অনেক দিন পরে আজ রিকশায় উঠেছেন জামশেদ চৌধুরী। শা – শা করে ছুটে চলেছে রিকশা। শীতের রাত। গায়ের শালটা আগে থেকেই ঘোমটার মতো করে মাথায় দেয়া ছিলো। সেই ঘোমটাটি আরো ভালো করে সামনে টেনে নিলেন তিনি। এরপর রিকশাচালক কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
—- কতোদিন ধরে রিকশা চালাচ্ছেন ভাই?
—- এই ধরেন, পেরায় দশ বছর হইবো একটানা রিকশা চালাইছি । তয় এক বছর হইলো খালি মাজেমইদ্যে চালাই।
—- মানে?
ভীষণ অবাক হয়ে জানতে চাইলেন জামশেদ চৌধুরী।
— না, স্যার.. তেমন কিছু না… মাইনে, যহন আমার কোন মানুষের লগে কতা কইতে মন চায়, খালি তহনই চালাই।
— ও…
অন্যমনস্ক হয়ে বললেন জামশেদ চৌধুরী। এই রিকশাচালকও দেখছি তার মতোই। তিনি নিজেও তো শুধু রিকশায় করে একটু ঘুরে বেড়ানোর জন্য, দেশের মানুষের সাথে দু’চারটা কথা বলার জন্য সুদূর আমেরিকা থেকে মাঝেমধ্যেই বাংলাদেশে চলে আসেন।
— কোন বাড়ি যাইবেন স্যার?
— কোনো বাড়ি-টাড়িতে না। এই গ্রামে বড় কোন বাঁশ ঝাড় থাকলে সেখানে নামিয়ে দিও।
একটু চমকে উঠলো রিকশাচালক রমিজউদ্দিন। তারপর মনে মনে বললো, কতো রকমের পাগল যে আছে দুনিয়ায়!
শীতকালে গ্রামে এখনও রাত আটটা/সাড়ে আটটা বাজলেই একেবারে শুনশান নিরবতা নেমে আসে।
এই শুনশান নির্জন রাতে শা– শা– করে ছুটে চলেছে জামশেদ চৌধুরীর রিকশা। রিকশাগুলো আজকাল ব্যাটারি চালিত হওয়ার ফলে চালকদের পরিশ্রম যেমন কমেছে, তেমনি দ্রত চলার ফলে আরোহীদেরও সুবিধা হয়েছে। খুব তারাতাড়ি গ্রামের একেবারে শেষ মাথায় বড় বাঁশবাগানের কাছে এসে রিকশাটি থামালো রিকশা চালক জমিরউদ্দীন। মনে মনে ভীষণ উৎফুল্ল বোধ করলো সে। ভাড়া নেওয়ার সময় সে যখন তার মাথার চাদরটা সরিয়ে ফেলে রিকশা আরোহীর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দিবে তখন সেই রিকশা আরোহীর কি অবস্থা হয়– শুধুমাত্র এই দৃশ্যটা উপভোগ করার জন্যই সে মাঝেমধ্যে রিকশা চালায়।
— এইবার বুজবা চান্দু, তুমি কার লগে এতোক্ষণ কতা কইছো… কার রিকশায় চড়ছো…
বিড়বিড় করে বললো সে।
— ভাড়া কতো হলো? জিজ্ঞেস করলেন জামশেদ চৌধুরী।
— আমনের যা মন চায় দ্যান…. বলে মাথার চাদরটা এক ঝটকায় সরিয়ে ফেলে ভাড়া নেয়ার জন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো সে….
জামশেদ চৌধুরী রিকশার নিচে ঝুলানো হারিকেন এর ঝাপসা আলোয় দেখলেন তার সামনে একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে,তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে আছে।
রিকশা চালক জমিরউদ্দীন ভীষণ অবাক হয়ে ভাবলো, আজ পর্যন্ত কোন মানুষ তো আমার এই আসল রূপ দেখে এভাবে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকেনি। সবাই তো ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌঁড়ে পালিয়েছে। কেউ কেউ অবশ্য অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিলো। আর এই লোকটা এরকম নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেনো! ভয় পেয়ে মরে গিয়ে মূর্তি হয়ে গেলো নাকি লোকটা!
এটা ভেবে তার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেলো। মানুষকে ভয় দেখাতে তার খুবই মজা লাগে, তাই বলে ভয় দেখিয়ে মেরে ফেলার মতো খারাপ ভূত তো সে নয়!
এবার সে “কি ভাই, কি অইলো? কতা কন না ক্যা?” বলে রিকশা আরোহীর মাথার শালটা টান দিয়ে সরিয়ে ফেলে দেখলো- সেখানে কোন মানুষ না, একটা কঙ্কাল দাঁড়িয়ে আছে? এরকম ঘটনা তার ভূত জীবনে কখনো ঘটেনি। তাই সে একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দৌঁড়ে পালাতে গেলে জামশেদ চৌধুরী খপ করে তার হাতটা ধরে ফেলে বললো,
— বেঁচে থাকলে হয়তো আমাদের দু’জনের মধ্যে অনেক ভেদাভেদ থাকতো, কিন্তু আমাদের ভূত সমাজে তো ভূতে-ভূতে কোন বৈষম্য নেই। চলো বন্ধু, আমরা একসাথে কিছুক্ষণ বাঁশ বাগানে ঘুরে বেড়াই। এরপর তোমাকে নিয়ে যাবো আমেরিকায়, সেখানকার বন্ধুদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো তোমায়….
(সমাপ্ত)