জিনের টান

জিনের টান

জলপাইগুড়ি থেকে খবর পাঠিয়েছে আমার ছাত্র উমেশ শর্মা। জলপাইগুড়ি জিলা তৈরির ১৫০ বছর পুরেছে। সেই উপলক্ষে এক স্মারকগ্রন্থ বেরবে। উমেশ তার অন্যতম সম্পাদক। আমাকে একটা লেখা দিতে হবে।

আমার যা জানা তাতে জলপাইগুড়ি জিলার দেড়শ বছর তো হয়ে গেছে গতবছর। ১৮৬৮-তে জিলা তৈরি হয়েছিল। সে যাই হোক স্মারকগ্রন্থ তো সব সময়ই বেরতে পারে। আমার লেখা আমি পাঠিয়ে দিয়েছি কিন্তু ভাবনাটা থেকে নেই। চলছেই। সেই লেখাটির নাম দিয়েছিলাম ‘নাড়ীর বন্ধন’। ভাবতে-ভাবতে মনে হল—এই নামে একটু অলঙ্কার আছে, যে-অলঙ্কার নামটির মিথ্যে করে দেয়।

সত্যি তো জলপাইগুড়ির সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা কী?

মানুষের জীবনে একটা সময় আসে যখন নিজের পরিচয়টা নিজের কাছেও আর লুকনো যায় না। এ-পরিচয় আমি আর এই বয়সে লুকোবো কী করে যে আমি একজন লেখক। লেখক হয়ে বেঁচে থাকার সমস্ত দায়, সার্থকতা ও ব্যর্থতা নিয়েই আমার আর স্বল্পতর বেঁচে থাকা। যত বছর বেঁচে এলাম তার ২১ ভাগের এক ভাগও আর বাঁচব কী না, তা নিয়ে সংশয় আর আজগুবি নয়। এই তো মাস দুইও হয় নি—মৃত্যু চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ডেকেছিল, ‘এসো, চলো’। আমি তার চোখে চোখ রেখে বলেছিলাম, ‘কী করে যাই। সেনটেন্সগুলো তো ঠিক আসছে না’। হাসপাতালের ডাক্তাররা আমায় বলেছিলেন—সত্যি না কী আমি এই কথাগুলি বলেছিলাম। তার পর থেকে ওঁরা এসেই আমাকে জিগগেস করতেন—‘কী? সেনটেন্সগুলো ঠিকঠাক আসছে তো?’

সত্যি তো। এতো লেখা শেষ না করে আমি কী করে আমার ছেলেকে বলব, ‘এবার আয়, আগুন নিয়ে’।

এই-যে জীবনব্যাপী হয়ে ওঠা তার সঙ্গে জলপাইগুড়ির সম্বন্ধ কী?

জলপাইগুড়ির কোনো প্রাচীনতা নেই। কোনো প্রত্নতত্ত্ববিদ এসে জলপাইগুড়ির মাটি খুঁড়ে কোনো প্রাচীনতা বের করতে পারবে না, যেমন দিনাজপুরের আছে, মালদহের আছে।

তেমনি আমাদের বাড়িরও কোনো প্রাচীনতা নেই। আমার ঠাকুরদা জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলের হেডমাস্টারি থেকে ১৯১৭-তে অবসর নিয়ে আমাদের দেশের বাড়িতে, পাবনা জিলার পুব-দক্ষিণে বাঘমারা গ্রামে চলে যান। আমার জন্ম সেখানেই ১৯৩৬-এ। তার পর সে-গ্রাম যমুনা নদীর ভাঙনে ভেসে যায়। কয়েক মাইল দূরে নতুন ভারেঙ্গা বা সাফল্লা নামে একটা জায়গায় আমাদের নতুন বাড়ি তৈরি শেষ হতে না-হতেই আমরা জলপাইগুড়ি চলে আসি। ১৯৪৩ থেকে ১৯৭৫—এই ৩২ বছর আমি জলপাইগুড়িতে ছিলাম। এই ৩২ বছরে আমরা ভাড়া বাড়িতেই ছিলাম। জলপাইগুড়িতে আমাদের কোনো বসতবাড়ি ছিল না, নেইও।

তা হলে জলপাইগুড়ির সঙ্গে আমার সম্বন্ধটা কী? আমার, মানে, আমার লেখার।

শিশু জন্মাবার পর তার মা-বাবা-আত্মীয়জন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চান সে কার মত দেখতে হয়েছে। অর্থাৎ কার কাছ থেকে কী নিয়ে সে জন্মাল। তাকেই তো বলা যায় জিনের টান।

আমি কতটা লেখক ও কী দরের লেখক তা আমি সত্যি-সত্যি জানি না। কিছুটা আত্মবিশ্বাস ছাড়া তো কেউ সারা জীবন লিখে যেতে পারে না। কিন্তু তেমন আত্ববিশ্বাস যে কতটাই ফাঁপা তা বোঝা যায় তাঁর মৃত্যুর পর। লেখক থাকার জন্য প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস যে একাত্তই ব্যক্তিগত সে-কথা আমি কখনো, কখনোই, ভুলি না। তা হলে? জলপাইগুড়ি?

একটা উদাহরণ দিলে কথাটা স্পষ্ট হবে হয়তো।

এবার একটি পুজো সংখ্যায় একটি ছোট উপন্যাস লিখেছি। উপন্যাসটির নিহিতার্থ যে-কোনো জায়গায়, দেশের বা বিদেশের, ঘটতে পারে। লিখতে বসে দেখি তার নায়ক হয়ে উঠল—ভোলা কোল মুন্ডা—জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে ক্লাস সেভেন থেকে স্কুল ফাইন্যাল পর্যন্ত আমার সহপাঠী। পরে এসে জুড়ল নাগরাকাটায় আমাদের পার্টির এম-এল-এ প্রেম ওঁরাও, তার এক পা কাটা, বগলে ক্রাচ, ভুটান পাহাড়ের সানুদেশে, এক চা-বাগানে। এ-উপন্যাস কোনো অর্থেই জলপাইগুড়ি নিয়ে লেখা নয়, কিন্তু যে-কোনো অর্থেই জলপাইগুড়ি নিয়ে লেখা।

আমার একটা ছোট উপন্যাস আছে, পশ্চিম এশিয়ার তেলের রাজনীতি নিয়ে। বাঙালি দম্পতি তাঁদের এক প্রতিবন্ধী শিশুকে নিয়ে কোনো এক বড় কর্পোরেটের বড় চাকরিতে থিতু। এই দম্পতি আমার চেনা—কলকাতায়। সেই উপন্যাসটিতে তো জলপাইগুড়ি আসার কোনো ছিদ্রপথও নেই। কিন্তু সেদিন পাতা ওল্টাতে গিয়ে দেখি—সেই মরুভূমির রাস্তাঘাট ও দোকানপাটে জলপাইগুড়ি এসে গেছে।

লেখক বোধহয় দু-ধরনের হয়। কোনো-কোনো লেখকের স্বভাব মাছের মত—নিজের জল ছাড়া সে বাঁচে না। তারাশঙ্কর তেমন লেখক। বলা হয়, ‘ডাবলিন’ শহর যদি ধ্বংস হয়ে যায়, তা হলে জেমস জয়েস-এর ‘ডাবলিনার্য’ থেকে তা হুবহু পুনর্নিমাণ করা যাবে।

আর-এক ধরনের লেখকের স্বভাব পরিযায়ী পাখির মত। ঋতুতে ঋতুতে তারা মহাদেশ মহাসাগর পাড়ি দেয়। রবীন্দ্রনাথ, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তেমন লেখক। কেউ কি বলতে পারেন ‘পথের পাঁচালী’র গ্রামটা কোথায়? বা, ‘চতুরঙ্গ’ কোথায় ঘটছে?

লেখক তো সে, যে কল্পনাকে বাস্তব, ও বাস্তবকে কল্পনার সত্য করে তুলতে পারে। আর সেই কাজে যা সে লিখছে সেটাকে বিশ্বাসও করতে পারে, যাকে অভিনব গুপ্ত বলেছিলেন সাধারণীকরণ আর টি.এস এলিয়ট বলেছিলেন ইউনিভার্সালাইজেশন।

আমার লেখা দেখে সবাই খুঁজুক কোথায় আছে জলপাইগুড়ি। আমার জিন।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত