লোকাল বাসে কোনো মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে খারাপ লাগে আমার। মেয়েদের কাছে ব্যাপারটা খুবই অসহ্যকর। তবুও বাধ্য হয়ে বাসে উঠতে হয়। মিহিন মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে৷ বাসের সিট একটাকে শক্ত করে ধরে আছে৷ ভীড় তত বেশি নেই। এর মাঝেও কিছু ভালো চেহারার মানুষ ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। আমার অসহ্য লাগল। খানিকটা রাগ হলো মিহিনের উপর। ওর দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে৷ আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি৷ আমার সহ্য হলো না। নিজের সাবেক প্রেমিকা হলেও অন্তত একজন মেয়ে হিসেবে তার জন্যে কিছু একটা করা উচিৎ। সামনে থেকে আরো ভীড় বাড়বে। অনেক লোকজন উঠবে৷ তারউপর এই শহরে তো সুযোগসন্ধানী অনেক সুপুরুষ আছেই। তারা সুযোগ বুঝেই এদিকে ওদিক হাত ছেড়ে দেয়। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। আমার পাশের সিটে বদা ভদ্রলোককে বললাম,
-একটু খেয়াল রাখবেন। যাতে কেউ এই সিটে না বসে। আমি ওই মেয়েটাকে পাঠাচ্ছি। ও বসবে এখানে। এই বলে সকল লজ্জা সম্মানের মাথা খেয়ে তার কাছে গিয়ে বললাম,
-ওই সিটে গিয়ে বসো৷
ও একদম আমার চোখের দিকে তাকালো। তার সেই তাকানোয় কী ভীষণ সরলতা লেপ্টে ছিল! ঘোর লাগানো কিছু একটা ছিল। আমি চোখ কচলে নিলাম। তারপর অন্য দিকে তাকালাম। মিহিন মৃদু স্বরে বলল,
-আমি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকব৷ তোমার পাশে। আমি এবারেও ওর দিকে তাকালাম না৷ অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম,
-দেখো, সামনে থেকে অনেক লোকজন উঠবে৷ তোমার এমনিতেই দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। তারউপর এতো ভীড়ের মাঝে ঠিকভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না৷ সমস্যা হবে।
-হোক সমস্যা। যদি সমস্যার ছুতোয় তোমার সাথে একটুখানি কথা বলা যায়,যদি তোমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা যায় তবে আমি সেই সমস্যাটাকে গিলে নিবো৷ আমার কোনো আপত্তি নেই।
-আমি যদি এখান থেকে চলে যাই? ওর মুখটা আগ থেকেই মলিন ছিল। এখন আরো খানিকটা মলিন হয়ে গেল৷ চোখে জল জমতে থাকল যেন। কোনো মতে বলল,
-যেও না। প্লীজ। পাশ থেকে এক আঙ্কেল বলে উঠলেন,
-তুমি ওখানে গিয়ে বসো না। সমস্যা কই? ও বলল,
-না আঙ্কেল, আমি এখানেই ঠিক আছি। উনি বললেন,
-তোমার দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে।
-সমস্যা নেই। আমি সামলে নিবো। আমি আঙ্কেলের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-ওর আসলে ওই সিটে গিয়ে বসতে প্রব্লেম হচ্ছে৷ আঙ্কেল, প্লিজ কিছু মনে করবেন না৷ আপনি যদি ওই সিটে গিয়ে বসতেন! উনি হাসলেন। দ্রুত বললেন,
-ঠিকাছে বাবা। যাচ্ছি। এই, তুমি বসো এখানে।
এই বলে তিনি দ্রুত ওই সিটে গিয়ে বসে পড়লেন৷ মিহিনকে সিটে বসতে বললাম আমি৷ ও বসল না৷ আমি জোর করে বসিয়ে দিলাম। ঠিক তার অল্প কিছু পরেই বাস ব্রেক করল এবং কিছু মূহুর্তের মধ্যেই বাস পুরে গেল মানুষে। সত্যি বলতে আমার দাঁড়িয়ে থাকতেও কষ্ট হচ্ছিল৷ সামনে থেকে প্রেশার আসছিল। কোনো মতে দাঁড়িয়ে থাকলাম। হঠাৎ মিহিন দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে৷ কী মায়াময় সেই দৃষ্টি। অথচ এই মায়ার পেছনে মেয়েটার আসল রূপ আমার সমস্ত জ্বালিয়ে ছাই করে দিল৷ আমার সমস্ত পৃথিবীকে উলোটপালোট করে দিল। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস নিলাম৷ চুপচাপ মিহিন সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম৷ মিহিন এবং আমাকে একই জায়গাতে নামতে হয়৷ বাসার পথ একই দিকে। তবে ওর-টা একটু কাছে। এর কিছুদূরে আমার বাসা৷ কিছুদূর বলতে এত কমও না৷ মোটামুটি দূরে বলা চলে। সেটা সমস্যা নয়৷ সমস্যা হলো মিহিন। গত এক সপ্তাহ ধরে আমার পেছনেই পড়ে আছে৷ কিছুতেই পেছন ছাড়াতে পারছি না৷ মহা মুশকিলে পড়লাম। কী করা যায় এখন?
আমার স্টপেজ চলে এল৷ আমি নেমে গেলাম। পেছন পেছন মিহিনও নেমে এল৷ একটু দ্রুতই নামল যেন। হয়তো তার মাঝে এই তাড়নাটা ছিল যে আমাকে আবার হারিয়ে ফেলে নাকি! আমি ভাবলাম এক কাপ চা খাই৷ এখানেই খানিকটা সময় কাটিয়ে দিবো। ও আর অপেক্ষা করবে না৷ বিরক্ত হয়ে চলে যাবে৷ আমি সোজাসুজি দোকানে গিয়ে এক কাপ চায়ের অর্ডার করলাম। ঠিক তখনই মিহিন আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। মৃদু স্বরে বলল,
-প্লীজ! আমি একবার ওর দিকে তাকালাম।বললাম,
-বাসায় চলে যাও মিহিন৷
-আমাকে আর একটা সুযোগ দাও। কথাটা কেমন অসহ্য লাগল আমার কাছে। আমি কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। দোকানি তখনও চা বানানো শুরু করেনি। অন্য কাস্টমারের সাথে কথা বলছিল। আমি উনাকে বললাম,
-থাক মামা, চা দেওয়া লাগবে না।
এই বলে আমি ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম। ফুটফাত ধরে হাঁটতে থাকলাম। মিহিনও আমার সাথে সাথে আসতে থাকল। কিছু পথ হেঁটে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মিহিনও দাঁড়িয়ে গেল। আমি ওর দিকে তাকালাম। একদম ওর মুখ বরাবর। বললাম,
-কিছু কথা বলি। মন দিয়ে শুনবা,সঠিক জাবাব দিবা। ঠিক আছে? মিহিন কিছু বলল না। আমার দিকে কেবল চেয়ে থাকল। আমি বললাম,
-আমাকে যখন প্রপোজ করছিলা তখন তোমাকে কিছু কথা বলেছিলাম। মনে আছে তোমার? ও মাথা নিচু করে নিল। জবাব দিল না। আমি বললাম,
-জবাব দাও? কথা গুলো মনে আছে তোমার? ও মাথা দোলালো। আমি বললাম,
-কী বলেছিলাম? মনে আছে? ও চুপ করে থাকল। আমি বললাম,
-চলো, একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। সেদিন তুমি আমায় প্রপোজ করলে।
অনেকেই সেখানে ছিল। তাই অস্বীকার করতে পারবা না। তোমার প্রতি আমার আগ থেকেই দূর্বলতা ছিল। একটা সময় আমি ধরেই নিয়েছিলাম যে যদি বিয়ে করি তবে তোমাকেই করবো। সেখানে তুমি আমাকে আগেই প্রপোজ করে দিলে,ব্যাপারটা আমার জন্যে যে কতটা আনন্দদায়ক ছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। তবুও তখন নিজের সেই আনন্দের অনুভূতিকে চাপা দিয়ে, আমাদের ফিউচারের কথা ভেবে তোমায় কিছু কথা বলি। কথা গুলো হলো,আমার উপর তুমি অযথা সন্দেহ করতে পারবা না। বিশ্বাস রাখতে হবে। আমার ফ্যামিলির আর্থিক অবস্থা মোটামুটি। একটা বৃহৎ পরিবার আমার। তবুও দিনকাল আলহামদুলিল্লাহ ভালো যায়। আমার ফ্যামিলি এবং আর্থিক আবস্থান নিয়ে আমাদের মাঝে কখনই ঝামেলা হবে না।
মোস্ট ইম্পরট্যান্ট আমি কখনই আমার বাবা-মাকে বৃদ্ধা আশ্রমে দেখতে চাই না। তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র অন্যায় আমি মেনে নিবো না। এর জন্যে আমাকে যদি আমার স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে আজীবন একা একা পার করতে হয় তবে আমি সেটাকে সহজেই মেনে নিবো। শেষ কথা,কান কথা শুনে আমাকে অপমান করতে পারবে না। প্রত্যেকটা সম্পর্কে এই তৃতীয় ব্যক্তিরা খুবই ঝামেলা করে। তোমাকে আমার উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। এই কথা গুলো মানা অনেক কঠিন। গুটি কয়েক মেয়ে আমাকে প্রপোজ করেছিল এবং তাদের এই কথা গুলো বললে তারা লেজ গুটিয়ে পালায়। পালাবার মতোই কথা। আসলে যারা পালালো তাদের যোগ্য আমি ছিলামই না। এখন তুমি বলো? পারবে? এছাড়া তুমি চাইলে তোমার শর্ত বলতে পারো। তুমি আমার এই কথা গুলো মানলে আমি তোমার সকল শর্ত মানতে প্রস্তুত। তুমি সেদিন চুপ করে থাকলে অনেক সময়। তারপর বললে,
-আমি তো কোনো শর্ত সাপেক্ষে তোমার প্রেমে পড়িনি। আমি কেবল তোমাকে ভালোবেসেছি তোমার জন্যে। প্রেম কখনই কোনো শর্ত মানে না তাসফি। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। কারন তোমার প্রতি, তোমার প্রেমের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা ছিল। যেখানে আমার শর্তটা বেমানান। বললাম,
-আমি বাধ্য মিহিন। এই প্রকৃতি,এই পরিবেশ,অবস্থান,প্রেক্ষাপট আমায় বাধ্য করেছে। আমার কিছুই করার নেই। এর জন্যে আমি সকল কিছু করতে রাজি। তুমি না পারলে নিষেধ করে দাও প্লিজ। আমরা আর আগাবো না। প্লিজ, কেবল আবেগের বসে আমার এই শর্ত গুলো মেনে নিও না। তোমাকে যে মানতেই হবে এমন তো না।
এই কথার জবাবও তুমি অনেকটা সময় ভেবে দিলে। বললে,
-অর্থ সম্পদের প্রতি আমার লোভ নেই। যেখানে সততা সেখাই শান্তি। আমি তোমাকে নিজের জান করে নিয়েছি। অথচ তোমার জান কি না তোমার বাবা মা! তাহলে আমি কি আমার জানের জন্যে জানের জানকে ভালোবাসতে পারবো না? এতটা অকেজো আমি নই তাসফি। আমার উপর ভরসা রেখো। তুমি কেবল আমার একটা কথা রেখো। কখনই আমায় ছেড়ে যেও না। যাবে না। আমায় আজীবন ভালোবাসবে। তোমাকে ছাড়া আমার বেঁচে থাকাটা অনেক কষ্টকর হবে তাসফি।
তোমার এমন জবাব আমায় অভিভূত করল। আমি ইম্প্রেস হলাম। এরপরের সময় গুলো আমাদের দারুন কেটেছিল। প্রত্যেকটা সম্পর্কের মতোই আমাদের সম্পর্কটা ছিল অনবদ্য। ভার্সিটির কাপলদের মধ্যে আমাদের অবস্থান ছিল প্রথমে। সুখেই দিন যাচ্ছিল। তারপর হঠাৎ কিছু মাস আগে, হুট করেই তুমি বদলে যেতে শুরু করলে। ধীরে ধীরে আমাকে এড়িয়ে যেতে থাকলে। আমার সাথে কথা কম বলতে থাকলে। দেখা হলে বাধ্য হয়ে কথা বলতে। তোমার মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ দেখেছিলাম আমি। এক সময় কথা,দেখা হওয়া কমে আসে। আমি নির্লজ্জের মতো তোমার পেছনে পড়ে থাকতাম। রোজ রাতে তোমার বাসায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকতাম আমি। লোকে নানান কথা বলতো। তোমার এলাকার উগ্র ছেলেরাও আমাকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের এলাকায় এসে তোমার রুমের দিকে তাকিয়ে থাকা আমিকে তারা বখাট ভেবে একদিন রামধোলাই দেয়। রক্তারক্তি অবস্থা। অথচ তোমার বারান্দার দুয়ার খোলা হয়নি।
তোমার দুজোড়া চোখে আমায় দেখতে আসেনি। আদমরা হয়ে পড়ে থাকি রাস্তার পাশে। হাতেপাঁয়ে প্রচন্ড ব্যাথা। কোনো মতে উঠে ফুটপাতের উপর বসে থাকি। ছেলে গুলো আবার আসে। আমাকে এই অবস্থায় আবার মারে। অথচ তোমার জানালার থাই খোলা হয়নি। পর্দা সরিয়ে দুজোড়া চোখ আমায় দেখেনি। দেখলে কি তুমি আসতে? ভাবি, ভালো হয়েছে তুমি দেখোনি। দেখলে যদি না আসতে? যদি বিরক্তি নিয়ে জানালাটা বন্ধ করে দিতে? আমি হয়তো সেই ব্যাথা সহ্য করতে পারতাম না। হাসপাতালে কাটল কিছু দিন। তুমি দেখতে এলে। শুদ্ধ ভাষায় বললে তুমি সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটাতে এলে। একটা শেষ পরিনাম যাকে বলে। জানালে,আমি যদি সকল শর্ত উঠিয়েই নেই তারপর তুমি ভেবে দেখবে।
ভেবে দেখবে? আমার হৃদয়ে আঘাত লাগে। খুব কষ্ট পাই। কোনো মতে বলি, “তুমি এখন আসতে পারো। দোয়া করো যেন আমাদের আর দেখা না হয়।” তুমি সেদিন কী সাবলিল ভাবে হেঁটে চলে গেলে। একটু পেছন ফিরেও দেখলে না। আমি ভাবনায় পড়ে যাই, হঠাৎ তোমার এতো প্রেম বায়ুর মতো কোথায় মিশে গেল। এত স্বল্পতে তো প্রেম হারায় না। তোমারটা হারালো কী করে? হয়তো আমার শর্ত তোমার উপর ভোজা লাগল। আমি তা সাদরে মেনে নিলাম। তোমাকে আমার শর্ত মানতে হবে যে তেমন তো না।
আমি মনে মনে এটা বিশ্বাস করে নেই, আমার শর্ত আমাদের বিচ্ছেদের মূল কারণ। আমার দুঃখ কমে আসে। তোমার সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো নিয়েই আমার বাকি জীবন কাটাবো বলে প্রতিজ্ঞা করি। আমাদের কথা ভেবে আমার দিন যায়। ততদিন পর্যন্ত আমি তোমাকে মনে মনে ভালোবেসে এসেছি। মনে নেই? তোমাকে কথা দিয়েছিলাম। আজীবন ভালোবেসে যাবো। আমার জীবনটা তোমার নামে করে দিলাম। তোমাকে নিয়েই কাটাতে থাকলাম আমার মূহুর্ত গুলো। আমি তোমাকে ছেড়ে যাইনি। তোমাকে ভালোবাসা কমাইনি। আমরা ছেলেরা কথা দিলে তা ঠিকই রাখতে জানি। মেয়েদের পক্ষে সেই দেওয়া কথাটা রাখা বড় কষ্ট কর। আমরা ছেলেরা কষ্ট শুষে পাথর হই।
তোমরা হও না। হলেও তার সংখ্যা নগন্য। আমি ততদিন তোমায় গভীর থেকে ভালোবেসে গেলাম। কিন্তু যখন জানতে পারলাম, তুমি তোমার রুমমেট বড় আপুর কথায় এসে আমাকে, আমাদের সম্পর্কের বিনাশ ঘটিয়েছো, তখন বিশ্বাস করো তোমার প্রতি আমার সকল আস্থা উবে গিয়েছিলা। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে তুমি উনার কথায় আমাকে ছেড়েছো। আমার মনে হচ্ছিল আমাদের মধ্যে আসলেই কি প্রেম ছিল? সত্যিই ছিল? তাহলে কারো কথায় কীভাবে আমাকে ছাড়লে? কিছুদিন কাটল দোটানায়। তোমায় ঘৃণা করব না ভালোবেসে যাবো সেটা আমি স্থির করতে পারছিলাম না। তোমায় ভালোবাসা ছাড়া আমি থাকতে পারছিলাম না। আবার ঘৃণাও আসছিল। ওই সময়টা আমার জীবনের সবচে কষ্টকর সময় ছিল। কীভাবে পার করেছি সেটা কেবল আমি জানি, আর আমার বন্ধু সাদিক জানে।
ওই ছেলেটা না থাকলে আজ হয়তো আমি পাগলাগারদে কিংবা তিনহাত মাটির নিচে পড়ে থাকতাম। আমি সেই অন্তিম মূহুর্ত গুলো পেরিয়ে এসে,আজ যখন একটু ভালো থাকার চেষ্টা করছি ঠিক তখনই তুমি ফিরে আসতে চাইছো। কেন মিহিন? হঠাৎ কী এমন হলো? আমি আর কষ্ট পেতে চাই না প্লিজ। নিজের প্রতি বড় অন্যায় করে ফেলেছি আমি। আর না। তুমি বড় আপুর কথায় আমায় ছেড়েছো। বড় আপু ঠিক কি কারণ দেখিয়েছে আমি তা জানতে চাই না। এখন হুট করে কেন ফিরে আসতে চাচ্ছো তা জানারও ইচ্ছে নেই আমার। আমি কেবল এটা জানি, তুমি আমায় ছেড়েছো। আমাদের মাঝে আর কিছুই নেই। মিহিন, আমি হাসপাতালে তোমার ওই পিঠ দেখিয়ে চলে যাওয়াটা ভুলে যেতে পারিনি। আমার পক্ষে সম্ভব না ওই সাবলিল ভাবে চলে যাওয়া মিহিনকে ভুলে যাওয়া। তোমাকে দেখলেই আমার সেই স্মৃতি জাগ্রত হয়। আমি ভীষণ কষ্ট পাই। তুমি প্লিজ আমার সামনে এসো না। আর কখনোই না। প্লিজ।
মিহিন কান্না করে দিল। ভেজা চোখে আমায় দেখল। আমার ভীষণ মায়া হলো বটে, তবে তা প্রকাশ করার কোনো ইচ্ছে আমার মনে জাগ্রত হলো না। সেই কন্দনরত মিহিনকে ফুটফাতের উপর রেখে আমি চলে এলাম সেখান থেকে। মনে মনে প্রতিজ্ঞা নিলাম। ভালো থাকব। আমাকে ভালো থাকতে হবে। এরপর দুদিন কেটে গেল। পেছন পেছন আমার রাগ ভাঙ্গাতে মিহিন মেয়েটা এলো না আর। চারদিন কেটে গেল। মিহিন এলো না। হঠাৎ আমার মন কেমন জানি করে উঠল।
মেয়েটার শেষ কান্নাটা একদম হৃদয়ে লেগে গিয়েছিল। কী নিষ্পাপ ভাবে কান্না করছিল সে। আমি ভুলতে পারছিলাম না। পাথরের মতো চুপ করে পড়ে থাকলাম। নিজেকে বড় নির্জিব মনে হলো। যেন বিন্দু মাত্র সতেজতা নেই আমার মাঝে। আমি কেমন জানি হয়ে যাচ্ছিলাম। তবুও ভালো থাকার তীব্র তাড়না আমায় ভালো করে তুলছিল বটে, আমি মিহিনকে ভুলতে পারছিলাম না। দিন যাচ্ছিল। তবু মিহিনের দেখা নেই। ভার্সিটি এলো না সে। কাউকে জিজ্ঞেসও করতে পারছিলাম না লজ্জায়। অষ্টম দিনের দিন হঠাৎ করেই একজন ভদ্রলোক এসে উপস্থিত হলেন আমার বাসায়। আমি আর সাদিক তখন নাস্তা করছিলাম। ভদ্রলোককে দেখে মনে হলো এই কয়দিনে বড়সড় ধকল গেল উনার উপর। চোখের নিচে কালি,ঘুম কাতরে চোখ তাইই বলছে। বললাম,
-কাকে চাই? ভদ্রলোক ভারী কণ্ঠে বললেন,
-তুমি তাসফি? আমি উনাকে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। বড় পরিচিত লাগছে উনাকে। বললাম,
-জ্বী। কেন?
-ভেতরে আসতে পারি?
-অবশ্যই। আসুন প্লিজ।
ভদ্রলোক আমার বিছানায় বসলেন। ক্লান্তি আর অবসাদ উনাকে যেন ঘ্রাস করে নিচ্ছিল। আমি উনার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। সাদিক নাস্তা খাওয়া রেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। একটা সময় হঠাৎই ভদ্রলোক কান্না শুরু করে দিলেন। আমার এই এতোটুকু জীবনে একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে এতো মর্মান্তিক ভাবে কাঁদতে দেখিনি। আমি উনার পাঁয়ের কাছে বসে বললাম,
-কী ব্যাপার আঙ্কেল? আপনি কান্না করছেন কেন? ভদ্রলোক আমার দু’হাত শক্ত করে ধরে খানিকটা শব্দ করেই কান্না করতে থাকলেন। আমি বাক রুদ্ধ হয়ে পড়লাম। সাদিক উঠে এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। ভদ্রলোক অনেকটা সময় কাঁদলেন। তারপর একটা সময় মাথা তুলে আমার দিকে জলভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
-আমায় ক্ষমা করে দাও বাবা। মস্তবড় ভুল করে ফেললাম আমি। আমি বললাম,
-কী ভুল? কী হয়েছে আঙ্কেল? উনি ভেজা গলায় বলতে থাকলেন,
-আমার মেয়েটা মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছে বাবা। এই বার তো ওকে বাঁচাতে পারলাম। কিন্তু পরেরবার পারব কি না আল্লাহই ভালো জানে। ওর জ্ঞান যাওয়ার শেষ সময় ও তোমার নাম নিয়েছিল। জ্ঞান আসার পরও ও তোমার নাম বলে যাচ্ছে। কেবল আমার একটা ভুল আজ আমাকে, আমার মেয়েকে এমন অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
আমি খানিকটা ভয়ে ভয়ে বললাম,
-আমি মিহিনের কথা বলছেন না তো? উনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। বললেন,
-আমি মিহিনের বাবা। আমি ফ্লোরের উপর বসে পড়লাম। আমার গা কাঁপতে থাকল। চোখে জল জমতে থাকল দ্রুত। কোনো মতে বললাম -কী হয়েছে ওর আঙ্কেল?
-সুইসাইড করতে যাচ্ছিল। ঘুমের ঔষধ খেয়ে নেয় অনেক গুলো।
-কীহ? কখন এমনটা হলো? আমাকে আগে জানান নি কেন? ভদ্রলোক একটা চিঠি বের করে দিলেন। বললেন,
-এটা তোমাকে দিতে বলল। আমার জন্যে যে চিঠিটা রেখে গেল ওখানে লেখা ছিল যে এই চিঠি যেন আমি ওর মৃত্যুর পর তোমাকে দিয়ে আসি। আমি চিঠিটা বাড়িয়ে নিয়ে বললাম,
-আপনি আমাকে এক্ষুনি ওর কাছে নিয়ে চলুন আঙ্কেল? প্লিজ।
আমরা গাড়িতে বসে আছি। মিহিনকে দেখতে যাচ্ছি। আমার ভেতরে ঝড় বইছিল তখন। মেয়েটা পাগল নাকি? সুইসাইড করতে গেল কেন? আমার মন কেমন জানি করছিল। চিঠিটা খুলতে ভয় হচ্ছিল। তবুও কোনো মতে চিঠিটা খুললাম। গুটি গুটি করে লেখা অক্ষর গুলো পড়তে থাকলাম।
প্রিয় তাসফি,
তুমি আমার প্রিয় ছিলে। প্রিয় থাকবে। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই চিঠিটা তুমি যখন পড়বে তখন হয়তো এই মিহিন এই মহাবিশ্ব ছেড়ে চলে গিয়েছে। যার চেহারা তুমি দেখতে পর্যন্ত চাও না, সে একেবারে পৃথিবী ছেড়েই চলে গিয়েছে, শুনে তুমি নিশ্চয়ই খুশি হবে তাই না? হবারই কথা। তাসফি, ভুলটা আসলে আমার ছিল। আমি স্বল্পতেই সবাইকে বিশ্বাস করে ফেলি। সেই বিশ্বাসই আমাকে ভোগায়। তুমি তো বলে গেলে,তুমি কত কষ্টে ছিলে। কিন্তু এটা তো জানতে চাইলে না যে আমি কিসের মধ্যে ছিলাম। কতো কষ্টের মাঝে ছিলাম।
আমি আসলে তোমাকে বলতে পারছিলাম না। আসছিল না মুখ দিয়ে। বাবাকে ভীষণ ভালোবাসি যে তাই। কীভাবে সেই বাবার নামে কথা গুলো বলতাম। না পারছিলাম তোমাকে বলতে আর না পারছিলাম তোমাকে ছেড়ে থাকতে। এই দুদিকের কষ্ট আমায় উন্মাদ করে তুলছিল তাসফি। আমি পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিলাম। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শেষে তোমার কাছে ছুটে যাই। অথচ তুমি আমার দিকে তাকাও না পর্যন্ত। বড় কষ্ট হয়, যখন প্রিয় চোখ দুটোয় আমার প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা দেখি। রোজ রাত কাটে বড় বিষন্নতায়। ঘুম হয় না। কী একটা বাজে সময় যাচ্ছিল আমার। যাই হোক, এসব বলে লাভ কী! যে কথাটা বলা অতি জরুরি সেটা বলি। এখন বলা যায়। বলা উচিৎ।
আমি চাই না তুমি আমাকে নিয়ে দ্বিধায় পড়ে থাকো। ঘৃণা করো। সে জন্যেই বলা। যে আপু আমাকে তোমার কাছ থেকে দূরে সরিয়েছিল, উনাকে আমি খুব বিশ্বাস করতাম। ভালোবাসতাম। শ্রদ্ধা করতাম। অথচ তিনি তার কী বাজে পরিনাম দিলেন আমায়। উনি বলতেন, আমি আরো ভালো কাউকে পাবো। আমার জীবনটা অনেক সুন্দর হবে। তোমার সাথে গেলে সুখ পাবো কি পাবো না সেটা বলা মুশকিল। কারণ তোমার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড এতটা স্ট্রং না। প্রথম প্রথম আমি এসব গায়ে মাখিনি। বরং উনাকে এভয়েড করতে থাকলাম। কিন্তু একদিন হুট করেই তিনি একটা ছেলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। যার নাম উৎস ছিল। সুদর্শন এবং অর্থবিত্তবান। আমার পেছনে পড়ে যায় ছেলেটা। তার সাথে এক কাপ কফি খাওয়ার জন্যে খুব অনুরোধ করে। একদিন বিরক্ত হয়ে বলি,
-এটাই ফার্স্ট এন্ড লাস্ট কফি হবে। আর কখনই এমন হবে। এরপর আপনি আপনার রাস্তায়,আমি আমার রাস্তায়।
এটাই আমার ভুল ছিল। আমি তাকে প্রশ্রয় দিয়ে ফেলি। একবার, দুবার করে আমাদের বেশ কয়েকবার কফিশপে যাওয়া হয় তার বিলাশ বহুল কারে করে। ততদিনে আমি তোমাকে এভয়েড করতে থাকি। তোমার সাথে কথা বলা ছেড়ে দেই। কারণ ছেলেটা আমায় নানা ভাবে ইম্প্রেস করে নিয়েছিল। জানি, লেখা গুলো পড়তে তোমার খুব খারাপ লাগছে। ঘৃণা হচ্ছে। বিশ্বাস করো, আমি যে লিখছি, আমার নিজের প্রতিই ঘৃণা হচ্ছে। ছিহ! কী করতে যাচ্ছিলাম আমি। আমি মিথ্যা বলছি না।
একজন মৃত্যুমুখি যাত্রি কখনই মিথ্যা বলে না। সেদিন হাসপাতালে তোমাকে পিঠ দেখিয়ে চলে আশার পর, বেশ কিছু দিন তোমার কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। আমি হঠাৎই কিছু একটা অনুভব করি। মনের ভেতরের কিছু একটা যেন বারবার তোমার কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি ভার্সিটিতে ক্লাস করতে পারছিলাম না। ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরলাম। তুমি নেই। ক্যান্টিনেও পেলাম না। আমার কেমন জানি লাগতে থাকে। হঠাৎ একটা পাগল করা অনুভূতি হয়। ঠিক তখনই উৎস ফোন দেয়। আমাদের আজ ঘুরতে যাওয়ার কথা। শহরের বাইরের দিকে। আমি ওর জন্যে ভার্সিটির গেইটের দিকে যাই। ও গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি যখন গাড়ির দরজা খুলতে যাই, আমার হাত তখন কেঁপে উঠে। বুকের ভেতর কাঁপতে শুরু করে। আমি দরজা না খুলে দাঁড়িয়ে থাকি।
ভেতর থেকে উৎসের গলার আওয়াজ পাওয়া যায়। ওর গলার স্বরে গায়ে কাটা দিয়ে উঠে আমার। বুমি বুমি ভাব লাগে। অসহ্য লাগতে থাকে। আমি সেখান থেকে দৌড়ে চলে যাই। কতক্ষন দৌড়াচ্ছিলাম মনে ছিল না। একটা সময় রিক্সা নিয়ে বাসায় আসি। রুমের দরজা বন্ধ করে বিছানার উপর উপড়ে পড়ি। পুরোটা সময় কান্না করি আমি। আমার গা জ্বলতে থাকে যেন। নিজের প্রতি কেমন জানি ঘৃণা তৈরী হচ্ছিল। এভাবে কিছুদিন কেটে যায়। কাঁদতে কাঁদতে একটা সময় আমি দূর্বল হয়ে পড়ি। আমার জ্বর এসে যায়। ওই বড় আপু কেয়ার করে অনেক। বাবা একবার দেখে গিয়েছিলেন। এরপর একদিন মাঝ রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আমার। আমি কোনো রকমে উঠে বসি। বারান্দা থেকে বড় আপু তথা রুনা আপুর গলার স্বর পাই। গভীর রাত বলে উনার আস্তে আস্তে বলা কথা গুলো আমি স্পষ্ট শুনতে পাই। উনি কারো সাথে কথা বলছিলেন। বলছিলেন,
-আমরা কাজটা মোটেও ঠিক করিনি। মিহিনের প্রতি বড় অন্যায় হয়ে গেল।ওপাশের মানুষটার কথা শোনা যাচ্ছিল না। আপু আবার বললেন,
-আমার নিজেকে খুব দোষী মনে হচ্ছে উৎস। কেবল আঙ্কেল বলাতেই আমি এসব করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি মন থেকে এসব চাচ্ছিলাম না। তাসফির সাথে মিহিনের খুব মানাবে। খুব ভালো একটা কাপল হতো। কিন্তু ওর বাবা কেন যে নারাজ হলেন। আমার খুব খারাপ লাগছে ওদের জন্যে। নিজেকে পিশাচীনি মনে হচ্ছে। একজন খুনি মনে হচ্ছে।
আপু কান্না করে দিল। আর আমি পাথরের মতো বিছানায় বসে থাকলাম। এর পেছনে যে আমার বাবার হাত ছিল সেই কথাটা যেন আমাকে পাথর করে দিল। তাসফি, আমার আম্মু মারা গিয়েছেন অনেক আগেই। আমার একটা ভাই জন্ম হওয়ার ছিল। কিন্তু কিছু জটিলতার কারণে ডাক্তাররা ভাই এবং মা কাউকেই বাঁচাতে পারেননি। আমি ছোট বেলা থেকেই মা হারা। এই বাবাই আমাকে কোলেপিঠে মানুষ করেছি। ছোট বেলা থেকেই বাবাকে মাই হিরো বলেআসতাম। আজ যখন আমার হিরো আমার সামনে, আমার প্রেমে ভিলেন হয়ে এল সেটা যেন মেনেই নিতে পারছিলাম না আমি। খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। তারউপর তোমাকে দেখিনা। বুকের ভেতরটা খুব ফাঁকা লাগছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। এদিকে নিজের প্রতি ঘৃণাও হচ্ছিল। গভীর অনুশোচনায় ভুগছিলাম। এসব বয়ে বেড়ানো সম্ভব হয়নি। তাই তো ছুটি নিতেই হচ্ছে আজ। গাড়ি থেমে গেল। সাদিক আমায় ধাক্কা দিতেই আমার ধ্যান ফিরে এল। আমি চোখ মুছে নিলাম। চিঠিটা পড়লাম না আর। খুব যত্নে বুক পকেটে রাখলাম। তারপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত হাটা দিলাম। মিহিনের বাবা আমাদের নিয়ে যাচ্ছিলেন। একটা সময় আমরা একটা রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াই। আঙ্কেল বললেন,
-যাও তুমি বাবা। আমি যেতে পারব না ভিতরে। মেয়ের চোখের দিকে তাকাতে পারি না আমি। আমি দাঁড়িয়েই থাকলাম। আমার এক পাঁ আগানোর শক্তিটুকু নেই যেন। সাদিক আমার কাঁধে হাত রাখল। বলল,
-যা।
আমি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। ঠিক তখনই আমার চোখে গেল সাদা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় গাল ফুলিয়ে বসে থাকা একটা পরীর উপর। শুকিয়ে কী একটা অবস্থা তার। চোখের নিচে কেউ যেন কালি লেপে দিয়েছে। আমি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। ওর বেডের পাশে একটা চেয়ারে অন্য আরেকটা মেয়ে ছিল। ইনি সম্ভবত রুনা আপু। হ্যাঁ ইনিই। উনি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। আমি দরজা সামনে থেকে সরে দাঁড়ালাম। উনি মাথা নিচু করে রুম ছেড়ে চলে গেলেন। মিহিন গাল ফুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে তো তাকিয়েই আছে। চোখ নামানোর নাম নেই। আমি ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম। চেয়ারটাতে কোনো রকমে বসলাম। কী বলব ভেবে পেলাম না। কথা বের হচ্ছিল না মুখ দিয়ে। ও যেভাবে আমাকে দেখছে,এভাবে দেখতে থাকলে আমি কখনই কোনো কথা বলতে পারবো না। আমি ফুঁপিয়ে উঠল। তারপর ঠোঁট উলটে কান্না করা শুরু করে দিল। অল্প কিছু সময়ের মধ্যে ওর নাকের ডগাটা লাল হয়ে গেল একদম। আমি তবুও কিছু বললাম না। চুপ করে থাকলাম। ও কান্না করতেই থাকল। তারপর হুট করেই ভেজা গলায় বল্র উঠল,
-তুমি চিন্তা করো না। আমি আবার সুইসাইড করব। তখন কোনো খুঁত রাখব না। একেবারে স্পট ডেথ হবে। তখন আর তোমাকে আমায় দেখতে হবে না। আমাকে আমি চেয়ার ছেড়ে তেড়ে গেলাম ওকে মারতে। মারার জন্যে হাত উঠালাম। কিন্তু মারলাম না। ও এবার একটু শব্দ করে ফুঁপিয়ে উঠল। আমি ওর পাশে বসে বললাম,
-খবরদার আর যদি এমন কিছু বলছো। মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলব। বেয়াদব মেয়ে। একবার ভেবে দেখেছো তোমার কিছু হলে আমার কী হবে। ভেবে দেখেছো?
-তো কী করতাম আমি হু? পাগল হয়ে যেতাম?
-তাইই হতে। পাগল হলেও অন্তত বেঁচে থাকতে। মিহিন পাগলীকে নিয়েই আমি সংসার করতাম। অন্তত পাগলিটা তো থাকত।
কথাটা একদম ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম। ও কেবল আমার দিকেই তাকিয়ে থাকল। তারপর হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত করে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকল। তার সে কি কান্না। ফুপানোর তো শেষ নেই। আমার শার্ট ভিজিয়ে দিল একদম। আমরা অনেকক্ষন একে অপরে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। বলা বাহুল্য আমিও কম কান্না করিনি। আসলে কান্না না করে থাকতে পারছিলাম না। একটা সময় আমি মিহিনকে ছাড়িয়ে নেই। তার চোখের জল মুছে দেই। ও নিজের আমার চোখের জল মুছে দেয়। তারপর আমার কপালে চুমু খায়। বলে,
-বুকের উপর থেকে যেন একটা বোঝা সরে গেল। বিশ্বাস করো নিজেকে বিশ্বের সেরা সুখি মনে হচ্ছে এখন।
আমি বললাম,
-আমার তো দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ও আমার গালের কাছে হাত রেখে মায়া ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
-তোমাকে ছাড়া থাকাটা আমার পক্ষে অসম্ভব তাসফি। আমি এতদিনে সেটা টের পেয়ে গিয়েছি।
আমি কিছু বললাম না। কেবল ওর চোখের দিকে চেয়ে থাকলাম। ও যেন আমার চোখের ভাষা বুঝতে পারল। মৃদু হাসল। তারপর খানিক এগিয়ে আমার ঠোঁটে চুমু খেল ও। আমি ওকে কোলের কাছে এনে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,
-এই কিসটা বড় মিস করেছি আমি। ও হাসল খানিক। বলল,
-আমিও।
তারপর তার হাসি আরেকটু স্থায়ি হলো। লজ্জায় লাল হলো সে। অনেকদিন পর তার মুখে হাসি দেখা গেল। এ যেন পুরো দিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকার পর শেষ বিকেলে হুট করে দেখা রক্তিম সূর্যটা। যেটা আমার হৃদয়ের ভেতর সুখের ঝড় তোলে। যা কেবল মিহিনের দ্বারাই সম্ভব। সেই প্রথম থেকেই মিহিন নামক ঝড়টা বয়ে বেড়াচ্ছে আমার হৃদয়ে।
কিছু কথাঃ আত্মহত্যা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। আমি গল্পের খাতিরে মিহিনকে বাঁচিয়ে দিয়েছি। কিন্তু আত্মহত্যা করলে যে বেঁচে যাবেন তার নিশ্চয়তা কী! এটা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনি যা নিয়ে হতাশ, তা নিয়ে খোলাখুলি ভাবে কারো সাথে কথা বলুন। তাকে সমস্যাটা জানান। তারপরই তো আপনার সমস্যার সমাধান হবে। এভাবে সুইসাইড করে সমস্যা সমাধান করার চেষ্টাটা অযথা সময়ের অপচয় ছাড়া কিছুই না।