মধ্যরাতে বাড়িতে চোর এসে নিয়ে গেছে এক গৃহিণীর কানের গয়না। বাড়ির বাকি সবাই তখন ঘুমে। এখন গয়না হারিয়ে বাড়ির বউয়ের মনে ত্রাহি ত্রাহি দশা, কিন্তু শত খুঁজে কি আর সে গয়না ফেরত পাওয়া যাবে? আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এই বাংলা মুলুকের প্রেক্ষিতে প্রথম চোরের উল্লেখ এভাবেই মিলেছে বাংলা সাহিত্যের আদিতম নিদর্শন চর্যাপদের একটি পদে। কুক্কুরীপাদ লিখিত ওই পদের মধ্যস্থ কয়েকটি পঙ্ক্তি এমন:
‘আঙ্গন ঘর পন সুন ভো বিআতী।
কানেট চৌরি নিল অধারাতী॥
সসুরা নিদ গেল বহু জগঅ।
কানেট চোরে নিল কা গই মাগঅ॥’
আজকের চলিত বাংলায় এর আক্ষরিক অর্থ হলো, আঙিনাসংলগ্ন ঘর থেকে মধ্যরাতে কানের অলংকার চোরে নিয়ে নিল, শ্বশুর নিদ্রা গেলেও বউ জেগে, চোরের চুরি করা কানের গয়না সে কার কাছে খুঁজবে। এক্ষণে আলোচনার সীমানা খানিকটা বর্ধিত করে সংস্কৃত সাহিত্যে চোরের উপস্থিতিসংক্রান্ত যৎকিঞ্চিৎ তথ্যাদিও উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রাচীন চৌষট্টি কলার মধ্যকার একটি কলা যে চুরিবিদ্যা, এ কথা খুব অবিদিত নয়। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মধ্যে রচিত শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকে শর্ব্বিলক নামের এক চরিত্রের সন্ধান মেলে, যে কিনা জাতে বামুন হলেও চুরিবিদ্যায় নিজের পারদর্শিতা নিয়ে গর্ব করতে এবং রাজরক্ষীরা যে তার চতুরতার কাছে কতটা অসহায়, তা বলতেও কসুর করে না: ‘আমি এই চৌর্য্যবৃত্তি সাধুবিগর্হিত বলিয়া নিন্দাও করিতেছি এবং তাহাতেই আবার প্রবৃত্তও হইয়াছি।…আমি শর্ব্বিলক, আমার কাছে আবার রক্ষীপুরুষ! আমি বিড়ালের ন্যায় নিঃশব্দে গমন করিতে পারি। মৃগের ন্যায় দ্রুতবেগে দৌড়াইতে পারি। শ্যেন পক্ষীর ন্যায় সহসা গ্রাহ্যবস্তু ধরিতে ও খণ্ড খণ্ড করিতে পারি। কুক্কুরের ন্যায় নিদ্রিত ও জাগরিত ব্যক্তির বল পরীক্ষা করিতে পারি। সর্পের ন্যায় বক্ষঃস্থলেও গমন করিতে পারি। এবং আমি নানাবিধ রূপ ধারণে ও বিবিধ বেশবিন্যাসে ঐন্দ্রজালিকের সদৃশ, সর্ব্বদেশীয় ভাষার উচ্চারণে দক্ষ এবং স্থলপথে ঘোটকের ও জলপথে নৌকার তুল্য।’ (সংস্কৃত থেকে অনুবাদ: রামময় শর্ম্ম তর্করত্ন) এর কিছু পরে সপ্তম শতকে রচিত দণ্ডীর গদ্যকাব্য দশকুমারচরিত-এও চৌর্যবৃত্তির নানা ‘গুণাগুণের’ পরিচয় পাওয়া যায়।
এটা অবাক করা ঘটনা যে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের মতো সেকালের বাংলা সাহিত্যের নানা পালাগানেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে এমন চোরবন্দনা। সেখানে চোর শুধুই দাগি আসামি বা অপরাধী নয়, বরং নানা ‘প্রতিভা’র অধিকারী এক ধুরন্ধরও। আবার একই সঙ্গে চৌর্যবৃত্তির পথে যে কেউ শখে আসে না, বরং আসে অসহায়ত্বের বশে—সমকালীন সমাজের এ রকম সব রূঢ় বাস্তবতাও পালাগানে উঠে এসেছে। ধরা পড়লেও তাই দরিদ্র চোরেরা নিজেদের পেশা সম্পর্কে সরল স্বীকারোক্তি দিতে পিছপা হয় না। যেমন চট্টগ্রাম-নোয়াখালী অঞ্চলে প্রচলিত গীতিকা ‘কাফন-চোরা’র নায়ক মনসুর চুরি করতে গিয়ে ভোরবেলা গৃহস্বামীর কাছে ধরা পড়ে গিয়ে সোজাসুজি বলে দেয়:
‘আমার কাফন চোরা নাম।
দুনিয়াতে করি আমি
দাগবাজি কাম ॥
নাহি অন্য পেশা আমার
চুরি করি খাই।
তোমার ঘরে সিং দিয়াছি
মালমাত্তার লাই…’।
আর বাংলা লোকসাহিত্যের ভান্ডার তো চোরের বুদ্ধিমত্তা ও চাতুর্যের নানা গল্পে পরিপূর্ণ। কীভাবে অসহায় গরিবজন নেহাত পেটের দায়ে চুরিবৃত্তির পথে পা বাড়ায়, তার বিবরণও লোকায়ত সমাজের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। ১৮১২ সালে প্রকাশ পাওয়া উইলিয়াম কেরির ইতিহাসমালার ৩৮তম গল্পটিতে রয়েছে এক চমকপ্রদ কাহিনি: চোর কীভাবে নিজের বুদ্ধির বলে রাজার শাস্তি থেকে রক্ষা পাওয়ার পর উল্টো রাজাকে মুগ্ধ করে সোজা তারই রাজসভায় তৎক্ষণাৎ মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেল। আবার ১৮৯৫-৯৬ সালে অজ্ঞাতনামা এক লেখকের রচিত চোর-চক্রবর্তী শিরোনামের পুঁথিতে মেলে ভিনদেশি চোরের প্রতিভায় সন্তুষ্ট হওয়া রাজার নিজের কন্যাকে ওই চোরেরই সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার আখ্যান। এ আখ্যানের শেষে চোর রাজকন্যাকে বিয়ে করার পর স্বদেশে ফিরে চুরিতে জড়িত স্বদেশি ভাইদের উদ্দেশে রাখে কিছু মজার উপদেশও:
‘আপনার সুখে তোমরা
যথা তথা যাও।
ব্রাহ্মণ সজ্জন এড়ি চুরি করি খাও॥
ব্রাহ্মণ সজ্জন দাতা
বৈষ্ণব তিন জন।
ইহার ঘরে চুরি না করিহ কখন॥’
নিছক সাহিত্যিক উদাহরণ যদি ছেড়েও দিই, তাহলে সেকালের সংবাদপত্রেও বাংলার চোরদের বহু চাতুর্যের ও কলাকৌশলের পরিচয় পাওয়া যাবে। ১৯ ডিসেম্বর ১৮১৮–এর সমাচার দর্পণ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় জনৈক চোরের কথা, যিনি কিনা দিনমজুরের বেশে মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে রাস্তায় চলতে চলতে পথিমধ্যে কোনো ফাঁকা পালকি বেহারাবিহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে, এমন দেখলে তখনই সেখানে হানা দিয়ে পালকিতে থাকা মূল্যবান সামগ্রী ঝুড়িতে পুরে তৎক্ষণাৎ পগারপার হতেন। মজুরের বেশে থাকায় কেউ সন্দেহও করত না তাঁকে। পরে অবশ্য তিনি ধরা পড়েছিলেন। ১৩০২ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত চোরের বুদ্ধি নামে একটি আখ্যানে পেশাদার দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন আরেক চালাক চোরের কথা, চিনির বস্তা নিয়ে পালাতে গিয়ে যে ধরা পড়ে ঠিকই, তবে এর আগেই বস্তাটা নদীতে ফেলে দিতে সক্ষম হয়। পরে তাকে এহেন কাণ্ডের কারণ জিজ্ঞেস করলে সে জানায়, ‘মহাশয়, আমি পুরাতন চোর; চোরা-দ্রব্যের সহিত ধৃত হইয়াছি। সেই দ্রব্যের ফরিয়াদি যদি আপনারা প্রাপ্ত হন, তাহা হইলে বহুদিনের নিমিত্ত আমাকে নিশ্চয়ই জেলে গমন করিতে হইবে।…মাল ও ফরিয়াদি না পাইলে আপনারা কী করিতে পারেন?’ চোরের এমন বুদ্ধি কাজে লেগেছিল, দারোগা তাকে প্রমাণের অপ্রাপ্যতার কারণে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। বাংলার চোরের কৌশলি খপ্পর থেকে রেহাই পাননি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও। ১৯১৮ সালে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে তাঁর খুব প্রিয় একটি ফাউন্টেন পেন চুরি হয়ে যায়। যদিও পরবর্তীকালে পুলিশ এক চোরকে গ্রেপ্তারের পর তা সেই চোরের বাড়ি থেকে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছিল কবিকে।
ইতিহাসের সাক্ষ্য অবশ্য বিপরীত একটা চিত্রও তুলে আনে, অভাবের কারণে কেউ চোর হয়েছেন বলে চুরি করাটাকে অতীতের সাহিত্যিক সম্প্রদায়ের মতো করুণার দৃষ্টিতে দেখতে বাংলার শাসকগোষ্ঠী খুব একটা রাজি ছিলেন না। নবাব মুর্শিদকুলি খানের আমলে বাংলার কাটোয়া এলাকায় একটি থানা স্থাপন করে চোর নির্মূল করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ খাসনামা মোহম্মদ জান। গোলাম হোসেন সলিম তাঁর ইতিহাসগ্রন্থ রিয়াজ-উস-সালাতিন-এ জানাচ্ছেন, মোহম্মদ জান থানাদারের দায়িত্ব পাওয়ার পর কোনো চোর ধরা পড়লে তাঁকে হত্যা করার পর লাশ টুকরো টুকরো করে থানার পাশের এক গাছে ঝুলিয়ে রেখে দিতেন। এ কারণে এলাকায় চুরি কমে গিয়েছিল বলে কেউ কেউ দাবি করলেও ঘটনার বীভৎসতা এড়িয়ে যাওয়াটা মুশকিল।
আঠারো শতকের গোড়ায় মোগল সরকারের বাদশাহি ফরমান নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যেসব সাহেব কলকাতা-সুটানুটি-গোবিন্দপুর এলাকায় জমিদারি বসিয়েছিলেন, চোরদের প্রতি তাঁদের আচরণও কম নৃশংস ছিল না। ১৭০৬ সালের একটি বিবরণীর ভাষ্য এমন, কয়েকজন চোর ধরা পড়ার পর তাঁদের গালে গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে নদীর ওপারে ফেলে আসার আদেশ দিয়েছিলেন কোম্পানির ম্যাজিস্ট্রেট। ১৭৮৫ সালে শ্রীরামপুর এলাকার এক চোর গোবিন্দরাম চক্রবর্তী কলকাতার একজন পরিচিত ধনী রামকান্ত মুন্সীর বাড়িতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। পরে তাঁকে জেলখানায় নেওয়া হলে সেখানেই তিনি পুলিশি অত্যাচারের ভয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। ১৮৫৩ থেকে ১৮৬০ সাল অব্দি কৃষ্ণনগর-নবদ্বীপ অঞ্চলের দারোগা ছিলেন গিরিশচন্দ্র বসু, ১৮৮৫ সালে প্রকাশিত নিজের পুলিশি-জীবনের স্মৃতিকথা সেকালের দারোগার কাহিনীতে তিনি মুন্সী শেখ নামের এক চোরের চাঞ্চল্যকর ভাষ্য মারফত কীভাবে পুলিশ বীভৎস ‘থার্ড ডিগ্রি’ প্রয়োগ করে চোরদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করত, তা পাঠকদের জানিয়েছেন: ‘আমি অনেক জেলায় বড় বড় গুরুতর মোকদ্দমায় ধৃত হইয়া অনেক দারোগার হস্তে মার খাইয়াছি…যশোর জেলার এক ব্যাটা পাপিষ্ঠ দারোগা তামাকের গুল পোড়াইয়া আমার জানুতে চাপিয়া ধরিয়াছিল। আমার জানুর মাংস চড় চড় করিয়া পুড়িয়া দুর্গন্ধ বাহির হইল, আমি চীৎকার করিয়া ক্রন্দন করিয়াছিলাম…।’
চুরি মোটেও সমর্থনযোগ্য কাজ নয়, সেকালেও ছিল না। ফলে শাসক সম্প্রদায়ের মতোই ঔপনিবেশিক আমলের বাংলার শিক্ষিত ‘আলোকিত’ সমাজও চোরদের করুণার দৃষ্টিতে দূরে থাক, কেন তারা চুরি করতে নামে, তার কারণ খতিয়ে দেখতেও প্রায় রাজি ছিল না। আরও অদ্ভুত কাণ্ড এই, তথাকথিত ‘ভদ্র’ লেখকেরা অনেক সময় দস্যু বা ডাকাতগোষ্ঠীর ভেতরে ‘মহত্ত্বশালী’, ‘নির্ভীকচিত্ত’ বা ‘পুনরুত্থানক্ষম’ ব্যক্তিদের দেখতে পেলেও চোরদের অভিহিত করেছেন ‘অতি নীচশয়, ক্ষুদ্র প্রকৃতির এবং অধমজাতি’ বলে! ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত ‘চোর চরিত: চোর ও দস্যুর পার্থক্য’ শিরোনামে এক প্রবন্ধে বান্ধব পত্রিকার সম্পাদক কালীপ্রসন্ন ঘোষ যেমন লিখেছিলেন, চোরেরা ‘লজ্জায় জড়সড় হইয়া অধোবদনে থাকে; চুরি করিয়াছি এমন কথা প্রাণান্তেও মুখে আনিতে সাহস পায় না।’ তাঁর ভাষায়, ডাকাতেরা ঠিক এর উল্টো, ‘ডাকাতের চরিত্রে একটু পুরুষকার, একটু মহত্ত্ব আছে; চোরের তাহা নাই। সুতরাং সমস্ত মনুষ্যজাতি যেন একমনে চোর অপেক্ষা ডাকাতকে অধিক সম্মান করে।’ সম্ভবত পশ্চিম থেকে আসা রবিনহুড ঘরানার নীতিবাগীশ ও বলশালী ডাকাতের গল্পের স্বাদ পাওয়া ইংরেজিপড়ুয়া বাঙালি সমাজ একই ঘরানায় ডাকাতি-প্রথার ‘হিরোইজমে’ মশগুল হচ্ছিল তখন। আর ভুলতে শুরু করেছিল সাবেকি হয়ে যাওয়া লোকসাহিত্যে উপস্থিত চোরের বুদ্ধিমত্তার গল্প ও দারিদ্র্যের কারণে চুরিবৃত্তিতে নামার অসহায় আখ্যান।
উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ যেভাবে চোরেরা কেন চুরিতে নামে, তা না ভেবে তাদের নিছক ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখত আর ‘বলশালী’ ডাকাতদের বন্দনা করত, ‘সেই ট্র্যাডিশন’ এখনো চলমান, আমাদের চারপাশে তাকালে এমন ভ্রম হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
প্রায়শই পত্রিকায় খবর বেরোয়, ধরা পড়া কোনো চোরকে পিটিয়েই মেরে ফেলেছে অকুস্থলে সমবেত ‘উৎসাহী জনতা’। কিন্তু নাগরিকদের জীবনযাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন যে বড় বড় ডাকাতেরা, পুঁজিবাজার থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ অব্দি যাঁদের কালোহাত বিস্তৃত, তাঁদের নাগাল কি কেউ পায়, তাঁরা কি ধরা পড়েন? এ–ও কি সেই উনিশ শতকীয় বাংলা শিক্ষিত শ্রেণির ‘চোরভীতি’ ও ‘ডাকাতপ্রীতি’র পরম্পরা?
সূত্র: প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের চোর চতুর্দশী; গিরিশচন্দ্র বসুর সেকালের দারোগার কাহিনী; হরিসাধন মুখোপাধ্যায়ের কলিকাতা—সেকালের ও একালের এবং মুহম্মদ আবদুল জলিলের মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বাংলা ও বাঙালি সমাজ।