-মা তোমার নাম কি? আমার মেয়ে মাথা নিচু করে জবাব দিল জান্নাতুল ফেরদাউস (মৌসুমি)।
– জান্নাতুল ফেরদাউস তো সুন্দর নাম সাথে আবার মৌসুমি লাগাল কেন? বলেই ছেলের বাবা বিরক্ত মাখা মুখ নিয়ে আমার বড় আপার দিকে তাকালেন।
– তা , মা তুমি পড়ালিখা কি করছ?রান্না করতে পারো?
– জি রান্না করতে পারি ,আমি ইডেন থেকে ইংলিশ এ অনার্স করছি ।
– ও! আমার ছেলে তো অর্থনীতিতে অনার্স – মাস্টার্স দুটোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করেছে বলেই আবার মুখ কুচকালেন, তুমি কি আরবি পড়তে আর লিখতে পার?
– জি পড়তে পারি কিন্তু লিখতে পারি না। উনি যেন খুবই নিরাশ হলেন এমন ভাব করে আবারও বড় আপার দিকে তাকালেন । আমার মেজাজ সপ্তমে উঠে গেল খুবই কষ্ট করে নিজেকে ঠিক রাখলাম ।
– আচ্ছা মা, সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত আমাকে পড়ে শুনাও তো আমার মেয়ে অসহায় চোখে আমার দিকে তাকাল আমি বললাম বল মা ভয়ের কিছু নেই। আমার দিকে তাকিয়েই আমার মেয়ে তেলয়াত করে শুনাল । ছেলের বাবা এবার যেন একটু খুশী হলেন নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন মুরাদের মা আমার আর কিছু জানার নেই তোমার কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞাসা করো। সাথে সাথে ছেলের চাচী অথবা মামি এই টাইপের কিছু হবেন বসা থেকে উঠে মেয়ের পাশে এসে বললেন দেখিতো তোমার চুল কতো বড়? বলেই নিজেই মৌসুমির মাথার কাপড় সরিয়ে চুল খুলে দেখে বললেন চুলও বড় আছে মাশাল্লাহ ।
আমি এইবার অনেক কষ্ট করে মুখে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে বললাম কেন আপা ছোট চুলের মেয়ে আপনাদের ছেলেকে বিয়ে করাবেন না? উনি তাড়াতাড়ি বলেলেন চুল ছোট মানে মেয়ে পার্লারে যায়, আর পার্লারে যাওয়া মেয়েরা বিশেষ সুবিধার হয় না , শুধু সাজ-সজ্জার দিকেই মন থাকে । আমি বললাম আর কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না মৌসুমিকে ভিতরে নিয়ে যাবো? ছেলের বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন আহ! মৌসুমি বলে ডাকেন কেন? জান্নাত বলে ডাকবেন শুনতেও ভালো লাগে আমি অবাক হয়ে উনার দিকেতাকালাম কি বলে এই লোক! মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য এখন মেয়েকে ছেলের পরিবারের পছন্দ করা নামেডাকতে হবে! বড় আপা আমাকে চোখের ইশারায় কিছু না বলতে বললেন। আমি মৌসুমিকে নিয়ে ভিতরে চলে গেলাম যাবার সময় লক্ষ্য করলাম ঐ মহিলা মেয়ের পায়ের দিকে তাকিয়ে আছেন তারমানে পা ঠিক আছে কিনা দেখছেন আমি ইচ্ছা করে মৌসুমির শাড়ি একটু উপরে তুলে দিলাম যাতে উনি ভালো করে আমার মেয়ের পা দেখতে পারেন। মেয়ে আমার ঠিকই বুঝতে পারলো ঘটনা কি।
ভিতরের রুমে আসতেই মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর মুখ অপমানে লাল হয়ে গেছে। আমার এই মেয়েকে আমি অনেক আদরে বড় করেছি ওর যখন চার বছর বয়স সে সময় ওর বাবা মারা গেছেন । সবাই আমাকে বলেছিল আরেকটা বিয়ে করতে কিন্তু আমি চিন্তা করেছি যদি আরেকটি বিয়ে আমি করি তাহলে আমার মেয়েটি হয় আমার বাবা-মার কাছে বড় হবে নয়তো ওকে আমার সাথে অন্যর বাড়িতে গিয়ে থাকতে হবে, মেয়ে নানার বাড়িতে থাকলেও ওর মন ছোট করে থাকতে হবে মামিরাওকে আপদ মনে করবে আর অন্য একজনের বাড়িতে গিয়ে থাকলে কি হবে সেটা তো জানা কথা। আমার মেয়ে যেন কখনো কোথাও অপমানিত না হয় আমি সব সময় সেই দিকে খেয়াল রাখতাম ।
আমার মনে আছে একবার ও ক্লাস সিক্স এ পড়ার সময় পাশে বসা মেয়ের সাথে কথা বলার অপরাধে ওর ক্লাস টিচার বেত দিয়ে ওকে এতো জোরে হাতে বাড়ি দিয়েছিল যে মেয়ের আমার বিকালেই জ্বর এসে গিয়েছিলো । আমি পরের দিনই থানায় গিয়ে ঐ টিচারের নামে কমপ্লেইন করেছি । আমার মেয়েকে কষ্ট করে আমি বড় করবো আর সামান্য অপরাধে অন্য মানুষ ওর গায়ে হাত তুলবে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারিনি। আমার মনে হয় কোন বাবা-মাই এটা মেনে নিতে পারবে না। আমি মৌসুমিকে বিয়ে দেয়ার ব্যাপারেও এখন রাজি ছিলাম না। কিন্তু বড় আপা এসে বললেন আরে ওরা দেখুক না দেখলেই কি বিয়ে হয়ে যায়?
আর যদি হয় তা হলে তুই অমত করিস না ছেলে খুব ভালো পরিবার খুবই শিক্ষিত । ওরা মৌসুমিকে লিখা পড়া করাবে বলেছে। কিন্তু শিক্ষিত পরিবারের মন মানুষিকতা যে এতটা ছোট তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার মনে হল গরুর হাটে গরু কিনতে গেলেও আমরা এতো কিছু দেখিনা আর ওরা তো ওদের পরিবারের বউকে দেখতে এসেছে । যেই পরিবারে বিয়ের আগেই এতো অসন্মান বিয়ের পরের অবস্থা তো বুঝাই যায়। আমি মেয়েকে রেখে ড্রইংরুমে আসতেই ছেলের বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে এখন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করেন তবে আগেই আপনাদের একটা কথা বলে নেই আমাদের কোন দাবি দাওয়া নেই কিন্তু আপনারা আপনাদের মেয়েকে খুশী হয়ে কিছু দিতে চাইলে আমরা কোন আপত্তি করবনা।
কিন্তু আমার ভাই পরিবার অনেক বড় আর আমার এটাই একমাত্র ছেলে তাই সবাইকে বলতে হবে মেহমান কিন্তু বেশি হবে ঐ ব্যাপারে আপনারা কিছু বলতে পারবেন না। আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম ভাই সাহেব এই সব কথা পরে হবে আগে আসুন খাবার খেয়ে নিন। খাবার দাবার শেষ করে আমি এসে ছেলের পাশে বসলাম তারপরে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললাম মুরাদ তুমি নামায পড় ? মুরাদের বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন আমার ছেলে আল্লাহর রহমতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযই পড়ে আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম আপনি যখন আমার মেয়েকে একের পর এক প্রশ্ন করেছেন আমি কোন কথা বলেছি? আপনাদের যেমন আমার মেয়ের সম্পর্কে জানার ছিল আপনারা জেনেছেন ঠিক তেমনি আমারও ছেলের সম্পর্কে জানতে হবে তা মুরাদ তুমি কি কথা বলতে পারো না ? না , মানে এতক্ষন তোমাকে কোন কথা বলতে শুনলামনা তো তাই জিজ্ঞাসা করলাম ছেলে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল না অ্যান্টি আমি কথা বলতে পারি।
– তা তুমি যখন সব নামাযই পড় তাহলে আমি তোমাকে সহজ একটা প্রশ্ন করি বাবা, নামাযের দুই সেজদার মাঝখানে যে দুয়াটি পড়ে তা একটু আমাকে শুনাও তো এইবার ছেলে অসহায় চোখে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল ছেলের বাবা তাড়াতাড়ি বললেন দুই সেজদার মাঝে কি দুয়া পড়তে হয়? এইসব আপনি কি বলেন? এইবার আমি মহা বিরক্ত হয়ে আপার দিকে তাকিয়ে বললাম কিরে আপা তুই না বললি এরা খুব পরেহেজগার এখন দেখি এই সামান্য জিনিসও জানা নেই ।
– ভদ্রলোক রেগে গিয়ে বললেন আপনি এইটা দিয়ে কি করবেন? আমার ছেলে কতো বেতন পায় কিসে চাকরি করে সেই সব জানেন ।
– আমার যদি এইটা জানার দরকার না থাকে তাহলে আমার মেয়ে সূরা হাশরের শেষ তিন আয়াত পারে কিনা সেটা আপনি জানতে চাইলেন কেন?
– সেটা জানতে হবে না , ভবিষ্যতে আমার নাতি নাতনি হলে ওদেরকে শিখাতে হবে না?মা যদি না জানে তাহলে ছেলে মেয়েকে শিখাবে কি করে?
– তা ছেলে মেয়েকে শিক্ষা কি শুধু মা ই দিবে? আপনার ছেলে দিতে পারবে না? নাকি আপনার ছেলে এইটাও পারে না ?আমার মেয়ে ইডেনে পড়ে শুনে আপনি মুখ এমন ভাবে কুচকে ফেলেছিলেন যেন ইডেন কোন পড়ার জায়গাইনা । ভাইরে এমন অনেক বড় বড় মানুষ আছে যারা নামকরা কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হয়নি। কি আছে না? এইবার আমি মহিলাদের দিকে তাকিয়ে বললাম এই যে আপা আপনি যে বললেন পার্লারে যাওয়া মেয়েরা সুবিধার হয়না , আপনার ওত দেখি ভ্রু প্লাগ করা তারমানে আপনিও পার্লারে যান কি যান না? নিজেদের বেলায় সব জায়েজ আর বউদের বেলায় সব নাজায়েজ তাই না? আমাদের দেশে এখন অনেক মেয়ে আছে যারা সংসার সামলায় , চাকরি করে আবার নিজেদের ও সুন্দর রাখে । আর সাজ সজ্জা তো মেয়েদের জন্যই,মেয়েরা সাজলে যদি সংসারে মন না থাকতো তাহলে কোন সংসারই টিকে থাকতো না । কারন সব মেয়েরাই সাজে।
বড় আপা বারবার আমাকে থামাতে চাইছিলেন কিন্তু আমার মনে হল এই কথাগুলো এদের মত মানুষের জানা দরকার।আমি বড় করে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম আপনাদের আমার মেয়ে পছন্দ হয়েছে কিন্তু আমার আপনাদের কাউকেই পছন্দ হয়নি । আপনারা আসতে পারেন । ছেলের বাবা বড় আপার দিকে তাকিয়ে বললেন আপনি জানেন কতো মেয়ের বাবারা আমার ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ে আছে? আমার ছেলে কতো বড় চাকরি করে? কতো মেয়েকে দেখিয়েছি কিন্তু ছেলের পছন্দ হয়নি বলে বাদ দিয়েছি আর আপনার বোন আমাদেরকে কি ভাবে অপমান করলো, এতো যদি অহংকার থাকে কখনই মেয়েকে বিয়ে দিতে পারবেনা। এই মেয়েকে ঘরে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে হবে
– ভাই সাহেব আপনি কিন্তু ভুল করছেন আমি আপনাদের কোন অপমান করিনি । এই যে আপনি বললেন আপনার ছেলে অনেক টাকা বেতন পায় আশা করি আমার মেয়েও পড়া শুনা শেষ করে ভালো বেতনের চাকরি করতে পারবে।আপনারা এর আগেও অনেক মেয়ে বাদ দিয়েছেন তারমানে সব মেয়েদের আপনারা আমার মেয়ের মত অপমান করে এসেছেন ওদের বাবা মা আপনাদের কিছু বলেনি কিন্তু বলা উচিত ছিল ।
আমার মেয়েকে আমার সামনে আপনারা অপমান করে যাবেন আর আমি খুশী হয়ে মেয়ে বিয়ে দিয়ে দিবো যাতে আমার মেয়েকে আপনারা আরও অপমান করতে পারেন আমি সেই মা না । যে ছেলে আমার মেয়েকে গরুর মত না দেখে মানুষের মত দেখে পছন্দ করবে সেই ছেলের কাছেই আমি মেয়ে বিয়ে দিবো। আর যদি বলেন অহংকারের কথা তাহলে বলবো হ্যাঁ আমি অহংকারী কারন আমি কন্যা সন্তানের মা । আল্লাহ খুশী না হলে কাউকে কন্যা সন্তান দেয় না জানেন নিশ্চই । রাগে গজ গজ করতে করতে সবাই বের হয়ে চলে গেলেন। আমার কন্যা দৌড়ে এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।