অস্তিত্ব

অস্তিত্ব

“তিথি কে?” ভ্রু কুঁচকে জামানকে প্রশ্ন করলো তারিন। একটু আগে মুখ ফসকে ‘তিথি’ শব্দটা বেরিয়ে পড়েছিলো। এখন দুঃখিত চোখে তারিনের দিকে তাকিয়ে আছে জামান।

–“কথা বলছো না কেনো? তিথি কে? আবারও প্রশ্ন করলো তারিন। জামান বলল,

–” বলতে পারি একটা শর্তে। পুরোটা না শুনে কোনো জিনিসপত্র ভাঙচুর করতে পারবে না। ঠিক আছে? তারিন কঠিন মুখ করে বসে রইলো। কিছু বলল না। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জামান বলতে শুরু করলো,

–“মাস্টার্স শেষ করার পর চাকরির উদ্দেশ্যে আমি মামার বাসাতেই থাকতাম। সেবার মামারা বাসা পরিবর্তন করেন। মামাদের সেই নতুন দোতলা বাসায় আমি যাই দুদিন পর। রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে যখন গেটে ঢুকতে যাবো, তখনই মেয়েটার সাথে আমার দেখা। কাজলকালো চোখ, খোলা চুল। হাতে শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’। কেন জানিনা, হঠাৎ এই অপরিচিত মেয়েটির সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করলো। বললাম,

–“কোথায় যাচ্ছেন তিথি? মেয়েটি গম্ভীর কন্ঠে আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
–“নাম যখন বলতে পেরেছেন, তখন কোথায় যাচ্ছি সেটাও বলতে পারবেন আশা করি।” চোখের সানগ্লাস খুলে হতাশ কন্ঠে বললাম,
–“আপনার গলায় ঝুলানো আইডিকার্ডে শুধু নামটাই লেখা আছে। কোথায় যাবেন সেটাতো লিখা নেই!”

এবার মেয়েটা হেসে ফেলল। আমাদের পরিচয়পর্ব এমনভাবে শুরু হলো যেন আমরা অনেকদিনের পরিচিত! ভোরবেলা ছাদে হাঁটাহাঁটি করা ছিল তিথির অভ্যেস। এটা জানার পর আমারও ভোরবেলা ছাদে হাঁটার অভ্যেস হয়ে গেলো। কারণে অকারণে ওর সাথে কথা বলতে শুরু করলাম। শুরুতে বিরক্ত হলেও, পরে সে ঠিকই বুঝতে পেরেছিল যে, আমি আর চার-পাঁচটা ছেলেদের মতো নই। আমার সাথে বন্ধুত্ব করা যেতেই পারে। ওর পরিবার বলতে, বড়বোন মিথি আর বাবা সাইফুল ইসলাম। মা মারা গেছেন সেই ছোট্টবেলা। মিথির সাথে আমার তখনো দেখা হয়নি। বেশিরভাগ সময় নানুর বাসায় কাটায়। বোনের চিন্তায় সারাক্ষণ অস্থির থাকতো। ওর ভাষ্যমতে, “মিথি অতিরিক্ত রাগী, যে কারো সাথে ঝগড়া লেগে যায়। বলা যায় ওর বন্ধু কম, শত্রুই বেশি।” নিজের ছোট্ট জগৎটা নিয়ে অনেক সুখীই ছিল তিথি। আমি সবসময়ই তার ছোট্ট জগৎটায় ঠেলেঠুলে একটুখানি জায়গা খুজে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। একবার তিথি খুশি খুশি কন্ঠে বলল,

–“কাল মিথি বাড়ি আসবে। তুমি ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় এখানে চলে আসবে। তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবো। ও তোমার ব্যাপারে সবই জানে।

–“জো হুকুম মহারাণী। তিথি হাসে। আমার মেয়েটাকে জানতে ইচ্ছে করে খুব। জিজ্ঞেস করি,
–” তোমার প্রিয় রঙ কী তিথি?
–“নীল।
–“নীল! শুনেছি অধিকাংশ মানুষের নীল পছন্দ।
–“আমি সেই অধিকাংশদের একজন।
–“তাও ঠিক।
–” তুমি কখনো নীল রঙের পেয়ারা দেখেছ?
–“নাতো! তুমি দেখেছ?
–“দেখেছি বলেই তো জিজ্ঞেস করলাম।

আমি কিছুটা অবাক হলাম। কারণ আমি জানি মেয়েটা মজার ছলেও কখনো মিথ্যে বলেনা। সে অবশ্যই কোথাও না কোথাও নীল রঙের পেয়ারা দেখেছে। আমি তিথির দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। তিথি হাই তুলে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,

–“তোমারতো অনেক বুদ্ধি। নিজেই খুজে বের করো।” আমি ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লাম। ঐ মুহুর্তে বুদ্ধি দেখাতে একদম ইচ্ছে করছিলো না। আলতো করে ওর কপালের চুলগুলোতে আঙুল ছুঁঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছিলো। পরেরদিন হঠাৎ করেই বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় আমাকে বাড়ি যেতে হলো। চারদিন বাড়িতে থেকে আবার মামার বাসায় চলে এলাম। কারণ পরেরদিনই আমার চাকরির ইন্টার্ভিউ। তাছাড়া এ ক’দিন তিথির সাথেও কথা হয়নি। সমস্যাটা কি হয়েছে সেটাই ভাবছিলাম। তখনই মামী চাপা কন্ঠে বললেন,

–“খবর শুনেছিস জামান! মিথি নাকি কোন ছেলের সাথে পালিয়েছে। নানুর বাসা থেকে যেদিন এসেছিল সেদিনই সন্ধ্যেবেলা পালিয়েছে। সাইফুল ভাইতো মেয়ের মুখ দেখতেও রাজি না, আর পুলিশে খবর দেওয়া তো দূরের কথা। এদিকে তিথি নাওয়া খাওয়া ছেড়ে শুধু মিথি মিথি করে যাচ্ছে। আরে মিথি! বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে… অবশ্য তুই চেনার মামীর কথা পুরোটা শেষ হওয়ার আগেই আমি তিথিদের বাসায় রওয়ানা হলাম। ড্রয়িং রুমে কয়েকজন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। দরজায় দাঁড়িয়েই ভাল করে চারদিকে দেখে নিলাম আমি। এই প্রথম ওদের বাসায় এলাম। কিন্তু তিথিকে দেখতে পেলাম না। তারপর সাতপাঁচ না ভেবে ছাদে চলে গেলাম। তিথি সেখানে বিষন্নমনে দোলনায় বসে ছিলো। আমি এগিয়ে গিয়ে ওর ঘাড়ে হাত রাখতেই সে কেঁপে উঠলো। বলল,

–“মিথিকে নিয়ে হাজার দুশ্চিন্তা থাকলেও ও এমন কিছুই করবে ভাবতেই পারিনি। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে মিথি ভালো নেই। কিন্তু বাবা ওর নাম পর্যন্ত শুনতে চাইছেন না। আমি এখন কী করব জামান!” আমি চুপচাপ ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইলাম শুধু। আলতো হাতে ওর বা’কাঁধ জড়িয়ে ধরতেই সে কেঁদে ফেলল। সারারাত নির্ঘুম কাটার পর ভোরবেলা একটু চোখে লেগে গিয়েছিলো। ঘুম ভাঙলো নয়টায়। ইন্টার্ভিউয়ে যাওয়ার আগে তিথির সাথে দেখা করে বললাম,

–“ইন্টার্ভিউ আছে। মনে হয়না এবারও হবে।” তিথি ফ্যাকাশে হাসি হেসে বলল,

–” গ্রীন শার্টে তোমাকে বেশ হ্যান্ডসাম লাগছে। কোনো মেয়ে যদি ইন্টারভিউ নেয় তাহলে চাকরি নিশ্চিত।” ওর কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে হেসে বললাম,

–“চিন্তা করোনা। মিথি ভালোই আছে হয়তো।

ইন্টার্ভিউ দিতে আসা একটি মেয়ের সাথে আমার বেশ খাতির হয়েছিলো। কথায় কথায় মেয়েটি বলে উঠলো, “কিছু মনে করবেন না। নীল রঙে আপনাকে একদমই মানাচ্ছে না।” বলেই সে হেসে ফেলল। আমি কিছু একটা বলতে গিয়েও থমকে গেলাম। দ্রুত হিসাব মিলাতে লাগলাম।পাঁচমিনিট চিন্তা করে ঠিক করলাম বাসায় চলে যাবো।পথে তিথিকে কল করে বললাম, দ্রুত দেখা করতে। মিথির খোঁজ পাওয়া গেছে ” প্রায় পাঁচমিনিট পর হুড়মুড় করে তিথির প্রবেশ। হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল,

–“মিথি কোথায় আছে? সে ভালো আছে তো? আমি বললাম,
–“প্রশ্নটা উল্টো হয়ে গেছে। এর সঠিক বাক্য হবে, তিথি কোথায়?
–“মানে? আমি একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,

–“তিথি সবসময় বলতো, মিথিকে দেখলে আমি নাকি অবাক হয়ে যাবো। আমার সেই “অবাক চোখ” দেখার জন্য তার সে কী আগ্রহ! আমি ঠিকই অবাক হয়েছি, প্রচণ্ডরকমের অবাক হয়েছি সেদিন, যেদিন ড্রয়িংরুমে তিথিকে খুঁজতে গিয়ে তোমাদের দুবোনের ছবি দেখলাম। একই চেহারার অধিকারী তোমরা। তিথি যে তোমার ছবি আমাকে দেখায়নি এটা তুমি জানতে। তাইনা মিথী?

–“তুমি কী ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বলবে জামান? আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। ওর কপালের চুল সরিয়ে দিয়ে আমি বললাম,

–“পাঁচদিন আগেও জাপানি মেয়েদের মতো চুলগুলো চোখের ভ্রুয়ের সামনে এসে আটকে যেতো। আজ দেখি একেবারে কানের লতি পর্যন্ত দৌড়াচ্ছে। কী তেল মাখো গো তুমি? জুই নাকি প্যারাশ্যুট? আচ্ছা থাক বলতে হবে না। আমার মোবাইলের লকটা খুলে দিলেই সব প্রমাণ হয়ে যাবে। তোমার আর আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেওয়া আছে।”
আমার সামনে বসা মেয়েটি নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। মিথি নিশ্চুপ হয়ে গেল। আমি বললাম,

–“আজ সকালে তুমি একটা ভুল করেছিলে। জানতে চাও সেটা কী? মিথি কিছু বলার আগেই আমার পুলিশ বন্ধু শাহীন এসে হাজির হলো। আমি থামতেই তারিন বলল,

–“সত্যি মেয়েটা মিথিই ছিল?
–“হুঁ। তিথিকে আমরা উদ্ধার করি ওর বেডরুমের পাশে লাগোয়া বদ্ধ ঘর থেকে। ঘরটা অনেকদিন থেকেই তালাবদ্ধ ছিলো। ছোটবেলা থেকেই তিথির প্রতি একধরণের রাগ/আক্রোশ কাজ করতো মিথীর। লোকজন কথায় কথায় দুবোনের তুলনা করতো। তিথি শান্ত, লক্ষী, ভদ্র স্বভাবের মেয়ে। কিন্তু মিথি সম্পূর্ণ তার বিপরীত। নিজের বাজে আচরণের জন্য লোকজনের নানান আজেবাজে কথা শুনে বড় হয়েছে। সুতরাং তিথির ওপর রাগ থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু তিথিকে মেরে ফেলার মতো জঘন্য কাজটি করার জন্য শুধুমাত্র এই টিপিক্যাল হিংসাই একমাত্র কারণ ছিল না। এর জন্য একটু পেছনে যেতে হবে। একটু থেমে জামান বলল,

–” সাইফুল সাহেবের সাথে শবনম আরা’র পারিবারিকভাবেই বিয়ে হয়। মিথির যখন একমাস বয়স, তখন হঠাৎ করেই শবনম অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার এসে চেকআপ করে ঔষধ লিখে দিচ্ছিলেন। এদিকে ডাক্তারকে চা দিতে এসে কাজের মেয়ে শাফিয়া জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটে পড়লো। অভিজ্ঞ ডাক্তার একবার শাফিয়াকে দেখেই বলে দিলেন, মেয়েটি প্রেগন্যান্ট। শরীর দুর্বল। শবনম প্রচণ্ড অবাক হলেন। শাফিয়া বাক-প্রতিবন্ধি হওয়ায় তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে না পারলেও, দুইয়ে দুইয়ে চার মিলাতে গিয়ে উনার মাথা ঘুরাতে শুরু করলো। সংসার জীবনের শুরুতেই এমন আঘাত তিনি মেনে নিতে পারেন নি।

কাউকে কিছু বলতেও পারছিলেন না। একপর্যায়ে প্রচণ্ড অভিমানে নিজেকে একটি ঘরে বন্দী করে রাখেন। ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পরেন এবং শেষপর্যন্ত ঐ বন্ধ ঘরেই তিনি মারা যান। এর পাঁচমাস পর তিথিকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান শাফিয়া। দেরিতে হলেও সাইফুল সাহেব নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিথি, মিথির কাছ থেকে এই কঠিন সত্যগুলো লুকিয়ে রেখে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মিথি কোনভাবে সবকিছু জেনে ফেলেছিল। খুব সম্ভব ওর নানুর বাড়ির কারোও কাছ থেকে শুনেছে। সে মনে করে তার মায়ের মৃত্যুর জন্য পরোক্ষভাবে তিথীই দায়ী। তিথির ওপর এতটা ক্ষেপে গিয়েছিল যে, ওর ক্ষতি করার জন্য নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেনি।

তিথিকে আটকে রাখলো সেই ঘরে, যেখানে মিথির মা মারা যান। আসলে সে নিজের মনেই একটা বাহানা খুজছিল তিথির ক্ষতি করার। নয়তো সুস্থ মস্তিষ্কে চিন্তা করলে বুঝতে পারতো এখানে তিথির কোন দোষ ছিল না। যাইহোক উদ্ধার হওয়ার পরও তিথি জানতো না ওর সাথে কী ঘটেছিল। কিছুদিন পর সুস্থ হলে তাকে সব জানানো হলো। কিন্তু পরে বুঝলাম জানানো’টা ওকে মোটেও ঠিক হয়নি। নিজের জীবনের চরম সত্য আর প্রিয় বোনের কাছ থেকে পাওয়া আঘাতগুলো তাকে ভেতর থেকে একদম শেষ করে দিচ্ছিলো। প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে চলে যায়। এবং এই ডিপ্রেশন থেকেই একদিন ভার্সিটির গণিত বিভাগের ছাদ থেকে সে লাফ দেয়। জামান গল্প বলা শেষ করে আগ্রহ নিয়ে তারিনের তাকালো। মেয়েটা ঝিম মেরে বসে আছে। কলিংবেলের শব্দ শুনে তারিন মূর্তির মতো দরজা খুলে দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। ভেতরে ঢুকে সোফায় বসে শাহীন বলল,

–“ভাবীর কী হয়েছে রে? এমন উদভ্রান্তের মতো চেহারা বানিয়ে ঘুরছে কেনো?  জামান হাই তুলে বলল,
–“তিথির গল্প বলছিলাম। ব্রেইনে একটু চাপ পড়েছে বোধহয়।” রান্নাঘর থেকে হুকুম এলো নতুন কেনা নীল মগটা নিয়ে যাওয়ার জন্য। জামান সবুজ মগ হাতে নিয়ে দাঁড়াতেই শাহীন বলল,

–“আচ্ছা নীল পেয়ারার কাহিনীটা কী ছিলো?
–“কাহিনী কিছুই না। তিথি কালার ব্লাইন্ড। সবুজ রঙের সবকিছু সে নীল দেখে। ওর মা, বাবা অর্থাৎ সাইফুল আর শাফিয়া দুজনই কালার ব্লাইন্ড ছিলেন।” শাহীন প্রায় ফিসফিসিয়ে বলল,

–“গল্প যে বললি, মনে পড়লো কিছু?
–“উঁহু।
–“বাজে অতীতগুলো মনে না পরাই ভালো।

মাথায় এতবড় আঘাত পেয়ে যে বেঁচে আছে এটাই অনেক। ভাগ্যিস একতলা থেকে লাফ দিয়েছিলো। চার-পাঁচ তলা হলে আর দেখতে হতোনা!” রান্নাঘরে খুটখাট আওয়াজ হচ্ছে। জামান সেদিকে তাকিয়ে মুগ্ধকন্ঠে বলল,

–“সুস্থ, হাসিখুশি, সংসারী এই মেয়েটাকে পাওয়ার জন্য ‘তিথি’ নামটার বিসর্জন দিতে রাজি আছি। ভবিষ্যতে ওর অতীত মনে না পড়লেও কোনো আক্ষেপ নেই আমার!

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত