(৮৩ বছরের এক জীবনে কত কী-ই না থাকে! একটু পিছন ফিরলেই রং-বেরংয়ের ইতিহাস। আর সে জীবন যদি হয় রাজনীতিক-সাহিত্যিক-সমাজবিজ্ঞানীর, তাহলে তেমন জীবন থেকে বিচ্ছুরিত হতে থাকে বর্ণমালা। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস বাংলায় দেবেশ রায়ের কলামের প্রথম ভাগ, মনে পড়ে কী পড়ে না!)
মাস দুই হল আমি পকেটমারের খপ্পরে পড়েছি। আমার শেষ উপন্যাসটি বাংলা নববর্ষে বেরবে বলে প্রকাশক লড়ে যাচ্ছেন। আর সেই ব্যস্ততার মধ্যে যতবার প্রুফ আসছে, ততবারই আমি নতুন কয়েক লাইন যোগ করছি। সেটা আবার দেখাতে আনছেন কেউ। একেবারেই পাতলা একটা বই। এত ঝামেলার কথাই না।
কিন্তু গল্পটার একটা অংশে—এক বিশ্ব-বিখ্যাত আইনজ্ঞ কলকাতার পকেটমার নিয়ে অনেক কথা বলেছেন, যেন, তিনিও এককালে পকেটমার ছিলেন।
পকেটমারার এত কথা তিনি জানলেন কী করে—এটার একটা তো ছুতো দরকার। সেই ছুতোটা কিছুতেই যুৎসই হচ্ছিল না। বারবার বদলাচ্ছিলাম।
এমন যখন সংকট চলছে—প্রেস আর আমার মধ্যে, তখন এক ইংরেজি কাগজে রাফাল চুক্তির গোপন নথি বেরিয়ে গেল।
কেন্দ্রীয় সরকারের অ্যাটর্নি জেনারেল সুপ্রিম কোর্টের কাছে আবেদন করলেন—এ তো শাদাসিধে সিন্দুক-ভাঙার ঘটনা, এখনই এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি চুরির মামলা রুজু হোক ও একে জেলে পোরা হোক।
প্রধান বিচারক ও এজলাশের আর-এক বিচারক আলাদা করে বললেন, ‘একটা মামলায় যদি কোনো একটা সূত্র থেকে এমন নতুন খবর আসে যে মামলাটাই বদলে যায়, তা হলে কি ও কী করে জানল এই কথাটা বড় হবে, না আসল মামলাটা বদলে যাবে?’
বেঁচে গেলাম। এ না হলে সুপ্রিম কোর্ট। আমি যে-বিশ্বখ্যাত আইনজ্ঞের মুখে পকেটমারের গোপন রহস্য বেশ রসিয়ে বসিয়েছিলাম, তাঁর মুখে এই কথাটুকু অবিকল জুড়ে দিলাম, ‘আমি যা যা বলব, তার কোনো প্রমাণ চাওয়া চলবে না’।
এই একটি লাইনে প্রেস, প্রকাশক ও আমি তিন জনই বাঁচলাম। বইটি যথাসময়েই বেরল। প্রকাশকের সঙ্গে আমার সম্বন্ধ বহু বহু বছরের। সে বলল, ‘দাদা, এই একটা লাইন কি আগে লিখে দিতে পারতেন না?’
আমি তাকে বললাম, ‘সুপ্রিম কোর্ট না বললে লিখতে পারি—কথার কোনো প্রমাণ চাইনা?’
বই তো বেরল কিন্তু পকেটমার আমাকে ছাড়ল না।
সেই সপ্তাহেই অধ্যাপক ডক্টর পবিত্র সরকার, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্বের পি-এইচ-ডি, প্রাক্তন উপাচার্য, কাগজে তাঁর কলামে শিকাগোর বিখ্যাত ‘মাগার’দের গল্প লিখলেন। তাদের জন্য নাকি হাতের মুঠোয় দু-ডলার রাখতে হয়, চাওয়া মাত্র দিয়ে দিতে হয়। একজন নবাগত ভারতীয় বাঙালি গবেষককে এটা শেখানো হয়েছে। সে-ও প্রথম যে-মাগার তার কাছে আধুলি চেয়েছে, তার হাতে সেই দু-ডলার গুঁজে দিয়েছে। সেদিনই কাগজে না কী খবর বেরিয়েছে যে ভারতের কোনো একটি জায়গায় শিশুমৃত্যু ঘটেছে। মাগারটি জিগগেস করল, ‘তুমি কি ভারতীয়?’ ‘হ্যাঁ’ শোনার পর, সঙ্গে-সঙ্গে সে দুই ডলার ফিরিয়ে দিয়ে বলল, ‘না, না, সে কী করে হয়? আমাদের সব দেশেরই তো নিজের-নিজের সমস্যা আছে’।
কলকাতার পকেটমার নিয়ে কিছু-কিছু রটনা আছে—যার প্রমাণ দেয়া যাবে না। ৩৫-এ রুট বলে একটা রুট ছিল, যেটা মৌলালি হয়ে বন্ডেল রোড, রাইফেল রেঞ্জ রোড হয়ে পিকনিক গার্ডেনসে যেত। সে-বাসে টিকিট কেটে উঠতে হত, নইলে উঠতে-উঠতেই পকেটমার হয়ে যেত। আর, যে-বাড়িতে যাওয়া, তারা ফেরার ভাড়া দিয়ে দিতেন।
আমাদের ছাত্রজীবন থেকে পকেটমার সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি গল্প শুনেছি শঙ্খ ঘোষকে নিয়ে। আমি তার কিছু কিছু সাক্ষী বলে দাবি করতে পারতাম। কিন্তু সুপ্রিম কোর্ট তো তেমন সাক্ষ্যে ছাড় দিয়েছে।
শঙ্খদা তখন যাদবপুরে। উনি থাকতেন শ্যামবাজারে। কী করে, কী করে যেন তিনি একটা রুট বানিয়েছিলেন ট্রামে-ট্রামে যেতেন। উত্তর কলকাতা আর দক্ষিণ কলকাতা তো ট্রাম-ডিপোময়। গড়িয়াহাট পৌঁছে গেলে যাদবপুর আর কতটুকু। দিব্যি বই পড়তে-পড়তে চলে যাওয়া যেত।
একটা বিপদ ঘটতে লাগল। তাঁর পাঞ্জাবির তো দুটো পকেট। যে-পকেটেই রাখুন—গড়িয়াহাটে নেমে দেখতেন- যাদবপুর পৌঁছানোর মত ভাড়াটিও কোনো পকেটে নেই। তখন উনি বুদ্ধি বের করলেন—দু পকেটেই কিছু-কিছু করে পয়সা ভাগ করে রাখলেন। কিন্তু দেখা গেল, পকেটমার খুব যত্নের সঙ্গে দু-পকেটই ফাঁকা করে দিয়েছে। নিজের অসহায়তার চাইতেও বিস্ময়ই তাঁর বেশি ছিল। তার পর তিনি একটা নতুন উপায় বের করলেন। শঙ্খদা তো বই পড়তে-পড়তে যেতেন, সেই বইয়ের ভিতরের পাতার ভাঁজে দুটি-একটি নোট রেখে দিতেন। পকেটমার তো পকেট মারতে পারে, বইয়ের ভিতর থেকে পকেটমার তো ব্যাকরণে সিদ্ধ হয় না। একদিন এক ভদ্রলোক তাঁর পাশে জায়গা পেয়ে বসে শঙ্খদার বইটা দেখে বললেন, ‘স্ট্রেঞ্জ! এই বইটা কত খুঁজছি। পাচ্ছি না। কোথায় পেলেন? একটু দেখতে দেবেন?’
শঙ্খদা বললেন, ‘এটা তো লাইব্রেরির—পুরনো এডিশন’। তার পর তাঁর স্বভাবোচিত বিনয়ে বইটা ভদ্রলোককে দিলেন। তিনি খুব মন দিয়ে বইটা পড়তে লাগলেন। আমির আলি অ্যাভিনিউয়ে ট্রাম বেঁকতেই ভদ্রলোক বইটি ফেরৎ দিলেন বাংলায় ‘ধন্যবাদ’ বলে। শঙ্খদা বললেন, ‘আরো একটু পড়তে পারেন, আমি শেষ পর্যন্ত যাব’। ‘না আমার নামার জায়গা এসে গেছে’।
তিনি উঠে পড়লেন। শেষ স্টপে নেমে শঙ্খদা দেখলেন—বইয়ের ভিতরে রাখা নোট গুলো নেই।
সুপ্রিম কোর্ট তো রায় দিয়েছেন—প্রমাণ-বাধ্য নয় কোনও মামলা।
পকেটমারের গল্প আরেকটি ঘটনা না-বলে শেষ হয় না।
কবি সিদ্ধেশ্বর সেন ট্রামেই আসছিলেন শেয়ালদা হয়ে ‘পরিচয়’-এ। এমন ভিড়ের চাপ যে নড়াচড়া দূরের কথা, দাঁড়িয়ে থাকাই অসম্ভব। সিদ্ধেশ্বরদা টের পেলেন যে তাঁর পকেটমার হচ্ছে। কিন্তু পকেটরক্ষা কোনো ভাবেই সম্ভব নয়। তখন তিনি ট্রামের সিলিঙের দিকে চিবুক তুলে বললেন, ‘আপনি যেই হোন, আমার ফেরার বাসভাড়াটা রাখবেন’।