আজ ৭ বছর পরে মানুষ টাকে দেখে চিনতে সাজিদের একটুও কষ্ট হয়নি। মাত্র ২ ঘন্টায় যেই মানুষ টা সাজিদ কে ছেলের আসনে বসিয়ে নিজের জীবনের গল্প গড়গড় করে বলেছিল তাকে এত সহজে সাজিদ কেমনে ভুলবে?
গুটিগুটি পায়ে হাসপাতালের কেবিনের ভেতর প্রবেশ করল সাজিদ। বেডে শোয়া অবস্থায় রাজেদা আন্টির কঙ্কালসার শরীর দেখে আপনা আপনি চোখে জল চলে আসলে তাড়াতাড়ি করে সেটা লুকিয়ে ফেলে সাজিদ। বেডের পাশেই মলিন মুখে মাথায় কাপড় দেয়া অবস্থায় ২৫ কি ২৬ বছর বয়সী মেয়েকে দেখতে পেল সাজিদ। চোখের নিচে তার কালি আর ফর্সা মুখটার উপরে কেমন যেন কালচে দাগ পড়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে কতদিন সে মুখে সাবান স্নো ব্যবহার করা হয়নি।
—স্যার, পেসেন্টের অবস্থা বেশি ভালো না। এই যে রিপোর্ট। কথাটা নার্স জেসমিন সাজিদের কানের কাছে এসে বলল।
সাজিদের মুখ টা শুকে গেল। বুকের মধ্যে একটা চাপা ব্যথা অনুভব করল। মেয়েটা বুঝি জেসমিনের বলা কথাটা শুনে ফেলেছে তাই হঠাৎই মেয়েটার দিকে তাকাতেই সাজিদ দেখতে পেল তার চোখ থেকে পানি পড়ছে।
—আম্মা বাঁচবে না তাই না?? মেয়েটা কান্নামিশ্রিত কন্ঠে বলল।
অনু! সাজিদ অবাক হয়ে যায়। তারমানে এই সেই অনু, রাজেদা আন্টির একমাত্র মেয়ে? সাজিদ ভাবছে। অনু ওর মায়ের মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে নিঃশব্দে কান্না করছে। রাজেদা আন্টির কোন হুস নেই। উপরের দিকেই চেয়ে আছেন অপলকে। সাজিদ ৩০৪ নাম্বার রুমের রাজেদা বেগমের কেবিন থেকে সোঁজা নিজের রুমে চলে এসেছে। চেয়ার টেনে চুপচাপ বসে রইল। চোখ বন্ধ করে চলে গেল ৭ বছর আগের সেই সময় টাতে। সাজিদ বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। ছোট থেকে উচ্ছৃঙ্খল আর জেদি প্রকৃতির ছেলেটাকে বাবা আতিক হোসেন আর মা জয়নাব বেগম নিজেদের চায়তেও বেশি ভালোবাসতেন। তবে হাঁপানি রোগের কারণে মায়ের ভালোবাসা টা ৮ বছরে এসেই থেমে গিয়েছিল। মারা যাওয়ার আগে মা সাজিদের পুরো দায়িত্ব বাবা আতিক হোসেনের উপরে দিয়ে গেলেন।
পুরুষ মানুষ আর যাই হোক জগতের সব কিছু উদ্ধার করতে পারলেও মাতৃত্বের যে ভালোবাসা সেটা দেওয়ার ক্ষমতা অর্জণ করেনি। আসলে পায় নি। কারণ সৃষ্টিকারী সেই ভালোবাসা টা একমাত্র মায়েদের জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। তাই পুরুষ মানুষ হাজার টা যুদ্ধ জয়, বাহ্যিক সংগ্রাম, জীবন যুদ্ধ জয় করতে পারলেও এটা তারা কখনই পারবে না। আতিক হোসেন ৮ বছরের অশান্ত ছেলে সাজিদকে নিয়ে খুব চিন্তায় থাকতেন। এমন ছেলেকে তিনি কিভাবে সামলাবেন এই নিয়ে সবসময় ভাবতেন। এক পর্যায়ে ছেলে সাজিদের ভালোর কথা ভেবে আতিক হোসেন ২য় বিবাহের কথা চিন্তা করেন। কিন্তু ওনার ভাবনাতে জল ঢেলে দেয় ওনারি ছেলে সাজিদ।
মায়ের মৃত্যুতে আচঙ্কা সাজিদ বদলে যায়। উচ্ছঙ্খল আর অশান্ত ছেলেটাকে দেখে কেউ ভাবতেও পারতো না যে এটাই সেই সাজিদ। বাবার একদিকের চিন্তার অবসান ঘটলেও অন্যদিকে আবার নতুন করে চিন্তা উদয় হয়েছিল যে, তার ছেলের এতটা চুপচাপের প্রভাব যদি পরবর্তী জীবনে কোন নেগেটিভ প্রভাব ফেলে?? মাকে প্রচন্ড পরিমানে ভালোবাসতো সাজিদ। তাই কল্পনায় সাজিদ ওর মায়ের সাথে কথা বলতো। যখন কল্পনায় ওর মা আসতো তখন ও অনেক হাসিখুশি থাকতো কিন্তু কল্পনায় মা চলে গেলেই গেলেই সাজিদ চুপচাপ হয়ে যেত। মায়ের জন্য তখন খুব কষ্ট হত। সাজিদের সেই বিভীষিকাময় দিনগুলো থেকে পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পুরো ৩ বছর সময় লেগে যায়।
১২ বছর বয়সে সাজিদ কে ক্লাস ৪ এ এডমিট করায়ে দেয় বাবা আতিক। সাজিদ এখন আর আগের মতো নেই। হাসিখুশি, তবে আগের চায়তে দুষ্ট নেই। ক্লাস ছাড়াও কলোনির প্রতিটা মানুষের অন্তরে একটা নামি ছিল আর সেটা ছিল সাজিদ। ভদ্র, স্বল্পভাষী, হাসিখুশি ছেলেটাকে কেই না পছন্দ করে?? যে পছন্দ করতো না সেও সাজিদের সংস্পর্শে এসে কেমন যেন বদলে যেত।
একবারের এক ঘটনা, এলাকার বখাটেদের লিডার আদি। চোখে চশমা, পরণে স্ট্যাইলিং টি শার্ট পড়ে পুরো কলোনিতে দাঙ্গা করে বেরাতো আদি। আদিকে দেখে অন্য সকলে ভয় পেলেও সাজিদ কখনো আদিকে ভয় পেত না। কারণ, সাজিদ আদিকে অন্য সব মানুষের মতো সাধারণ মানুষ হিসেবে ভাবত। ব্যাপার টা খেয়াল করত আদি। ছেলেপুলে লাগিয়ে দেয় সাজিদের পিছে। ছেলেপুলে এসে খবর দেয়, বস আপনারে দেখে তো হেই কোন সম্মানি দেয় না। দেখেন না পাশ কাইটা চইলা যায়। যেখানে অন্যরা আপনারে দেখে ডরায় সেখানে ওই হালায় আপনারে কিছুই মনে করে না। বুজ্জেন কত্ত বড় বেয়াদপ।
আদি ঐদিনেই সাজিদের পথ আগলে ধরে। এসএস সি পরীক্ষা সামনে। তাই পড়ার প্রচুর চাপ। বিকেলে কোচিং শেষেই বাসায় ফিরছিল সাজিদ। কোচিং নিয়েও কাহিনি আছে। কোচিংয়ের খরচের টাকা বাবা আতিকের কাছে ছিল না। তাই কোচিং বাদ দিয়ে নিজ আত্মবিশ্বাস নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেছে ঠিক তখনি জিসান ভাইয়ার সাথে একদিন সাজিদের দেখা। জিসান ভাইয়া সাজিদ কে বলল, তুই আমায় তোর ব্যাচের কয়েকজন স্টুডেন্ট যোগার করে দে, আমি তোকে ফ্রি কোচিং পড়াবো। সাজিদের কাছে এটা ছিল অনেক বড় একটা সুযোগ। কারণ জিসান ভাইয়া ছিলেন অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট আর অনেক ভালো একজন মানুষ তাই তার কাছে পড়তে কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। আর ক্লাসের স্টুডেন্ট যোগার করা সাজিদের দু মিনিটের ব্যাপার ছিল। কারণ ক্লাসের ফাষ্ট বয় সাজিদের কথা ফেলার মানুষ ছিল খুব কম।
যাহোক, জিসান ভাইয়া বলেছিল ১০,১৫ জন স্টুডেন্ট এর কথা। কিন্তু সাজিদ বলাতে ক্লাসের পুরো স্টুডেন্ট ই জিসান ভাইয়ার কাছে পড়তে শুরু করে। এদিক দিয়ে সাজিদের লাভ আর ক্ষতি দুটোই হয়েছিল। লাভ হিসেবে ছিল, জিসান ভাইয়ার কাছে ফ্রি পড়ার সুযোগ আর অতিরিক্ত স্টুডেন্ট যোগার করার দরুণ সাজিদ কে জিসান ভাইয়া কিছু টাকা হাতখরচের জন্য দিত।আর ক্ষতি হিসেবে ছিল ক্লাসের টিচার রা যাদের কাছে স্টুডেন্ট সকলে প্রাইভেট পড়তো তারা সবাই টিচারদের ছেড়ে জিসান ভাইয়ার কোচিংয়ে যেত বলে কিছু স্যারদের চোখে সাজিদ খারাপ হয়ে যায়।
সেটা নিয়ে সাজিদ কখনোই মাথা ঘামাত না। ও ভাবত এক্সাম দিলেই তো স্কুলের মায়া শেষ। স্যারদের কে আর আমার জন্য কষ্ট পেতে হবে না। সেদিন জিসান ভাইয়ার কাছ থেকেই সাজিদ কোচিং শেষে বাসায় ফিরছিল। প্রতিমধ্যে আদির দল এসে সাজিদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। সাজিদ সাইড কাটতে গেলে, আদি এসে সাজিদের সামনে দাঁড়ায়। সাজিদ পুনরায় সাইড দিতে গেলে আদি সাজিদের কলার চেপে ধরে।
—তোর এত্ত বড় সাহস। তুই আমারে সম্মান দিস না। ভয় করোস না। এত্ত সাহস কত্তে পাস ক??
–সাজিদ সহজ ভাবে উত্তর দেয়, ভাই, আমি আপনাকে যথেষ্ট সম্মান দেই জন্য আপনার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় চোখ নামিয়ে যাই। আর ভয়ের কথা বলছেন? দুঃখিত ভাই৷ এটা আমি আপনাকে দেখে একটুও পাই না।
–দেখছেন ভাই হালায় কয় কি?? আপনের সামনেই তো প্রমাণ হইলো দেখলেন??
—তুই আমারে ভয় পাস না কে?? আমার এই লাঠির বারি কি খাওয়োনের পর ভয় পাবি আমারে??
–আপনারে আমি ভয় পাবো কেন ভাই?? আপনিও যার সৃষ্টি আমিও তারই সৃষ্টি। আপনার হাত পা মস্তিষ্ক বুদ্ধি সব আছে, আমারো আছে। আপনার মাথায় শুধু দুষ্ট বুদ্ধি আছে আর আমার মাথায় আল্লাহর ভয় আছে। পার্থক্য শুধু এটাই। আদি চুপ করে থাকে।
–আমি আপনাকে না আপনার আমার আমাদের রব, আল্লাহ কে ভয় পাই। আপনি আমায় মেরে হাত পা ভেঙে দিতে পারেন কিংবা একদম জানেও মেরে ফেলতে পারেন সমস্যা নাই। কিন্তু তাতে আমিতো জাহান্নামে যাব না ভাই। বরং আপনি পাপ করবেন আপনিই তার সাঁজা হিসেবে জাহান্নাম পাবেন। আদি সাজিদের কলার ছেড়ে দেয়। তারপর হুড়মুড় করে গলির ভেতর চলে যায়। এরপর থেকে সাজিদকে আদি আর কখনোই বিরক্ত করেনি বরং সাজিদের সাথে দেখা হলে সাজিদ কেমন আছে? পড়াশোনা কেমন করছে? এগুলোই জানতে চায়তো। সাজিদ খুশিমনে আদির সমস্ত কথার জবাব দিত। এইভাবেই প্রতিটা মানুষের অন্তরে সাজিদ নামটা গেঁথে গেছিল।
মাকে হারানোর কষ্টটাকে দূর করার জন্য হয়তো মালিক, সেই ছোট্ট সাজিদ কে এতটা মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। আস্তে আস্তে করে সাজিদ স্কুল লাইফ শেষে কলেজ লাইফে পা দেয়। কলেজের টিচারগুলোর একটাই কথা, সাজিদ, মনোযোগ দিয়ে পড়বা বাবা। তোমাকে মেডিকেলে চান্স পেতেই হবে। সাজিদ স্যার দের কথামতো পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতো সবসময়। কিন্তু হঠাৎই সাজিদের জীবনে পুনরায় কালো অধ্যায় এসে ধরা দেয়।
বাবা আতিক হোসেন অতিরিক্ত মাত্রায় ফুঁলে উঠেছেন ক দিনে। ব্যাপার টা সাজিদের কাছে ভালো ঠেকছিল না। বাবা আতিক হোসেন কে ডাক্তার দেখাতে বললেও সংসারের দূর্বস্থার জন্য যাব যাব বলেও তিনি যেতেন না। একদিন সাজিদ জোর করেই বাবাকে নিয়ে হাসপাতালে যায়। এবং সেখানে কিছু পরীক্ষা শেষে রিপোর্ট আসে আতিক হোসেনের দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে। কথাটা শুনতেই সাজিদ পড়ে যেতে নিলে বাবা আতিক হোসেন, সাজিদ কে ধরে ফেলে। সাজিদ বাবার দিকে তাকাতেই বাবার মুখে মুচকি হাসি আর কোন চিন্তাবিহীন মুখ দেখতে পায়। বাসায় এসে সাজিদ রুমে একা কান্না করে। মাকে হারিয়ে তো কান্নাটাও করতে পেরেছিল না। এখন বাবাকে কয়েক দিন পরেই হারাবে, ও থাকবে কেমনে বাবাকে ছাড়া?? বাবা আতিক হোসেন সাজিদের রুমে এলে সাজিদ দ্রুত নিজেকে লুকিয়ে ফেলে।
–কি করছিস বাবা??
–ক কিছুনা বাবা।
–আমায় একটু সময় দিবি?? আজ নাহয় না পড়লি।
বাবার এমন আবদার সাজিদ কিভাবে ফেরাবে?? কখনোই ফেরাতে পারবে না। বাপ আর ব্যাটা মিলে বারান্দায়ে বসে আছে চুপচাপ। কালো মেঘ মাঝে মাঝে চাঁদ টাকে আড়াল করছে তো পুনরায় তার আলোতে দুজন কে মাখামাখি করে দিচ্ছে। যাহোক কিছুসময়টা এভাবেই নিরবতার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। নিরবতা ভাঙ্গল সাজিদের বাবা।
–আমি না থাকলে তোর কষ্ট হবে না সাজিদ?? সাজিদের বুকের ভেতরটার কলিজায় কেউ একজন আঘাত করল। খুব জোরে করে। কান্না টাও করতে পারছে না সাজিদ।
–তোকে ছেড়ে যেতে আমার ইচ্ছে করছে নারে বাবা। এই হাতে তোরে না খাওয়াইলে আমার শান্তি লাগত না। তুই নিজেও তো এখন অবধি নিজের হাতে খাস না। কাল থেকে নিজে নিজে খেতে শিখবি কেমন?
–এত সহজেই পর করে দিচ্ছ বাবা?? এই তোমার ভালোবাসার নমুনা?? বাহ
আতিক হোসেন ছেলেকে ধরে কান্না করে দেয়। আর বলতে থাকে, আমার কলিজা তুই বাবা। তোরে ছেড়ে যাব কেমনে বল?? তোর মাকে দেয়া কথাটা আমি রাখতে পারলাম নারে। আমায় মাফ করে দিস বাবা। সাজিদ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। কান্না করে দিয়েছে। রাত টা বাবা আর ছেলের চোখের জলেই কেটে গিয়েছিল যার সাক্ষী ছিল দূর আকাশের আধাখানি চাঁদ।
এরপর থেকে আতিক হোসেনের অবস্থা ক্রমাগত খারাপ হতে থাকে। ডায়ালাইসিস করতে যেই টাকা লাগে সেটা সাজিদের কাছে ছিল না। তবে বাবার ব্যাংকে জমিয়ে রাখা সাজিদের জন্য কিছু টাকা ছিল যেটা বাবাকে না জানিয়েই সাজিদ উঠিয়ে এনে দুবার ডায়ালাইছিস দিয়েছিল। এত কষ্টের মাঝে সাজিদের এইসএসসি এক্সাম টা শেষ হয়ে যায়।
পরীক্ষা শেষে একদিন বাবাকে নিয়ে ট্রেনে চেপে বসে সাজিদ। উদ্দেশ্য, বাবাকে নিয়ে ঢাকা মামার বাসায় যাবে। ওখান থেকে মায়ের সম্পত্তির কিছু অংশ বিক্রি করে বাবার চিকিৎসা করাবে। ট্রেনে কানড়াই ডানদিকের সিটে বসে পড়ে সাজিদ আর ওর বাবা। সামনের সিটে একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা বসে আছেন। ওনার শারীরিক অবস্থা ছিল এমন, গোলগাল মুখ, চোখ, হাত দুটো গোল বেলুন এমনকি গোল চশমা মিলে পুরো গোল বাদাম যেন বসে ছিল। সাজিদ বিষয় টাই ভাবছিল। সাজিদের চিন্তার অবসান ঘটালেন মহিলাটি নিজেই।
–কই যাইতেছ বাজান??
–ঢাকা যাচ্ছি আন্টি। পাশে বাবার দিকে তাকিয়ে মহিলাটি সাজিদকে পুনরায় প্রশ্ন করল, ইনি তোমার কে হয়??
— আমার বাবা।
—অসুস্থ??
—জ্বি।
–আল্লাহ, রক্ষা করুক আমিন।
–সুম্মা আমিন।
এই সেই বলতে বলতে সাজিদ কে এক এক করে নিজের জীবনের সমস্ত ঘটনা ভদ্রমহিলা বলতে লাগলেন। ওনার বাবার বাড়ি চাটমোহর, পাবনা। বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে শুভর সাথে ১৮ বছরের মেয়ে অনুর বিয়ে দিয়েছেন তিনি। ওনার এ বিয়েতে কোন মত কখনোই ছিল না। মেয়ে জামাই নাকি একে অপরকে পছন্দ করতো সেই হিসেবেই বিয়েটা দেওয়া। মহিলাটি আক্ষেপসূরে বললেন, আত্মীয়ের মধ্যে কোন সম্পর্কে যাইতে চাইনি বুঝলা বাবা। এক নতুন মুখদের আত্মীয় বানাইতে চাইছিলাম। কিন্তু আমার মেয়ে টা সব কিছু জলে দিয়েছিল। সাজিদ চুপচাপ শুনছে। ওদিকে আতিক হোসেন ঘুমিয়ে পড়েছেন। মহিলাটি বলেই চলেছেন, মেয়েটি এর জ্বালা টের পেয়েছে বুঝলা বাবা। সাজিদ উৎসুক হয়ে বলল, ক্যান আন্টি কি হয়েছে??
ভাইয়ের ছেলে শুভ ছেলেটা ভালা না। কয় দিন পরেই জুয়া খেলে এসে আমার মাইয়াডার উপরে নির্যাতন করতো। আর আপন মানুষ হয়েও যৌতুকের জন্য দাবি দাওয়া করত। সব পূরণ করলেও আমার মেয়ে অনুরে কষ্ট থেকে বেরোতে দিত না। শেষে আবার ৩ লাখ টাকা চেয়েছে শুভ। না হলে নাকি মাইয়াডারে আমার মাইরা ফালাইবো। পুলিশ কেস করতে চাইছিলাম কিন্তু কোন লাভ হবে না কারণ শুভর মামা ছিলেন ওই এলাকার এস আই। তাই যাই করতাম সেডা নাকি ধামাচাপা দিতে ওদের সময় লাগত না। তাই বলেছিল।
–এখন কি করবেন??
–টাকা নিয়া যাইতেছি বাজান। তয় পুরোডা না। মাইয়াডা তাও সুখে থাক। কথাটা মহিলাটি সাজিদের কানের কাছে এসে বলল।
আরো কিছু কথা বলার পরে মহিলাটি সাজিদের কাছে টাকার ব্যাগ টা দিয়ে বলল, বাবা, আমি মানুষ টা বড্ড মনভুলা। সবকিছু ভুইলা যাই। তোমার কাছে এইডা রাখো আমি এই পরের স্টেশনে নাইমা যামু আমারে একটু মনে কইরা দিও।
–কিন্তু আন্টি??
–না কইরো না বাজান। এই ভুলোমনার লাইগা একবার ৪ ভরি সর্ণ হারাইছি বুঝলা বাজান। আমার স্বামী আমারে এখনও সেই ভুলের লাইগা কথা শোনায়।
সাজিদ উপান্তর না পেয়ে হাসিমুখে মহিলার কথা মেনে নিল। এরই মধ্যে সাজিদ মহিলা টির নাম জেনে ফেলেছে। রাজেদা বেগম। বাবার বাড়ি চাটমোহর। শ্বশুড় বাড়ি রাজশাহী। যাহোক অনেক্ষণ জেগে থাকতে থাকতে সাজিদের চোখে হঠাৎই ঘুম চলে আসে। সবাই ঘুমে বিভর ছিল একমাত্র সাজিদই জেগে ছিল রাজেদা আন্টির টাকার ব্যাগের দায়িত্ব যে ও পেয়েছে। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেঁলে সাজিদের ঘুম ভেঙে যায়। সামনে তাকিয়ে দেখে রাজেদা আন্টি নেই। সাজিদ তাকিয়ে দেখে ব্যাগ টা ওর কাছেই রয়ে গিয়েছে। দ্রুত উঠতে গিয়ে আতিক হোসেন সাজিদের হাত ধরে ফেলে,
–কই যাস বাবা??
–বাবা,ওই মহিলা। ওনার ব্যাগ??
–কোন মহিলা?? রাজেদা বেগম??
–জ্বি বাবা।
–উনি তো আরো এক স্টেশন আগেই নেমে গিয়েছেন। তুই ঘুমাসছিলি জন্য তোকে আর ডাকিনি। উনিও ডাকতে বারণ করলেন তাই আর ডাকিনি।
–সাজিদ ধুপ করে বসে পড়ে। আন্টি ভুলে গিয়েছেন টাকার ব্যাগের কথা। আর আন্টি যখন আমাকে ব্যাগ টা দিচ্ছিলেন বাবা তখন ঘুমে ছিলেন। তাই উনিও ব্যাপার টা বুঝতে পারেন নি।
সাজিদ কি করবে বুঝতে পারছে না। এদিকে ট্রেন কমলাপুর এসে থামে। সাজিদ পুরো রাস্তা এসব চিন্তা করতে করতেই আসে। ঢাকায় মামার বাসায় এসে বিপদে পড়ে সাজিদ। মামা রা একরকম অপমান করেই বাবা ছেলেকে বের করে দেয় বাসা থেকে। যেহেতু আতিক হোসেন আর জয়নাব বেগম পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলেন তাই জয়নাব বেগমের অগত্যায়, জয়নাব বেগমের বাবা জয়নাব কে ত্যাজ্যসন্তান করে দেন।
রাস্তায় এসে বাবার শরীর টা আচঙ্কায় খারাপ হয়ে যায়। যার অবনতি ছাড়া উন্নতি হচ্ছিল না। হাসপাতালে নিতে নিতেই বাবা আতিক হোসেন ইহলোক থেকে পরকালের পথে তার কলিজার ছেলেটাকে একা রেখে চলে যান। কারোর ডাকে সাজিদ সম্বেত ফিরে পায়। জেসমিন এসেছে। কিসব রিপোর্ট দিয়ে জেসমিন চলে যায়। সাজিদ পুনরায় ডুব দেয় চিন্তায়।
ঐদিনের পর থেকে সাজিদের সবকিছু পুরোপুরি বদলে যায়। টাকাগুলো ফেরত দেওয়ার জন্য রাজেদা আন্টির অনেক খোঁজ করলেও তাকে পেয়েছিল না। আর ফোন নাম্বার কিংবা অন্য কোন লোকেশন না থাকায় পুলিশ কেও এ ব্যাপারে কিছু জানাতে পেরেছিল না সাজিদ। তাছাড়া এতগুলো টাকা বলে আর কাউকে ভরসা করতে পেরেছিল না সাজিদ। শেষে, আদির কথামতো টাকাগুলো আধা মসজিদে আর আধাটা দিয়ে নিজের পড়াশোনা টা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সাজিদ। প্রথমে ব্যাপার টা মানতে না পারলেও পরে ঠিকি আদির কথায় সাজিদ মেনে নিয়েছিল।
স্টুডেন্ট জীবন অতিক্রম করে চাকরি জীবনে প্রবেশ করে সাজিদ জীবনের প্রথম বেতন টাই রাজেদা আন্টির নামে অসহায় আর দুস্তদের মাঝে বন্টন করেছিল। আর শুধু একবার না। প্রতিবার বেতনের আধা টাকা সাজিদ রাজেদা আন্টির নামে অসহায়দের মাঝে ব্যয় করত। তবে এত কিছু করেও প্রায় প্রতিটা রাত্রে ভয় পেয়ে সাজিদের ঘুম ভেঙে যেত। আর টাকাগুলোর সাথে রাজেদা আন্টির কথাগুলো মনে পড়ে মনের অপরাধ বোধ টা চোখ বেয়ে জল আকারে ঝরতো। নামাজে বসে শুধু দোয়া করতো, মালিক আমার তো এখন সবকিছু হয়েছে। কিন্তু তবুও আমি সেই যন্ত্রণায় পুড়ছি। আমার জীবনে তোমার কাছে চাওয়ার আর কিছুই নেই শুধু রাজেদা আন্টির সাথে আমার দেখা করিয়ে দাও। আমি যে ঋনি মালিক, এ ঋন নিয়ে মারা গেলে আমার স্থান জাহান্নাম ছাড়া জান্নাতের কিনারাও হবে না।
সাজিদ পুনরায় বাস্তবে ফিরে এল। এত দিন পরে আমার মালিক আমার কথা শুনেছে ভাবতেই সাজিদের চোখ চকচক করে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই রাজেদা আন্টির শরীরের কথা চিন্তা করে মনটা মলিন হয়ে গেল। চেয়ার থেকে উঠে সোঁজা কেবিনের দিকে পা বাড়ালো সাজিদ। রাজেদা আন্টি তখন মেয়ের সাথে কথা বলছিলেন। সাজিদ গিয়ে রাজেদা আন্টির পাশে বসে পড়ল। রাজেদা আন্টি সাজিদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইল।
–আমায় চিনতে পারছেন আন্টি?? রাজেদা আন্টি কিছুটা কপাল কুঁচকালেন। মনে মনে হয়তো উনি কিছু ভাবছেন।
–আমি সাজিদ, ওইযে ট্রেনে যাত্রা, আপনার টাকার ব্যাগ আমার কাছে দিয়েছিলেন। আন্টির চোখমুখে হাসি খেলে গেল।
–বাবা তুমি?? আন্টির চোখ থেকে জল পড়ছে।
সাজিদের চোখেও পানি। সাজিদ সেদিনের পুরো ঘটনা রাজেদা আন্টিকে খুলে বলে। রাজেদা আন্টি সাজিদের মাথায় হাত রেখে বলে, আমার কোন টাকা লাগত না বাবা। শুধু আমার একটা কাজ করবা বাবা??
–জ্বি আন্টি বলুন।
–আমার মেয়েটা আজ ৭ বছর ধরে তালাক পেয়েছে। অন্য কোথাও বিয়েতেও আর মত দেয় নি। ঐদিন টাকা না পেয়ে আমার মেয়েকে ওরা আমার সাথেই ফেরত পাঠিয়ে দেয়। আর তার পরের দিনেই ডিভোর্স প্যাপার পাঠায়। আমি ছাড়া মেয়েটার আর কেউ নাই বাবা। ওর বাবা তো ২ বছর আগেই চলে গিয়েছেন। এখন আমিও সে পথেরি যাত্রী। এই একা মেয়ে টাকে তুমি দেখে রাখবা বাবা?? ওর চাচারা ওর বাবার সব সম্পত্তি জালিয়াতি করে নিয়ে নিয়েছে। মামারাও আমায় ও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। এখন আমি মারা গেলে মেয়েটার মরণ ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না বাবা। রাজেদা আন্টিকে দেয়া সেদিনে বলা কথাটা সাজিদ রেখেছিল তবে বিপরীত ভাবে। রাজেদা আন্টির মৃত্যুর কয়েকদিন পরের ঘটনা।
একজন যুবক ছেলে আর তালাকপ্রাপ্ত মেয়ে তো আর এক একসাথে এক বাসায় থাকতে পারে না। তাই সাজিদ অনুর অনুমতি নিয়েই কাজী ডেকে সাধারণ ভাবেই বিয়ের কাজ টা সম্পন্ন করে ফেলে। আজ দু বছর হতে চলছে, সাজিদের এখন আর মাঝরাতে ঘুম ভেঙে নিজের মনের মধ্যকার অপরাধবোধের জন্য কান্না করতে হয় না। কারণ, এখন ও নিজেকে দ্বায়মুক্ত হিসেবে দাবি করতে পারে।