে এনেছেন।

ডাল হাতে প্রায় একঘন্টা সোফায় বসে ছিলেন তাহার অপেক্ষায়। তাহা ঢুকতে না ঢুকতেই মার শুরু করেছেন ইচ্ছামতো। মা রান্নাঘরে নির্বাক শ্রোতার মতো কাজ করে যাচ্ছেন। যেন তরুর কান্না বা তার গায়ে আঘাত করার শব্দ তার গায়ে লাগছেনা। মাঝখান দিয়ে এসে পেঁপে খাবার জন্য সেধে গেছেন বড় মেয়েকে। তরু অবাক হয়নি। মাথায় হাত দিয়ে বলেছে ,”খাবোনা।” একঘন্টা পর তাহা রুমে ঢুকলো। মেয়েটার সারা গায়ে লাল দাগ। চোখ মুখ লাল। রুমে ঢুকেই সোজা শুয়ে পড়লো। তরু এখন পাশে গিয়ে বসতে চাইলেও বসতে পারবেনা। সন্ধ্যার সময় টেবিলে না দেখলে ঘরে আরেক লঙ্কা কান্ড ঘটবে।

তরুদের ঘরের পরিস্থিতি এতটা খারাপ ছিলোনা। তরু আর তাহা দুইবোন।দুইবছরের পার্থক্য বয়সে। তরু এখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। তাহা সবেমাত্র ক্লাস টেনে উঠলো। মা-বাবা সবসময়ই কড়া ছিলেন পড়াশুনার ব্যাপারে।বাবা তেমন নাক গলাতেন না। তরুর পড়াশুনা মোটামুটি মানের ছিল।কোনোমতে চালিয়ে নিত। বাবা তাও কথা শোনাতেন মাঝে মাঝে। নিজের ঘরের নিয়ম কানুন তরু অল্প বয়সেই বুঝে নিয়েছিল। শান্তশিষ্ট ছিল। বাবা-মা যাই বলতো মেনে নিতো। তাহা ছিল সবকিছুর উল্টো। পড়াশুনায় কখনো ক্লাসে দ্বিতীয় হয়নি। নাচ গান সবকিছুতে ভালো ছিলো। ভালো ছবি আঁকত মেয়েটা। এসবের মধ্যে বাবাও তাহাকে কিছু বলতেন না। পুরো ঘরের প্রাণ ছিল তাহা। মা ছিলেন বন্ধুর মতো।দুই মেয়ে নিয়ে থাকতেন সারাদিন। ঠিকঠাক ছিল সব।

বিপত্তি বাঁধলো যখন ক্লাস নাইনের শেষ দিকে তাহাকে একটা ছেলের সাথে রাস্তায় হাঁটতে দেখলেন বাবা। সবকিছু এক নিমেষেই ধ্বংস হয়ে গেল। দু-তিন দফা উত্তমমধ্যমের পর ডাইনিং রুমের চেয়ারে গোলটেবিল বৈঠকে বসে মাথায় হাত দিয়ে মা বাবা অনেক বুঝালেন। কিন্তু মা বাবার প্রথম প্রতিক্রিয়ার পর একটা দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেলেছিল তাহা। বাবার কথা বাদ দিলে,চিরচেনা বন্ধুসুলভ মাও শত্রু হয়ে গেলেন। মা সারাক্ষন চোখে চোখে রাখতেন। কারণে অকারণে সন্দেহ করতেন। দশমিনিট দেরি করলে দুনিয়া খবর করে ফেলতেন। এমনকি তাহার আর তরুর রুম এক করে দিলেন। একলা ঘরে থাকতে দিতেন না। সবকিছুর পর তাহার পরিবর্তনটা হলো খুব আস্তে আস্তে। কিন্তু সেটা তরুর চোখ এড়ায়নি।

মেয়েটার সুন্দর শ্যামলা চেহারার নীচে আস্তে আস্তে কালি জমলো। সে চুল আঁচড়ানোর পর চিরুনীতে লম্বা লম্বা চুলের গোছা আটকে থাকতো। রাতের পর রাত জেগে থাকতো। লাফালাফি পাগলামি সব বন্ধ। পড়াশুনার বেহাল দশা। মা বাবা ভাবতো সবই ঢং। দুদিন পরে ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাচ্ছিল সব,আগের মতোই চলছিল।শুধু তাহা তিলেতিলে শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তরু এসবের মাঝে নিশ্চুপ দর্শক। একদিন রাত তিনটায় খুটখাট সুবাদে ঘুম ভেঙে দেখে তাহা টেবিলে বসে মাথা ফেলে পেন্সিল দিয়ে শব্দ করছে। তার মাথার সামনে একটা শিশিতে অনেকগুলো ওষুধ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাহা সেখানে। তরু ভয়ে একঝটকায় উঠে ওষুধগুলো বাথরুমে ফেলে দিয়েছিলো। সেদিন তরুর বুকে শুয়ে তাহা খুব কেঁদেছিল।খুব।

তাহার পছন্দের মানুষটাকে চিনতো তরু।এলাকারই ছেলে।তাহার বন্ধু হিসেবে চিনতো। বেশ হাসিখুশি চেহারার ছেলে। ভীষণ ভদ্র। আড্ডাবাজি তে কখনো ছিলোনা। পড়াশুনায়ও ভালো। অনেকদিন পর রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় তরু একটা টং দোকানে দেখেছিলো ছেলেটাকে। তাহার মতো তার চোখেও কালি পরে গেছে। হাতে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। তরুকে দেখলে আগে সালাম দিত। সেদিন চোখের দৃষ্টি পরার সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নিয়েছিলো ছেলেটা। তরুর কেন জানি সব কিছু ভাবলে হাসি পায়। দুনিয়ায় এত নাটক কেন ,ভেবে কুল পায়না সে।

রাতের খাবারের ডাক পড়েছে। তাহা হাতমুখ ধুয়ে স্বাভাবিক ভাবে খেতে বসেছে সবার সাথে। বাবা সামনের চেয়ারে বসে খেতে খেতে রাজনীতির গুণকীর্তন গাচ্ছেন। মা সাথে সাথে তাল মিলাচ্ছেন আর খাচ্ছেন। তরু ভাত মাখতে মাখতে আড় চোখে তাহার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রতি লোকমা ভাতের সাথে একঢোক করে পানি গিলছে মেয়েটা। খাওয়া পর করে উঠলো সবার শেষে। তরু মনে মনে ভাবল ,”খারাপ না। খেয়েছে তো। বাবা-মা বুঝেছে খেয়েছে ,এতটুকুই যথেষ্ট। বাবা-মার বুঝই বড় কথা।” নিজের ভাবনায় নিজেই মনে মনে হাসলো তরু।পরক্ষণেই কেন যেন দুনিয়ার উপর ঘৃনা হলো ভীষণ। একটা দীর্ঘশ্বাস মনের অজান্তে বেরিয়ে এলো।

রাতে শোয়ার পর রুমের অন্ধকারে সিলিং এ তাকিয়ে তরুর চোখ ঝাপসা হয়ে গেল। একগাদা স্টিকার লাগানো ।অন্ধকারে জ্বলে। স্কুল থেকে আসতে সময় তাহা পনেরো টাকা দিয়ে কিনে এনেছিল। সিলিং এর উপর লাগাতে গিয়ে দুই বোনের লাফালাফি আর হাসাহাসির শব্দ তার কানে বাজছে। এগুলো লাগাতে গিয়ে সেদিন তাহা কোচিং মিস দিয়েছিল। আর তাতে মার কি চিল্লাচিল্লি। বকাবকির পর তাহা লাফাতে লাফাতে মার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, “মা চা খাবো।”

মা আরেকটা ধমক দিয়েছিলেন ঠিকই ,কিন্তু একটু পরেই তিন কাপ চা বানিয়ে এনেছিলেন।বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে মার গল্প বলার আওয়াজগুলো কানে ভাসছে তরুর। চোখ থেকে পানি বের হওয়ার আগেই চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। পাশে তাহা ফোঁপাচ্ছে। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো তরু। কাঁদুক। সে জানে সব ঠিক হয়ে যাবে। সব আগের মতো চলবে। ছেলেটা একদিন মাল্টিনেশনাল কোম্পানিতে চাকরি করবে। মেয়েটা ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা সামলাবে। কোনোকিছুই থেমে থাকবেনা। শ্বাস-প্রশ্বাসের লাইনগুলোতে ফুলস্টপ না পড়া পর্যন্ত জীবনের রচনা রচিত হতে থাকবে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত