দেখে মনে হতেই পারে, বাড়ি যথাযথ। আছে একটি ছোট ঘর, মাথায় খড়ের ছাউনি, এমনকি একটি দাওয়া ও সংলগ্ন কিছুটা ফাঁকা জায়গাও প্রস্তুত, যার সৌজন্যে একটি গৃহস্থ বাড়ির আকারই ধারণ করেছে বলা যায়। কিন্তু হাঁকলা অন্ধকারের আবছা পর্দা ভেদ করে কোনওরকমে বহিরঙ্গ দেখে বুকের ভেতর থেকে স্বস্তির নিঃশ্বাস বার হবার অবকাশ মেলবার আগেই যদি একবার ঘরটার মধ্যে একটু গলা বাড়িয়ে উঁকি মারা যায়, তাহলে সে নিঃশ্বাস চুপসে গিয়ে হতাশার ‘হঃ’ ধ্বনি বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা প্রবল, এমনকি সুশোভন অধিকারীর মত ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ হাবভাবওয়ালা কর্মীর থেকেও এমন প্রতিক্রিয়া খুব অপ্রত্যাশিত হবে না। ছোট্ট ঘরটার ভেতর কয়েক মুঠো খড় ছাড়া আর কিছুই নেই, না শোওয়ার, না মাথায় দেওয়ার। ন্যাংটো উঠোনে একটা ভাঙা লাঙল, ব্যাস। উঠোন সারাদিন ক্ষেতভূমি মুখে করে বসে আছে, এই মাঘের শেষে যার শরীর একেবারেই লেপাপোঁছা। শুধু দুদিকের দুটো ন্যাড়া গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটা বিশাল বড় ফ্লেক্স ঝুলছে, এমনকি ক্ষেতের ওপারের আলে দাঁড়ানো অথবা পাশের গ্রাম থেকে মেঠোপথ ধরে আসা বহুদূর আগন্তুকেরও চোখে পড়বে। অবশ্যই খেতমজুর সম্মেলনের লেখাগুলো চোখে পড়া সম্ভব নয়, কিন্তু সূর্যের আলোতে ঠিকরে গিয়ে মানুষের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে বাধ্য ঝকঝকে লাল রঙ, যা সম্ভবত ফ্লেক্সটির এখানে টাঙানোর উদ্দেশ্যও বটে, তার পরিচিত কাস্তেহাতুড়ির চিহ্নটি নিয়েই আপাতত অন্ধকারেও উজ্জ্বল। কিন্তু ফ্লেক্স দেখার ভালোলাগাটুকুকে দমিয়ে সুশোভনের এই হতাশার কারণ, যতই সে কষ্ট করতে অভ্যস্ত হোক অথবা মাঠে ঘাটে রাত কাটানোয়, সামনে ভূতের মত দাঁড়িয়ে থাকা বাড়িটি যতটা, যাকে একটিমাত্র ঘরের কঙ্কালই বলা চলে, তার থেকেও সম্ভবত বেশি তার পিছনে প্রহরারত কমরেড চন্দ্রধর রাজবংশীর মাতাল, ফলত টলটলায়মান অবয়বটির প্রভাব।
সামনে পিছনে এরকম যুগপৎ আক্রমণে কিছুটা বিমর্ষ হয়েই সুশোভন ঘাড় অর্ধেকটা ঘোরায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই চমকে উঠে লাফিয়ে সরে আসে, কারণ তার মনে হচ্ছিল চন্দ্রধর এবার বমি করবে। পেটে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ছিল চন্দ্রধর, এবং তার সারা শরীরে কাঁপুনি দিচ্ছিল যা সামনে উপস্থিত সুস্থ মানুষকে কিছুটা ইন্সটিংক্ট বশতই পিছিয়ে যেতে বাধ্য করবে। কিন্তু পরক্ষণেই সুশোভন বুঝতে পারে যে এ হল চন্দ্রধরের সেই প্রতিরাতের জ্বর আসার সময়, যার কথা বাড়ির পথে সুশোভনকে নিয়ে হেঁটে আসতে আসতে সে বহুবার জানিয়েছে।
“আত-আত জাড় লাগে, ত, লুকাম কুনঠেরে? ত অ্যালায় আবার ডাগদর না আসে কামরিড! পাইসা নাই, ডাগদারও নাই। তয় মুই চন্দ্রধর, কোটত যাম? রয় এই হাড়িয়া, না খাই ত ব্যথায় মরিম। নয় ত জাড়ে মরিম। খাই ত জাড় না লাগি। অ্যালায় চাষের সিজন না হইল, ত প্যাটত ভোখ বাদ কুছু নাই। ভোখ থিকা জাড়, তয় জাড় থিকা ভোখ। হাড়িয়া জাড় মারে, ভোখ মারে। বোধ না হয়, সব্ব অঙ্গ অসাড় নাগে কামরিড।”
এহেন অবিশ্রান্ত বকবকানির মধ্যে দিয়ে মাতালের পেছন পেছন আলপথ বেয়ে সাবধানে হাঁটতে হাঁটতে গভীর রাত্রে সুশোভন অধিকারী যখন চন্দ্রধরের বাড়িটিতে রাত্রিযাপনের জন্য আসল, ক্লান্তিতে তার গা ছেড়ে দিচ্ছে। পেটের খাবার হজম হয়ে গিয়েছে বহুক্ষণ আগেই। আজকের শেষ মিটিং হওয়ার আগেই সকল ডেলিগেটকে রাতের খাবার দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার পরেও সম্মেলন, তর্কাতর্কি এবং পরের দিনের জন্য প্রস্তুতি, মূলত কমিটি গঠন নিয়ে পার্টি নেতৃত্বের চুলচেরা বিশ্লেষণ যা ঐতিহাসিকভাবে কখনোই মতানৈক্য নামক অনন্ত সমুদ্রপথটির ঝঞ্ঝাবহুল যাত্রা পেরিয়ে আর নিশ্চয়তার তীরে পৌঁছতে পারে না, সামলে উঠে ডেলিগেটরা যখন রাত্রিবাসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, কীভাবে যেন সুশোভনের কপালেই চন্দ্রধর জুটে গেল। ষাটের কাছাকাছি বয়েস। থ্যাবড়া মুখে হো চি মিনের মত দাড়ি, কুতকুতে চোখ, পাতলা কাগজের মত চামড়া, শিরা ওঠা কপাল আর হাড্ডিসার শরীরটি দখল করে চন্দ্রধর বসে ছিল কনফারেন্স রুমের একদম পেছনে। পরনে তাপ্পি মারা হাফপ্যান্ট, আর এই ঠান্ডাতেও ঝলঝলে একটা টি-শার্ট মাত্র। অথচ খগেনদা কত প্রশংসা করেছিলেন ! “ট্রাস্টেড কমরেড আমাদের। হুমকির মুখেও এখনও ফ্ল্যাগ লাগায়। ওর গ্রামের একমাত্র ফ্লেক্সটা নিজের ঘরের সামনে টাঙ্গিয়েছে। থ্রেটও খেয়েছে তার জন্যে। পঞ্চায়েত ফরমান দিয়েছে, তাই কাজ পায় না। কেউ পাওয়ার টিলারও ভাড়া দেয় না। ও সেই আদ্যিকালের ভাঙা লাঙল নিয়েই কাজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। কে আর ওই লাঙল ব্যবহার করে আজকের দিনে ! না খেয়ে আছে, কিন্তু কিছুতেই দল বদল করবে না। যাও সুশোভন। এদের কাছ থেকে শেখো।”
কনফারেন্সের পরেই ভরপেট হাড়িয়া খেয়ে মাতাল হয়ে যাওয়াটা পার্টির ঠিক কত নম্বর সাংবিধানিক ধারার লঙ্ঘন, সেসবের চুলচেরা বিশ্লেষণ নিজের মনে করতে করতে সুশোভন নির্জন গ্রামপথ পেরচ্ছিল। মনে মনে খগেন বর্মণের কিছুটা মুণ্ডপাতও করছিল হয়ত। যে সুশোভন অধিকারী একদা কলকাতা ফেরত ঝকঝকে ছাত্রনেতা হিসেবে নিজের জেলায় সাদরে গৃহীত হয়েছিল, এমনকি চল্লিশ পেরোবার আগেই ইতিউতি ফিসফাস শোনা যাচ্ছে যে তাকে জেলা কমিটিতেও নেওয়া হতে পারে, এবং সেই কানাকানিটুকুর সুবাদেই সুশোভন আজকাল বুঝতে পারে যে তার আকাচা খয়েরি পাঞ্জাবিটুকুর মধ্যে দিয়ে নির্গত এক প্রকার গুরুত্বসূচক গম্ভীর গন্ধ তাকে নিজের মফস্বলের চায়ের আড্ডা, পূর্বতন এলসি অফিস অথবা কৃষক ভবনের কার্যগৃহে এক প্রকার সম্ভ্রমের দূরত্বে নিরাপদ রেখেও মানুষের প্রতি আন্তরিক উষ্ণতাটুকুকে হারিয়ে যেতে দেয়নি, সেই একনিষ্ঠ প্রতিশ্রুতিবান পার্টিকর্মীর জন্য কি এক মদ্যপ কমরেডের ভাঙা গৃহ বাদে আর কিছুই মিলল না? খগেনদা অথবা অর্জুন বাহেকের মত সিনিয়র লিডারদের কথা ছেড়েই দেওয়া যাক, এমনকি রামচন্দ মাহাতো যিনি সারাজীবন জেলা নেতৃত্বকে পাখির চোখ করে গিয়েও শেষমেশ নির্ভরযোগ্য ভাইস ক্যাপ্টেনের পরিচিতিতেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হলেন এবং সেই সুবাদে মুল বলয়ের মধ্যে হয়ত পা পিছলেই হড়কে কিছুটা ঢুকেও পড়লেন যেন, তাঁর কথাও না হয় ধরবার দরকার নেই, কিন্তু ইন্দ্রনাথ দাসের মত তরুণ তুর্কিও কি মাত্র কয়েক বছরের বড় হবার সুবাদেই সুশোভনের তুলনায় অনেক বেশি আরামপ্রদ জায়গাতে থাকবে না? প্রশ্নটাকে এভাবেও ঘুরিয়ে বলা যায় যে, এমন ঘরে থাকতে কি তাঁরা রাজি হতেন? একটা হাল্কা অভিমান সুশোভনের গলার কাছে জমাট বেঁধে ওঠে। ঘর বড় কথা নয়। সে শিয়ালদহের নোংরা বস্তিতে বহু রাত কাটিয়েছে। কিন্তু আর কতদিন তাকে ডিক্লাসড হবার পরীক্ষা এরকমভাবে দিয়ে যেতে হবে? কলকাতায় পড়াশোনা করতে যাওয়া তো কারোর দোষ হতে পারে না, এমনকি সেই ট্যাগলাইনকে তো কলঙ্কচিহ্ন হিসেবে বয়ে বেড়ানোও অনুচিত। অথবা, এমনটা নয় তো যে সদ্যই যুব সংগঠন থেকে বেরিয়ে কয়েক মাস হল কৃষক সভা করতে আসা উজ্জ্বল সুশোভনকে এটা হাল্কা র্যাগ দেবার একটা কৌশল?
সুশোভন এগিয়ে এসে দেখল, টালমাটাল পায়ে চন্দ্রধর উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। একটু ঝুঁকে চন্দ্রধরের পিঠের পেছনে হাত দিয়ে বেড় তৈরি করল সে।
“উঠে দাঁড়ান কমরেড। পারবেন। ধীরে ধীরে উঠুন। ”
জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে চন্দ্রধরের। তার ওপর ঝাঁঝালো হাড়িয়ার গন্ধ। চন্দ্রধর পায়ে ব্যাল্যান্স করতে করতে, ব্যাথায় কোঁকাতে কোঁকাতে নেশাজড়ানো গলায় তার প্যাচাল পাড়তে শুরু করল আবার, “মুই মরিম। নিচ্চই মরিম। এত জাড়, সব্ব অঙ্গ টসটসায় কামরিড! আজ তিন দিনত বাদ কানপ্রিসে ভাত খাইলম। তাত প্যাটত জোরসে ব্যথা চাগাড়িছ।”
“তাহলে মদটা খেলেন কেন? পেট ব্যথা আরও বাড়বে তো !” সুশোভন ধরে ধরে চন্দ্রধরকে দাওয়াতে নিয়ে এসে বসায়। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে এগিয়ে দেয়। চন্দ্রধর ঢক ঢক করে কিছুটা খায়। জ্বরের ঘোরে মাথাটা ঝুঁকে থাকে তার বুকের উপর।
“খগেন মাস্টার কয়, ‘হেই চন্দ্রধর। তোর মনে লয় আলসারিয়া। ডাগদর দেখাইছ?’ তো মুই চন্দ্রধর, কুনঠে ডাগদর পাই? মুই কই, ‘কামরিড, অ্যালায় এত দিনকার আগত জমিটা গেইল। পঞ্চাইত বিধান দিল, চন্দ্রধর বিরিগেড যাইছ তয় ই জমির পাট্টা ছাড়িবার নাগিবে। মুই বলি, তয় আইন কোটত গেইল? মালিক কয়, শ্যালায় লাল পাটটির আইন, না মানুম হে। ত মুই এক প্যাটত ভোখ আর এক গা জাড় নিয়া কুনঠে যাম? কুনঠে যাম হে?’ খগেন কয়, ‘টাউন আয় রে। মুই ডাগদর আনবেক”। মুই টাউন না যাও। নেংটি পিন্ধি অধম চন্দ্রধর, সে এই গেরামে রেড ফেলাগ লাগাইছ, ধরো কেনে মাড্ডার হম। হতিই পারি। কিন্তু টাউন না যাও। মোক জমিটুকু ফিরায়ে দাও হে কামরিড। তয় জাড় না রম।”
সুশোভন অসহায় বোধ করে একটু। চন্দ্রধরের পাট্টা ফেরানো তার হাতে নেই। জ্বরের তাড়সে চন্দ্রধরের চৈনিক মুখমণ্ডল অল্প অল্প লাল হয়ে আছে। ঝুলে পড়া গালের চামড়া কাঁপছে অল্প অল্প। ‘বাড়িতে আর কোনও মানুষ নেই?’ প্রশ্নটা করতে গিয়েওনিজেকে সামলে নিল সুশোভন। যখন স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, চন্দ্রধর রাজবংশী একলা নির্জন মানুষ, তাকে নতুন করে এরকম প্রশ্ন করাটা অসভ্যতা। রাত অনেক হয়েছে। আকাশের গা থেকে ঝুলে আছে কালচে চাপ মেঘ, কিন্তু তাতেও ঠান্ডা আটকাচ্ছে না। এক একবার করে হিমেল হাওয়ার ঝাপটা আসছে, আর ফ্লেক্সটা ফুলে উঠছে। মনে হচ্ছে দড়ির বাঁধন ছিঁড়ে খুঁড়ে ফাঁকা খেতের উপর দিয়ে ডানা মেলে উড়ান লাগাবে। চামড়া ভেদ করে হাড়ে আঁচড় কাটে এমন হাওয়া। এখানে বুড়ো মানুষটাকে ফেলে রাখলে নিউমোনিয়া হয়ে মরবে।
“কমরেড, চলুন ঘরে গিয়ে শোবেন”।
“হ?” লালচে চোখ অতি কষ্টে মেলল চন্দ্রধর।
“ঘুমোব না? কাল ভোর থেকেই কনফারেন্স শুরু হয়ে যাবে। চলুন, শুতে হবে”। সুশোভন মাথাটা ঝুঁকিয়ে একটু জোরেই বলল।
“হয় হয়। কানপ্রিস। তুমি অন্দর যাও। মুই এইঠে আতপাহারা দিবার ছে”।
“পাগল নাকি ! এই জ্বর নিয়ে আপনি বাইরে থাকবেন?” এবার একটু বিরক্ত হয় সুশোভন। পাগলছাগলদের সামলানো এমনিতেই কঠিন, আর সত্যিই তার ক্লান্ত লাগছে এখন। “আপনি চলুন, পাশাপাশি শুয়ে পড়ব”।
“মুই না যাও। মুই এইঠে রয়। খগেন মাস্টার বলিছ, ‘হেই রে চন্দ্রধর, ই মাতব্বর কামরেড আছ। দেখিস, ভোগান না পায়’। মুই বুঝি নিছু, মোক আতপাহারা দিবার নাগিবেই নাগিবে। আর আতপাহারা দিবার হয় তো জাগত নাগিবেই নাগিবে। আর জাগত নাগিবার হয় তো অ্যালায় দাবায় বসিবার নাগিবেই নাগিবে। মুই আছি হে, বসিবার আছি। তুমি যাও”।
“এটা হয় কখনো? খগেনদা অতশত বোঝে নি, আপনাকে কিছু একটা বলতে হবে তাই বলে দিয়েছে। আমি ভেতরে ঘুমোব আর এই শরীরে আপনি বাইরে বসে থাকবেন এই হিম রাতে, তারপর ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে আমি পার্টিকে কী জবাব দেব?”
“তুমি যাও হে কামরিড। মুই এইঠে বসিছু”। রক্তাভ চোখ মেলে জড়িয়ে জড়িয়ে কথাগুলো উচ্চারণ করল চন্দ্রধর, তারপর পাশ ফিরে দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে ফ্লেক্সটার দিকে তাকিয়ে রইল, যেন সুশোভনকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করছে। খগেন বর্মণ বলে দিয়েছে তো ব্যাস, এবার ভূমিকম্প হলেও চন্দ্রধর নিজের জায়গাটুকু থেকে নড়বে না। দ্বিধায় পড়ে গেল সুশোভন। এই মানুষকে বাইরে রেখে ভেতরে আরামে, যদিও কী আরাম তা দেখতেই পাচ্ছে, ঘুমোনো অসম্ভব তো বটেই, আবার এটাও ঠিক যে সে আর পারছে না। এদিকে চন্দ্রধরের সারা শরীরের মধ্যে এমন এক প্রত্যাখ্যান মাখানো ছিল যা বলে দিচ্ছিল যে এখন থেকে সুশোভনের কোনও কথাই সে আর শুনবে না।
কিছুক্ষণ পর ক্লান্তিই জয়ী হল, এবং পায়ে পায়ে সুশোভন এগিয়ে গেল ঘরের দিকে। চন্দ্রধর ঝিমোচ্ছে। উঠোনে রাখা তার একলা লাঙল স্থির, যদিও তার পচে যাওয়া কাঠ খুলে খুলে পড়বার প্রক্রিয়াটি সম্ভবত সারাদিন ধরেই চলছে। খাঁ খাঁ প্রান্তরের মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু ফ্লেক্সটির পতপত আওয়াজ হাওয়াতে, যা অনৈসর্গিকতাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে। সুশোভন শক্ত মাটির ওপর শরীরটা এলিয়ে দিল। মোবাইলে টাওয়ার নেই, তাই জানার উপায় নেই বাড়িতে কে কী করছে। কী ভাগ্যিস বেরোবার সময়ে চন্দ্রা জোর করে ব্যাগের ভেতর একটা শাল গুঁজে দিয়েছিল ! নাহলে শুধুমাত্র সোয়েটারে এই শীত আটকায় না। খড়ের স্তূপের ওপর পা ছড়িয়ে দিতে এক প্রকার আরামের উত্তাপ তার কোমর বেয়ে উঠতে শুরু করবার কারণেই হয়ত এতক্ষণ বাদে একটু একটু ভাল লাগছিল সুশোভনের, এবং কিছুটা স্বার্থপরভাবেই, বাইরে বসে থাকা এক অসুস্থ মানুষের কথা কিছুটা পাশ কাটিয়েই চোখ দুটো যেন হালকা বুজে আসছিল। পার্টির প্রতি তার যে অভিমানটুকু জমা হয়েছিল, সেটুকুও এতক্ষণে সম্ভবত থিতিয়ে পড়ছে ঘুমজলের একদম নিচের পলিমাটিতে। সুশোভন শালটা গায়ে ঢাকা দিয়ে পাশ ফিরে শুল।
খুব বেশিক্ষণ ঘুমোনোর সুযোগ পায়নি, কারণ খড়ের চালের উপর বৃষ্টির প্রথম শব্দেই তার চটকা ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু ক্লান্ত শরীর মাথার নির্দেশ মানতে চাইছিল না, তাই অন্ধকারের মধ্যে নিঃসাড়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে সুশোভন বৃষ্টিপাতের বাস্তবতা যাচাই করবার অজুহাতে নিজেকে আরেকটু গড়িয়ে নেবার সময় দিচ্ছিল। মাথা ভার হয়ে রয়েছে, যেন চোখ দুটো টেনে ধরেছে কেউ। কিন্তু যে অস্বস্তিটা এতক্ষণ জোর করেই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল, সেটা যেন সহস্রগুণ হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার তার উপর, এবং তার হ্যাঁচকা টানেই সুশোভন ধড়মড় করে উঠে বসল। চন্দ্রধরের মাথার ওপর কিছুই নেই। সে কি এই বৃষ্টিতে ভিজছে?
বাইরের অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, এবং বৃষ্টি খুব জোরে পড়ছে। এবার যা হয় হোক, দরকার পড়লে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে আসবে, এই ভাবনায় সুশোভন দরজার কাছে গিয়ে দেখল, চন্দ্রধর তার জায়গাতে নেই। এমনকি উঠোনেও না। গেল কই? আশেপাশে অন্য বাড়িও নেই যে সেখানে ঢুকবে। খাঁ খাঁ খেতের ওপর দিয়ে একটা বৃষ্টির ঝাপট উড়ে এসে সুশোভনের মুখে ধাক্কা মারতে সে অস্থির হয়ে চিৎকার করতে গেল ‘কমরেড’, কিন্তু সেটা গলাতেই থেকে গেল কারণ তখনই একবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল এবং সুশোভনের চোখে পড়ল চন্দ্রধর কাঁপতে কাঁপতে সম্মেলনের ফ্লেক্সের দড়ি খুলছে।
এক পা এক পা করে ঘরের ভিতর পেছিয়ে গেল সুশোভন। সে জানে, এরপর কী ঘটতে চলেছে। শিয়ালদহর ফুটপাতে ঘুমনো রিকশওয়ালাদের কমন প্র্যাকটিস ছিল এটা। যে চন্দ্রধরের শীতকালেও একটা ঝলঝলে জামা বাদে আর কিছুই অবলম্বন নেই, একটা তিরিশ বর্গফুটের ফ্লেক্স তার কাছে আরামদায়ক কম্বল না হোক, কিছুটা ওম কি দিতে পারবে না?
কিন্তু ভিজে ছুপছুপে চন্দ্রধর দাওয়ার দিকে আসল না। সে ফ্লেক্সটা খুলে কাঁপতে কাঁপতে শুইয়ে থাকা লাঙলের কাছে গেল, এবং লাঙলের ওপর কাস্তে হাতুড়ি চিহ্ন আঁকা ফ্লেক্সটা বিছিয়ে তার এক দিকের কোণ লাঙলের ফলার নিচে গুঁজে দিল, আর উল্টোদিকের কোণের ওপর নিজে বসে পড়ল গুটিসুটি মেরে, এক আকাশ বৃষ্টির নিচে দুই হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে রেখে, যাতে ঝোড়ো হাওয়াতে ফ্লেক্স উড়ে না যায়। পচা কাঠের পুরনো লাঙল, সে দামাল বৃষ্টির আক্রমণ সহ্য করবেই বা কী করে ! ষাট বছর হারিয়ে এসে চন্দ্রধর রাজবংশীর একমাত্র সম্পত্তিকে কিছুতেই ভিজতে দেওয়া চলে না।
সুশোভনের মনে হচ্ছিল, সে দাওয়া পেরিয়ে চন্দ্রধরের জ্বরের পাশে গিয়ে বসে। কিন্তু দুজনের মধ্যিখানের উঠোনটুকু বৃষ্টির তোড়ে এতটাই ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল যে তাকে অতিক্রম করবার সামর্থ্য তাদের কারওরই ছিল না।