ছোট গল্প: স্পর্শ

ছোট গল্প: স্পর্শ

মৃদু ঝাঁকুনি আর প্ল্যাটফর্মের দৃশ্যপট ধীরে সরে যাওয়া, এসি কম্পার্টমেন্টে থাকলে ট্রেন চালু হওয়াটা এরকমই লাগে। যেন অভিজাত সহবত। আভাস মোবাইল বার করে বউকে ফোন করল, “এইমাত্র ছাড়ল। রাইট টাইম-ই আছে।”

“তোমাদের সবাই এসেছে তো?” ওপ্রান্ত থেকে জানতে চাইল পায়েল।

“এসেছে।”

“ছেলের সঙ্গে কথা বলবে?”

“পরে বলব।”

“আবার কখন ফোন করবে?”

“চেন্নাই স্টেশনে নেমে।”

“না, রাতে শোওয়ার আগে একবার কোরো।” বলার পর একটু থেমে পায়েল বলল, “ঠিক আছে, আমিই করে নেব’খন।”

“কোরো,” বলে ফোন কাটল আভাস।

সাইড লোয়ার বার্থ নিয়েছে সে। লাগোয়া কুপে দলের বাকি পাঁচজন। চারজনের কানেই ফোন। ট্রেন ছাড়ার খবর যে যার বাড়িতে জানাচ্ছে। রঞ্জনাদির কানে ফোন নেই। কারণ, বর সঙ্গেই আছে। বর, অর্থাৎ প্রতাপ রায় ছেলেকে ফোন করে জানাচ্ছেন ট্রেন সময়মতো রওনা হওয়ার খবর।

ছ’বার্থের কুপটার একটা বার্থ আভাসের নামে ছিল। এখন যে সাইড লোয়ারে বসে আছে, সেটা ছিল এক বৃদ্ধার। উনি আভাসদের রিকুয়েস্ট করলেন, কুপের একটা বার্থ ওঁকে দিতে, ওঁর বার্থটা আভাসরা কেউ নিক। সাইড লোয়ারটা গেটের পাশেই। মহিলার সঙ্গে অনেক ব্যাগপত্তর আছে। কেউ একটা ট্রেনে বেরিয়ে নিয়ে গেলেই হলো। সারাক্ষণ সতর্ক থাকতে হবে ওঁকে। রাতে ঘুমও হবে না।

দলের মধ্যে আভাস সর্বকনিষ্ঠ এবং ইয়াং, বার্থটা স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছে তাকেই। আভাসের হাইট বেশ ভালোই। লম্বা মানুষের পক্ষে সাইড বার্থ অসুবিধেজনক, পা গুটিয়ে শুতে হয়। তবু আভাসের মনে হচ্ছে দল থেকে একটু বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে ভালোই হয়েছে। নিজের মতো থাকা যাবে। লাগাতার বকবক করতে হবে না।

আভাসদের আজকের এই দলটার কোনও প্রাক ইতিহাস নেই। একে অপরকে চেনে ঠিকই, শুধুমাত্র এই ছ’জন মিলে কোথাও আড্ডা মারতে বসা হয়নি কখনও। বেড়াতে যাওয়া হয়নি কোথাও। এই ট্যুরের শর্তেই প্রথমবার এই দলটা গঠন হয়েছে। চেন্নাইয়ের একটি বেঙ্গলি ক্লাব ছ’জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পার্টিসিপেট করার জন্য। দলে তিনজন সাহিত্যের, আভাস, রূপময়দা গল্প-উপন্যাস লেখে, ধ্রুবদা কবি। প্রতাপদা, রঞ্জনাদি নাটক-সিনেমার অভিনয় করেন। টিভি সিরিয়ালেও রঞ্জনাদিকে প্রায় নিয়মিত দেখা যায়। সেইহেতু আভাসের সঙ্গে বার্থ চেঞ্জ করা বৃদ্ধা রঞ্জনাদিকে সহজেই চিনেছেন। মেতে উঠেছেন খোশগল্পে। বৃদ্ধাকে বাকি পাঁচজনের সঙ্গে আলাপ করিয়েছেন রঞ্জনাদি। উনি চিনি চিনি ভাব করে হাসলেন বটে। বোঝাই যাচ্ছিল ফলস হাসি। মোটেই চিনতে পারেন নি। আসলে টিভি সিরিয়াল সাংস্কৃতিক জগতটাকে পুরো খেয়ে ফেলেছে। এই যে এতটা পথ উজিয়ে আভাসরা প্রোগ্রামটায় যোগ দিতে যাচ্ছে, টাকা-পয়সা খুব অল্পই পাবে। কত পাবে, সেটাও জানায় নি কর্মকর্তারা। বলেছে, “আসুন না দেখি কতটা কী করা যায়।”

রঞ্জনাদির জন্য কিন্তু প্লেন ফেয়ার দিতে চেয়েছিল। এছাড়া ভালো অ্যামাউন্টের টাকা তো দেবেই। বরকে ছেড়ে প্লেনে যেতে চায় নি রঞ্জনাদি, সকলের সঙ্গে আড্ডা মারতে মারতে ট্রেনে যাওয়াটাই বেছে নিয়েছে।

আভাসও চলেছে অপরের পয়সায় কদিন ছুটি কাটাতে। অফিস, লেখালেখি, সংসারের বাজার-হাট, অন্যান্য কাজ নিয়ে জেরবার হয়ে থাকে সারাক্ষণ। বিনা খরচের এই বেড়াতে যাওয়াটা তাই হাতছাড়া করতে চায় নি। জার্নিটাতে বউ-বাচ্চা নেই বলে যেমন একটু খারাপ লাগছে, ভালো যে লাগছে না, তা নয়। ওরা থাকা মানেই একটা অ্যাটেনশন, বাড়তি দায়িত্ব। সেই অর্থে ছুটিটাকে নিরবচ্ছিন্ন বলা যায়। শরীর, মন দুটোই বেশ হালকা লাগছে।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার পিছনে আর একটা আকর্ষণ বা বলা ভালো তাগিদ আভাসের আছে। যা একেবারেই ব্যক্তিগত ব্যাপার, প্রকাশ্যে জানানোর নয়। চেন্নাইয়ের কর্মকর্তাদের থেকে যখনই শুনেছে রূপময় সরকার এই অনুষ্ঠানে যাবে এবং তাদের সঙ্গে একই ট্রেনে, একই কামরায়, দুবার ভাবেনি। আভাস হ্যাঁ করে দিয়েছে। রূপময় সরকার আভাসের অত্যন্ত প্রিয় গল্পকার, প্রায় গুরু বলে মান্য করে। আভাসের নিজের অবস্থান একলব্যর মতন। রূপময়দার গল্প পড়েই সে ভক্ত হয়েছে, ব্যক্তিগত আলাপ বেশিদূর গড়ায়নি। সুযোগ ঘটেনি বিশেষ। দু’জনের বাসস্থানের দূরত্ব অনেকটাই – আভাস থাকে বেলঘড়িয়ায়, রূপময়দা যাদবপুর। দু’জনের আড্ডার জায়গা, পছন্দের লোকজন সবই আলাদা।

কফি হাউজে অথবা কোনও সাহিত্য-অনুষ্ঠানে যদি-বা বারকয়েক দেখা হয়েছে, আভাস একবার আগ বাড়িয়ে বলেছে আমি আপনার লেখার দারুণ ভক্ত। রূপময়দা খুশি হয়েছে ঠিকই, আভাসের পরিচয় জানার পরই গম্ভীর হয়ে গেছে। ভেবেছে আভাসের ভক্তি আসলে মিথ্যে। বিনয়ের মোড়কে অহঙ্কার প্রকাশ। এরকমটা ভাবার কারণ, রূপময়দার চেয়ে প্রায় বারো-চোদ্দ বছর পরে লেখালেখিতে এসে আভাস অনেক বেশি জনপ্রিয়। আভাসের আত্মপ্রকাশ কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনে। লিটল ম্যাগে বড় একটা লেখেনি। প্রাইভেট কোম্পানির চাকরি সামলে সময় পায়নি লেখার। বৃহত্তর পাঠক সমাজ আভাসের লেখা গ্রহণ করেছে। কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনের আমন্ত্রণে ইতিমধ্যে বেশ কটা উপন্যাস লেখা হয়ে গেছে আভাসের। তার গল্প-উপন্যাস থেকে সিনেমা, নাটক, টেলিফিল্ম সব কিছুই হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে সাহিত্যজগতে ইতিমধ্যেই খানিকটা তারকার মর্যাদা পায় আভাস। যেটা নির্ঘাত পছন্দ হয় না রূপময়দার। কখনো-সখনো দেখা হয়ে গেলে আভাসকে তাই এড়িয়ে চলে। রূপময়দা সিরিয়াস কাগজে লেখালেখি করে বেশি। কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনেও লিখে থাকে, নিজের লেখার ধারা না পাল্টে।

আভাসও বেশ কিছু সিরিয়াস লেখা লিখেছে, তার মধ্যে কিছু গল্প রূপময়দার লেখা থেকে প্রাণিত হয়ে। সে সব লেখা হয় রূপময়দা পড়েনি, বা পড়েও গুরুত্ব দেয়নি। আভাসের গায়ে বাণিজ্যিক কাগজের ছাপ, সেটাই যেন তার অপরাধ। এই বৈরিতা আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এবারের যাত্রাতে কাটিয়ে দেবে ঠিক করেছে আভাস। রূপময়দাকে বোঝাবে ভালো লেখা বাণিজ্যিক পত্রিকায় ছাপালে খারাপ হয়ে যায় না। মান একই থাকে। এছাড়াও আরও অনেক কিছুই বলার আছে। যেমন আভাস তো রূপময়দার মতো আরামের সরকারি চাকরি করে না। তার চাকরিতে খাটুনি বেশি, নিরাপত্তা কম। কমার্শিয়াল পত্রিকায় লিখে সে যদি ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করতে চায়, তাতে কি বিরাট অন্যায় করা হয়? কথাগুলো ট্রেনপথেই তুলবে ভেবেছিল আভাস। দীর্ঘ যাত্রা, প্রায় সাতাশ ঘণ্টা। কিন্তু বিধি বাম। বৃদ্ধা প্যাসেঞ্জারটি একগাদা লাগেজ নিয়ে খুঁড়িয়ে এসে কুপের লোয়ার বার্থ চাইলেন, আভাসকে নিজের জায়গা ছেড়ে আসতে হলো।

“আভাস যে বই খুলে ফেললে দেখছি। এতটুকু সময় নষ্ট করতে রাজি নও। কী পড়ছ?” কুপ থেকে জানতে চাইল ধ্রুবদা। মিশুকে মানুষ। আভাস বই খুলেছে বটে, এখনও পড়া শুরু করেনি। উত্তর দেয়, “গোয়েন্দা গল্পের সিরিজ। ইংরেজি বই। বিদেশি গল্প।”

“সামনের পুজোর প্রিপারেশন মনে হচ্ছে।” এটা বলল রূপময়দা। স্পষ্ট খোঁচা। টুকলির অপবাদ। মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই রাগ করে না আভাস। আপনহাসি হাসে, বুঝিয়ে দেয় অভিযোগটা সে মানছে না। প্রত্যেক পুজোয় বাচ্চাদের জন্য একটা গোয়েন্দা উপন্যাস লেখে আভাস। ভাঁড়ার এখনও শূন্য হয়নি, যে অন্য লেখা থেকে প্লট নিতে হবে। বিভিন্ন গোয়েন্দা গল্প পড়ে বুদ্ধিটাকে শানিয়ে নেয়।

বৃদ্ধা সহযাত্রীর সঙ্গে কথা বলা থামিয়ে রঞ্জনাদি বলে উঠল, “আমি আভাসের ডিটেকটিভ উপন্যাসের বিরাট ফ্যান। পুজোয় প্রথমেই ওটা পড়ি। গোয়েন্দা শাশ্বত রায়কে আমার দারুণ লাগে।”

রঞ্জনাদির উচ্ছ্বাসের মুখে একটু বুঝি ম্রিয়মাণ হলো রূপময়দা। বলল, “আমি অবশ্য আভাসের কোনও গোয়েন্দা গল্প পড়িনি। গোয়েন্দা গল্প পড়তে আমার ভালো লাগে না। অপরাধীকে আগে থেকেই নির্দিষ্ট করে রাখে লেখক, তাকে দিয়ে অপরাধের নানান প্রমাণ ফেলে রাখে। নিজের সৃষ্ট গোয়েন্দার মাধ্যমে ধরিয়ে দেয়। এর মধ্যে বাহাদুরিটা কোথায়, আমি ঠিক বুঝতে পারি না।”

“বাহাদুরিটা হচ্ছে পাঠককে ভালো লাগানো,” বলল ধ্রুবদা।

রূপময়দা বলে, “ভালো তো মানুষের অনেক কিছুই লাগে। যেমন, ম্যাজিক। ঠকছে জেনেও মানুষ উপভোগ করে। ঠকাচ্ছে বলে ম্যাজিশিয়ানেরও কোনও আত্মদংশন হয় না। কারণ, ওটাই তার কাজ। লেখকের কাজ তো সেটা নয়। বিনোদনের বাইরেও কিছু দায় থাকে। অবশ্য আমি বলছি না সাহিত্যে সমস্ত গোয়েন্দা গল্পই বিনোদনমূলক। কিছু উচ্চমানের লেখা নিশ্চয়ই আছে, সংখ্যায় বেশ কম।”

আলোচনার কেন্দ্রে এসে পড়েছে বলে বেশ অস্বস্তিই হচ্ছে আভাসের। রূপময়দা তাকে অপছন্দ করে, সেটাও প্রমাণ হচ্ছে। প্রসঙ্গটা যত তাড়াতাড়ি থামে, ততই মঙ্গল। কথা ঘোরানোর জন্য কী বলবে ভাবছে আভাস, প্রতাপদা বলে উঠল, “আভাসের ছোটগল্প আমার সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে। ও যদি অন্যান্য লেখা কমিয়ে দিয়ে বেশি করে ছোটগল্প লিখত, আমাদের বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হতো।”

লজ্জার একশেষ। কোথায় মুখ লুকোবে আভাস? প্রতাপদার কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। এই সময়ের শ্রেষ্ঠ গল্পকারের সামনে আভাসের গল্পের প্রশংসা করছে। আড়চোখে রূপময়দাকে দেখে নেয় আভাস, ফর্সা, চশমা পরা মুখটা বেশ থমথমে। ঝড়ের গতিতে ছুটছে ট্রেন। প্যান্ট্রি কারের কোনও হকারও যাতায়াত করছে না, যে তার থেকে কিছু কিনতে গিয়ে প্রসঙ্গের মোড় ঘোরাবে আভাস। খড়্গপুরের আগে ট্রেন থামবে না। ওখানেই ফার্স্ট স্টপেজ। …ভাবনার মাঝে ধ্রুবদা বলে উঠল, “আভাস কিন্তু উপন্যাসেও যথেষ্ট সাড়া ফেলেছে। ওর সবকটা উপন্যাস পড়েছে আমার বউ। খুব সুখ্যাতি করছে দেখে আমিও একটা পড়লাম। সম্ভবত ওর দ্বিতীয় পুজোর উপন্যাস, ছবিঘর। দারুণ লেখা।”

কথা শেষ করে ধ্রুবদা আভাসের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে জানতে চাইল, “ওই উপন্যাসটা কী একটা পুরস্কার পেয়েছে না?”

অধোবদন হয়ে মাথা নাড়ল আভাস, পুরস্কারের নাম মুখ ফুটে বলে উঠতে পারল না। এবার সে টয়লেটে যাবে, প্রয়োজন ছাড়াই। নয়তো পয়েন্ট থেকে এরা নড়বে না। বার্থ থেকে পা নামাতে যাবে আভাস, রূপময়দা বলে উঠল, “লেখালেখিতে আভাস তো প্রায় সব্যসাচীর ক্ষমতা ধরে। টিন এজারদের বিখ্যাত যে ম্যাগাজিনটা আছে, সেখানে প্রায়ই প্রেমের গল্প লেখে। ভূতের গল্পতেও আভাস নাম করেছে। আমার পাশের ফ্ল্যাটে একটা বাচ্চা ছেলে আছে, প্রায়ই আমাকে বলে, জেঠু, তুমি আভাস বসুর মতো ভূতের গল্প লেখো না কেন? ভীষণ ভালো লাগে পড়তে। আমি বলি, ভূতের লেখা খুব ঝুঁকির ব্যাপার বাবা। গল্প খারাপ হলে ভূতেরা এসে চাঁটি মেরে যায়। যত খারাপ, তত চাঁটি…”

হাসছে রূপময়দা। হাসির আড়ালে বিদ্রূপটা গ্রুপের কারুরই পড়তে অসুবিধে হচ্ছে না। গুম মেরে গেছে ধ্রুবদা, রঞ্জনাদি, প্রতাপদা। ধ্রুবদা বলে ওঠে, “সব ধরনের লেখা লিখতে পারা কি খারাপ?”

প্রশ্নটা যেহেতু রূপময়দার উদ্দেশে, উত্তর দেয়, “না না, খারাপ কেন হতে যাবে। পাঠক পাবে বিরাট রেঞ্জের। অর্থ, যশ, পরিচিতি, সবই হবে। যেমনটা লিখলে পাঠক খাবে সেটাই লিখে যাবে জীবনভর। কিন্তু ও যখন লেখালেখি শুরু করেছিল, সেই সময়কার কিছু গল্প আমি পড়েছি। মনে হয়েছিল সমাজের প্রচলিত ধ্যান-ধারণাগুলো ভাঙতে এসেছে। পাঠককে ভাবাতে এসেছে অন্যভাবে।”

মুখভর্তি অসন্তুষ্টি নিয়ে চুপ করে গেল রূপময়দা। প্রতাপদা বলল, “কথাগুলো একটু ভেঙে বললে হয় না? মাথায় ঢুকল না ঠিকমতো।”

বলার ভঙ্গি থেকেই বোঝা যাচ্ছে প্রতাপদার কাছে ব্যাপারটা সত্যিই ক্লিয়ার হয়নি। নিশ্চিত হয়ে নিয়ে রূপময়দা বলতে থাকে, “আভাস যে ভূতের গল্প লেখে, নিজে কি বিশ্বাস করে ভূতে? প্রেমের যে গল্পগুলো লেখে সব হান্ড্রেড পারসেন্ট লাভ। আর কে না জানে প্রেমের সম্পর্কের মধ্যেই সংশয় সবচেয়ে বেশি। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অপরকে বিশ্বাসের ভান করে অবিরত।”

“কিন্তু আভাসের আগেও তো অনেক বড় বড় লেখক প্রেম বা ভূতের গল্প লিখেছে। তাহলে তো সাহিত্যের একটা বিপুল অংশকে অগ্রাহ্য করতে হয়।” এটা বলল ধ্রুবদা।

রূপময়দা বলে, “আমি অগ্রাহ্য বা পরিত্যাগের কথা বলছি না। যা লেখা হয়েছে, তার পরের লেখাটা আশা করছি আভাসের থেকে। নবীন লেখক, নতুন কিছু তো দেবে পাঠকদের।”

“আচ্ছা মুশকিল, আভাস হয়তো ভূত বিশ্বাস করে। বহু বড় বড় লেখক ভূত বিশ্বাস করতেন, করেন,” বলল প্রতাপদা।

রূপময়দা আভাসের দিকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে, “তুমি কি ভূত বিশ্বাস করো? মনে করো বিশুদ্ধ প্রেম বলে কিছু হয়?”

এবার তো কিছু বলতেই হবে। শ্রদ্ধা করে বলে রূপময়দার সমস্ত অন্যায় অভিযোগ মেনে নেওয়া ঠিক হচ্ছে না। আভাস বলে, “ভূত, বিশুদ্ধ প্রেম আমি যেমন বিশ্বাস করি না, অনেক পাঠকও করে না। পাঠকদের লেখকের চেয়ে বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। তারা সাহিত্য থেকে রস পেতে চায়, জ্ঞান নয়। জ্ঞানের জন্য স্কুল কলেজ আছে।”

“স্টুডেন্টরা কি শুধুমাত্র স্কুল-কলেজ থেকেই সবকিছু শেখে? এই যে তুমি গল্প লিখে বাচ্চাদের মনে ভূতের অস্তিত্ব আছে বলে জানান দিচ্ছ, এই ভুল ধারণা তাদের আদৌ কোনোদিন কাটবে কিনা, কে জানে। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার যা হাল। বয়ঃসন্ধির ছেলেমেয়েরা তোমার গল্প পড়ে মনে করছে প্রেম এক স্বর্গীয় ব্যাপার। অযোগ্যের কাছে সমর্পণ করছে নিজেকে। বাস্তবটা জানছে না। ঠকছে। এর দায় তুমি নেবে না?”

রূপময়দার কথার মাঝখানে রঞ্জনাদি বলে ওঠে, “এ মা, তোমরা তো দেখছি ঝগড়াঝাঁটি শুরু করে দিলে। ট্রিপের প্রথমদিনেই যদি এই অবস্থা হয়, শেষে না জানি কী হবে। একসঙ্গে ফিরব তো?”

“সরি সরি, আমি একটু ওভার রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছি। সত্যি কথা বলতে কী, আভাস খুব পাওয়ারফুল লেখক বলেই ওর প্রতি এক্সপেকটেশন আমার বেশি।” বলে পরিস্থিতি সামলে নিল রূপময়দা।

বৃদ্ধা সহযাত্রী এতক্ষণ সকলের কথা মন দিয়ে শুনছিলেন, এবার আভাসের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, “আচ্ছা, ‘হিমরাত’ নাটকটা আপনারই না? আপনিই সেই আভাস বসু। নাটকটা আমি অ্যাকাডেমিতে দেখেছি। মেয়ে-জামাই নিয়ে গিয়েছিল দেখাতে। কী দারুণ নাটক! অসাধারণ!”

আভাস বুঝতে পারে আর এখানে বসা যাবে না। জেতেই হবে টয়লেটে। নয়তো নাটক নিয়ে শুরু হবে আর এক প্রস্থ। মুখটা হাসি হাসি করে আভাস বার্থ থেকে নেমে গেট টেনে বাইরে যায়।

খড়্গপুর পার হয়ে গেছে ট্রেন। টয়লেট থেকে ফিরে এসে আভাস দেখেছিল আলোচনা ঘুরে গেছে। স্বস্তি পেয়েছিল। যার সাহচর্য পাওয়ার জন্য এই ট্যুরে সে চলেছে, তার সঙ্গেই তৈরি হচ্ছিল তিক্ততা। খড়্গপুরের প্ল্যাটফর্ম থেকে মাটির ভাঁড়ের চা এসেছিল কামরায়। সকলে মিলে খাওয়া হলো, বৃদ্ধা সহযাত্রী সমেত। বৃদ্ধা প্রায়ই এই ট্রেনে চেন্নাই যান, মেয়ে-জামাইয়ের কাছে। প্রতিবারই নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হয়। পরে যোগাযোগ হয় ফোনে। কলকাতার ফ্ল্যাটে একাই থাকেন মহিলা। ছেলে বিদেশে, স্বামী গত হয়েছেন। চেন্নাই যাত্রাপথের বন্ধুদের ফোন পেলে নিঃসঙ্গতা কাটে। বয়স্ক মহিলার জন্য খারাপ লাগে আভাসের, নিশ্চয়ই বড়ি, আচার আরও নানা জিনিস মেয়ে-জামাইয়ের সংসারে নিয়ে যাচ্ছেন বলেই এত লাগেজ হয়েছে। ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। এমনকী কুলির দেখা পাওয়া যায় নি। হয়তো পাননি খুঁজে। ওই পা নিয়ে কম্পার্টমেন্ট অবধি পৌঁছলেন কীভাবে, সেটাই আশ্চর্যের।

ভদ্রমহিলার পারিবারিক প্রেক্ষাপট শোনার মাঝে আভাস বারদুয়েক রূপময়দার গল্প নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েছিল। বিখ্যাত কয়েকটা গল্পের নাম করে শুরু করেছিল প্রশস্তি, রূপময়দার কত বড় ভক্ত বোঝাতে চাইছিল, “এখন এসব থাক” বলে রূপময়দা অন্য কথায় চলে গেল। এই হচ্ছে সত্যিকারের গুণী মানুষের শিষ্টাচার। এখন গ্রুপ থিয়েটার নিয়ে আলোচনা চলছে কুপে। সামান্য দূরে থাকার সুবাদে আভাস সন্তর্পণে সরে এসেছে গল্পগাছা থেকে। এখনও তো অনেকটা পথ, কয়েকটা দিন পড়ে আছে হাতে, প্রচুর কথা বলতে হবে। ডিটেকটিভ গল্পের বইটায় মন দিয়েছে আভাস। ধীরে ধীরে ঢুকে গেছে কাহিনিতে।

বেশ খানিকক্ষণ চলার পর ট্রেনের গতি কমতে লাগল। বই থেকে মন সরে গেল আভাসের। কাচ ঢাকা জানলায় চোখ রেখে বোঝার চেষ্টা করল কেন স্লো হলো ট্রেন। বোঝা যাচ্ছে না। বাইরে বিকেল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে।

“জাজপুর ঢুকছে ট্রেন।” কুপ থেকে বলল রূপময়দা। আভাসের উদ্দেশেই, জানলায় চোখ রেখেছে বলে। ট্রেনের পাশে আরও অনেক লাইন দেখা যেতে লাগল, সিগনাল পোস্ট, দাঁড়িয়ে থাকা মালগাড়ি। রূপময়দা ফের বলল, “আভাস, নামবে নাকি একবার প্ল্যাটফর্মে? দু’বছর জাজপুরে কাটিয়েছি। অফিস থেকে পোস্টিং দিয়েছিল।”

“কোনও দরকার নেই নামার। সুপারফাস্ট ট্রেন, এসব স্টেশনে বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না,” বলল ধ্রুবদা।

প্ল্যাটফর্মে ঢুকে পড়ল ট্রেন। আভাসের নামার ইচ্ছে নেই খুব একটা। রূপময়দাও গা করল না।

সত্যিই খুব অল্প সময় দাঁড়াল ট্রেন। ফের চালু হয়েছে। আভাস বইয়ে মন দেয়। ট্রেন জার্নিতে পড়া খুব ভালো হয় তার। এই কম্পার্টমেন্টে একটা বাড়তি সুবিধে পাওয়া যাচ্ছে, সমস্ত বার্থে প্যাসেঞ্জার থাকা সত্ত্বেও হইচই একেবারেই নেই। সবসময় এমনটা হয় না, হই-হট্টগোলের একটা দুটো গ্রুপ থেকেই যায় কামরায়। পড়তে পড়তে আভাসের কানে আসে বৃদ্ধা সহযাত্রীর গলা, “এত জোরে চালাচ্ছে কেন ট্রেন? এখনই তো এরকম স্পিড নেয় না। রাতের দিকে জোরে চালায়।”

ভদ্রমহিলা ভয় পাচ্ছেন। বোঝাই যাচ্ছে ভীতু প্রকৃতির। আভাস গতিটা বেশ উপভোগ করছে। সুপারফাস্ট ট্রেন বলে কথা, মর্যাদা রাখতে জোরে তো দৌড়বেই। রাতের দিকে স্পিড তুললে লাভ হতো না, ঘুমের মধ্যে টের পেত না আভাস…ভাবনা শেষ হয়েছে কী হয় নি, প্রবল ঝাঁকুনি সমেত হেলেদুলে চলতে লাগল ট্রেন। সাপের চলনে। রেললাইন তো এরকম আঁকাবাঁকা হয় না, এভাবে চলবে কেন? শিরদাঁড়ার বেজায়গায় মোচড় লাগছে, প্রবল যন্ত্রণা। বাচ্চা এবং মহিলা প্যাসেঞ্জারদের আর্ত চিৎকার…গোটা ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই ট্রেন পুরোপুরি থেমে গেল। বিষম আতঙ্কে আভাস কুপের দিকে তাকায়, ভয়ে সাদা হয়ে গেছে গ্রুপের চারজন আর বৃদ্ধার মুখ। কেউই বুঝতে পারছে না, কী ঘটেছে। আবার একবার দুলে উঠে স্থির হয়ে গেল ট্রেন।

ভয় এতটাই গ্রাস করেছে সবাইকে, ‘কী হলো’ কথাটা পর্যন্ত উচ্চারণ করে উঠতে পারছে না কেউ। মনে হচ্ছে এই বুঝি দুলে উঠল আবার।…এইভাবে ঠিক কত মিনিট বা সেকেন্ড কাটল, কে জানে। আভাসের বার্থ লাগোয়া দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল, একটা লোক, রক্তে ভেজা তার সাদা টি-শার্ট। ভয়ার্ত গলায় চিৎকার করছে, “পটরি সে গির গয়ি ট্রেন। পটরি সে গির গয়ি…” বলতে বলতে করিডোর ধরে এগিয়ে গেল লোকটা। তার মানে ট্রেন ডিরেলড। এই কামরাটা লাইন থেকে নেমে গেলেও সোজা দাঁড়িয়ে আছে। নয়তো আভাসরা এতক্ষণে হেলে পড়ে যেত। রক্তমাখা লোকটা ওভাবে হেঁটে যেতে পারত না। আভাস কী করণীয় ভাবছে, ঝপ করে অন্ধকার হয়ে গেল গোটা কামরা। পাওয়ার কাট হয়ে গেল। এসিও চলবে না। আবার বাচ্চাদের কান্না, বড়দের আর্তরব। মৃদু আলো জ্বলে উঠল আভাসদের গ্রুপ যে কুপে আছে। লাইটার জ্বালিয়েছে রূপময়দা, বাকিরা বজ্রাহতের মতো স্থির। আভাসের উদ্দেশে ধ্রুবদা বলে, “চলো, বাইরে গিয়ে দেখি, কাণ্ডটা কী হলো!”

দেখতে তো হবেই কতটা মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে। বার্থ থেকে নামে আভাস। লাইটার নিভিয়ে এগিয়ে এলো রূপময়দা। কান্নাছোঁয়া গলায় রঞ্জনাদি বলে, “কোনও দরকার নেই এখন বাইরে যাওয়ার।”

প্রতাপদা বলল, “কী অবস্থা হয়ে আছে বাইরে, কে জানে! আমরা সবাই এক জায়গায় থাকা ভালো।”

আভাস, রূপময়দা কানে নিল না ওদের কথা। কামরার গেট টেনে বাইরের প্যাসেজে গেল। ট্রেন থেকে নামার ডানদিকের দরজা খুলল আভাস, মুখ বাড়িয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে, তাদের সামনের দুটো কামরা লাইন থেকে নেমে হেলে পড়েছে।

“বাকি কম্পার্টমেন্টগুলো গেল কোথায়?” বিষম বিস্ময়ে বলল রূপময়দা, আভাসের পাশ দিয়ে মাথা বাড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছে।

আভাস বলল, “ওপাশের দরজা দিয়ে দেখা যাক।”

বাঁদিকের দরজা দিয়ে ঘটনার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করা গেল। দু’জনেই স্তব্ধবাক। প্রায় সশব্দে ধড়াস ধড়াস করছে আভাসের বুক। সন্ধের আবছা অন্ধকারে দেখা যাচ্ছে কোনও বোগি কাত হয়ে পড়ে রয়েছে, একটার ওপর একটা উঠে গেছে কামরা। প্রায় চার-পাঁচ তলা সমান। কোনও কামরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আছে খানিক দূরে। তুমুল চিৎকার-কান্না যাত্রীদের।

“একটুর জন্য বেঁচে গেলাম আমরা। আমাদের পরের কামরা থেকেই লাইনের বাইরে রয়েছে ট্রেন। নিশ্চয়ই বিশাল আওয়াজ হয়েছিল, এসি কম্পার্টমেন্টে ছিলাম বলে তেমন টের পাই নি,” বলল রূপময়দা। সহজ বাচনভঙ্গিতে বোঝা গেল খুব একটা ঘাবড়ে যায়নি। তাতে আভাসও বিহ্বলতা কাটিয়ে স্বাভাবিক হলো। ফের রূপময়দা বলে, “যা অবস্থা দেখছি রেসকিউ করতে অনেক সময় লাগবে। রেলের রেসকিউ টিম কখন আসবে, তারও কোনও ঠিক নেই। আমাদের জল এবং খাবার সবই ফুরোবে। রাত্রের খাবার প্যান্ট্রি থেকে নেওয়া হবে ঠিক হয়েছিল। বেশিক্ষণ চলার মতো খাবার, জল স্টকে নেই আমাদের। কিনতে হবে।”

“এখানে দোকান কোথায়? দু’পাশে তো ফাঁকা, শুধুই অন্ধকার,” বলল আভাস।

রূপময়দা বলে, “কাছাকাছি হাইওয়ে আছে। আমি জাজপুরে ছিলাম, জানি। হাইওয়েতে একটা না একটা দোকান পেয়ে যাবে। যেতে দেরি করলে এই গাড়ির প্যাসেঞ্জাররাই দোকানটা খুঁজে নিয়ে সব মাল শেষ করে দেবে, লুঠ হয়ে যাবে দোকান।”

“চলুন তাহলে, খোঁজা যাক দোকান।” বলার পর আভাস বলে, “যাই, প্রতাপদের একবার জানিয়ে আসি।”

“কোনও দরকার নেই জানাবার। যেতে দেবে না। খাবার না পেয়ে পরে আবার কষ্টও পাবে,” বলে রূপময়দা বাঁদিক ছেড়ে ডানদিকের দরজা লক্ষ্য করে এগোল। হাইওয়েটা তার মানে ওই সাইডে।

ঝুবকো অন্ধকারে পাশের রেললাইন ধরে আভাসরা এগিয়ে চলেছে। পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে বেশ কিছু আতঙ্কগ্রস্ত প্যাসেঞ্জার। তাদের পরিজনরা হয়তো সামনের দিকে আছে। পিছনের কয়েকটা বোগি বাদে পুরো গাড়িটাই তো উল্টে গেছে।

সাদাটে শাড়ি পরিহিতা একজনকে দৌড়ে যেতে দেখে থমকে গেল আভাস, রূপময়দা। একে অপরের দিকে তাকালো। রূপময়দা জিজ্ঞেস করল, “তুমি নিশ্চয়ই একই জিনিস দেখলে?”

ঘাড় নাড়ল আভাস। ট্রেনের সেই সহযাত্রী বৃদ্ধাকে এখনই তাদের পাশ দিয়ে দৌড়ে যেতে দেখল। রূপময়দা বলে উঠল, “অসম্ভব, উনি তো ভালো করে হাঁটতেই পারছিলেন না। আমরা কি তাহলে ভুল দেখলাম?” একটু থেমে নিজেকেই প্রশ্ন করে রূপময়দা, “দু’জনের একই ভুল হলো?”

ট্রেনের দিকে তাকায় রূপময়দা। আশঙ্কার গলায় জানতে চায়, “আভাস, আমরা পিছন থেকে কত নম্বর কামরায় ছিলাম?”

গলা শুকিয়ে গেছে আভাসের। ট্রেনের দিকে তাকিয়ে আছে সেও। কোনোক্রমে বলে, “ছিলাম চার নম্বর কম্পার্টমেন্টে। এখন তো দেখছি সেটা মাটিতে। লাস্ট দুটো কামরা লাইনে। তাহলে আমাদেরটা সমেত আর একটা এখনই পড়ল?”

“না, পড়লে বিকট আওয়াজ হতো। চিৎকার করত প্যাসেঞ্জাররা। আমরা কি সত্যিই সশরীরে নেমে আসতে পেরেছি?”

বুক ফাঁকা হয়ে যায় আভাসের। বৃদ্ধাও কি আর সশরীরে নেই, তাই ওভাবে দৌড়তে পারছেন? গাঢ় বিষাদের সঙ্গে রূপময়দা বলে, “কোথাও একটা বড় গণ্ডগোল হয়ে গেছে আভাস। একটু আগে আমি আমার সেজ কাকাকেও দৌড়ে যেতে দেখলাম। বছর পাঁচেক হলো মারা গেছেন কাকা। খুড়তুতো ভাই রেলে মাথা দিয়েছিল। এই ভাবেই দৌড়ে গিয়েছিলেন কাকা।”

ভীষণ শীত লাগছে আভাসের। ভয় যে এত ঠাণ্ডা হতে পারে, ধারণা ছিল না। খানিক আগে সেও একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখেছে, পায়েল ছেলেকে নিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে অ্যাকসিডেন্ট হওয়া ট্রেনটার দিকে। আভাসের মনে হয়েছিল মনের ভুল। এখন মনে হচ্ছে, না। ট্রেনের মতো তাদের কাছে সময়টা তালগোল পাকিয়ে গেছে। রূপময়দা দেখছে অতীত, আভাস ভবিষ্যৎ। বৃদ্ধার দৌড়ে যাওয়াটা বর্তমান। আচমকাই আভাসের মাথায় একটা প্ল্যান আসে। রূপময়দাকে বলে, “আমরা বেঁচে আছি কিনা বোঝার জন্য একে অপরকে ছুঁয়ে দেখি না।”

প্রস্তাবটা মনে ধরে রূপময়দার। মুখোমুখি হয় দু’জনে। হাত তুলতে গিয়েও থমকে যায় দু’পক্ষই। ভূত বিশ্বাস করে না এরা। অথচ একে অপরকে ছোঁয়ার মতো সহজ কাজটাও করে উঠতে পারছে না। ছুঁলেই যদি প্রমাণ হয়ে যায় তারা নেই। নেই হয়ে যেতে কেউই চায় না। ঘোর আতঙ্কে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সময় বয়ে যায়। এভাবে কতক্ষণ অপেক্ষা করবে দু’জনে? অবশ্য এদের জীবনের সময়ের মূল্য আদৌ আর আছে কি? কে জানে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার: মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত