অমন করে ট্যারা চোখে আমাকে দেখোনা।
এখন আমার গায়ে পুকুরের কাদা মাটি আর গোবর মিশিয়ে তাদের এক রুমের ছোট্ট মাটির ঘর লেপন করছে। তাই তুমি আমার সুন্দর শরীর টাহর করতে পারছোনা!
অথচ এই আমাকে দেখে কত যুবকের যে মাথা আউলা হয়েছে তা কি তোমরা জানো?
জানোনা।
কিভাবে জানবে , আমাকে তো আজ আর আমার রূপে দেখাই যায়না। বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্সের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি দোকানে আমার গায়ে তিন হাজার ছয় শত টাকার ট্যাগ লাগিয়ে যখন সাজিয়ে রেখেছিলো, কত তরুন যে অসহায় চোখে তাদের অসামর্থ্য হাত দিয়ে আমাকে ছুঁয়ে দেখেছে হিসাব নেই।
আমি তাদের বুকের ধুকধুক ধ্বনি শুনতে পেতাম, তারা মুখের ভেতর অস্ফুট আফসোসও করতো যেন।
আমার কখনো খুব গর্ব হতো, কখনো কষ্ট লাগতো। সবচেয়ে বেশী কষ্ট লেগেছে শোভা নামের মেয়েটির জন্য। আমার যদি পা থাকতো বা নড়ার সামর্থ্য, তবে সেদিন আমি তার ব্যাগে চুপটি করে ঢুকে যেতাম। শোভা’র মুখটা আমি কোনোদিন ভুলবনা।
শোভা তার বান্ধবীকে নিয়ে এসেছিলো প্রিয় বন্ধু’র জন্মদিনে গিফট দেবার জন্য কিছু কিনতে। সাথে এনেছে দু’হাজার একশত টাকা । মনে হয় এক’শ টাকাটা গাড়ি ভাড়ার জন্য। হয়তো ওটা বন্ধু নয়, প্রেমিক ছিলো তার।
মেয়েটি তার প্রথম দর্শণেই আমাকে ভালো লাগে তার। তারপর আমার কাঁধে’র জায়গাটা চেক করে মুখ কালো করে ফেলে। ফিসফিসিয়ে বান্ধবীকে কিছু বলে।
বান্ধবী ব্যাগ খুলে টাকা গুনে দেখে বলে,
“সাত’শ সত্তর আছে আমার। ”
ওরা হিসেব করে দোকানদার চাচা’র কাছে কত অনুনয় যে করে আটাশ’শ টাকা দিয়ে শার্টটা দেবার জন্য। কিন্তু পাষান্ড মালিক কিছুতেই রাজি হন না। বলেন কি, কেনা দামও আসেনা। অথচ এটা ডাহা মিথ্যে কথা। আমাকে কিনেছে আঠারো’শতে।
বেটা তুই এক হাজার লাভ কর, এতো লোভ কেনো তোর? কি হতো কোনো এক ভালোবাসার ছোঁয়ায় আমাকে আলোকিত করলে, হয়তো আমি এখনো তার বন্ধু’র যতনে থাকতাম!
সে গভীর রাতে হয়তো বান্ধবী’র কথা ভেবে বালিশের নীচ থেকে আমাকে বের করে নাকে নিয়ে শুঁকে খুশবো দেখতো। মেয়েটি হয়তো জন্মদিন আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে বারবার ব্যাগ থেকে বের করে দেখতো । আর তার সুন্দর হাত দুটো দিয়ে সুন্দর করে গভীর মমতায় গিফট প্যাকে মুড়িয়ে দিতো। দেবার আগে বন্ধুটিকে ভেবে প্যাকেটের উপর চুমুও খেত হয়তো। আহা কত ভালো লাগছিল এমন ভাবতে! বেটা খবিস দোকানদার।
আরেকদিন দোকানে এসেছিলো এক মধ্যবিত্ত বাপ পুত্র। পুত্র নয়, দশ বা এমনই বয়সের হবে ।
পুত্র বলে, আব্বু কি সুন্দর জামা ! আমি নিব।
পিতা তখন জবাব দেন,
বাবা…এটা বড়দের জামা।
-আব্বু ..তাহলে তুমি কিনো।
-দাঁড়াও দেখি।
বলে তিনি দাম দেখে চুপসে গেলেন।
“চলো সায়ান, আমরা অন্য দোকানে যাই।”
-কেনো আব্বু? কিনবেনা?
-না, আমার সাইজের নেই , এটা টাইট হবে।
-তাহলে আমি একটু বড় হলে আমাকে কিনে দিও এটা।
-আচ্ছা তোমাকে কিনে দেব।
ওরা চলে যায়। ঐ বাপের জন্যও আমার কষ্ট হয়েছিলো।
তারপর দোকানে আমার শেষ মুহূর্ত টা আসে। এক যুবক তাড়াহুড়ো করে দু’একটা শার্ট নেয়, আমাকে সহ। ভালোভাবে না দেখেই নিয়ে নিলো মনে হয়।
বল্লো, “প্যাক করো, কত হলো?”
কি একটা কার্ড একটা মেশিনে ঢুকিয়ে , প্যাকেটে করে আমাদের কার এর ভেতর তার পাশের সিটে রেখে, বাসায় নিয়ে আসে।
সারা দিন রাত অমন পরে থাকি। পরদিন সকালে আমাকে পছন্দ হয় বোধহয়, গায়ে দিয়ে কি একটা স্প্রে লাগালো, পড়ে দেখলাম পয়জন!
অমা, বিষ নাতো?
না, বিষ না, খুবই মিষ্টি সুগন্ধ । পারফিউম এটা। আমার ইচ্ছে হচ্ছিল বলি, আর একটু লাগাওনা।
আমি দামী কার করে ঘুরে বেড়ালাম, আবারো শীতাতপ একটা ঘরে থাকলাম অনেকক্ষণ। তারপর হোটেলে গেলাম, ওখানে আমার সমমানের আরো শার্টকে গর্ব ভরে চলতে দেখলাম অন্য বড়লোকদের শরীরে করে।
আহা কত সুখ আমাদের! বাসায় এসে আমাকে এক পাশে ছুঁড়ে মারে অযত্নে, খুব গায়ে লেগেছিলো ব্যাপারটা আমার। অনেকক্ষণ মন খারাপ ছিলো। তারপর দেখি এক পুঁচকে কিশোরী মেয়ে এসে আমাকে আরো অনেক কাপড়ের সাথে মেশিনে ঢুকায় দেয়। মেশিন ঘুরতে থাকে, সাথে আমিও। আমার মাথা থাকলে ঘুরতে ঘুরতে বমি এসে যেতো নিশ্চয় আর নাড়িভুড়ি বের হয়ে যেত।
সে পরদিন যখন আমাকে সাহেবের রুমে রাখতে যায়, ঐ বেটা তো আমাকে দেখেই এক চিল্লান দেয়,
“কি করছিস এটা!”
-কি ভাইজান?
এটা ড্রাই ওয়াসের.. তুই ওয়াসিং মেশিনে কেনো দিলি? যা আমার সামনে থেকে নিয়ে যা এখুনি।
আমার জায়গা হলো পুরনো কাপড়ের ভিড়ে।
একদিন বাড়ীর কর্তী অনেক কাপড় সহ আমাকে তাদের ড্রাইভারকে দিয়ে দেয়। সে সুবাদে আমি আবার কার আর ড্রাইভারের ঘরের বাসিন্দা হই। আমার আগের সৌন্দর্য্য একটু কমছে বুঝতে পারি, তাইতো দু’একদিনের ব্যবধানে সাহেব থেকে ড্রাইভারের গায়ে।
সেও অবশ্য সস্তা ধরণের একটা পারফিউম ইউস করে, নামের কাগজটা ছিঁড়ে গেছে, তাই নাম পড়তে পারিনি!
একদিন ড্রাইভার পত্নী আমাকে শুকাতে গিয়ে পেরেকের সাথে লাগিয়ে অনেকখানি ছিঁড়ে ফেলে।
সে সুন্দর করে সেলাই করেও দেয়, তবুও বেটা আর আমাকে পছন্দ করেনা। তার যে সাহেবের মায়ের দেয়া অনেক জামা আছে। তাই আমার জায়গা আবার পুরনো কাপড়ের সাথে।
একদিন ড্রাইভার পত্নী এক ফেরিওয়ালেকে আমি সহ এক গাট্টি কাপড় দিয়ে পঁচিশ টাকা মতো প্লাস্টিকের জিনিস কিনে। আমি ফেরিওয়ালার ফেরির জিনিসের ভেতর করে হেলতে দুলতে ওর বাড়ী যাই। যুক্ত হই নতুন আরেক পরিবারের সুখ দুঃখের সাথে।
ফেরিওয়ালার বয়স কম ,ঊনিশ কুড়ি বয়স।মাও জোয়ান মহিলা, শক্ত সামর্থ্য। বাপ নেই বোধহয়। আর কেউ তো নেই ঘরে!
পরদিন সে ছেলে আর সবার মতো আমাকেই পছন্দ করে পরে নেয় গায়ে। ফুরফুরে মেজাজে শিস দিতে দিতে ফেরি করে প্ল্যাস্টিক সামগ্রী। প্ল্যাস্টিকের ব্যাংক, ঝুড়ি, বাচ্চাদের ব্যাট বল সব আছে তার কাছে।
আচ্ছা, আমার পাশ ঘেঁষেই তো শোভা গেলো মনে হয়! অবাক দৃষ্টিতে কি সে আমাকেই দেখছিলো না!? সাথে কি ঐ ছেলেটা? বাহ, সুন্দর তো। খুউব মানাবে দু’জনকে। শোভা’র চোখে ঐ বিষ্ময়কে তো আমি চিনি।
যে শার্ট ও কিনতে পারেনি, তা এই গরীব ফেরিওয়ালার গায়ে কেনো? তাকে শোনাবার জন্যই যে আজ আমার এই গল্প বলা।
শোভা, তুমি কি আমার কাহিনী পড়ছো? আমরা একটা ঘরে গেলাম। গৃহকর্তা অনেক জিনিস কিনে, টাকা দেবার সময় দরাদরি শুরু করে দেয়।
শেষে আমার নতুন মালিকের গায়ে চড় থাপ্পড়, লাথি দিয়েই ক্ষান্ত হয়না। আমাকেও ছিঁড়ে ত্যানা ত্যানা করে ফেলে। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে গা থেকে খুলে আরেকটা পুরনো জামা গায়ে দেয়। তবুও আমাকে ফেলে দেয়না। তার দুঃখে আমারও কান্না আসে। চোখ থাকলে পানি গড়িয়ে পড়তোই। কি দোষ ছিলো ওর। বেচারা গরীবকে ঠকিয়ে তুই কি বড়লোক হবি?
শরীরে বল থাকলে দিতাম বেটা’র পাঁচায় দু’টা। তারপর আর কি …. ।
আমার জা’গা হয় মাটির কাদা আর গোবরের মিশ্রণে। কোথায় তিন হাজার ছয়’শ টাকার মানুষের স্বপ্ন আমি , আর কোথায় এই আমি!
২২.০৩.১৭