একটা দৃশ্য কল্পনা করুন।
অন্ধকারে ছুটে চলেছে দূরপাল্লার রেলগাড়ি। কামরায় প্রায় সবাই ঘুমন্ত। ম্লান হলুদ আলোয় হাত, পা, মাথাগুলো বিভিন্ন ভঙ্গিতে স্থির, ট্রেন চলার তালে দুলছে শুধু। একজন বৃদ্ধ ঘুম ভেঙে উঠে দাঁড়ালেন। টয়লেটের দিকে যেতে গিয়ে একটু থেমে গেলেন। বাঙ্কে শুয়ে থাকা একজনের হাত কিছুটা বেরিয়ে এসে পথ বন্ধ করেছে। পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়ে টয়লেটের সামনে আবার দাঁড়াতে হল – কয়েকজন রিজার্ভেশনহীন মানুষ মাটিতে কাপড় পেতে শুয়ে আছেন। একটু থেমে থেকে তাঁদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর কিছু একটা ভেবে ফিরে গেলেন কামরায়। যে হাতটা পথ আটকেছিল সেটা আবার নিচু হয়ে দেখলেন। তার পরে আরেকজন ঘুমন্ত মানুষের কাছে গিয়ে খুব সন্তর্পণে তাঁর হাতের তালুটা পরীক্ষা করলেন। তার পরে আরেকজনের।
ছোট ছেলেটা ঘুমোচ্ছিল। আট বছর বয়স। মামাবাড়ি বেড়াতে গেছিল গরমের ছুটিতে, দাদুর সঙ্গে বাড়ি ফিরছে। হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে গেল – দাদু ডাকছেন। ট্রেনটা কোনো একটা ছোট স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে।
“ওঠো তো দাদুভাই, আমরা এইখানে নামব।”
“হাওড়া এসে গেছি, দাদু?”
“না ভাই, আমরা পরের ট্রেনে হাওড়া যাব। এখন এখানে নামতে হবে। তাড়াতাড়ি কর, লাল সিগন্যালে থেমেছে, এখনই আবার ছেড়ে দেবে।”
“এটা কোন জায়গা, দাদু? এখানে কেন নামছি?”
“জায়গার নাম জানি না দাদুভাই। নামতে হবে তাই নামছি।”
পোঁটলা-পুঁটলি নিয়ে নামতে নামতে গাড়ি আস্তে আস্তে ছেড়ে দিল, শিশু ও বৃদ্ধ কোনোমতে লাফ দিয়ে প্ল্যাটফর্মে পড়লেন।
ছোট্ট ওয়েটিং রুমে রাত কাটিয়ে সকালে ট্রেনের খবর নিতে গিয়ে শুনলেন, আপাতত সব গাড়ি বন্ধ। কাল রাতে যে ট্রেনে ওঁরা যাচ্ছিলেন, সেটি কয়েক স্টেশন পরে একটা থেমে থাকা মালগাড়িকে ধাক্কা দিয়েছে। দুটো গাড়ির ইঞ্জিন পরস্পরের মধ্যে ঢুকে গেছে। ছ’টি বগি চূর্ণ, শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
প্রথম কাজ বাড়িতে টেলিগ্ৰাম করে আস্বস্ত করা। সেটাও সেখান থেকে সম্ভব নয়। নিকটতম বড় শহর পাটনা, গাড়ি ভাড়া করে যেতে হল। হোটেলে ঘর ভাড়া নিয়ে উঠলেন দু’জনে। সঙ্গে টাকা বেশি নেই। টেলিগ্ৰাম পেয়ে বৃদ্ধের জামাই, ছেলেটির বাবা, চলে এলেন। হোটেলের টাকা মিটিয়ে তিনজনে কলকাতা ফিরলেন।
আট বছরের সেই ছেলেটি এখন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, আয়কর বিশেষজ্ঞ। সেলিমপুরে যখন ভাড়ায় থাকতাম, পরিচয় হয়েছিল। ভূয়োদর্শী ব্যক্তি, অনেকরকম অভিজ্ঞতা আছে ওঁর জীবনে। এখনও ওঁর কাছে যাই, দাদা বলে ডাকি। আমার যৎসামান্য আয়ের তৎসামান্য করের হিসেব করে দেন, পয়সাকড়ি নেন না, আমিও প্রস্তাব করার ধৃষ্টতা করিনি কখনো। গপ্পে লোক, চেম্বার ফাঁকা থাকলে চা-মুড়ি সহযোগে আমরা নানারকম আলোচনা করি। জানতে চেয়েছিলাম রহস্যটা কী।
“ফিরে এসে দাদু কিছু বলতে চান নি। প্রচারবিমুখ লোক ছিলেন তো। প্রথমদিকে যারা এসেছিল, বিভিন্ন গল্প দিয়ে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া হল। পরে আমাদের বলেছিলেন। দাদু বড় মাপের জ্যোতিষী ছিলেন। শুধু ঠিকুজি বা করকোষ্ঠী বিচার নয়। ওগুলো তো যান্ত্রিক হিসেব। কোনো কোনো মানুষের খাঁটি ভবিষ্যৎদৃষ্টির ক্ষমতা থাকে। আমার মনে হয় দাদুর সেটা ছিল। এরকম লোক আমি আরও দু-একজনকে দেখেছি। তোমার হাত দেখে এমন সব কথা বলে দিতে পারবেন যা পুঁথিপড়া জ্যোতিষীর বোধের বাইরে। হাত বা কোষ্ঠী দেখাটাও সম্ভবত এঁদের একটা অছিলা। কিছু দেখতে হয় না। মুখের দিকে তাকিয়েই এঁরা বলে দিতে পারেন। এর জন্য সাধনা করতে হয় কিনা আমি জানি না। বোধহয় এমনিই আসে। দাদু তো সাধারণ গৃহস্থের মতো সামান্য পুজো-আচ্চার বেশি কিছু কোনোদিন করেছেন বলে শুনি নি।”
“কী বুঝতে পারলেন?”
“টয়লেটে যেতে গিয়ে যে হাতটা বেরিয়ে ছিল, তাতে দেখলেন মৃত্যুযোগ, আজ রাতেই। তারপর যারা মাটিতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল তাদের হাতেও সেই একই রেখা। ফিরে এসে আরও কয়েকজনের হাত পরীক্ষা করে দেখে বুঝলেন, ট্রেনের একটা কামরায় এতজন লোক একসঙ্গে আজ রাতেই মারা যাবে, এটা একমাত্র একভাবেই হতে পারে – ট্রেনটার একটা ভয়াবহ অ্যাক্সিডেন্ট হতে চলেছে। জানি না গাড়িটা সিগন্যালে থেমেছিল, না দাদু চেন টেনে থামিয়েছিলেন।”
“অন্যদেরও জাগিয়ে তুলতে পারতেন, হয়তো অনেকের প্রাণ বাঁচত।”
“বাঁচত না আরও কিছু। পাগল বলে গালমন্দ করে জোর করে বসিয়ে রাখত, চেন টানতে দিত না। তা ছাড়া নিয়তিকে লঙ্ঘন করা যদি সম্ভবই হত তাহলে রাজা ইডিপাস্ দীর্ঘদিন সুখে রাজত্ব করে থিব্সের রাজপ্রাসাদে বৃদ্ধ বয়সে পালঙ্কে শুয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতেন, আর সামারার সওদাগরের কাহিনীও কোনোদিন লেখা হত না।”
“সামারার সওদাগর আবার কে?”
“শোনো নি বুঝি? সেই যে প্রাচীন পারস্যের সামারা নগরীতে এক সদাগরের বাপের আমলের চাকর একদিন সকালে হঠাৎ এসে বলল সে কাজ ছেড়ে দিতে চায়, সেদিনই সে তার দেশের বাড়ি ইস্পাহান্ চলে যাবে। সদাগর তো অবাক। পঞ্চাশ বছরের লোক, কী এমন হল যে বিনা নোটিশে তক্ষুনি বিদায় নিতে হবে? চাকরটি বলল, হুজুর, একটু আগে বাগানে গেছিলাম। দেখি কালো আলখাল্লা পরে মৃত্যু স্বয়ং দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমাকে দেখে একটা মারমুখী ভঙ্গি করলেন। আমাকে নিস্তার দিন, এখানে থাকলে আমি আর বাঁচব না। সদাগর তো তখনই তাকে যা মাইনেকড়ি বাকি ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি দিয়ে, আর নিজের আস্তাবলের সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়াটা উপহার দিয়ে রওনা করে দিলেন। সামারা থেকে ইস্পাহান্ অনেকটা পথ, রাতের আগে পৌঁছতে পারবে কিনা বলা যায় না। বলে দিলেন, ভয় কেটে গেলে আবার আসতে, তার পদ খালিই থাকবে।
“একটু বেলার দিকে সদাগর নিজে বাগানে হাঁটতে গেছেন, দেখলেন কালো আলখাল্লা পরে মৃত্যু ঘুরে বেড়াচ্ছে। উনি তার কাছে গিয়ে বললেন, হে মৃত্যু, তুমি তো সর্বশক্তিমান। তবু তুমি ভাড়াটে গুন্ডার মতো দুর্বল লোককে ভয় দেখিয়ে বেড়াও কেন? আমার বহুদিনের ভৃত্যটি আজ কাজ ছেড়ে ইস্পাহান্ চলে গেল, সকালে তুমি তাকে দাঁত খিঁচিয়ে ভয় দেখিয়েছ। মৃত্যু বলল, দূর পাগল। মানুষকে ভয় দেখিয়ে বেড়াব, আমার কি এত সময় আছে, না প্রয়োজন আছে? ভয় আমি ওকে দেখাইনি। চমকে গেছিলাম শুধু, ও সেটা ভুল বুঝেছে। আমার বইয়ে লেখা আছে সন্ধেবেলা ইস্পাহানে ওকে তুলে নিতে হবে, অথচ সকালে দেখছি ও সামারা-তে। তাই ভাবছিলাম লোকটা পৌঁছবে কী করে।”
“দাদু কি নিজের হাত, আপনার হাত পরীক্ষা করেছিলেন চেন টানার আগে? যদি আপনাদের হাতেও একই রেখা থাকত? তাহলে নামতে চেষ্টা করে কোনো লাভ হত কি? হয়তো ট্রেন থেকে পড়েই আপনাদের মৃত্যু হত। আর যদি মৃত্যুর রেখা আপনাদের হাতে না থাকত, তাহলে বসে থাকলেই বা কী ক্ষতি ছিল? মরতেন না নিশ্চয়ই।”
“এইটা ভাল বলেছ তো। আগে মাথায় আসেনি। দাঁড়াও, নেক্সট প্ল্যানচেটে অবশ্যই দাদুকে জিজ্ঞেস করে নেব।”
প্রসঙ্গত, ট্রেনটা ছিল হাওড়াগামী পাঞ্জাব মেল। তারিখ ২২ জুলাই, ১৯৬২। স্টেশনের নাম দুমরাও, পাটনার কাছে। পুরোনো কাগজ ঘাঁটলে শতাধিক মৃত্যুর খবর দেখতে পাবেন। দাদার নামটা আর বললাম না, অনেকেই চেনেন, ওঁকে বিব্রত করতে চাই না।