তুলারাশির লোকেরা নাকি প্রায়ই অতিপ্রাকৃত বোধসম্পন্ন হয়ে থাকে। আমার বাবা ছিলেন ঐ রাশির। কিছু অদ্ভূত অভিজ্ঞতা হয়েও ছিল। একটা বলি।
১৯৬৪ সালে বাবা যখন কলেজের ছাত্র, ওঁর মাতামহ ষোড়শীকান্ত মারা যান। অত্যধিক ধূমপান করতেন, হাঁপানির রোগ সৃষ্টি হয়েছিল। শেষের দিকে ফুসফুসে জল জমে যেত, ট্যাপ করে বের করতে হত। হয়তো কর্কটরোগ, কিন্তু সে যুগে ডাক্তাররা বলেছিলেন ‘প্লুরিসি’। শেষ সাত-দশ দিন বিছানা ত্যাগ করতে পারতেন না, হাঁপানির টান সবসময় চলত। ঠাকুমার কাছে শুনেছি, ওঁর মৃত্যুর সময় নাকি মাথার দিকের জানালার বাইরে যে কলাগাছগুলো ছিল, সেগুলো ঝুঁকে পড়ে জানালা দিয়ে পাতাসুদ্ধু ঢুকে আসার চেষ্টা করছিল। শোনা যায় ষোড়শীকান্ত কিছুদিন তন্ত্রসাধনা করেছিলেন। তারই কোনো রহস্য হয়তো। কিন্তু সে কথা পরে কখনো হবে।
বাবাকে ষোড়শীকান্ত খুব ভালবাসতেন। আমার ঠাকুর্দা যখন মারা যান, তখন বাবার বয়স তিন বছর। সেই থেকে দাদুর কাছেই লেখাপড়া শিখে মানুষ।
শেষ দিন। সেই মুহূর্তে ঘরে কেউ নেই, বাবা একা বসে পাহারা দিচ্ছেন। ষোড়শীকান্ত হাত নেড়ে বাবাকে কাছে ডাকলেন। হাঁপাতে হাঁপাতে ফিসফিস করে বললেন, “দাদু, তুমি খুব ভাল ছেলে হবে।” এটাই ছিল ওঁর শেষ উচ্চারিত কথা – এর কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু হয়।
এইটুকু পারিবারিক ইতিহাস বলার দরকার ছিল, নইলে আসল গল্পটা বোঝা যাবে না। সেই অংশটা বাবার মুখে শোনা।
প্রায় আড়াই দশক পরের কথা। ১৯৮৭ সাল। বাবা তখন সরকারী চাকুরে, রাইটার্স বিল্ডিং-এ তথ্য ও সংস্কৃতি বিভাগে আছেন। আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার ভাই তৃণাঙ্কুর ক্লাস ওয়ান বা টু-তে। জুলাই মাসের বর্ষার রাত। আমাদের বাড়িতে যে সহায়ক কর্মী তখন থাকতেন, তিনি ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি গেছেন। শেষ অতিথিকে বিদায় দিয়ে রাতের খাওয়া সেরে আমরা দোতলায় যে যার ঘরে শুয়ে পড়েছি। বাবা গেছেন একতলায়, দরজায় তালা দিতে। রাত তখন হয়তো সাড়ে বারোটা কি একটা।
বাড়িতে কেউ এলে সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই প্রথম যে ঘরটা, সেখানেই প্রথমে বসানো হতো, তাই কিছু লোহার শিকের রেক্সিন-ছাওয়ানো চেয়ার এবং একটা প্রাচীন সোফাসেট পাতা ছিল (এখনও আছে – হয়তো সে-যুগের বলেই টিকে গেছে)। দরজায় ও পেছনের বারান্দার লোহার গেটে তালা দিয়ে, আলো নিভিয়ে, দোতলায় ওঠার আগে বাবা ঐ অন্ধকার ঘরেই সেই পুরনো সোফাসেটে বসে একটা সিগারেট ধরিয়েছেন। সারাদিন মুষলধারে বৃষ্টি হয়েছে, তখনও টিপটিপ করে পড়ে চলেছে, হয়তো সারারাত চলবে। অন্ধকারে একা বসে বাবা সিগারেটে টান দিচ্ছেন আর মনে মনে নানারকম চিন্তা করছেন।
এমন সময় একটা শব্দ হল – ফোঁস!
বাবা যে ঘরে বসে আছেন, তার দরজার বাইরেই আমাদের ছোট্ট বাগান – দুই-একটা বড় এলাচের ঝোপ, একটা জবা গাছ, একটা মাধবীলতা, আরও কয়েকটা ছোট ফুলের গাছ। বর্ষায় কখনো সাপ আসে না এমন নয়। পঞ্চাশের দশকের বাড়ি, ফুটোফাটা আছে, ভারী বৃষ্টিতে নর্দমার গর্ত দিয়ে ঘরের ভেতরে জল ঢুকে আসে। সাপ ঢুকতে পারে, এবং বার-দুয়েক ঢুকেওছে। একবার তো দোতলার মাঝের ঘরেও একটা গোখরো ঢুকে এসেছিল, কীভাবে কে জানে। সুতরাং শব্দটা শুনে প্রথমেই বাবার কী মনে হল তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। বাবা মাটিতে পা রেখে বসেছিলেন, এবার চটি খুলে পা গুটিয়ে সোফায় তুলে নিলেন।
প্রথমেই প্রয়োজন আলোর। সোফাসেটটা যেখানে, সেখান থেকে আলোর সুইচ কিছুটা দূরে – বসে থেকে বা সোফার ওপরে দাঁড়িয়ে হাত পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু হেঁটে গিয়ে জ্বালানোও উচিৎ হবে না, কারণ অন্ধকারে সাপের গায়ে পা পড়তে পারে। ঘরটা প্রায় বারো ফুট বাই চোদ্দ ফুট, সুতরাং সিগারেটে জোর টান দিলে যেটুকু আলো হয় তাতে নিজের পা এবং সোফা ছাড়িয়ে আর বিশেষ কিছু দেখা গেল না।
ইতিমধ্যে হয়তো কয়েক সেকেন্ড সময় কেটেছে। আবার শব্দ হল – ফোঁস!
বাবার মনে পড়ল, পকেটে দেশলাই রয়েছে। সেটা বের করে একটা কাঠি জ্বালালেন। যে দেড়-দু’ ফুট অবধি আবছায়া তৈরি হলো, তার মধ্যে অন্ততঃ কিছু নেই, অথবা নেই বলেই মনে হলো। ভাল করে অবশ্য দেখা গেল না, এবং কয়েক সেকেন্ড পরেই কাঠির আগুন আঙুল অবধি পৌঁছে যাওয়ায় ফেলে দিতে হল। এবং আবার শব্দ হল – ফোঁস!
মোবাইল ফোন আসতে তখনও পনেরো বছর দেরি আছে। কাউকে ডাকা সম্ভব নয়। চিৎকার করলে অত রাত্তিরে কেউ শুনতে পাবে বলে মনে হয় না। দোতলায় স্ত্রী এবং দুই নাবালক পুত্র ঘুমোচ্ছে। তারা শুনলেই বা করবে কী? আতঙ্কিত হয়ে বসে থাকবে শুধু। অথবা খোঁজ করতে এলে নিজেরাই বিপদে পড়বে। বাড়ির পাশে পুলিশ ফাঁড়ি, কিন্তু বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে যতই জোরে আওয়াজ হোক, দেওয়াল ভেদ করে বাগান পেরিয়ে পাঁচিল টপকে সে আওয়াজ নিদ্রিত কনস্টেবলের কানে পৌঁছনোর আশা অতি ক্ষীণ। তাছাড়া সাপের বিরুদ্ধে আইপিসি-র কোন ধারা প্রযোজ্য তাও সেই মুহূর্তে বাবার মাথায় এলো না। এত কথা ভাবতে ভাবতে আবার শব্দ – ফোঁস।
এইভাবে কিছুক্ষণ চলল। বাবা একটা করে দেশলাই কাঠি জ্বালিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছু দেখা যায় না। এবং কয়েক সেকেন্ড পর পর শব্দটা হতে থাকে। এই করে করে দেশলাই কাঠি একসময় ফুরোল।
শব্দটা প্রথম শুনতে পাওয়ার পর থেকে হয়তো দশ মিনিট কেটেছে। এমন সময় বাবার দুটো কথা মনে হল। এক নম্বর, শব্দটা নড়ছে না। মানুষের দুটো কানের মধ্যে অবস্থানের যে পার্থক্য, তার জন্য কোনো শব্দ (যদি না একেবারে সোজাসুজি সামনের থেকে অথবা সোজাসুজি পেছন থেকে আসে) দুই কানে একটু আগে-পরে পৌঁছয়। এই সময়ের পার্থক্য এতই সূক্ষ্ম যে সচেতনভাবে তা ধরা যায় না। কিন্তু লক্ষকোটি বছরের বিবর্তনের ফলে শ্রবণেন্দ্রিয়-সম্পন্ন বেশির ভাগ প্রাণীর মস্তিষ্ক অচেতনভাবে এই সময়ের পার্থক্যের থেকে শব্দের উৎসের দিক নির্ণয় করে নিতে পারে। এই কারণেই অন্ধকারেও আমরা প্রায়ই বুঝতে পারি কোন দিক থেকে শব্দ আসছে। বন্য প্রাণীর আত্মরক্ষা বা শিকার করার জন্য এটা অত্যন্ত জরুরি ক্ষমতা। মানুষের জীবনে হয়তো এর গুরুত্ব অনেকটা কমে এসেছে, কিন্তু ক্ষমতাটা রয়েই গেছে।
সাপ হলে এক জায়গায় বসে ফোঁসফোঁস করাটা অস্বাভাবিক। সে শিকার খুঁজবে অথবা বেরোনোর পথ খুঁজবে, এবং শব্দটাও সেইমতো ঘুরে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু তা হচ্ছে না। ঘরের যে দিকটায় পুলিশ ফাঁড়ির পাঁচিল, সে দিকের জানালার কাছ থেকে শব্দটা ক্রমাগতঃ আসছে।
এবং দ্বিতীয় কথা – শব্দটার মধ্যে একটা ছন্দ আছে। যেন সাপটা (যদি সত্যিই সাপ হয়) জানালার ধারে বসে অতি ঢিমে লয়ের কোনো ধ্রুপদী সঙ্গীতের তালে-তালে ফোঁসফোঁস করে সঙ্গত করছে। এরকম সমঝদার সাপ দুনিয়ায় আছে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া নিশুতি রাতে গানই বা কোথায়? গাছের পাতায় বৃষ্টি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে শুধু।
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো। আকাশে নয়। বাবার মাথার ভেতরে। একটা অনেক পুরনো কথা মনে পড়ে গেল। শব্দটা বাবার চেনা। সাপের শব্দ হিসেবে নয়, অন্য একটা প্রসঙ্গে। এবং সেই শব্দটা শেষ শোনা গেছিল এই ঘরেই, কারণ এ ঘরেই ষোড়শীকান্তর মৃত্যু হয়েছিল।
১৯৬৪ সালে বাড়ির দোতলা তৈরি হয়নি। একতলার এই সদর ঘরেই ষোড়শীকান্ত থাকতেন। এখানেই ছিল তাঁর রোগশয্যা। ফুসফুসে জল জমে যেত, নিঃশ্বাস নিতে হতো খুব কষ্ট করে। এবং শেষ দিকে হার্ট ফেইলিওরের কারণে শুরু হয় এক ধরণের অত্যন্ত কষ্টকর নাভিঃশ্বাস, যা কয়েক দিন ধরে চলেছিল। তখন বাবাকেই বসে পাহারা দিতে হতো বেশির ভাগটা। ডাক্তার বসন্ত ঘোষ দুঃখ করে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, “চেইন-স্টোক্স (Cheyne-Stokes) রেসপিরেশন শুরু হয়ে গেছে, আর বোধহয় রাখতে পারব না।” ডাক্তারি নামটা বাবার মনে থেকে গেছিল।
আর মনে ছিল কানের কাছে ক্রমাগতঃ তালে-তালে সেই কষ্টকর নিঃশ্বাসের ওঠাপড়া। ঐ জানালার দিকেই মাথা করে শুয়ে ছিলেন দাদু।
কয়েক দিন পরে ঘটনাটা শুনেছিলাম বাবার কাছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম, “তোমার ভয় করল না?” বাবা বলেছিলেন, “না রে। প্রথমে সাপ ভেবে ভয় পেয়েছিলাম। যখন বুঝলাম দাদু, এক মুহুর্তে সব ভয় কেটে গেল। দাদু তো আমাকে ভালবাসতেন। বলেছিলেন, তুমি ভাল ছেলে হবে। মনে মনে ওঁকে প্রণাম করে উঠে ওপরে এসে শুয়ে পড়লাম। আলোটাও জ্বালার প্রয়োজন বোধ করিনি।”