অপরিচিতা

অপরিচিতা

নিধির ফোন কন্টাক্ট এ দু’টো নাম্বার ছিল৷ একটা তোমার, আরেকটা ওর মায়ের৷ ওর মা নেই আজ দু’বছর৷ তবুও পাগল মেয়েটা মায়ের নাম্বারে রোজ ফোন দেয়৷ আমার মেয়েটা বড় হলেও পাগলামীটা ছাড়তে পারেনি বুঝলে৷ ওর মায়ের পরই তোমার নাম্বারটা দেখলাম৷ তাই ফোন দিয়েছি৷” ভারী গলায় কথাগুলো বলল নিধির বাবা৷ আমি নিধির দিকে তাকালাম ভালো মতো৷ চোখের নিচে গাঢ়ো কালো হয়ে আছে৷ আগেও ছিল৷ এখন আরেকটু গাঢ়ো হয়েছে৷ আমি নিধীর মুখবয়বে উদাস হয়ে তাকিয়ে বলতাম, চোখে গাঢ়ো কাজল দিও৷ ভালো দেখাবে৷”

নিধী তাচ্ছিল্য ভরা হেসে বলতো, প্রকৃতিই তো আমার চোখে কাজল এঁকে দিয়েছে৷ আর কাজল দেয়ার প্রয়োজন কী বল?” জবাবে আমিও হাসতাম মৃদ্যু৷ আর কিছু বলতাম না৷ নিধী সিগারেট ধরাতো হুট করে৷ এই জিনিসটা আমি নিতে পারি না একদম৷ কেমন যেন অসহ্য লাগে৷আমার এই অসহ্য লাগাটা আমি নিধীকে জানাতাম৷ছেলেমানুষ হয়ে এসব সহ্য করতে না পারার কথা শুনে নিধী হাসতো প্রথম প্রথম৷ শেষে সিগারেট খাওয়ার নেশা ধরলেই একটু দূরে সরে যেতো৷” আমি নিধিকে অদ্ভেত সব প্রশ্ন করে বসতাম৷ নিধীও উত্তর দিতো৷ একবার বলে বসলাম,

-এই পাতলা ঠোঁটগুলার ফাঁকে ভারী সিগারেটটা রাখো কিভাবে?”

প্রশ্নের পরে আমি বুঝতে পারি, বোকার মতো প্রশ্ন করেছি৷তবুও নিধী উত্তর দিতো৷ একদম শৈল্পিক উত্তর৷ আমি বুঝিনা এত সুন্দর করে কথা বলা শ্যামবর্ণের মেয়েটার বদঅভ্যাস থাকবে কেন?” একটা মেয়ে থাকবে গোছালো৷ যে যত্ন করে কথা বলবে৷ যত্ন নিবে আশপাশের মানুষগুলোর৷ তার মন খারাপে দু’একটা রেসিপি বানাবে৷ হাতে বই আর কফির মগ নিয়ে উদাস হয়ে বসে রবে৷ জানালার গ্রীল ধরে আকাশের কান্না দেখবে৷ পায়ে নূপুর পরে ঝুম বৃষ্টিতে লাফাতে লাফাতে ভিজবে৷ মনে বেদনা এসে ভর করলে বৃষ্টিতে ভিজে কাঁদবে৷ সুখ এসে ভর করলে গুণগুণ করে গান গাইবে৷”

এই ভাবনাগুলো আমার নয়৷ এসব নীতু বলতো আমায়৷ মেয়েটার সাথে আমার কয়েক বসন্ত প্রেম ছিল৷ আমরা যখন হাঁটতে বেরোতাম৷ নিতুর হাতে বই থাকতো একটা৷ কবিতার বই৷ এই কবিতা আমার একদম পছন্দের নয়৷ সহ্য হয় না আমার৷ তবুও নীতু শোনায়৷ আমি উঠে যেতে চাই৷ নীতু আমার বাহু ধরে জোর করে বসাতো৷ “কবিতা তোমাকে শোনাবোই” টাইপের একটা ভাব থাকতো৷ আমি নীরষ মুখে কবিতা শুনতাম৷ আমাদের বিপরীত পাশে কিংবা আশেপাশের কপোত-কপোতীদের দেখিয়ে বলতাম, দেখেছো ওরা কত প্রেমময়ী৷ প্রেমিকের কাঁধে মাথা রেখে আকাশ দেখছে, একজন অপরজনকে ফুচকা খাইয়ে দিচ্ছে৷

আর তুমি? তুমি মেয়ে, নাকের ডগায় চশমা নামিয়ে জোর করে কবিতা শোনানোয় ব্যস্ত৷” নীতু যত্ন করে কবিতার বইটা বাঁধতো৷ চশমা ছোট চোখ দু’টোর সামনে এনে বলতো, আমার ওসব ন্যাকামো সহ্য হয় না বুঝলে৷ আমি অতো হাই লেভেলের প্রেমিকা নই৷” আমার প্রথম প্রেম কবিতা৷ মোলায়েম কবিতা৷ বিদ্রোহ টাইপ কবিতা আমি পছন্দ করি না একদম৷ আমি মোলায়েম মনের মানুষ, তাই নরম কবিতা পড়বো, শোনাবো৷” আমি এসব এলোমেলো উত্তর শুনে বিরক্ত হতাম৷ তবুও আমি ভালোবাসি মেয়েটাকে৷ নীতুর নরম হাতটা ত্রামার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতাম,

-তা মোলায়েম মনের মেয়ে৷ প্রেমিকের জন্য বিদ্রোহী হতে পারবে কখনো?” নীতু প্রশ্ন করতো,
-কেমন?

-এই ধরো, বাবা-মা বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে৷ তুমি আমার হাত ধরে বেরিয়ে পড়লে! পারবে?” নীতু হাতটা ঝাড়া দিয়ে বলতো,

-মাথা খারাপ নাকি৷ আমি অতো হাই লেভেলের প্রেমিকা না বুঝলে৷” আমার মন খারাপ হতো৷ নীতুর সামনেই মুখটা গোমড়া করে রাখতাম৷ আমি ভাবতাম, পরক্ষণেই নীতু খিলখিল করে হেসে বলবে, পাগল ছেলে৷ আমিতো মজা করেছি৷” আমার সেই ভাবনাটা আর বাস্তবে রূপ নিতোনা৷ নীতু মেয়েটাও আর আমার হয়নি৷ আষাঢ়ের একটা ঝুম বৃষ্টি৷ আমার হুট করে নীরষ কবিতা পড়ার ইচ্ছে হল৷ হাতে চায়ের মগ নিয়ে কবিতা বই হাতড়ে খুঁজে নিলাম বুক সেলফ থেকে৷ ভাবলাম ফোনের ওপাশের মেয়েটাকে বৃষ্টি ছন্দে ছন্দে কবিতা শোনায়৷ ফোন বন্ধ! আমার বুকটা মুচড়ে উঠলো৷ বৃষ্ঠির দিনে মেয়েটা ফোন বন্ধ রাখেনা৷ তার বিশ্বাস, একদিন আমি ফোন দিয়ে কবিতা শুনাবো ঝুমবৃষ্টিতে৷” খানিক বাদেই বৃষ্টি মিলিয়ে গেল৷ আমি ছুটলাম নীতুর কাছে৷ বাসার দরজায় তালা ঝুলানো৷ আমার ভেতরটায় আরেকবার মোচড় লাগলো৷ এরপর কত ফোন আর ফোন৷

মেয়েটাকে আর খুঁজে পাইনি৷ তার বাসার দরজার ঝুলানো তালার মতো আমার বুকভরা অনুভূতির বাক্সটায় ও তালা ঝুলে গেল৷” কষ্ট পেলাম ভীষনভাবে৷ অন্যপ্রেমিকদের মতো আমারও বিড়ি সিগারেট কিংবা মদের নেশা ধরার কথা ছিল৷ কিন্তু অদ্ভূতভাবে আমার কবিতার নেশায় ধরে বসলো৷” নীতুর যে নীরষ কবিতাগুলোর জন্য আমি বিরক্ত হতাম৷ এখন সেই কবিতাগুলোও আমার কাছে রষে টুইটুম্বুর মনে হতো৷ নীতুর প্রিয় কবিতাগুলো আমি বারবার পড়তাম৷ তবুও নীতুর মুখটা আমার ভুলা হয়ে উঠেনা৷ নীতুর নাম্বারটা আমার ভোলার চেস্টা করতাম৷ অনেক চেস্টা করেও ভোলা হয়ে উঠে না৷

বৃষ্টি এলেই আমার কবিতা শোনানোর নেশা জাগতো৷ কেউ আমার কবিতাগুলো গালে হাত রেখে মুগ্ধ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে শুনুক৷ আরেক বৃষ্টিতে আমি আবারো নীতুর ডিজিট চাপি৷ রিং বেজেছিল৷ রিসিভ হতেই মনটা খুশিতে নেচে উঠলো৷ আমি কানে ফোন গুজে বিছানায় শুয়ে পড়ি৷ লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বললাম, নীতুর প্রিয় কবিতার কয়েকটা লাইন শুনিয়ে বসলাম৷” ওপাশে সাড়া শব্দ নেই৷ আমিও চুপ থাকলাম৷ খানিক বাদেই রিনরিনে গলায় ওপাশ থেকে জবাব আসলো, আমি নীতু নই৷ আমি চাইলে আগেই বলতে পারতাম৷ ভাবলাম কবিতাটা শোনা যাক৷”

আমি টুপ করে কেটে দিলাম ফোনটা৷ খেয়াল করে দেখলাম দু’টো ডিজিট ভুল চেপে ফেলেছি৷ আমি কী নীতুর নাম্বারের শেষ দু’টো ডিজিট ভুলে গিয়েছি!” সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম৷ তারপর বৃষ্টি হলেই ঐপাশ থেকে ফোন আসতো৷ বরাবরই কবিতা শোনার আবদার৷ আমিও শোনাতাম অপরিচিতা মেয়েটাকে৷ অদ্ভূতভাবে আমিও বৃষ্টিদিনের অপেক্ষা করতাম৷ বৃষ্টি আসলেই অপরিচিতার ফোন আসবে৷ নিয়ম করে বর্ষার বৃষ্টি হতো৷ ফোনও আসত অপরিচিতার৷ বর্ষা শেষ হতেই আমার মনটা একটু খারাপ হলো৷ বৃষ্টি সারাবছরই হয় কমবেশি৷ তবুও নিয়ম করে আসবেনা৷ আমার ইচ্ছে হয় তবুও অপরিচিতাকে ফোন দিয়ে কবিতা শোনায়৷ পরক্ষণেই ইচ্ছেটা বাদ দেই৷ কী ভাববে ভেবে৷” তারপর কড়া রোদের একটা দুপুরে অপরিচিতার ফোন এসে হাজির হয়৷ আমার মনটা ঊৎফুল্লতায় ভরে উঠে৷ তবুও আমি চেপে রাখি৷ রিনরিনে গলায় বলল,

-অপরিচিতা বলছি৷”
-বলুন৷
-একবার আসুন না এদিকটায়৷ সমুদ্রের পাশে বাড়ি আমার৷ সমুদ্রের সামনে বসে আপনার কবিতা শুনবো৷”

আমি না করিনি৷ দিনকয়েক পরই আমি অপরিচিতার সামনে হাজির হই৷ শ্যামবর্ণের মেয়েটা৷ চেহারাটা গোলগাল৷ হালকা করে বোচা নাকটা চেহারার সাথে দারুণভাবে খাপ খেয়ে গিয়েছে৷ সৃষ্টিকর্তার যত্নময় সৃষ্টি৷ অপরিচিতার নামই নিধি৷ আমার সাথে ভাব হয়ে গেল খুব৷ শেষ বিকেশে সমুদ্রের ধারে বসে কবিতা শোনানো৷ ফাঁকে ফাঁকে জীবনের গল্প৷ আমার আর নীতুর গল্প৷ মেয়েটারও হারানোর গল্প, বেদনার গল্প৷”

গল্পের সূত্রে অদ্ভূত সত্য জানালো৷ ফোনের ওপাশ থেকে আমার শোনানো কবিতাগুলো মেয়েটা শুনতো নিকোটিনএ চুমূক দিয়ে৷ সিগারেট জিনিসটা আমার অসহ্য লাগলেও, মেয়েটার কবিতা শোনার জৌলুশ দেখে খারাপ লাগেনি৷” ছ্যাকা খেয়ে আমার কবিতার নেশা জেগে উঠার কথাশুনে মেয়েটা হাসে৷ হাসা শেষে বলে, তুমি ছেলে হয়েও সিগারেটের নেশা ধরেনি৷ আমি মেয়ে হয়েও ধরে গিয়েছে৷ যদিও আমার প্রেম ট্রেম হয়নি কখনো৷ তবুও বেদনা ধরে গেছে আমার৷ জাহির করার কেউ নেই৷ অদ্ভূত না?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বলতাম, অদ্ভূত বটে৷” মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে গিয়েছিলাম আমি৷ সমুদ্রপারে হাঁটতে গিয়ে আমার ইচ্ছে হতো, হাতটা ধরি৷ কিংবা সিগারেটে টান দেয়ার সময় পাতলা ঠোঁটের মাঝ থেকে সিগারেট নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে৷  তবুও দমিয়ে রাখি৷ ফেরার দিন মায়ামায়া চেহারাটার দিকে দৃষ্টিগোচরের আগ পর্যন্ত চেয়ে ছিলাম৷” “শুভ্র!” নিধির ডাকে ধ্যান ভাঙে আমার৷ আমি থতমত খেয়ে বসি৷ নিজেকে সামলে নেই৷ নিধি উঠে বসার চেস্টা করে৷ আমি বারণ করি৷ নিধীর মুখ উৎফুল্লতায় ভরে উঠে৷ তা আমি বুঝতে পারি৷ এলেমেলো হয়ে কপাল ঢেকে রাখা চুলগুলো পরম যত্নে সরিয়ে দিলাম৷ নাদুস নুদুস গালগুলো হালকা টেনে বললাম,

-এই বেহাল অবস্থা কেন?”
-হাল করার কেউ নেই যে৷

আমি ভ্রু কুচকে তাকায়৷ নিধি মোলায়েম একটা হাসি দিয়ে বলল, আমি মেয়েটা হুট করে প্রেমে পরে গেলাম বুঝলে৷ আমার ভালোলাগার কথা কখনো কাউকে জানানো হয়নি৷” “আচ্ছা তুমি কি আমাকে সারাজীবন কবিতা শোনাবে? এলোমেলো কবিতা! বৃষ্টির দিনে তুমি কবিতার বই নিয়ে বসবে৷ আমার হাতে চায়ের কাপ থাকবে৷ দু’টো নয়, একটা থাকবে৷ দু’জনে মিলে চুমুক দিয়ে খাবো৷” চা শেষ হতেই বৃষ্টিতে ভিজবো৷ প্রতি বৃষ্টিতে নতুন পায়েল পরিয়ে দিবে আমার পায়ে৷”

কড়া রোদের দুপুরেও কবিতা শোনাবে আমায়৷ কবিতা শোনাতে গিয়ে তোমার নাকের ঢগায় জমে থাকা ঘামগুলো আমি শাড়ির আঁচলে মুছে দিবো৷” আমার কপালে চুমু এঁকে দিবে মুচকি হেসে৷ তারপর আবারো কবিতা শোনাবে৷ সকাল, দুপুর কিংবা রাত শুধু কবিতাই শোনাবে৷ আর ভালোবাসবে৷ নয়তো ভাত বন্ধ৷ কবিতা শুনিয়ে বিরক্ত বানিয়ে ফেলবে৷ আমি মেকি বিরক্তমুখ নিয়ে বলবো, উফফ! এতো কবিতা ভালো লাগে না৷” তবুও তুমি জড়িয়ে ধরে কবিতা শোনাবে৷ সিগারেটের নেশা ধরলে, টুপ করে চুমু দিয়ে বসবে! পারবে?” আমি অবাক হই৷ নিকোটিনের দহনে নিজের ভেতরটা ছাই বানানো মেয়েটার ভেতরে এতো লুকানো আবেগ দেখে৷ আমি অনুভব করি, মেয়েটার বেদনা জাহির করার একজন দরকার৷ সেই একজনটা নাহয় আমিই হলাম৷” নিধী আমার হাতটা নাড়া দিয়ে বলল,

-আমার হবে?” আমি হালকা বোঁচা নাকটা টেনে বললাম,
-হবো!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত