মণ্ডপে আরতি শেষ হতেই পায়ে পায়ে বেরিয়ে এল শ্রী। বাইরে উদ্দাম ঢাক বাজছে। চারজনের দলটা ঘুরে ঘুরে, নেচে নেচে বোল তুলছে ঢাকে। বেশ বড়সড় একটা ভিড় জমে উঠেছে ঢাকির দলকে ঘিরে। শ্রোতা-দর্শকদের কেউ পায়ে তাল ঠুকছে, কারুর বা শরীর জুড়ে হালকা দুলুনি। মণ্ডপ থেকে নেমেই সামনের চত্বরটায় অল্পবয়সী ক’টা ছেলে ধুনুচি নিয়ে নাচছে ঢাকের সাথে তাল মিলিয়ে। অস্পষ্ট একটা হাসি ফুটে ওঠে শ্রী-এর ঠোঁটে। যুবসঙ্ঘের ঢাকিরা আজও তাহলে একইভাবে মাতাল করে দর্শকদের।
সামনেই মায়ের বারো হাতের প্রতিমা। একসময় কুড়ি হাতের হত। একসময় এই ক্লাবের পুজোয় সত্যিই প্রাণপ্রতিষ্ঠা হত। আর সেটা করত একজনই…। এই ঢাকিদের ও তো এই ক্লাবে এনেছিল সেই ব্যক্তিই। আশেপাশের ক্লাবগুলো অনেক চেষ্টা করেও তাদের ভাঙিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। নির্নিমেষে তাকিয়ে থাকে শ্রী। শ্যামাকালীর শান্তশ্রী কীভাবে যেন ঘর করে নিয়েছে এই শ্মশানকালীর অবয়বে। গত দশবছর ও পা রাখেনি এই পাড়ায়, এই মণ্ডপে। কত কিছু বদলে গেছে চারপাশে, কিন্তু মায়ের সেই মুখ আজও এক। অবিকল এক।
যুবসঙ্ঘের পুজোয় শ্রী প্রথম পা রেখেছিল ওর আট বছর বয়সে। সেই রজত জয়ন্তী বর্ষে সেক্রেটারি ছিল ওর বাবা। মণ্ডপের পাশেই চিনুকাকুদের টানা বারান্দায় বসে বাবার সাথেই অনুষ্ঠান সূচী ঘোষণা করছিল ও। বিরক্তির সাথে পরিচিত জনেদের আদরের উপদ্রব সরিয়ে রেখে, ওর সরু গলাটাকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে, বাবার লিখে দেওয়া কাগজ দেখে ঘোষণা করছিল…”আসুন আসুন আসুন…রজত জয়ন্তী বর্ ষে… আজ যুবসঙ্ঘের নি…বেদন…প্রখ্ খ্যাত শিল্পী অমর পাল ও সনৎ সিংহ। আগামী কালের শিল্পী শ্রী অনুপ ঘোষাল…… আমাদের অনুষ্ঠানকে সাফল্য মণ্ডিত করে তুলতে…
ঢাকির দলটার কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় শ্রী। সামনে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে দেখতে থাকে ওদের। লম্বা, ঝাঁকড়া চুলের লোকটা রবি। এখনো একই আছে চুলের স্টাইল। নাচের তালে তালে ঝাঁকি দিয়ে চুলগুলো সরিয়ে দিচ্ছে মুখের ওপর থেকে। “Perfect swag”, ভাবে শ্রী। চোখটা ঘোরাতেই দেখতে পায় ভানু’কে। ভানুকাকু, দলের নেতা। বড় বড় চোখের সাদা জমি সবসময়ই ঈষৎ লালচে। নিচের ঠোঁটে একটা কাটা দাগ। একটু ঠোঁট বেঁকিয়ে ধীরে ধীরে মার্জিত ভঙ্গিতে কথা বলত। আর সুদর্শন’কাকু। সবথেকে ছোটখাটো চেহারার, মিষ্টি মুখের, একটু মেয়েলী। অনেক গল্প বলত সে। কই, নেই তো!! তার বদলে অন্য একটা ছিপছিপে, সুপুরুষ অল্পবয়সী ছেলে বাজাচ্ছে। গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে বাজাচ্ছে ওরা। পিঠে লেপ্টে গেছে ওদের ঘামে ভেজা জামাগুলো। উদ্দাম বিটে দুলছে সমবেত দর্শক। নেশার ঘোরের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে দুলুনি। তন্ময় হয়ে যেতে থাকে শ্রী। ধুনোর গন্ধের সাথে মিশে যাচ্ছে একটা হারিয়ে যাওয়া সন্ধের গন্ধ, পুরুষালি ঘামের একটা উত্তেজক ঘ্রাণের সাথে মিশে যাচ্ছে দূর থেকে ভেসে আসা ছাতিমফুলের সুবাস। ঘোর লাগা চোখের সামনে ব্লার হয়ে যাচ্ছে সমস্ত দৃশ্য।
“তুমি আবার ওদের খেতে বললে!!! ঘরে একটা পয়সা নেই…কোনো বাজার নেই…” মা রাগে, ক্ষোভে কথা শেষ করতে পারছে না।
” আরে…অত রাগ করছ কেন? ওরা কি পোলাও-কালিয়া খাবে নাকি? ভাত-ডাল-কিছু একটু ভাজা আর ডিমের ঝোল…ব্যস। গরিব মানুষ…যা খাওয়াবে, তাই আনন্দ করে খাবে।”
“সেই ডিমের ঝোল, ভাতের টাকাটাই বা আসবে কোথা থেকে? তুমি কি পাগল?” মায়ের ক্ষোভ কমছে না কিছুতেই।
“ব্যবস্থা হবে কিছু না কিছু। অত চিন্তা করোনা। তবে জানো…আমার খুব ইচ্ছা ওদের একদিন মাংস-ভাত খাওয়াবো। খাওয়াবোই…পেট ভরে মাংস-ভাত। মা একদিন সেই দিন দেবে…নিশ্চয়ই দেবে। দেখে নিও…”
মা কিছুক্ষণ অপলকে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। তারপর রান্নাঘরে চলে যায় নিঃশব্দে। কিছু স্বপ্নের গভীরতা নিজের লোকেরাও মাপতে পারে না হয়ত। ঠাকুরঘরের সিঁড়িতে বসে অঙ্ক করতে থাকে ক্লাস সেভেনের শ্রী’য়ের মনে দৃশ্যগুলো, শব্দগুলো ছাপা হয় যায়।
পরদিন দুপুরে মাটিতে আসন পেতে চারজন খেতে বসেছিল। মা ভাত বেড়ে দিচ্ছিল। সাহায্য করছিল শ্রী। আর একটা টুলের ওপর বসে অনর্গল ওদের সাথে বকে যাচ্ছিল বাবা। “বুঝলি ভানু, এবার ইচ্ছা বাড়িতে মা’কে আনার। যদি ক্ষমতা হয় তো তোদেরই বায়না করবো। আর না’হলে… তোরা ক্লাবে বাজানোর ফাঁকে এক-দুবার এসে বাজিয়ে যাস। কী’রে, আসবি না?”
“তুমি বলবে, আর আমরা আসবো না দাদা? আমরা তো কই নিজেদের মধ্যে, সুরেশ’দার জন্যই এই ক্লাবে আসা। নাহলে বাকিদের যা ব্যাভার..! মানুষ জ্ঞান করে না’গো দাদা…” শান্ত ভানুকাকু ঝলসে ওঠে হঠাৎই।
“এই তোমার ঘরে খেতে এসিছি, এই নিয়েই কত কথা কইবে সব…” সুদর্শনকাকু ফুট কাটে।
“সে’তো আমি তোদের প্রতি বছরই খেতে বলি শেষ দিনটায়…”
“কী বলে জানো দাদা, …বলে ক্লাবের থেকে কত ঝাড়ে!! নাহলে যার নিজের সংসার চলেনা, সে আবার ঢাকিগুলোকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে বসিয়ে খাওয়ায়…!!”
“চুপ কর রবি, একদম চুপ…” ভানুকাকুর আচমকা গর্জনে নিস্তব্ধ হয়ে যায় ঘর। অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে আসে। বাটিতে ডিমের ঝোল বাড়তে বাড়তে মা আড়চোখে দেখে বাবার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ। বাবা টুল থেকে উঠে পড়ে। এগিয়ে যায় ছাদের দরজার দিকে। আলীগড়ি পায়জামার ধুলোমাখা নিচের অংশটা লটপট করে পায়ের কাছে। মা কুঁচো চুলগুলো ঠেলে সরিয়ে দেয় কানের পিছনে। এঁটো লেগে যায় চুলে। কার্তিকের ঈষৎ ঠাণ্ডাতেও ঘামতে থাকা মা ডাকে, “শোনো, …শুনছো…। ” বাবার কানে ডাক পৌঁছয় না। ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে বাবা নারকেল গাছের পাতা গুনতে থাকে।
তিনজন ঢাকি ও একজন কাসর বাদক পুঁচকি ছেলে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনের তরুণীর দিকে।
“আপনি খাওয়াবেন আমাদের!!! কিন্তু কেন? আপনার ইচ্ছা হলে টাকা দিয়ে দিন। আমরা হোটেলে খেয়ে নেব।” সেই মার্জিত গলা। ভানুকাকু।
“না, আমি বাড়িতেই খাওয়াবো আপনাদের। কাল আসুন প্লিজ। অবশ্য আপত্তি থাকলে… আচ্ছা, সুরেশদার বাড়িতে তো খেতেন। ওঁকে না বলতেন না’তো…..?”
“আপনি চেনেন ওঁকে? কতবছর দেখিনি। কয়েকবছর আগে তো শুনলাম মারা গেছেন। কেউ তো কিছু বলেও না এখানে….। আমরা যাব আপনার বাড়ি দিদি। কোন বাড়ি?”
” ওই…সেই বাড়িই। যে বাড়িতে যেতেন….সুরেশদার বাড়ি। দুপুর একটায় চলে আসবেন।” পিছন ঘুরে দ্রুত পা চালায় শ্রী। জল খেতে হবে। গলায় কী একটা বিঁধছে যেন।
পিছন থেকে স্বর ভেসে আসে….”দিদিইইই….আপনি…সুরেশদা…সুরেশদার মেয়ে? মামণি? ও দিদি…”
দশজন বসার বিরাট ডাইনিং টেবিলের একদিকে শ্রী। উল্টোদিকে পরপর বাকি চারজন।
“আমরা চিনতেই পারিনি তোমায়, মামণি। ভালো আছো? বৌদি…..ভালো আছে? কোথায় এখন…?”
“মা’ও নেই কাকু। গত বছরই…। আচ্ছা সুদর্শন’কাকু আসেনা এখন আর?”
“ও মারা গেছে মামণি। …তালশাঁস পাড়তে গেছে উঠেছিল। গাছের মাথায় কেউটের ছোবল খেয়ে নীচে পড়ে গেল…” ভানুকাকু আনমনে ভাত নাড়াচাড়া করতে করতে বলে। বাতাসে কার্তিকের হিম ছড়িয়ে যাচ্ছে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে। দ্রুত শুকিয়ে যাচ্ছে ঠোঁট, জিভ, চোখ।
“সুদর্শনের বদলি এখন অনিল আসে। আর এই পুঁচকেটা মুরারী। সেই তখন যেমন বিশু আসতো।” দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টায় রবি। বয়স হলেও সেই লেডি-কিলার হাসিটা এখনো তেমনই আছে।
অনিল কিছুই বলছে না। স্থির চোখে শুধু মাঝে মাঝে দেখছে শ্রীয়ের দিকে। অস্বস্তি হচ্ছে ওর। একটা তীব্র শিরশিরে অনুভূতি পায়ের পাতা বেয়ে উঠে আসছে। অস্বস্তি কাটাতেই কথা বলে ওঠে ও।
“বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তোমাদের মাংস-ভাত খাওয়াবে। আর বাড়িতে পুজো করবে। ….পরের বছর থেকে পুজো করবো, ইচ্ছে আছে। আর আজ তোমাদের জন্য মুরগির মাংস-ভাত। আমি নিজে রেঁধেছি।”
মুরারী মুহুর্তে উঠে দাঁড়ায়। এতক্ষণ ও মন দিয়ে ডাল-ভাত, আলুভাজা, বেগুনভাজা খাচ্ছিল। “আমি মাংস খাব নে।”
অবাক শ্রী বলে ওঠে, “কেন রে?…কী হল? ছোটরাই তো মাংস বেশি ভালোবাসে। আমি ঝাল দিইনি বাবু…
খেয়ে দেখ।”
মুরারী তবু ঘাড় গুঁজে থাকে। “মা মানা করে দিসে। খাবনা।” শ্রী এদিক ওদিক তাকে সবার মুখের দিকে। ভানু-রবির মাথা নিচু। কী যেন প্রবল অস্বস্তি খেলা করছে ঘরটায়। অনিল শুধু একমনে খেয়ে যাচ্ছে। শ্রী বিপন্ন বোধ করে। তাল কাটছে। কিন্তু সমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারে না। সবিতাদি মাংসের বাটিগুলো টেবিলে রেখে যায়। সেদিকে তাকিয়ে শিউরে ওঠে মুরারী।
“হালাল নয়…হালাল করা নয়। মা মানা করসে…।”
নিজের মনে বিড়বিড় করে বলা চাপা শব্দগুলো পরিষ্কার শুনতে পায় শ্রী। হয়ত ঘর নিঃশব্দ বলেই। ঘরে বাজ পড়লেও এতটা চমকে উঠত না ও। বাকিরাও শুনেছে। তাদের অভিব্যক্তিতে তা স্পষ্ট। সকলের খাওয়া থেমে গেছে। হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে থাকে শ্রী।
“ওর নাম মুরারী নয়। মুরাদ। মুরাদ বেগ। ও মুসলমান। ওর বাপ মরে যাওয়ার পর থেকে আমাদের দলে বাজায়। ওর বাপ ছিল সুলেমান বেগ। আপনার সুদর্শন কাকা। বছরের বাকি সময় ও আমার কাছে পড়ে আর ক্ষেতে কাজ করে।” দুদিনে এই প্রথম অনিলের ভরাট গলাটা শুনতে পায় শ্রী। আজ বোধহয় ওর অবাক হওয়ারই দিন।
“তুমি…পড়াও? তুমি পড়াশোনা…কতদূর করেছ?”
একটা শ্লেষের হাসি ফুটে ওঠে অনিলের ঠোঁটের কোণে। মিষ্টি মুখটা ব্যঙ্গে বেঁকে গেছে। “আমি গ্র্যাজুয়েট ম্যাডাম। একাউন্টেন্সি অনার্স।”
“তাহলে তুমি…”
“ঢাক কেন বাজাই? সেইই…শিক্ষিত হলে তো আবার ঢাক বাজানো যায়না…। ওই প্যাশন আর পয়সা দুটোই…।” একটু থেমে আবার বলে, “মুরাদের সত্যিটা ক্লাবে বলবেন তো ম্যাডাম? আমি বলি কী, একটু দেরিতে বলুন। আমরা চলে যাই। নাহলে বাচ্চাটাকে নিয়ে বড্ড টানাহেঁচড়া হবে। এটুকু উপকার করুন।”
ছেলেটা বড্ড বেশি কথা বলে। ভীষণ বিরক্ত হয়ে শ্রী তাকায় ওর দিকে। তারপর টেবিলটাক পাক দিয়ে গিয়ে মুরাদের পাশে দাঁড়ায়। ওর কাঁধে আলতো চাপ দিয়ে বলে, “বোস, খেতে বোস। মাংস খেতে হবেনা তোকে।”
“সবিতাদিইইই…. একটা ডিম ভেজে এনে দাও তাড়াতাড়ি।”
ঘরের বাতাসটা আবার সহজ হয়ে আসে। শেষ না করা বেগুনভাজাটা আবার খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে মুরাদ।
খাওয়ার পর পাশের ঘরে শ্রীয়ের বাবা-মায়ের ছবির সামনে এসে দাঁড়ায় সবাই।
“পরের বছর পুজো করব ভানুকাকু। তোমরাই বাজাবে। আমি এখনই বায়না করে রাখলাম। সকলেই আসবে তোমরা।” একটা দু’হাজার টাকার নোট বাড়িয়ে ধরে শ্রী। “আসবো মামণি। তোমার কাছেই বাজাব। যতদিন বাজাতে পারব…। কিন্তু টাকাটা এখন থাক।”
বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা। কিছুতেই তাকাতে পারছে না শ্রী। মুরাদকে একটা চকোলেট দিল অন্যদিকে তাকিয়ে। চোখে কী যেন পড়েছে। ঝাপসা লাগছে দৃষ্টি। কটকট করছে। তবুও ও বুঝতে পারছে, দুটো শান্ত চোখ ওর দিকে স্থির। আর সেই দৃষ্টিতে ক্রমশ মিশে যাচ্ছে ছাতিমের ঘ্রাণ। আর অনন্ত অপেক্ষা।