দুই ইঞ্চি হিলের সাদা রঙের স্যান্ডেল পরে তিনি হাঁটছেন। ফাঁকা করিডরে শব্দ উঠছে খটখট আর দূরের সাদা দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসছে। এত সুন্দরও হয় একজন মানুষ! হতে পারে! আমার প্রাণের পরে চলে যাচ্ছেন তিনি।
আমি হাঁ করে তাকিয়ে আছি। আমার নাম শহীদুর রহমান তাপস। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হিস্ট্রিতে মাস্টার্স করেছি। ঢাকা শহরে থাকি কলাবাগান এলাকায়, একটা বাসায় তিনজন ব্যাচেলর। দুটো টিউশনি করি। মেসে যে চৌকিটাতে আমি ঘুমাই, সেটা আজিমপুর থেকে কিনেছি, আট শ টাকায়। আমার কাঁথাটায় মায়ের শাড়ি আছে। কিছুটা ছেঁড়া। অঘ্রানের শীতে সেটা গায়ে জড়িয়ে থাকি। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি হাজার পঁচিশেক বেতনের একটা চাকরির স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি।
আজ এসেছি চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট প্রজেক্টের জন্য অস্থায়ী ভিত্তিতে লোক নেওয়া হবে। এই ১৪ তলা ভবনের ১২ তলায় ১২০৯ নম্বর কক্ষে যেতে হবে আমাকে।
আমার গায়ে সাদা শার্ট। এটা আমার নয়। পাশের রুমের নেহালের। ও শার্টটা ঢাকা কলেজের উল্টো দিক থেকে কিনেছে চাকরির ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্য। আমি আজকের জন্য শার্টটা ধার নিয়ে এসেছি। আমার গলায় একটা টাইও ঝুলছে। এটা আবার আবুল কাশেমের। সে আমাদের আরেকজন মেসমেট। আবুল কাশেম একটা রেস্টুরেন্টে ওয়েটারের চাকরি করে। তাকে নিয়মিত টাই পরতে হয়। আমার গলায় টাইয়ের নট সে বেঁধে দিয়েছে।
আমি টেম্পো থেকে নেমে খানিকটা পথ হেঁটে আগারগাঁওয়ের এই ভবনে এসেছি। বাইরে তীব্র রোদ। যদিও আসন্ন শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে উত্তুরে বাতাস বইছে বাইরে, তবু আমার কপালে ঘাম। শার্টটা পিঠের কাছে চেপে বসছে।
দুটো সিঁড়ি ভেঙে এই বহুতল ভবনের নিচতলায় আসতেই একটা শীতল ছায়া আমাকে স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখি সাদা শাড়ি পরা এক অপ্সরী দুই ইঞ্চি হিলের সাদা স্যান্ডেল পরে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন।
‘দারুণ সুন্দর কিছু দেখলে আমার একটু একটু কান্না আসে’—সুনীলের কবিতাটা আমি আমার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের রুমমেটকে দিবস–রাত্রি বিরামহীনভাবে আবৃত্তি করতে শুনেছিলাম। তখন খুব বিরক্ত লাগত। এখন কবিতার লাইনটাই আমাকে পেয়ে বসেছে। আমার কান্না পাচ্ছে, গোপনে।
আমি অবশ্য এই নারীর মুখ এখনো দেখিনি। এখনো তাঁরে চোখে দেখিনি, শুধু স্যান্ডেলের খটখট আওয়াজ শুনেছি।
তিনি লিফটের সামনে দাঁড়ালেন। আমিও।
লিফট জিনিসটা আমি ভয় পাই। আমাদের গোবিন্দগঞ্জের কোথাও কোনো লিফট ছিল না। ওখানেই স্কুল-কলেজ সেরে আমি রাজশাহী যাই। রাজশাহীতে দু-চারটা ভবনে লিফট ব্যবহার করতে হতো, ভয়ে পারতপক্ষে আমি সেসব ভবনেও সিঁড়ি ব্যবহার করতাম।
আমার সামনে তিনি। তাঁর পেছনে আমি। পারফিউমের গন্ধে আমার সমস্ত অস্তিত্ব আচ্ছন্ন হয়ে আসছে।
লিফটের দরজা খুলে গেল।
এই মেয়ের সঙ্গে আমাকে এই লিফটে উঠতে হবে। ত্রিভুবনে আর কেউ নেই। শুধু তিনি আর আমি।
লিফটের ভেতরে আয়না। আয়নায় আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি। এ যে সোনালি বেন্দ্রে! আমি হিন্দি ছবি দেখি না। কিন্তু সোনালি বেন্দ্রের খবর আমি রাখি। ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’তে তিনি এসেছিলেন। তখন আমি ক্লাস এইট–নাইনে পড়ি। যতক্ষণ ওই অনুষ্ঠান হচ্ছিল, সারাটিক্ষণ সোনালি বেন্দ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সোনালি যখন হাসছিলেন, প্রতিবার আমার হৃৎস্পন্দন একবার করে থেমে যাচ্ছিল। সোনালির ক্যানসার হয়েছে, নিউইয়র্কে চিকিৎসা নিয়ে তিনি ভারতে ফিরে এসেছেন, এসব খবর আমি রাখি। চাকরির সন্ধানে ঢাকায় আসা যুবকদের দেশ-বিদেশের কত খবরই তো রাখতে হয়।
আমার সামনে একজন অল্প বয়সী সোনালি বেন্দ্রে। তাঁর শাড়ির রং সাদা। সাদা শাড়িতে রুপালি পাড়। ইস্তিরি করা নিপাট শাড়ির আঁচল। চুল বেণি করা। কপালের একপাশে সিঁথি। তাঁর শুকচঞ্চু নাসার ওপরে দুই টানা ভুরুর মাঝে একটা সাদা টিপ। উফ্। হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে পড়ে নারীদের মাত্র একটা উপমা আমি জানি। মেয়েটা দেখতে পরির মতো। আর চোখ দুটো তাঁর ভীষণ মায়াকাড়া।
আমরা একই লিফটে উঠেছি। তিনি বিড়বিড় করলেন, ‘টুয়েলভ।’
আমিও বিড়বিড় করলাম, ‘আমিও টুয়েলভ।’
লিফটের দরজা বন্ধ হলো। এইবার পারফিউমের সঙ্গে খানিকটা ঘামের গন্ধও পাচ্ছি। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছি। আমার নারীবর্জিত পৃথিবীতে এই রকম অপরূপার ঘামের গন্ধও যে ফুসফুস ভরে নেওয়ার মতো, এই কথা তো কাউকে বলাও যায় না।
লিফট উঠছে। দুই, তিন, চার…
একটা ছয় ফুট বাই চার ফুট পরিসরে আমার সঙ্গে একজন পরিমানবী। তাঁর গায়ে নাম না–জানা সুগন্ধি আর রুপালি দেহে সোনালি ঘামের অনির্বচনীয় গন্ধ।
ধপাস। একটা ঝাঁকুনি। লিফট অন্ধকার হয়ে এল। হাত দুয়েক নিচে নেমে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল লিফট। আমি একটা আওয়াজ শুনলাম, আউচ, আর তিনি সোজা এসে দু-হাতে আমার দু-বাহু খামচে ধরলেন।
ঠিক আলিঙ্গন নয়। কনুইয়ের ওপরে আমার দুই হাতে তাঁর খামচিটা খানিকক্ষণ রইল।
আমার নিজেরই ভয়ে আত্মারাম খাঁচাছাড়া।
লিফট অন্ধকার হয়েই আছে। বুক ধকধক করে কাঁপছে আমার। তিনি বললেন, ‘মা গো! আমি এই জন্যই লিফট খুব ভয় পাই!’
আমি বললাম, ‘আমিও লিফট খুব ভয় পাই।’
‘এখন কী হবে?’
আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই কারেন্ট গেছে। আসবে। জেনারেটর চলবে নিশ্চয়ই।’
পকেটের মোবাইল ফোন হাতে নিলাম আমি। মোবাইল সেটের টর্চ লাইট জ্বালালাম। অন্ধকার বেশি ভয়ের ব্যাপার। আলো তবু সান্ত্বনাদায়ক।
একটু পরে আলো জ্বলে উঠল।
তিনি আকুল হয়ে আছেন। আমিও। আমাকে খামচিমুক্ত করেছেন আগেই। আমি লিফটের নবে অ্যালার্মের ছবি খুঁজতে লাগলাম।
একটু পরে ভেতরের লেখাগুলো জ্বলে উঠল। তারপর ফের চলতে শুরু করল লিফট। টুয়েলভে এসে লিফট থামল। আমরা দুজনেই লিফট থেকে নামলাম। এদিক-ওদিক তাকালাম। তারপর সাইন দেখে এগিয়ে গেলাম। গেটে সার্চ করা হলো। স্বাক্ষর করতে হলো। ভিজিটর কার্ড গলায় ঝুলিয়ে আমরা ভেতরে এগোতে লাগলাম। পুরো অফিসটাই খুব নির্জন। অল্পসংখ্যক লোক বোধ হয় কাজ করে। আমাদের একটা কাচঘেরা ঘরে সোফায় বসতে বলা হলো।
দুজন বসে আছি।
তিনিই মুখ খুললেন। বললেন, ‘আমার নাম নাতাশা। নাতাশা হাবিব।’
‘আমার নাম শহীদুর রহমান তাপস।’
‘আমি এসেছি জবের ইন্টারভিউ দিতে।’
‘আমিও।’
‘আপনার ব্যাকগ্রাউন্ড কী? কোন সাবজেক্ট?’
‘হিস্ট্রি। আপনি?’
‘আমি আর্কিয়োলজি। জাহাঙ্গীরনগর। এরা তো বোধ হয় একজন নেবে।’ তিনি বললেন।
আমি বললাম, ‘তাহলে আপনাকে নেবে। ইউএন জবের পলিসি হলো নারীদের অগ্রাধিকার।’
‘না না। এমন কোনো কথা নেই। এদের কাজে প্রচুর ঢাকার বাইরে থাকতে হবে। কাজেই ছেলেদের এরা পছন্দ করতে পারে।’
আমার ইন্টারভিউ খারাপ হয়নি। সাইফুরসে স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করছি। ইন্টারনেটে রোজ এক ঘণ্টা ইংরেজি শেখার কোর্স করি নিজে নিজে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগল। মেক্সিকোর রাজধানীর নাম কী, পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত জাতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেনি। একজন দেশি, একজন বিদেশি ছিলেন। দুজনেই পুরুষ। আমি কোথায় পড়েছি, কী পড়েছি, কী নিয়ে আগ্রহ—এসব বিষয়ে তাঁরা গল্প করলেন।
তাঁরা বললেন, ‘আপনার সঙ্গে যে ভদ্রমহিলা এসেছেন, তাঁকে কি একটু অনুগ্রহ করে আসতে বলতে পারবেন? আপনার কাজ শেষ। আপনি যেতে পারেন।’
আমি বাইরে এলাম। আমার ফুরফুরে লাগছে। ওয়েটিং রুমে এসে বললাম, ‘নাতাশা, আপনার কল। ওই যে দুই নম্বর দরজাটা, ওইটায় যেতে হবে।’
আমি বেরিয়ে এলাম। লিফটের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। দরজা খুলল। আয়নায় নিজের চেহারা দেখতে দেখতে গ্রাউন্ড ফ্লোরে যাওয়ার জন্য জি চাপলাম আমি।
রাত্রিবেলা নিজের ঘরে বসে আবার ইংরেজি শেখার প্র্যাকটিস করছি মোবাইল ফোনে ইউটিউবে। কিন্তু বারবার মনে পড়ছে নাতাশা হাবিবের মুখখানি। তিনি অন্ধকারে আমাকে খামচে ধরেছিলেন।
অন্ধকারে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতার ভেতরে শুয়ে নানা কিছু ভাবি। আকাশকুসুম চয়ন করি। আমার গায়ে ছেঁড়া কাঁথা। ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি লাখ টাকা দামি স্বপ্ন রচনা করে যাই।
আমাদের দুজনেরই জব হয়ে গেছে। একই অফিসে চাকরি করি আমরা। দুপুরে একই ক্যানটিনে বসে খাই। নাতাশা ছোট্ট টিফিন বক্সে রান্না করা খাবার আনেন। আমার প্লেটে হলুদ খিচুড়ি আর সাদা ডিম তুলে দেন। আমি তাঁর চাপাকলির মতো আঙুলের দিকে তাকাই। তিনি ডান হাতের কনিষ্ঠায় লেগে থাকা একটা হলুদ ভাত নিজের লাল জিব বের করে চেটে নেন। তাঁর ঘামের গন্ধে টেবিলটার আশপাশ বুঁদ হয়ে থাকে।
রিগ্রেট লেটার আসে। ই–মেইলে। আমার ওই চাকরি হয়নি। আমি দমে যাই। মরমে মরে যাই। এই চাকরি হলে ভালো হতো। অবশ্য শুধু আমার হলে হতো না। নাতাশারও হতে হতো।
আমি ফেসবুকে নাতাশা হাবিব সার্চ দিই। তিনজনকে পাই। যাঁকে খুঁজছি, তাঁকেও পাওয়া যায়। রাতের বেলা বসে বসে মোবাইল ফোনে নাতাশার ছবি দেখি।
দুদিন পরে নাতাশা পোস্ট দেন ইউনেসকোর প্রজেক্টে তিনি যোগ দিয়েছেন।
একসময় নাতাশাকে আমি ভুলে যাই। টিউশনি, মেসের বাজার, চাকরির ইন্টারভিউয়ের চক্করে দিন কাটে। ছেঁড়া কাঁথাটা ভালোভাবে জড়িয়ে রাখি। এই কাঁথায় আমার মায়ের শাড়ি আছে। এটাতে আমি মাকে পাই।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছি। ছাত্র পড়াই, পরীক্ষা নিই, ক্লাবে যাই, শিক্ষক পলিটিকস করি। কিন্তু বেশি করে যা করি তা হলো, আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপের খবর সংগ্রহ।
দিন চলে যায়। গোবিন্দগঞ্জ থেকে মা ডেকে পাঠান। ‘বাবা, আয় বাড়িতে একবার। তোর জন্য মেয়ে খুঁজছি। কেমন মেয়ে চাস? বল।’
আমি বলি, ‘মা, আমি এখন বিয়ে করব না। আমি আগে পিএইচডি করব। তারপর…’
নাতাশাকে আবার খুঁজি ফেসবুকে।
পেয়ে যাই। নাতাশা লিখেছেন, ‘আমার আম্মুসোনার আজকে বার্থডে। সারা দিন মেয়েটার সঙ্গে কাটিয়েছি।’ একটা বছর দুয়েকের বাচ্চার সঙ্গে হুটোপুটি লুটোপুটির ছবি।
মাকে ফোন দিই। বলি, ‘মা, পাত্রী দেখো। পাত্রী শিক্ষিত হতে হবে মা।’
মা বলেন, ‘শিক্ষিত, সুন্দরী আর মার্জিত। আমার রাজপুত্রের মতো দেখতে ছেলে।’
আমি হাসি, ‘মা, রাজপুত্র তুমি কোথায় দেখেছ যে বলছ তোমার ছেলে দেখতে রাজপুত্রের মতো?’
প্যারিসে একটা সেমিনারের দাওয়াত পেয়েছি। ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনজারভেশনের ওপরে। তক্কে তক্কে ছিলাম। সারাক্ষণ ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে দেখি, কোথায় কী হয়। এটা হয়ে গেল। টিকিট অর্গানাইজাররা পাঠিয়েছে।
প্লেনে বসে আছি। বাঁ দিকে দুটো সিট। আমি পেয়েছি আইল। আমার বাঁ পাশে জানালার সিটটা ফাঁকা। যেন ফাঁকা থাকে। তাহলে হাত-পা ছড়িয়ে বসা যাবে। কোনো মোটা মানুষ যদি এই সিটে বসে আর মধ্যখানের কমন হাতলে যদি হাত রাখে, আমি মারাই যাব।
মাঝখানে একটা রোমশ হাত, মোটা মানুষটার থলথলে পা আমার পায়ে ঠেলছে, তার গায়ে বদবু…ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে আছি। ঘুম পাচ্ছে।
এই সময় মধুক্ষরা কণ্ঠ, ‘এক্সকিউজ মি…আপনার পাশের সিটটা আমার…’
এইবার আমার অক্কা পাওয়ার পালা। নাতাশা হাবিব…বিড়বিড় করে বললাম, ‘নাতাশা হাবিব…’
‘আপনি আমাকে চেনেন?’
‘হ্যাঁ। আপনি ইউনেসকোর প্রজেক্টে আছেন।’
‘কীভাবে জানলেন?’
‘আপনি ঠিকঠাকভাবে বসেন। বলছি।’
নাতাশা হাঁপাচ্ছেন। বললেন, ‘জ্যামে পড়েছিলাম। অল্পের জন্য ফ্লাইট মিস করিনি।’
তিনি তাঁর হাতের ট্রলি মাথার ওপরে রেখে বসলেন আমার পাশে।
আমি বললাম, ‘আপনার মেয়ে কেমন আছে? সুকন্যা?’
‘ও আসলে আমার বোনের মেয়ে, কিন্তু ও আমার জানটুস…আছে ভালো।’
‘কার কাছে থাকবে?’
‘ওর মায়ের কাছে থাকবে। আমাকে মিস করবে। কারণ, মায়ের চেয়ে মাসির দরদ তো সব সময় বেশি হয়। ’
প্লেন আকাশে। বেশ রাত এখন দেশে। প্লেনের ভেতরের বাতিও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমি ঘুমুতে পারছি না। আমার পাশে একটা বুনো গন্ধ। আর পারফিউমের মিষ্টি গন্ধ। দুটো মিলে আমার ঘুম কেড়ে নিয়েছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি। তারপর ঘুম ভাঙল। দেখি, নাতাশা আমার হাতের ওপরে হাত রেখে খামচে ধরে আছেন। ঘুমুচ্ছেন। বিড়বিড় করছেন।
একসময় আলো জ্বলে উঠল। বিমানসেবিকারা স্ন্যাকস দিচ্ছেন। নাতাশাও জাগলেন।
‘ইশ্, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ এরপর বললেন, ‘আপনি কই যাচ্ছেন?’
‘প্যারিস।’
‘ওমা, আমিও তো প্যারিস। প্যারিসে কী?’
‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কনফারেন্সে।’
‘ওমা আমিও তো…আপনার সঙ্গে কোথায় দেখা হয়েছিল বলুন তো।’
‘না। বলব না। আপনি কেন মনে রাখেননি। আমি তো একটি দিনের জন্যও ভুলিনি।’
প্যারিসে আমরা একই ট্যাক্সিতে একই হোটেলের লবিতে নামলাম। হোটেলটা একটা হেরিটেজ হোটেল। এর লিফটায় একসঙ্গে দুজন ওঠা যায় কি যায় না। কেচি গেট। মানে কলাপসিবল। নিজে টেনে গেট লাগাতে হয়। আর নিজের লাগেজ নিজেকেই টানতে হচ্ছে। একই লিফটে উঠলাম আমরা দুজন।
আমি বললাম, ‘আমি কিন্তু লিফট ভয় পাই।’
নাতাশা বললেন, ‘ওহ, মনে পড়েছে, আমরা একটা লিফটে আটকে পড়েছিলাম।’
আমাদের রুম পাশাপাশি। নাতাশা তাঁর ঘরে ঢুকলেন। আমি আমার ঘরে। দুপুরে একসঙ্গে খেতে যাব। এক ঘণ্টা পরে আমরা নিচে নামব…
আমার রুমের দরজায় নক।
‘কামিং…’আমি বললাম।
‘আমার ঘরে একটা মাকড়সা…আমি ভয়ে মারা যাচ্ছি…মাকড়সাটা একটু…’
‘আচ্ছা আমি আসছি…’
এর গায়ের এই বুনো গন্ধই আমাকে পাগল করে ফেলবে!
তিনি বললেন, ‘আমি আর ওই রুমে যাব না। আমি এই রুমেই রাত কাটাব।’
আমি বললাম, ‘তা কী করে হয়।’
বললাম কারণ, এই ঘরে বিছানায় একটা ছেঁড়া কাঁথা আছে। আমি সেটা সুটকেসে ভরে নিয়ে এসেছি। এই কাঁথায় আমার মায়ের শাড়ি আছে। আর ওই ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে আমি যে স্বপ্ন বুনে চলেছি…এই মেয়েটি ঘরে ঢুকলেই যদি আমার স্বপ্নটা ভেঙেচুরে যায়!