এইতো কদিনই হলো নিশির পরিবার জেনেছে তার বাবা অারেকটা বিয়ে করেছে।এটা জানার পর থেকে নিশি তার বাবার উপর রাগ করে বেশ কিছুদিন কথা বলেনি।অবশ্য রাগ করবে নাই বা কেন।এই বয়সে এসে তার অাবার বিয়ে করার কোন মানে হয়।পাড়ার সবাই ছি ছি করছে।নিশির পরিবার মুখ রাখতে পারছেনা সমাজে।ঘরে বৌ বাচ্চা নিয়ে একটা গোছানো সংসার থাকার পরেও অাবার বিয়ে।দুইটাকা কামানোর মুরুদ নেই তার উপর দুই দুইখানা সংসার।সপ্তাহ খানেক অাগে নিশির খাতা শেষ হয়েছিল।সন্ধ্যায় বাবাকে বললে পরদিন দিবে বলে চারদিনেও বাড়ি ফেরেনি তিনি।এটা কেমন বাবা যে তার মেয়েকে এক দিস্তা খাতা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেনা।
নিশি পরিবারের বড় মেয়ে।পরিবারের বড় ছেলের মতই সব দায়িত্ব তার ঘাড়ে।সে চাইলেও পারেনা রঙিন চকচকে জীবন কাটাতে।ওরা তিন বোন।কোন ভাই নাই।নিশি সবার বড়।ক্লাস নাইনে পড়ছে সে।বাকি দুইজন চম্পা অার বিথি।একজন ক্লাস ফোরে অন্যজন এখনও পড়েইনা।নিশি পড়ালেখায় মোটামুটি ভালোই।বাকি সবার মত প্রাইভেট স্যারের কাছে না পড়েও মেয়েটা ভালো রেজাল্ট করে বসে।ভালো গাইড না পেলেও তার রেজাল্ট থাকে প্রথম সারির দিকে।তাছাড়া খুব ভদ্র নম্র স্বভাবের হওয়াতে স্কুলের স্যার ম্যাডামরা তাকে খুব ভালোবাসে।পাড়াতেও ছোট বড় সবাই নিশিকে অনেক পছন্দ করে।
ওই ঘটনার পর থেকে নিশির বাবা সপ্তাহে প্রায় ৪দিনের মত নিশিদের সাথে ঘুমোইনা।ঠিকমত বাজার খরচও দেয়না।নিশিদের অনেকসময় না খেয়ে কিংবা অল্প খেয়ে থাকতে হয়।সেদিন স্কুল থেকে এসে নিশি দেখে যে তার মায়ের সাথে এক মহিলার ঝগড়া লেগেছে।খুব গালিগালাজ করছিল দুজনে।নিশি চুপিচুপি রত্না কাকিকে জিজ্ঞেস করে ওই মহিলার ব্যাপারে।রত্না কাকির মুখে জানতে পারে ওই মহিলা তার বাবার নতুন বিয়ে করা বৌ।মহিলার ৪-৫ বছরের একটা বাচ্চাও কোলে অাছে।মহিলা স্বামীর অধিকার নিয়ে এসেছে।মনে মনে খুব রাগ হচ্ছিল নিশির।সামনে পেলে বোধই বাবাকে দু-চার কথা শুনিয়ে দিত সে।
সেদিন রাত্রিবেলা হুট করে প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হয়।টিনের ছিদ্র দিয়ে বিছানায় পড়ছিল বৃষ্টির পানি।গেল বর্ষাতেও তারা এভাবে ভিজেছিল।নতুন টিন লাগানোর কথা থাকলেও টাকা না থাকার অযুহাতে লাগানো হয়নি অার।সারারাত ঘুমাতে পারেনি নিশিরা।বৃষ্টিতে ঘুম ভালো হয় সবার।বৃষ্টি উপভোগ করে অনেকেই।কিন্তু যাদের ঘরে বৃষ্টির পানি ঢুকে তাদের কষ্টের সীমা থাকেনা অার।মাঝরাতে বিছানায় পড়লে তো সাধের ঘুম হারিয়ে যায়।চম্পা অার বিথি বাচ্চা মেয়ে।মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গাতে খুব জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে তারা।পরে নিশি তাদেরকে মেঝেতে একপাশে শুইয়ে রেখেছিল।এদিকে নিশি অার তার মা বসে বসে ভোরের প্রহর গুনেছে রাতভর।
পরদিন ভোরে চুলা ধরাতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছিল নিশির মা।কাল রাতে সেখানেও পানি ডুকে স্যাঁতসেঁতে হয়েছে পুরো জায়গাটা।অাগুন জ্বলছেনা।খানিকক্ষণ পর যখন নিশির বাবা ঘরে ফিরে খুব বকাঝকা করে মা মেয়ে মিলে।নিশির মা তো বটি নিয়ে উঠে কেটে ফেলার জন্য কিন্তু নিশি সময়মত হাত ধরে ফেলে।নিশি পরিষ্কার গলায় বাবাকে শুনিয়ে দেয় সে যেন ভাবে তার বৌ বাচ্চা মরে গেছে।ওদের ঘরে না অাসতে বারন করে।হাতে থাকা গরম পরটার টোলাটা নিশির হাতে দিলে সে অন্যত্র ছুড়ে ফেলে সেটা।মেয়ের এমন রুপ দেখে হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হয় বাবার।
নিশির বাবা হয়ত নিজের ভুলটা কোথায় সেটা বুঝতে পেরেছেন।একটা পুত্র সন্তান লাভের অাশায় তিনি দ্বিতীয় বিয়েটা করেছিলেন।তাছাড়া বিয়েটা করার সময় তার মনে হয়েছিল দুইটা সংসার কোনরকমে সামলাতে পারবেন।কিন্তু বয়সের এপর্যায়ে এসে রোগা শরীরে অার ভারি কাজ করতে পারছেননা তিনি।অাজকাল রোগ বাসা বেঁধেছে তার শরীরে।মাঝে মাঝে বিলে মাটি কাটার সময় মাথা ঘুরেঘুরে পড়ে যায়।ভালো কোন ডাক্তার দেখায়নি।ওষুধপাতি খাওয়ারও কোন নাম নেই।বড় মেয়ের কথা শুনে যেন অারো ভেঙ্গে পড়েন তিনি।দিনরাত মাটি কেটে নতুন টিন কিনে নিয়ে যায় ঘরের জন্য।নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তা লাগিয়েও দেয়।
পরদিন দুপুরের কনকনে রোদে মাটি কাটছিল নিশির বাবা।হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি।অাশেপাশের লোকজন তড়িগড়ি করে হাসপাতালে নিয়ে অাসে।তারা বাড়িতেও খবর দেয়।কিছুক্ষণের মধ্যে ওনার দুই স্ত্রীই সেখানে উপস্থিত হয়ে যান।কর্তব্যরত ডাক্তার খুব সহজেই নিশির বাবাকে মৃত ঘোষণা করে দিলেন।কান্নার রোল পড়ে গেল মুহুর্তেই।মানুষটা এত তাড়াতাড়ি পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে সেটা কখনই ভাবেনি নিশির মা।জানলে এত কষ্ট দিতনা মানুষটাকে।সেদিন কত গালিগালাজ-ই না করেছিল মানুষটাকে।এতদিন যে মানুষটা তার দুচোখের বিষ হয়েছিল অাজ সেই মানুষটাকেই বুকে জড়িয়ে বিলাপ কান্না করছে নিশির মা।
সাদা কাপড়ে জড়িয়ে গেলে ভালোবাসার মানুষের অভাব হয়না।সেটার জলন্ত প্রমাণ বোধই অাজ নিশির বাবা।মানুষটাকে সমাজের মানুষ কম বকেনি।হাসাহাসিও করেছিল অনেকেই।অাজ তাদের মধ্যে প্রায় সবার চোখেই জল চিকচিক করছে।কেউ কেউ কেঁদে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।যারা ওনার শত্রু ছিল তারাও হয়ত গোপনে একবার ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছে মানুষটার কাছে।চম্পা বাবার মাথার কাছে বসেই কাঁদছিল।কারন তার বুঝ হয়েছে যে মানুষ মরলে অার ফিরে অাসেনা।কিন্তু ছোট্ট বিথি ঘরে বসেই পুতুল খেলছিল।তার ধারনা তার বাবা ঘুমিয়ে অাছে।ঘুম ভাঙ্গলেই তার বাবা অাবার কথা বলবে।
নিশিকে খবর দিয়ে স্কুল থেকে অানা হল।সারারাস্তা কাঁদতে কাঁদতেই এসেছে মেয়েটা।তারপর মৃত বাবার পাশে বসে সে কি বিলাপ কান্না তার।সেদিন নিশির অার্তনাদ শুনে বোধই বিধাতাও কেঁদেছিল।তিন পাড়ার মানুষ এক হয়েছিল নিশির কান্না শুনে।পাষান হৃদয়ের মানুষগুলোও ফিক করে কেঁদে ফেলেছিল সেদিন নিশির অাহাজারি দেখে।মিথ্যে বলবনা, অামিও নিশির কান্ড দেখে অচিরেই কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন।কান্নার এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে নিশি।অামি দৌড়ে গিয়ে মুখে পানি ছিটিয়ে লেবু পাতার ঘ্রাণ শুকিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে অানলাম।তারপর নিশিকে বারণ করলাম কাঁদতে।
একটা পরিবারে বাবা হল বটগাছের মত।ডাল হয়ে তিনি তার স্ত্রী সন্তানদের বিভিন্ন বিপদ থেকে সুরক্ষিত রাখেন।যখন মাথার উপর থেকে সেই বটগাছের ছায়াটা সড়ে যায় তখন সে পরিবারে দুঃখ দুর্দশার সীমা থাকেনা অার।নিশিদের অবস্হা তেমনই হল।তাদের অসহায় দেখে পাড়ার মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিল।তবে সেটা কিছুদিনের জন্য।কেউ ডাল দিত, কেউ চাল, কেউ তেল এভাবে মোটামুটি মাস তিনকে চলছিল।তারপর অাস্তে অাস্তে সবাই সরে যায়।পরে কোন উপায় না দেখে নিশির মা বাড়িতে গিয়ে কাজ করতে শুরু করে।সেখানে টুকটাক টাকা পয়সা, বাড়তি খাবার টাবার পায় সেগুলো এনে বাচ্চাগুলোকে খাওয়ায়।বিথি তো অাশায় বসে থাকে কখন তার মা শাড়ির অাঁচলে করে তার জন্য খাবার অানবে।
এভাবেই চলছিল দিন।মাত্র অল্পসময়ে এতকিছু ঘটে যাওয়ার পরেও নিশি থেমে থাকেনি।তার পড়ালেখা চলছিল দূর্বার গতিতে।সে নিজের পড়ালেখার পাশাপাশি ছোট বোন দুটোকে মানুষ গড়ার দায়িত্ব নিয়েছিল একা হাতেই।এসএসসিতে মেয়েটা চমৎকার রেজাল্ট করে বসল।অামি তখন ৪-৫ টা টিউশন করাতাম।সেগুলো যখন নিশিকে করাতে বললাম তখন নিশি অামাকে বলে- দাদা তোমার সব টিউশন অামাকে দিয়ে দিচ্ছ কেন? বললাম- অামি টিউশন না করেও দিব্যি চলতে পারব কিন্তু তুই পারবিনা।একটু কষ্ট করে হলেও টিউশন গুলা চালাইস।চম্পা অার বিথি তোর মুখের দিকেই চেয়ে অাছে।মনে রাখিস বাবার পরে ওদের অাবদার পূরনের মানুষ হচ্ছিস তুই। অামার মুখের উপর নিশি অার কিছু বলেনি।
ইদানিং নিশি দম ফেলার ফুরসত পাচ্ছেনা।সারাদিন নানা ব্যস্ততার মাঝে কাটাতে হয় মেয়েটার।কিছু রুটিনবাঁধা নিয়মে এগোতে হয় তাকে।সকালে নিজের দুইটা প্রাইভেট শেষ করে তারপর কলেজের ক্লাস, সেখান থেকে ফিরে অল্পসময় রেস্ট নিয়ে বাচ্চাগুলাকে পড়াতে হয়।পড়িয়ে উঠতে উঠতেই সন্ধ্যা নেমে অাসে ব্যাস।এরপর নিজের পড়া শেষ করতে করতেই ঘড়ির কাটা এসে থামে বারোটায়।ক্লান্তি লাগলেও কোনটাকেই এড়িয়ে যেতে পারেনা সে।কেবল সপ্তাহের শুক্রবারটাই যেন সে গলা ভরে শ্বাস নিতে পারে।একটু কষ্ট করছে বলেই তো সে মাস শেষে কিছু টাকা পায়।যা দিয়ে নিজের পড়ালেখার খরচ সাথে সংসারের যাবতীয় খরচ মিটিয়ে নিতে পারছে।চম্পা অার বিথির অাবদারের খনি তো এখন নিশিই।