এই দিনরাত এমন ন্যাকামি করো না তো। “সবই বিয়ের আগে না” , শুনতে শুনতে আমি জাস্ট বিরক্ত হয়ে গেছি ইন্দ্রানী। অ্যাট লিস্ট কিস তো করতে দেবে তোমার ঐ জুসি ঠোঁট দুটোতে ! আমূল কেঁপে উঠলো ইন্দ্রানী। আধুনিক কালের মেয়ে হলেও মনে মনে ও ভীষন সনাতন পন্থী। বিয়ের আগে শরীর কেউ ছোঁবে না গোছের মানসিকতার বশবর্তী। সৌনক প্রায়ই ভিড় রাস্তায় ইন্দ্রানীর হাত ধরতে গিয়েও টিপ্পনি কেটেছে। “ওহ..তোমার হাত ধরলে তো আবার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাবো! আজব প্রেমিকা জুটিয়েছি আমি বটে। বন্ধুরা শুনলে আমাকে নিয়ে খিল্লি করবে বুঝলে !”
“আমি আজ কোনো কথা শুনবো না ইন্দ্রানী। তোমাকে আজ উনিভার্সিটির পরে আমার বাড়িতে যেতেই হবে। আগে প্রমিস করো।” একরাশ অভিমান গলায় নিয়ে আব্দার জুড়লো সৌনক। ইন্দ্রানী ভালোবাসার পুরুষের অভিমানী মুখের দিকে তাকিয়েও শেষ চেষ্টা করলো, “কিন্তু সৌনক রাত হয়ে যাবে যে। উনিভার্সিটির পরে গানের ক্লাস সেরে আবার তোমাদের বাড়ি !” “ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড ইন্দ্রানী আমার বার্থ ডে আর তুমি প্রেজেন্ট নেই। অফিস কলিগরা কি বলবে বলতো !
তাছাড়া আজ মা-বাবার সাথেও তোমার পরিচয়টা করিয়ে দেব সোনা। প্লিজ একদিন তোমার বাড়িতে ম্যানেজ করো।” ইন্দ্রানী চিন্তান্বিত মুখে বললো, “বেশ দেখছি।” মুস্কিলটা হলো শীতের দিনে সাড়ে পাঁচটা মানেই সন্ধ্যে। গানের ক্লাস মিস করলেই গানের নীলিমা দি ডিরেক্ট মাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করে, “কি রে ইন্দ্রানী আজ এলো না কেন ?” তখন! তখন কি উত্তর দেবে ইন্দ্রানী।
সৌনকএর কথা এখনো বাড়িতে বলেনি। যদিও সৌনকের সাথে ওর বছর দুয়েকের সম্পর্ক। তবুও বাবার সামনে দাঁড়ালেই কেমন একটা অজানা ভয় চেপে ধরে ওকে। আসলে ছোট থেকেই যৌথ পরিবারের রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হয়েছে ইন্দ্রানী। বাবা,জ্যেঠুর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রেমের কথা বলবে, এমন সাহসই ওর নেই। ওদের বাড়ির কেউ প্রেম করে বিয়ে করেনি। অভিভাবকরা দেখা শোনা করে বিয়ে দিয়েছে সকলের। এমনকি ইন্দ্রানীর ছোট কাকার বিয়ের সময় ছোট কাকিমাকে কাকুর খুব একটা পছন্দ ছিল না।তবুও জেঠুর মুখের ওপর কোনো কথা না বলতে পেরেই চুপ করে ছাদনা তলায় বসেছিল কাকু।
ইন্দ্রানীর ভয়ে বুকটা কেঁপে ওঠে, কি করে বলবে ও সৌনকের কথা! বিশেষ করে ফেসবুকে পরিচয় ,তারপর প্রেম শুনলেই তো বাবা আর জ্যেঠু ওর ইউনিভার্সিটি যাওয়াই বন্ধ করে দেবে। মাঝে মাঝে খুব দমবন্ধ লাগে ওর। বান্ধবীরা জিন্স টপ পরে,ও সেই একটি ফুলহাতা চুড়িদার। ক্লাসের বন্ধুরা মজা করে বলে, “ওরে আমাদের কাননদেবী এসে গেছে।” আওয়াজ খেতে খেতে এখন ও অভ্যস্ত।
মুস্কিলটা হলো, সৌনকের সাথে পরিচয় বা বন্ধুত্ব হলেও প্রেম করতে তেমন আগ্রহী ছিল না ইন্দ্রানী। নিজের বাড়ির পরিবেশ তো ও জানতো। কিন্তু নিজের সব কথা সৌনকের সাথে শেয়ার করতে করতে কবে যে ওদের সম্পর্কটা প্রেমে পরিণত হয়ে গেছে ইন্দ্রানী নিজেও জানে না। মাঝে মাঝে ওরও মনেহয়, সৌনক বোধহয় এবার বিরক্ত হচ্ছে। কোথাও মিট করার কথা হলেই ইন্দ্রানী বলে, “দেরি করে ফিরলে বাড়িতে বকবে।” আজ ওর জন্মদিনে কি করে বলবে ইন্দ্রানী, “যে পার্টিতে যাবে না!” কাঁচুমাচু গলায় ইন্দ্রানী বললো, “বেশ আমি ট্রাই করছি সৌনক , কিন্তু আধঘন্টার বেশি থাকবো না কিন্তু।”
“যা ইচ্ছে করো,তাও এস প্লিজ। আর হ্যাঁ, আজ একটা শাড়ি পরে এসো কিন্তু।” কথাটা শোনার পর থেকেই ভিতরে ভিতরে ভয় করতে শুরু হয়ে করেছে ইন্দ্রানীর। বন্ধুদের বাড়ির নিমন্ত্রন থাকলে তারা মা বাবার সাথে ফোনে কথা বলে, দল বেঁধে যায়। বাড়িতে প্রবলেম হয়না। এক্ষেত্রে বলবেই বা কি! বেশ আমতা আমতা করে ইন্দ্রানী চায়ের টেবিলে গিয়ে বাবার সামনে গিয়ে বলল, “বাবা..আজ গানের স্কুল থেকে একটা বান্ধবীর বাড়ি যাবো। কিছু নোটসের দরকার।” বাবা মুখটা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফেরা ঔরঙ্গজেবের মত করে বলল, “বাড়িটা কোথায়? কি নাম বান্ধবির?”
সুলগ্না এত মিথ্যে একসাথে বলতে গিয়ে যেন ধরা না পড়ে যায়। “বাড়ি ওই গাঙ্গুলিবাগানের দিকে।” ওদের বাড়ি থেকে ওটা একটু দূরে আছে তাও। বাবা যাও কয়েদ খানায় নিয়ে যাও না বলে বললো, “বেশি দেরি করো না যেন।” এই শীতেও ইন্দ্রানীর হাতের তালু ঘেমে গিয়েছিল। যাইহোক,এত কাণ্ডের পর আবার মায়ের কাছে বলবে কি করে, যে শাড়ি পরে যাবে! অবশ্য মা একচান্সেই বললো, “হ্যাঁ শাড়ি পরা অভ্যেস কর। আর তো মাত্র তিনটি মাস, তারপরেই তোর ফাইনাল পরীক্ষা হবে আর পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।” চুপচাপ সৌনকএর পছন্দের হালকা গোলাপি শাড়িটা পরে নিলো ইন্দ্রানী। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই লজ্জা পেল। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতি। বিয়ের পরে যে বাড়িতে সংসার করবে সেই বাড়িতে আজ ওর প্রথম পদার্পন। কেমন হবে সৌনকের বাবা মা! ওকে মেনে নেবে তো? বিয়ে মানে তো শুধু স্বামী নয়, একটা সম্পুর্ন অপরিচিত গোটা জগৎ।
তাই সৌনকের পরিবারের সকলের সাথেই পরিচয় হওয়াটা জরুরি । সৌনক বলেছে এরপরেই ও ওর বাবা মাকে নিয়ে আসবে। ফুলের বুকে আর ওর পছন্দের পারফিউম কিনেই ট্যাক্সি ধরলো ইন্দ্রানী। আজ ইউনিভার্সিটিতেও সবাই আড়চোখে তাকাচ্ছিল ওর দিকে। অদ্ভুত একটা ভালোলাগা মিশেছিলো ইন্দ্রানীর মনে। আজ গানের ক্লাসে গিয়েও মন বসাতে পারছিল না ও। সৌনক একটা সাদা পাঞ্জাবি পরে বাড়ির সামনেই অপেক্ষা করছিল ইন্দ্রানীর জন্য। একমুখ হেসে সৌনক বললো, “যাক রাজকুমারীকে অবশেষে সম্রাট ছেড়েছেন।” সৌনকের বাবা মাও খুব খুশি হবু বৌমাকে পেয়ে।
সৌনকদের অফিসের কলিগদের সাথে পরিচয়ের আগেই ঘনঘন ঘড়ি দেখছিল ইন্দ্রানী। সেটা খেয়াল করেই সৌনক বললো, “মাত্র সাতটা বাজে ইন্দ্রানী। অন্তত আটটা পর্যন্ত থাকো প্লিজ।” এর মধ্যেই বাবা দুবার ফোন করেছিল। অসহায় মুখে ও বললো, “সৌনক আজ আর হবে না ,আমাকে এখুনি যেতে হবে যে।” সৌনকের বেডরুমে এই প্রথম ওকে জড়িয়ে ধরেছিল ও। ইন্দ্রানী কেঁপে উঠছিল প্রথম পুরুষের ছোঁয়ায়। ভালোলাগায় ভাসছিল ও, তবুও সৌনক মুখটা গম্ভীর করে রেখেছিল। এখুনি ঢুকবে ওর অফিস কলিগরা। সেই মুহূর্তেই বেরিয়ে গেল ইন্দ্রানী। সৌনকই ট্যাক্সি ডেকে তুলে দিল ওকে।
মিনিট দশেক চলার পরেই ট্যাক্সিটা গন্ডগোল করতে শুরু করলো। বিরক্ত হয়ে নেমে পড়লো ইন্দ্রানী। কয়েক পা হেঁটে ধরে নেবে অন্য ট্যাক্সী। বাবার ফোনে ভয়ে ভয়েই বললো, “আর ঘন্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে বাড়ি।” নির্জন রাস্তা ধরে কয়েকপা হাঁটার পরেই আর কিছু মনে ছিল না ওর। মুখটা বাঁধা, শরীরে অকথ্য যন্ত্রনা নিয়ে সেন্স ফিরেছিল ওর। বেশ কয়েকজন ঘিরে ধরে ছিল ওকে। ওর গোলাপি শাড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। ভিড়ের মধ্যেই দেখতে পেয়েছিল বাবার মুখটা। বেশ কয়েকদিন বাড়িতে ঘর বন্দী হয়ে বসেছিলো ইন্দ্রানী।
বাবা নিজের চুলের মুঠি ঝাঁকিয়ে বলেছিল, “ইন্দ্রানীর ফোন থেকেই বোধহয় নাম্বারটা পেয়েছিল ওখানের লোকগুলো। আমাকে ফোন করে বললো, একটি গোলাপি শাড়ির মেয়ের আর বলতে পারেনি বাবা। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ইন্দ্রানীর ছবি। ওই ভিড়ের মধ্যে কে যে ওর ছবি তুলেছিল বুঝতেও পারেনি অজ্ঞান ইন্দ্রানী। ওকে বাঁচানোর লোকের অভাব ছিল ঠিকই কিন্তু ওর ছবি তোলার লোকের অভাব ছিল না। এমনকি মিডিয়ার ভিড় লেগে গিয়েছিলো ওদের বাড়ির সামনে। ইন্দ্রানী কারোর সামনে বেরোয় নি।
পাগলের মত সৌনককে ডায়াল করে গেছে ও। কিছুতেই ফোন ধরেনি সৌনক। শুধু একটা মেসেজ “ক্ষমা করো ইন্দ্রানী। আমার বাবা মা সকলে দেখেছে তোমার ছবি। কেউ আর মেনে নেবে না এই সম্পর্কটা।” কিন্তু সৌনক আমার দোষ কোথায়? না আর উত্তর আসেনি ও তরফ থেকে। ধর্ষিতা মেয়েরা করুনার পাত্র হতে পারে কিন্তু কারোর প্রেমিকা বা স্ত্রী নয়। সত্যিটা খুব সহজেই বুঝে গিয়েছিল ইন্দ্রানী। নিজের শরীরের ক্ষতগুলোতে ওষুধ না লাগিয়ে কষ্টটা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছিল ইন্দ্রানী। আর মনে মনে সঞ্চয় করছিল একরাশ প্রশ্নের সম্মুখীন হবার মত জোর।
পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছে ও ,অন্ধকারে কাউকে চিনতে পারেনি ও। সত্যিই চিনতে পারেনি ওর জীবনটা তছনছ করে দেওয়া মানুষ দুটো অথবা চারটেকে। শুধু শহরের রাস্তায় কোনো প্রতিবাদী মোমবাতি মিছিল বেরোয়নি ওকে কেন্দ্র করে, কারণ ধর্ষকরা ওকে জীবিত ছেড়েছিল, মেরে ফেলেনি। ইউনিভার্সিটির লাস্ট পরীক্ষার জন্য পাগলের মত খেটে চলছিল ও। কিন্তু পড়তে বসলেই শুধু সেই কালো মুখগুলো দৃষ্টিপথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো। নোনতা জলে ভিজে যাচ্ছিল বইয়ের পাতা।
বাবার সাথে ইন্দ্রানী বসে আছে একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর চেম্বারে। বাবার শরীরটাও যেন ভেঙে গেছে এই সাত দিন। সেই রাগী রাগী ভাবটা চলে গিয়ে কেমন বিধস্ত চেহারা নিয়েছে। বাবা নিজের মুখটা ঢেকে কেঁদে বলেছিল, “মেয়ের বাবার বড় জ্বালা।”
ওটা শুনেই বোধহয় সব থেকে বেশি কষ্ট হয়েছিল ইন্দ্রানীর। ওর রাশভারী বাবাকে ভেঙে পড়তে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছিল ওর। ডক্টর দিগন্ত রায় বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন ইন্দ্রানীর দিকে। অপলক তারপর বললেন, “কি মনে হয় তোমার, রেপ মানে কি? মনের বিরুদ্ধে জোর করে যে কোনো কাজ! তাই তো?” ঘাড় নাড়লো ইন্দ্রানী। দিগন্ত বললো, “একটু ভালো করে ভেবে বলো তো…জীবনে কত বার তুমি নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো কাজ করেছ?”
ইন্দ্রানী বললো, “হ্যাঁ করেছি। আমার ইচ্ছে ছিল ইকোনমিক্স অনার্স নিয়ে পড়বো। কিন্তু বাবার ইচ্ছেয় ইংলিশ পড়ছি।” ডাক্তারের মুখে মিষ্টি হাসি। “এটা রেপ নয়? কোনোদিন হয়তো ভেটকি মাছ খেতে না, কারোর অনুরোধে জোর করে ভেটকি ফ্রাই খেলে, সেটাও কিন্তু তোমার মনের বিরুদ্ধেই। ওই দিন রাস্তায় তুমি মনের বিরুদ্ধেই কিছু মানুষের নোংরামির স্বীকার হয়েছ, কষ্ট হয়েছে তোমার। কিন্তু বাকিগুলোর মত এটা নিয়ে এত কুন্ঠিত কেন তুমি?”
বছর সাইত্রিশের ডাক্তারের ঝুলপির কাছে দু একটা সিলভার লাইন। চোখে পাওয়ারের চশমা। শুধু হাসিটা অমলিন। পৃথিবীতে কিছুই যেন খারাপ নেই। “শরীরের বাকি রোগগুলো যদি সারতে পারে তাহলে এটাও সারবে।” কাঁদছিলো ইন্দ্রানী। ফুঁপিয়ে কেঁদে ফেলেছিল। দিগন্ত বললো, “ইন্দ্রানী ..পবিত্রতা শরীরের মত ক্ষণে ক্ষণে রোগে পড়া জায়গায় থাকে না,থাকে মনে।” ইন্দ্রানী জানে না কেন! তবুও একমাত্র দিগন্তর সাথে কথা বললেই ও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার প্রাণ শক্তি খুঁজে পাচ্ছে।
প্রায় রেগুলারই ফোনে কথা বলে ওরা। ডাক্তার নয় ,দিগন্ত যেন খুব কাছের বন্ধু। পরীক্ষাটা ভালোই দিয়েছে ইন্দ্রানী। তবে এই ভালো পরীক্ষা দেবার জন্য সম্পুর্ন কৃতিত্ব দিগন্তর। ও যদি এভাবে শক্তিসঞ্চার না করতো, তাহলে হয়তো কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না ইন্দ্রানী। আজ রাতে দিগন্তের কোনো একটা মিটিং আছে। তাই আজ ইন্দ্রানী কল করেনি ওকে। এই প্রথম ইন্দ্রানী বুঝতে পারলো, দিগন্তকে ইন্দ্রানী অন্য চোখে দেখতে শুরু করেছে। খুব কাছের বন্ধুর বেশিই কিছু।
দিগন্তর বয়েস প্রায় সাইত্রিশ। ইন্দ্রানীর থেকে তেরো বছরের বড়। হয়তো স্ত্রী সন্তানও আছে ওর। ইন্দ্রানীর অসহায় অবস্থায় ওকে সাহায্য করেছে বলেই ,এই ধরণের ভাবনাটা বড্ড ভুল হচ্ছে । কিন্তু কেন কিছুতেই ইন্দ্রানী ওকে ভুলতে পারছে না। ওর বলা সব কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে ওর। “ইন্দ্রানী, জীবনে কখনো ছোট্ট ডোবাকে ভালোবেসো না। ডোবাকে করুনা করো কিন্তু ভালোবেসো সমুদ্রকে। সমুদ্র তোমাকে তার বিশালতা দিয়ে প্রসারতা চেনাবে। আর ডোবা তোমাকে চেনাবে সংকীর্ণতা।” কেন কে জানে আজকাল ইন্দ্রানীর সৌনককে ডোবার মতোই মনে হয়। একটা অন্তত সাধারণ সংকীর্ণ মনের ছেলে। যে ভালোবাসার অর্থই বোঝে না।
রাত তখন প্রায় বারোটা। আর পারছে না ইন্দ্রানী। উত্তরটা আজ ওকে পেতেই হবে। এতক্ষনে হয়তো দিগন্ত ফিরেছে মিটিং থেকে। হয়তো স্ত্রীর সাথে নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। ফোন করাটা কি ঠিক। তাছাড়া ব্যক্তিগত কথা তো শুধু ইন্দ্রাণীই বলতো , দিগন্ত তো নিজের ব্যাপারে কখনো কিছু বলেনি। প্রতিটা রিঙের আওয়াজে বুকের ভিতরে তোলপাড় হচ্ছে ইন্দ্রানীর। অবশেষে ঘুম গলায় ফোনটা ধরলো দিগন্ত। “কি হয়েছে ইন্দ্রানী? কোনো প্রবলেম?”
এ প্রান্তে শুধুই ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ। দিগন্ত ধীর গলায় বলল, “কেঁদো না ইন্দ্রানী। আমি জানি তুমি কি বলতে চাইছো। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। হয়তো আমিও… কিন্তু আমাদের বয়েসের পার্থক্যটা কখনো ভেবেছো? তোমার সামনে সুন্দর ভবিষ্যৎ।” ইন্দ্রানী কান্না ভেজা গলায় বলল, “মনের বয়েসটা বুঝি গুরুত্বপূর্ণ নয়? শরীরের বয়েসটাই বুঝি সব?” দিগন্ত খোলা গলায় হেসে বললো, “আমি অনাথ। খুব ছোট বেলায় বাবা মা মারা গিয়েছিলেন, পিসির কাছেই মানুষ হয়েছি।”
কথা শেষ করতে না দিয়েই ইন্দ্রানী বললো, “যদি তেরো বছরের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তোমাকে ছেড়ে আমি তেরো সেকেন্ডও না থাকতে পারি, সেটাকে কি বলে ডক্টর দিগন্ত রায়?” বেশ কয়েকমাস হয়ে গেছে ইন্দ্রানী আর দিগন্তর সুখী দাম্পত্যের। ইন্দ্রানী এখন একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা। ইন্দ্রানীর গোছানো সংসারের আদরে এলোমেলো দিগন্ত এখন পরিপূর্ণ। সেদিনও ছিল এমনি শীতের সন্ধ্যে। দিগন্ত চেম্বারে। চেম্বার সেরে দুজনের যাওয়ার কথা ছিল শপিংএ। গাড়ি নিয়েই ওর চেম্বারের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিল ইন্দ্রানী।
হঠাৎই চিৎকারটা কানে এলো ওর। গাড়ি দাঁড় করাতেই চোখে পড়লো একটা গোলাপি শাড়ির অল্পবয়সী মেয়ে পাগলের মত দিকবিদিক জ্ঞান শুন্য হয়ে ছুটছে। শাড়ীর কয়েক জায়গায় ছেড়া। ইন্দ্রানীর পাঞ্জাবি ড্রাইভার সামনে দাঁড়াতেই পিছনের ছেলে দুটো ছুট লাগলো। মেয়েটি ক্লান্ত ইন্দ্রানী গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল দিগন্তর চেম্বারে। প্রাথমিক চিকিৎসার পরেই দিগন্ত বললো, “মানসিক ভাবে বিধস্ত। বাড়িতে খবর দাও ইন্দ্রানী।” দিগন্তই ফোন করেছে ওর বাড়িতে। মেয়েটি কান্না ভেজা গলায় বলল, “আজ যদি তুমি না থাকতে দিদি তাহলে আমার সর্বনাশ হয়ে যেত।” হন্তদন্ত হয়ে যে মানুষটি ছুটে চেম্বারে ঢুকছে ,তাকে বছর খানেক আগে জন্মদিনের সন্ধ্যেতে শেষ দেখেছিল ইন্দ্রানী।
মল্লিকা বলে মেয়েটি তাহলে সৌনকের স্ত্রী। সৌনক ঢুকেই জড়িয়ে ধরেছে নিজের স্ত্রীকে। ভাগ্যিস ভাগ্যিস মল্লিকাকে বাঁচাতে পেরেছিল ইন্দ্রানী। নাহলে কি করতো সৌনক! অপবিত্র ধর্ষিতা স্ত্রী কে কি ডিভোর্স করতো! মল্লিকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “এই দিদিই আমাকে আজ সৌনকের চোখে বিস্ময়। কোনটা দেখে বিস্ময়? ইন্দ্রানীর সিঁথির লাল রংটা দেখে কি?
“ধন্যবাদ…” সৌনকের কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ইন্দ্রানী বললো,”আমার হাজবেন্ড ডক্টর দিগন্ত রায়কে থ্যাংকস জানান। ওই আপনার ওয়াইফের ট্রিটমেন্ট করেছে এই মুহূর্তে।” সৌনকের বিস্মিত ভাবটা কাটার আগেই ইন্দ্রানী বললো, “চলো দিগন্ত…আমাদের শপিংয়ের দেরি হয়ে যাচ্ছে।” ইন্দ্রানীর মনে পড়ে গেলো , দিগন্তর বলা সেই কথাটা “ইন্দ্রানী ডোবাকে নয় সমুদ্রকে ভালোবাসো। যে তোমাকে বিশালতা শেখাবে ডোবাকে করুণা কোরো, সমুদ্রকে আলিঙ্গন।”