পরিচয় পত্রিকার যাত্রা শুরু ১৯৩১-এর অক্টোবরে। ঠিক এক বছর আগেই বুদ্ধদেব বসু শুরু করেছেন কবিতাবিষয়ক ত্রৈমাসিক ‘কবিতা’। ওইবছরই অর্থাৎ ১৯৩০-এ অজিত দত্ত-এর সঙ্গে বুদ্ধদেব ‘প্রগতি’ নামে আরেকটি মাসিকপত্রও চালু করেছেন। ১৯৩৩-এ শুরু হবে সাপ্তাহিক ‘দেশ’। ওই তিনের দশকেই আসবে ‘সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘পূর্বাশা’। হুমায়ুন কবীরের মাসিকপত্র ‘চতুরঙ্গ’। বাংলা সাময়িকপত্রের ইতিহাসে গত শতকের তিনের দশক ঠাটবাটে উজ্জ্বল।
বিশ্বসাহিত্যে তখন রাজত্ব করছে জয়েস, প্রুস্ত, কাফকা বা এলিয়টের রচনা। সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চাইছেন বিশ্বসাহিত্য ও ভাবনার সঙ্গে বাঙালির তৈরি হোক গভীর যোগাযোগ। বছর দুয়েক আগে স্বাস্থ্য-সংস্কারের জন্য রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হয়ে গিয়েছিলেন বিদেশে। মূলত ইউরোপ। ইউরোপ থেকে ফেরার কিছুদিন পরে সুধীন্দ্রনাথের ইচ্ছে হলো – ইংরাজী বা ফরাসী ‘রিভিউ’ এর আদলে একটি উচ্চাদর্শের সাময়িকপত্র প্রকাশ হোক বাংলা ভাষায়। উদ্দেশ্য – “বিশ্বের পরিশীলন-সম্পদের সহিত বাঙালী পাঠকের আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ করিয়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সমৃদ্ধ সাধন।” তার এই সংকল্পকে সম্মান করে অন্যান্য সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুরা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন হাত।
নবতিপর এই পত্রিকা এখনও জীবিত। অধুনা তৈরি হয়েছে পত্রিকার একটি ফেসবুক পাতাও। সেই পাতা উলটে মিলছে কিছু ইতিহাস। লোকবল সংগ্রহের পর উদ্যোক্তারা পত্রিকার একটি পরিচালকমন্ডলী গঠন করেছিলেন। পত্রিকা-প্রকাশের পরিকল্পনার সঙ্গে প্রথম থেকে যারা যুক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে চারুচন্দ্র দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সুবোধচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, প্রবোধচন্দ্র বাগচী, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ রায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও গিরিজাপতি ভট্টাচার্য – এই আটজনকে নিয়ে সম্পাদকমন্ডলী গঠন করা হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল – এই মন্ডলীর কাজ হবে কাগজটির আকৃতি-প্রকৃতি নির্ধারণ ও বিশেষভাবে ছাপার জন্য লেখা নির্বাচন। আরো ঠিক হলো সম্পাদকমন্ডলীর নিয়মিত অধিবেশন হবে সপ্তাহের নির্দিষ্ট একদিনে। ক্রমে এই অধিবেশনই পরিণত হল পরিচয় গোষ্ঠীর সাপ্তাহিক বৈঠকে।
পরিচয় পত্রিকার উদ্যোক্তারা বুঝেছিলেন যে, পিছনে একটি সাহিত্যিক গোষ্ঠী না থাকলে উচ্চমানের একটি সাহিত্য-সাময়িক নিয়মিত প্রকাশ করা কঠিন। তাই ১৯৩১ সালের মাঝামাঝি – পরিচয় প্রকাশের কিছু আগে থেকে প্রতি শুক্রবারের সন্ধ্যায় পরিচয়-গোষ্ঠীর বৈঠক বসতে শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু আড্ডা নয় – কাজ। অর্থাৎ রচনা নির্বাচন, রচনা সংগ্রহের ব্যবস্থা ও এই উদ্দেশ্যে বিবিধ ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ।
শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের ডায়েরি থেকে জানা যায় পরিচয়-এর আড্ডায় সম্পাদকমন্ডলীর ‘অষ্টদিকপাল’ তো থাকতেনই, তাছাড়াও হারীতকৃষ্ণ দেব, সুরেন মৈত্র, আবু সৈয়দ আয়ুব, বিষ্ণু দে, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, সুমন্ত্র মহলানবীশ, বটকৃষ্ণ ঘোষ, হেমেন্দ্রলাল রায়, অন্নদাশঙ্কর রায় প্রমুখও আসতেন। প্রবোধচন্দ্র বাগচীর বাড়ির সভায় প্রমথ চৌধুরীও একাধিকবার উপস্থিত থেকেছেন।
১৩৪২ সালে পরিচয় কার্যালয় কলেজ স্কোয়ারে আসার পর একটা আড্ডা গড়ে উঠলো। এখানে যারা আসতেন তাদের মধ্যে ছিলেন – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, হরপ্রসাদ মিত্র, মণীন্দ্র রায়, বিশু মুখোপাধ্যায়, রজত সেন, স্বর্ণকমল ভট্টাচাৰ্য, অমিয় গঙ্গোপাধ্যায়, আশুতোষ কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ নীরদ ভট্টাচার্য, আশানন্দ নাগ এবং আরো অনেকে যাঁরা তখনই সাহিত্য জগতে খ্যাতি অর্জন করেছেন। আসতেন হুমায়ুন কবীর, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বা হিরণ সান্যাল। এমনকী বিভূতিভূষণ, পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন বোসও যোগ দিতেন পরিচয়-এর আড্ডায়। এখানেই একদিন মানিক বন্দোপাধ্যায়কে একটি উপন্যাস দিতে বললে তিনি সম্মত হন এবং মাসখানেকের মধ্যেই উপন্যাসের প্রথম কিস্তি দিয়ে যান। এই উপন্যাসটি পরিচয়ে ‘অহিংসা’ নামে প্রকাশিত হয়।
পরিচয় নিয়ে হঠাৎ এই সাতকাহন ফাঁদার মতলব কী? কারণ হাতে এসেছে সৃষ্টিসুখ থেকে প্রকাশিত প্রবীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পুস্তক ‘পরিচয়ের আড্ডায়’। ভূমিকা পড়ে মনে হলো বেশ সরস ভঙ্গিতে লেখক দিতে চলেছেন পরিচয়-এর বিখ্যাত আড্ডার সুলুক ও সন্ধান। দেবাশীষ দেবের প্রচ্ছদ সেই সরসতার সিংহদুয়ার। পরিচয়ের আড্ডার অনুপুঙ্খ বর্ণনা তো আর কেউ লিখে রেখে যাননি। শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের মতো কয়েকজনের স্মৃতিকথা ও ডায়েরিতে যা মেলে, সেটুকু দিয়েই সলতে পাকানোর পালা। লেখক তাই ভূমিকাতে বলেই দিয়েছেন তাঁর রচনাটি সম্পূর্ণভাবেই ফিকশন। ঐতিহাসিক পটভূমি ও চরিত্রের সত্যতা রেখে তিনি ফেঁদেছেন মোট দশটি গপ্পো। তবে আসল আড্ডার বহু গুণিজনকে সাইডে রেখে তিনি কিছুটা পক্ষপাত দেখিয়েই বেশিরভাগ গল্পেরই কুশীলব করেছেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, সুশোভন সরকার, চারুচন্দ্র দত্ত বা অপূর্ব চন্দকে। লেখকের মুগ্ধতা সত্যেন্দ্রনাথেই বেশি, ফলত সত্যেনই অধিকাংশ গল্পের কথক।
‘কিসসা লখনৌ কা’ অবশ্যই ধূর্জটি ছাড়া হয় না, কারণ ধূর্জটি ছিলেন লক্ষ্ণৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক। তাছাড়া তিনি ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ এবং রসনার সমঝদার। ফলত লক্ষ্ণৌয়ের নবাবী কোর্মা বা আনারদানা পোলাও বা ‘দুধ কা পুঁরিয়া’ বা ‘মিঠাই কে আনার’ এর সুবাসে শুরুয়াত মন্দ হয় না। ‘কবির বিভ্রম’ গপ্পে সত্যেন বোস সুধীন্দ্রনাথকে সামনে রেখে শোনাচ্ছেন কবিতা ও স্বপ্নের মায়াবিভ্রম। ‘পেনেটির সেই রাত’-এর মতো ভূতের গল্প তৈরি করে লেখক বলিয়েছেন তত্কালীন লীলা রায়কে (পরে মজুমদার) দিয়ে। বাংলায় কেন ভাল গোয়েন্দা গপ্পো লেখা হয় না, এনেছেন সেই বিতর্ক আড্ডায় আর লিখে ফেলেছেন ‘বন্ধ ঘরের রহস্য’ নামক এক মজাদার মার্ডার মিস্ট্রি। ‘জুলিয়াস সিজারের ক্যালেণ্ডার’ গপ্পে আছে বর্তমান সিজারিয়ান ক্যালেণ্ডারের ইতিকথা। সিজার-ক্লিওপেট্রার প্রেমপর্বে মিশে গেছে তৎকালীন বিশ্বরাজনীতি, সময়ের হিসেব ও মিথ। ভাষাবিদ সুনীতি চাটুজ্জেকে মাঝে রেখে ‘শব্দসন্ধানী’ বাংলাভাষার বৈভব ও গৌরবের গল্প। অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও, বাঙালি আড্ডার অন্যতম প্রিয় বিষয়, চৈতন্যের অন্তর্ধান রহস্যও ঢুকে পড়ে এই গপ্পে।
শ্যামলকৃষ্ণ বেশ কিছুকাল কাটিয়েছেন পূর্ব আফ্রিকায় আর আড্ডায় যোগ দিতেন বিভূতিভূষণ, এই দুটি তথ্য ছিল লেখকের ভাঁড়ারে। ব্যাস, খাপে খাপ উগাণ্ডার সাপ! মানে ব্ল্যাক মাম্বা! ‘নামাসাগালিতে’ শ্যামলকৃষ্ণ রসিয়ে বলছেন উগাণ্ডার ব্ল্যাক মাম্বার গল্প আর তন্ময় হয়ে শুনছেন আর ভাবছেন বিভূতিভূষণ। সুধীন্দ্রনাথের প্রশ্ন, ‘আপনার নিশ্চিন্দিপুরে সাপ নিয়ে আসবেন কিনা সেই নিয়ে ভাবছেন বুঝি?’ বিভূতিভূষণের সহাস্য উত্তর, ‘খানিকটা ঠিকই ধরেছেন। তবে নিশ্চিন্দিপুরে আর ব্ল্যাক মাম্বা আনি কী করে বলুন? নতুন কিছু লিখতে হবে, ওই আফ্রিকার পটভূমিকাতেই।’
তবে আড্ডার গপ্পোগুলো পর-পর পড়তে পড়তে মনে হবে, লেখক যেন গপ্পোর কাহিনীগুলো আগেই নির্বাচন করেছেন, তারপর সুবিধে মতো কুশীলব নির্বাচন করে বসিয়ে দিয়েছেন তাঁদের মুখে। বেশিরভাগ গল্পেই ন্যারেটিভ প্রায় নেই, কথোপকথন নির্ভর। কথকদেরও কথা-বলার ভঙ্গিও প্রায়-একধরনের। সত্যেন্দ্রনাথ যে-গল্প বলেন, সুধীন্দ্রনাথ বা ধূর্জটিপ্রসাদ সে-গল্প বললেও কোনও পার্থক্য হতো না। ফলত কোনও চরিত্রই দানা বাঁধে না যথাযথ।
অধিকাংশ গল্পে কাহিনি-নির্মাণ ও বিন্যাসের ক্ষেত্রে কিঞ্চিত দুর্বলতার কারণে গল্পগুলো কেমন নিরালম্ব ঝুলে থাকে। জমিতে পা দিয়ে খাড়া হতে পারে না। যে-ভাষা আর বিবরণের মুন্সিয়ানায় গল্প সার্থক হয়ে ওঠে, তার দেখা কোনও গল্পেই মেলে না। তিন বা চারের দশকের আড্ডার ভাষায়, বাংলাভাষার যে-আটপৌরে ঢং থাকার কথা, সেইসব লক্ষণের অনুপস্থিতিও প্রকট হয়ে পড়ে।
দশটির মধ্যে আলাদা করে দুটি গল্পের কথা উল্লেখ করা যায় যেগুলি গল্প হিসেবে কিছুটা উতরেছে। ঢাকা শহরে দীর্ঘ বসবাসকালীন সত্যেন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘কেচ্ছা-কাহিনী’ গল্পে কিছুটা সমসাময়িক রাজনীতি ও সমাজ উঁকি মেরেছে, তাই গল্পটিকে রক্তমাংসের মনে হয়েছে। ইতিহাসবিদ সুশোভন সরকারের ডাবলিন-অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘কালো শুধু কালো নয়’ চমকপ্রদ কাহিনী। ট্রিনিটি কলেজের লাইব্রেরির নির্জন স্বল্পালোকিত ঘরে, সুশোভন আবিষ্কার করেন একটি ডায়েরি, এক বৃদ্ধ লাইব্রেরিয়ান আর মৃত্যুর ঠিকানা। ডায়েরিটি কবি এবং প্র্যাকটিসিং অ্যালকেমিস্ট উইলিয়াম ব্লেকের। মৃত্যুর ঠিকানা লেখা ম্যাপের হদিশ দেন মোটা লেন্সের চশমা-পরা বৃদ্ধ গ্রন্থাগারিক আসলে যাঁর কোনও শরীরী অস্তিত্বই নেই। সুশোভন যেন সেদিন এক লহমায় দেখে ফেলেন মিশরীয় মৃত্যুর দেবতা আনুবিসকে।
পরিচয়-এর আড্ডা চা-তেলেভাজার বৈঠক ছিল না নিশ্চয়ই! নিছক বৈঠকি আড্ডাও ছিল না। বিশ্বসাহিত্য থেকে রাজনীতি, সংস্কৃতি থেকে সমাজতত্ত্ব সব-ই আলোচনায় উঠে আসতো তৎকালীন বাংলার বাঘা বাঘা ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের তরজায়। সে সবের প্রত্যাশা অধরাই থেকে গেল। সমসাময়িক রাজনীতি, সমাজ এবং সেইসময়ের কলকাতা যদি এ বইয়ে উঠে আসত, তাহলে পটভূমিও নির্মিত হত চমৎকার। কিন্তু তেমনটা না ঘটায় মূল আড্ডার মৃদু মিমিক্রি হয়েই থেকে গেল তারা। তবে এমন পরিকল্পনার জন্য, তাকে রূপায়িত করার জন্য যে মেধা ও পাণ্ডিত্য প্রয়োজন, তা বইয়ে ধরা পড়বেই। আর সে কারণেই আরও আরও প্রত্যাশার সৃষ্টি হতে থাকে।