টপ ফ্যান

টপ ফ্যান

ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নাফিসের উচ্ছ্বাস ভরা কন্ঠ শোনা গেল।

– ভাই, আমাকে কনগ্রেচুলেশনস জানান।
– কেন, তোর কী হয়েছে?
– মানে! আপনি জানেন না?
– বিয়ে করেছিস?
– না ভাই, কি যে বলেন! বয়স এখনো বিশ-ই হলো না, আর বিয়ে!
– তাহলে?
– এটা কিছু হলো ভাই? আপনি দুনিয়ার সব খবর জানেন আর আমার এই গুরুত্বপূর্ণ খবরটা জানেন না!
– প্যাঁচাল পাড়িস না তো। কী বলবি ঝটপট বল। আমার কাজ আছে।
– ভাই, রেগে যাচ্ছেন কেন?

আমি আরো ভাবলাম আপনাকে ট্রিট দিব। নাফিসের মুখে ট্রিট দেওয়ার কথা শোনা মাত্রই আমি পুরোটা বদলে গেলাম। বন্ধুদের কানের কাছে সারাক্ষণ প্যানপ্যান করেও যেখানে কোন ট্রিট আদায় করা যায় না, সেখানে নিজের এলাকার একটা জুনিয়র ছেলে যেচে আমাকে ট্রিট দিতে চাচ্ছে! নাহ, এর সাথে রাগারাগি করা যাবে না।

– তা কোন রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিবি ভেবেছিস?
– জ্বি ভাই। ট্রিট তো দিবই, কেন দিব সেটা জানতে চাইবেন না? মনে মনে বললাম, “না, জানতে চাইব না। আমার ট্রিট পাওয়ার দরকার। কিসের জন্য দিচ্ছিস সেসব জেনে কী হবে?” মুখে বললাম, “হ্যাঁ হ্যাঁ, বল কিসের জন্য।”

– ভাই, আমি টপ মডেল হয়েছি।
– কনগ্রেচুলেশনস!
– স্যরি ভাই, টপ মডেল না, টপ ফ্যান।
– কনগ্রেচুলেশনস! তা কিসের টপ ফ্যান? ইলেকট্রনিক কিছু?
– না, ভাই। বিবিসি বাংলার টপ ফ্যান।
– ওহ ফেসবুকে। এ আর এমন কি! না, না আই মিন এটা অবশ্যই অনেক বড় একটা অর্জন। সবাই কি আর টপ ফ্যান হতে পারে। এই দেখ, আমি ছয়-সাত বছর হলো ফেসবুক ইউজ করি, কোনদিন শুনেছিস আমি টপ ফ্যান হয়েছি?

– না, ভাই শুনিনি।
– হুম, সেটাই বলছিলাম। টপ মডেল স্যরি টপ ফ্যান সবাই হতে পারে না। তা কখন ট্রিট দিচ্ছিস?
– এইতো ভাই এখনই। আপনি তাড়াতাড়ি জিন্দাবাজার আসেন।
– ওকে, আমি আসছি।

জিন্দাবাজার যেতেই নাফিসের সাথে দেখা হল। তার চেহারাটা অসম্ভব খুশী খুশী। নাফিস প্রথমে আমাকে জড়িয়ে ধরল, তারপর মাথা নিচু করে পা ধরে সালাম করল। আমি “আরে আরে, কি করছিস, কি করছিস” বলে তাকে সোজা দাঁড় করালাম। নাফিসের চোখে পানি। জিজ্ঞেস করলাম, “কী ব্যাপার তোর চোখে পানি কেন? কান্না করছিস না-কি?” নাফিস উত্তর দিল, “এটা আনন্দের কান্না ভাই। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না এই দিনটার জন্য আমি কত  সারাক্ষণ আমাকে বকাঝকা করত। আমাকে দিয়ে নাকি কিছু হবে না এটাও খুব বলত। আজ আমি বিবিসি বাংলার টপ ফ্যান হয়েছি। আজ আমার আনন্দের দিন। বিবিসি বাংলার পেজে ১ কোটি ২৬ লক্ষের মত লাইক আছে। এর মধ্যে টপ ফ্যান আছে শ’খানেক মাত্র। এদের মধ্যে আমি একজন। টপ ফ্যানের লিস্টে সবার আগে আমার ছবিটাই আসে! এডমিশন টেস্টে ৪০-৫০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীকে পেছনে ফেলে আমি ভার্সিটিতে চান্স পাই নি সত্য; কিন্তু আজ আমি ১ কোটি ২৬ লক্ষ মানুষকে পেছনে ফেলে টপ ফ্যান হয়েছি…”

– নাফিস, আমরা রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে কথা বলি?
– জ্বি ভাই, চলেন। রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে আমি নাফিসের কথা শুনব কি, খাবারের অর্ডার দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলাম। নাফিস অনবরত কথা বলে যাচ্ছে।

– জানেন ভাই, এই টপ ফ্যান হওয়ার জন্য আমাকে কত কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে?
– হ্যাঁ, জানি। না তো, জানি না। খাবার আসার পরে বলিস, কেমন?
– আচ্ছা ভাই।

ওয়েটার খাবার নিয়ে আমাদের টেবিলের দিকে আসছে। তার ঠিক পেছনে পেছনে একটা মেয়েও আসছে। ওয়েটার খাবার টেবিলে রাখতেই মেয়েটা এসে আমার ডান পাশের চেয়ারটায় বসে গেল। আমি যেই ‘কি ব্যাপার’ বলে মেয়েটাকে একটা ধমক দিতে যাব, ওমনি দেখলাম নাফিস জিজ্ঞেস করছে, “লেট হলো যে?”

মেয়েটা উত্তর দিল, “জ্যামে আটকে গিয়েছিলাম।” নাফিস এবার মেয়েটার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিল, “ভাই, এ হচ্ছে মোহনা। আমার গার্লফ্রেন্ড। টপ ফ্যান হওয়ার পেছনে এই মেয়েটার যথেষ্ট অবদান আছে। সে না থাকলে আমি ফেসবুকে এত টাইম দিতাম না। আমার আর টপ ফ্যান হওয়াটাও হত না।” নাফিস এবার আমাকে মোহনার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে লাগল, “মোহনা, এ হচ্ছে আমার গুরু মুহিত ভাই। ভাই আমার ফেসবুক আইডি খুলে দিয়েছিল বলেই আজ আমি টপ ফ্যান হতে পেরেছি। শুধু তাই না, আমার আইডি বেশ কয়েকবার নষ্টও হয়ে গিয়েছিল। ভাই ঠিক করে দিয়েছে। এছাড়াও ভাই আমাকে এটা-সেটা বিভিন্ন বিষয়ে সাহায্য করে।” আমি মোহনার দিকে তাকালাম। মোহনা আমাকে চোখ টিপ দিল। আমি বুঝে গেলাম মোহনা মেয়েটা চালাক। নাফিসের মত হাবাগোবা কেউ না। নাফিসের এসব বোকামি কান্ডকারখানা সম্পর্কেও যে সে অবগত, এটাও কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গেলাম।

খাবারদাবার শেষ হতেই আমি বললাম, “তোমরা বসে গল্প করো। আমি উঠি। আমার একটু জরুরি কাজ আছে।” মোহনার দিকে চোখ পড়তেই সে আবার চোখ টিপ দিল। আমার ভেতরটা গুলাতে শুরু করল। এই চোখ টিপটাও কি সে যে নাফিসের বোকামি কাণ্ডকারখানা বুঝতে পারছে সে জন্য, না-কি অন্য কোন উদ্দেশ্যে? আমি জোর পায়ে হাঁটতে শুরু করলাম। কিছুদূর গিয়েই একজন মহিলার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে ফ্লোরে পড়ে গেলাম। তড়িঘড়ি করে উঠে যেই স্যরি বলতে যাব, ওমনি খেয়াল হলো আরে এ তো নাফিসের মা। আন্টি বোধহয় দেখেশুনে চলাফেরা করতে পারো না টাইপ কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। আমাকে চিনতে পেরেই আটকে গেলেন। “কি ব্যাপার বাবা, তুমি এখানে?” আন্টিকে কিছু না বলেই আমি পেছনে দৌড়াতে লাগলাম। নাফিস-মোহনার টেবিলের সামনে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললাম, “নাফিস আন্টি আসছে।”

– আন্টি! কোন আন্টি?
– তোর আন্টি। আই মিন তোর মা।
– কি বলো ভাই, আম্মু এত তাড়াতাড়ি চলে আসছে?
– তাড়াতাড়ি মানে! আন্টি যে আসবে তুই এটা জানতি?
– হু ভাই, জানতাম।

আমিই তো আম্মুকে ফোন করে এখানে আসতে বলেছি। আমার টপ ফ্যান হওয়ার পেছনে আম্মুর বিশাল অবদান আছে। ডাটা কেনার টাকাতো আব্বুর কাছ থেকে আম্মুর মাধ্যমেই আমার কাছে আসত। আমি আর মোহনা নাফিসের দিকে হা করে তাকালাম। জীবনে অনেক বড় বড় পাগল দেখেছি কিন্তু নাফিসের মত এত বড় কোন পাগল দেখেছি কি-না দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম।

– আচ্ছা, সে যাই হোক, তুই যে মোহনার সাথে প্রেম করিস, আন্টি এটা জানে?
– না ভাই।
– খাইছে! আজ তোর খবর আছে।

আমি মোহনাকে বললাম, “মোহনা, তুমি তাড়াতাড়ি টেবিলের নিচে লুকাও।” নাফিস খপ করেই তার গার্লফ্রেন্ডের হাত ধরে ফেলল। “না মোহনা, তুমি একদম লুকাবা না। আমি কোন কাপুরুষ না।” ততক্ষণে আন্টি চলে এসেছেন। আন্টি এসেই শক্ত করে নাফিসের চুলমুটি ধরে ফেললেন। নাফিস ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে। আন্টি কথা বলছেন, “বলেছিলাম দোকান থেকে চিনি এনে দিতে, বললি তুই কালের বিবিসি বাংলার টপ ফ্যান, কারো ঘরের চাকর না।

এখন এখানে কার চাকরি করতে আসছিস? আদর পেয়ে পেয়ে একেবারে মাথার উপরে উঠে বসেছিস। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!” ইয়া ঢিশুম ঢিশুম আমি অনেক কষ্টে আন্টিকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। মার খাওয়ার পরেও নাফিসের কোন ভাবান্তর হলো না। সে হাসি মুখেই চেয়ারে বসে আছে। তার চেহারা দেখে মনে হলো, সে খুব মজা পাচ্ছে। নাফিস ওয়েটারকে ডাক দিল। “আম্মু, বলো কী খাবে?” আন্টি কী খাবেন সে ব্যাপারে কিছু না বলেই মোহনার দিকে তাকালেন, “এই মেয়েটা কে?” মোহনা যে নাফিসের গার্লফ্রেন্ড আন্টি যদি এখন এ ব্যাপারে কিছু জানতে পারেন তাহলে নাফিসকে যে কি করবেন একমাত্র উপরওয়ালাই জানেন। নাফিস বোধহয় ‘আমার গার্লফ্রেন্ড’ বলতে চাইছিল।

আমি নাফিসের মুখ চেপে ধরলাম। “আন্টি, এটা আমার বোন মোহনা।” একথা বলেই আমি মোহনার হাত ধরে টান দিলাম। “মোহনা চল, আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।” রেস্টুরেন্টে বাইরে এসে মোহনাকে স্যরি বলতে গেলাম। মোহনা আমার মুখ চেপে ধরল। “প্লিজ স্যরি বলবেন না। আপনার মোবাইলটা বের করেন।” খানিকটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগতে ভোগতে পকেট থেকে আমি আমার মোবাইলটা বের করে মোহনার হাতে দিলাম। মোহনা তার ফোন নম্বর দিয়ে আমাকে একটা চোখ টিপ দিল। দ্বিতীয় বারের মত আমার ভেতরটা গুলাতে শুরু করল!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত