-এই যে সাকিব ভাই.! বৃষ্টিতে ভিজে কোথায় যাচ্ছেন.? প্রশ্নটা শুনে পিছে ফিরে তাকালাম। মীম বসে আছে রিক্সাতে। আমার ভার্সিটির জুনিয়র। অতিরিক্ত সুন্দরী যাকে বলে, মীম ঠিক সেটাই।
-সায়েন্স ল্যাব যাচ্ছি।
-আমিও সেদিকেই যাচ্ছি, চাইলে যেতে পারেন আমার সাথে।
কথাগুলো বলে কিছুটা চেপে জায়গা ছেড়ে দিয়ে বসলো ও। আমি একটু ভেবে উঠে পরলাম রিক্সায়। রিক্সা চলতে শুরু করলো।
-আপনার মঙ্গলবার ক্লাস নেই, তবুও প্রতি মঙ্গলবার আপনাকে এখানে দেখা যায়, কেন.! মীমের প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরলাম।
-না তেমন কিছু না, এমনিতেই আসি। আমতাআমতা করে বললাম কথাটা।
-ইশশশ.. বললেই হলো এমনি.!! আমি বুঝি না মনে করেছেন তাই না.!!!! সত্যি করে বলেন কেন আসেন
-তোমাকে দেখতে।
-সপ্তাহে দুইদিন দেখেও মন ভরে না বুঝি.!
কথাটা বলে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল মীম। বৃষ্টি বেড়ে চলছে। বৃষ্টির ছাট এসে আমাদের ভিজিয়ে দিচ্ছে। কারো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি মীমের হাতে হাত রাখলাম। ও সরিয়ে দিয়ে আমার বাহু জড়িয়ে ধরলো। আমরা অপলকনেত্রে তাকিয়ে আছি একে অপরের দিকে। রিক্সা সায়েন্স ল্যাব পার হয়ে কাটাবনের দিকে যাচ্ছে। রিক্সাওয়ালাকে কিছু বলতে ইচ্ছা করছে না কেন জানি.! ও আলতোভাবে আমার ঠোট একবার ছুঁয়ে দিলো। হঠাৎ রিক্সাওয়ালার ডাকে সৎবিৎ ফিরলো আমাদের। ও ঠিকঠাক হয়ে বসলো।
-ভাইজান, ভুল কইরা সায়েন্স ল্যাব ফালাইয়া আইসা পরছি। আপনারা এহানে নাইমা যান, বাস ধইরা যাইয়েন গা।
-কেন.! তুমি আবার ঘুরে চলো সায়েন্স ল্যাবের দিকে, তাহলেই তো হয়।
-এ মেঘের দিনে তাইলে ভাড়া বাড়াইয়া দিতে হইবো।
-কেন কেন.! ভুল তুমি করছো, তুমিই এইটা ঠিক করবা। আমরা কেন ভাড়া বেশি দিবো.?
আমার প্রতিবাদের মুখে রিক্সাওয়ালা মিয়ম্রাণ হয়ে রিক্সা ঘুরিয়ে চলতে লাগলো। হঠাৎ মীম খিলখিল করে হেসে উঠলো। মেয়েরা বড্ড অদ্ভুত, ছেলে মানুষের রাগ কমিয়ে দেওয়ার আশ্চর্যজনক এক ক্ষমতা সৃষ্টা মেয়েদের দিয়েছে।
পৃথিবীতে সবকিছুর একটা সীমা আছে। কিন্তু মীমের ভালোবাসার কোন সীমা আমি খুঁজে পায়নি। মাঝেমাঝে আমি চিন্তিত হয়ে পরতাম এতো ভালোবাসা নিয়ে আমি কি করবো.!! কোনকিছুই অতিরিক্ত ভালো না, তাহলে নাকি সেটা টিকে না। ভালোবাসাটাও মনে হয় অতিরিক্ত হওয়াটা ভালো না। তাই আমার পাওয়া ভালোবাসাটাও টিকেনি। অথচ এখনো অনেক বর্ষা বাকি ছিল আমাদের একসাথে ভিজার, এখনো শহরের অনেক রিক্সাওয়ালা আমাদের চিনে না। হয়তো কিছু জিনিস অপূর্ণ থাকাটার নামই বেঁচে থাকা.!
ভার্সিটি থেকে বের হয়ে এসেছি বছর দেড়েক হলো। চাকরির জন্য এখনো ছুটে বেড়াচ্ছি শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা। তবুও মঙ্গলবার আসি পান্থপথে, ভার্সিটির সামনে। মীম এখন ব্যস্ত ওর সংসার নিয়ে। ও হয়তো ভুলে গিয়েছে আমি এখনো প্রতি মঙ্গলবার অপেক্ষা করি।
আকাশে মেঘ জমছে। বড় বড় ফোটা হয়ে নেমে আসছে পৃথিবীর বুকে। আমি হেটে যাচ্ছি পান্থপথের আইল্যান্ড দিয়ে। রাস্তায় কাদাজল জমে আছে। একটা প্রাইভেট কার এসে সে জল আমার জামায় মেখে দিয়ে চলে গেল। কেন যেন রাগ হতে গিয়েও হতে পারলাম না। ইদানীং আমার বোধশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে। কারো উপর রাগ করতে ইচ্ছা করে না, কাউকে ভালোবাসতেও ইচ্ছা করে না। প্রাইভেট কারটা থেমে আছে কিছুটা সামনে। গাড়ির ড্রাইভার ছাতা মাথায় দিয়ে এসে আমাকে সরি বলছে।
আমি অবাক হলাম না, অথচ আমার অবাক হওয়ার কথা ছিল, কারন গাড়ির জানালা দিয়ে মীম মাথা বের করে আছে। বৃষ্টিরফোটা ওর নাক বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে পরছে। আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়ে গেছে ও। আমি ড্রাইভারের কাধ চাপড়ে দিয়ে হাটা শুরু করলাম। মীমের খুব ইচ্ছা ছিল বিয়ের পর ভালোবাসার মানুষের সাথে বর্ষাদিনে রিক্সায় করে ঘুরে বেড়ানোর, সৃষ্টা ওর ইচ্ছা পূরণ করেনি। ওকে এখন মেঘলাদিনে কাচঘেরা গাড়িতে করে বের হতে হয়। রাস্তার দু’পাশে অনেক ছেলেমেয়ে ছাতা বন্ধ করে হেটে বেড়াচ্ছে। কবিগুরু বলেছিলেন,
-সব বৃষ্টি সুন্দর না, যে বৃষ্টিতে তুমি ভিজবে, শুধু সেই বৃষ্টিই সুন্দর।