এক
পঁচিশে বৈশাখ রবীন্দ্র সদনে একসঙ্গে গান শোনার পর বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ দেবলীনা বুঝতে পারল দেবাশিস কেমন যেন সাইকোটিক হয়ে যাচ্ছে।
সারাদিন রবীন্দ্রসঙ্গীত, এগ চাউ, সফটি আইসক্রিম, হিঙের কচুরি, ভাঁড়ে চা, বোতলে আনা জল – এসবের সঙ্গে থাকা দেবাশিস ঠিকই ছিল। দুপুর তিনটের পর যখন অল্পস্বল্প বৃষ্টিটা শুরু হল, দেবাশিস বলল, “চলো ভিজি”।
এটা কোনও নতুন কথা নয়। প্রায় প্রতি বছরই ওরা এই দিনটায় ভেজে। দেবলীনা উঠে পড়ল। অ্যাকাডেমির পাশ দিয়ে কয়েক পা যাবার পরেই ঝিরঝিরে বৃষ্টিটা হঠাৎ কী খেয়ালে ঝুপঝুপে হয়ে গেল। নিমেষে দেবলীনার বুটিক শাড়ি, টেরাকোটার হার, দেবাশিসের হাফহাতা পাঞ্জাবি, জিন্সের প্যান্ট ভিজে একসা। দেবলীনা বলল, “এ একেবারে ভিজে যাব গো। চলো কোথাও একটু দাঁড়াই।”
“চলো।”
ক্যাথিড্রাল চার্চে ঢুকে পড়েছিল ওরা। কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! আর তেমনই হাওয়া। চার্চে সিঁড়ির সামনেটায় শেডের নীচে দাঁড়িয়েছিল দু’জনে। কম্পাউন্ডের ভেতর চওড়া পিচের রাস্তার ওপরে ধোঁয়ার মতো বৃষ্টি, ছোট বড় গাছগুলোর পাগল করে দেওয়া হাসাহাসি আর বড় নকুলদানার মতো শিল পড়া দেখতে দেখতে দেবাশিস হঠাৎ বলে উঠল, “জানো দেবলীনা, আমার খুব ইচ্ছে করে…”
“কী ইচ্ছে?”
“পরে বলব।”
কথা থেমে গেছিল, আরেকটু পরে বৃষ্টিও। ওখান থেকে সোজা ভিক্টোরিয়ায় গিয়েছিল ওরা। বৃষ্টির পরে গাছগুলোয় নতুন রং। গনগনে সবুজ, গনগনে হলুদ। বিকেলটাও দুম করে হলুদরঙা হয়ে গিয়েছিল।
একটা সোঁদাল গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আঙুরের মতো থোকা থোকা তীব্র হলুদ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে দেবলীনা বলল, “উফ্! রংটা দেখো।”
দেবাশিস হেসে বলল, “আজকে সবার গায়ে হলুদ।”
হলুদে দ্রব দেবাশিসকে তখনও কিন্তু বোঝা যায়নি। এমনকী দেবলীনার পিঠে ব্লাউজের ভিতর হাত ঢুকিয়ে বিষ-পিঁপড়েটাকে বের করে আনা পর্যন্ত দেবাশিসের সবকিছুই স্বাভাবিক ছিল দেবলীনার কাছে। তারপরেই হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেবাশিস আবার দেবলীনার দিকে তাকিয়ে বলল, “দেবলীনা, আমার খুব ইচ্ছে করে…”
“কী ইচ্ছে বলবে তো?”
“ঈশ্বর হতে।”
“কীহ্!” চমকে উঠেছিল বিএ ফার্স্ট ইয়ার, ইংলিশ অনার্স দেবলীনা। গভর্মেন্ট আর্ট কলেজ ফাইনাল ইয়ার ইন্ডিয়ান পেন্টিং দেবাশিসের চোখের মধ্যেও সেই ইচ্ছেটা তীব্রভাবে ফুটে উঠেছিল।
দুই
একেবারে ভোররাত, হিহি করা ঠান্ডা, চারদিকের অন্ধকার আর কুয়াশা ছিঁড়ে সামান্য আলো। গঙ্গায় হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রায়বৃদ্ধ, পাঁশুটে চেহারা, ন্যাড়া মাথায় কোমরের ধুতিটা থাই পর্যন্ত মালকোঁচা মেরে তোলা। হাড় জিরজিরে বুকে মোটা পৈতে। বৃদ্ধ শীর্ণ দু’হাতে নিজের শিশুসন্তানটিকে গঙ্গায় ডোবাচ্ছে।বাচ্চাটার অপুষ্ট চেহারা, ন্যাড়া করা মাথাটা দেহের তুলনায় বড়। মাথায় একটা টিকি। শিশুটির দম আটকে চোখ ঠেলে আসছে। সে প্রাণপণে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। বৃদ্ধ পিতা তবু নির্মম। তার চোখে সন্তানের পুণ্য সঞ্চয়ের আনন্দ চিকচিক করছে। বৃদ্ধের পাশে তার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার অল্পবয়সি স্ত্রী। তার চোখে একই সঙ্গে সন্তানের জন্য যন্ত্রণা আর পুণ্য অর্জনের আনন্দ ঝরে পড়ছে।
দেবাশিস ছবিটার নাম দিল ‘The Holy Bath’। টেম্পেরার কাজ। অনেকদিন সময় নিল ছবিটা। আজ প্রায় মাঝরাতে ছবিটা শেষ করে ইজেলে আটকানো ক্যানভাসটার দিকে বেশ কিছুক্ষণএকদৃষ্টে চেয়ে থাকল দেবাশিস। তারপর তুলিগুলো ধুয়ে রেখে শুয়ে পড়ল। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষণ পর ও বুঝতে পারল, ছবির সেই বাচ্চাটার জন্য ওর কষ্ট হচ্ছে। ধুস্! নিজের হাতে তৈরি একটা নিষ্প্রাণ ছবি, তার জন্য আবার কষ্ট! কিন্তু সত্যিই যদি জীবন্ত হয়ে ওঠে ছবিটা? প্রাণ পেয়ে যায় ফিগারগুলো? তাহলে বাচ্চাটার… নাহ্, বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল দেবাশিস। টিউবটা জ্বালিয়ে আবার ছবিটার দিকে তাকাল। একই রকম স্থির। আবার সামনে ঝুঁকে পড়ে দেখল। না, কোনও স্পন্দন নেই। হেসে ফেলল দেবাশিস। বিড়বিড় করে বলল বাচ্চাটাকে, “ভয় নেই তোর। আমি তোর জন্মদাতা। যন্ত্রণা দেব না তোকে।” অয়েলের মোটা টোন দিয়ে খসখস করে নির্মমভাবে বুজিয়ে ফেলল ছবিটাকে। তারপর নতুন ক্যানভাস বসিয়ে আবার স্কেচ করল, সেখানে বৃদ্ধ শুধু স্নান করছে। পাশে মা’র কোলে কাপড়ে জড়ানো শিশুটি নিশ্চিন্ত ঘুমে।
পরদিন সকালে কলেজে যাবার জন্য বাড়ি থেকে কয়েক পা এগোতেই পাথরটাকে দেখতে পেল দেবাশিস। বাড়ির সামনের নিমগাছটার নীচে রাখা। কে রেখে গেছে কে জানে? ও খানিকটা কৌতূহলী হয়ে সামনে এল। মনোযোগ দিয়ে ওটাকে দেখল। মসৃণ ডিম্বাকৃতি পাথরটা। ছাই-ছাই রং। ডাইনোসরের ডিম নয়তো? কথাটা ভেবেই হেসে ফেলল দেবাশিস।
তারপর থেকে রোজ প্রায় দু’বেলাই যাওয়া আসার পথে দেবাশিস পাথরটার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। মাঝেমধ্যে জিজ্ঞেস করে, “কী রে, কেমন আছিস?” পাথর চুপ থাকে। দেবাশিস নিজেই ওর হয়ে উত্তর দিয়ে দেয়, “ভালো।”
ধীরে ধীরে একটা সখ্য তৈরি হতে থাকে পাথরে মানুষে। একদিন সকালে পাথরটার মাথায় কয়েকটা ন্যাতানো টগর ফুল দেখে চমকে উঠল দেবাশিস। পাথরটার চারপাশে মাটি ভিজে। কেউ নিশ্চয় স্নান করিয়ে ফুল চাপিয়ে গেছে। দেবাশিস হেসে বলল, “বা রে ব্যাটা, তুইও কি আমার মতো ঈশ্বর হবি নাকি?” পাথর চুপ। দেবাশিস হঠাৎ খানিকটা গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, “ঠিক আছে, একদিন আমরা দু’জনেই একসঙ্গে ঈশ্বর হব। হবই দেখিস।”
সেদিন বিকেলেই পাথরের কথাটা দেবলীনাকে বলল দেবাশিস। দেবলীনা প্রথমটায় চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “তোমায় একটা কথা বলব?”
“কী কথা?”
“তুমি দিনে দিনে কেমন যেন অসংলগ্ন হয়ে পড়ছ।”
“তাই?”
“হ্যাঁ, তাই।”
“তাহলে?”
“তাহলে একটা কথা বলব। শুনবে?”
“শুনব।”
“তুমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাও।”
দেবাশিস ভুরুটা সামান্য কুঁচকে বলল, “হঠাৎ?”
“তুমি হঠাৎ কিম্ভুত সব ভাবছ।”
“কোনটা কিম্ভুত?”
“তোমার হঠাৎ ঈশ্বর হবার সাধ জাগল কেন? এমন একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ধারণা… তা ছাড়া নিজেই তো আগে বলতে, ক্ষমতা বিষয়টাই নেগেটিভ। তাহলে নিজেই এখন…”
“ঈশ্বর মানেই কি অপরের ওপর আধিপত্য করার ক্ষমতা?” অন্যদিকে তাকিয়ে পরিষ্কার গলায় বলল দেবাশিস।
দেবলীনা বলল, “তাই তো জানি।”
“ভুল জানো। সেই ঈশ্বর নয়। আমি চাই একটা প্রকাণ্ড সম্পর্ক। একটা… একটা এমন মন, যা দিয়ে পৃথিবীর প্রত্যেকটা মানুষ… শুধু মানুষ কেন, একটা ঘাস, কিংবা একটা শ্যাওলা পড়া ইট, জলের গভীরে ছোট্ট একটা মাছ… সব্বার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে পারি। আসলে তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারছি না, মানে একটা বিশালতা।”
দেবলীনা নিস্পৃহভাবে বলল, “শুধু এর জন্যই ঈশ্বর হতে হবে? মানুষ হয়ে কি সম্ভব নয়?”
“না, চারদিকটা বড় পচে যাচ্ছে দেবী। শুধু মানুষ হয়ে থাকলে পারব না। একমাত্র ঈশ্বর হতে পারলে এই পচাগলাগুলো সাফ করতে পারব। আসলে কী জানো, শুধু মনটা প্রশস্ত করতে চাইলেই হয় না। তার আগে পরিবেশটাকেও তার উপযুক্ত করে তুলতে হয়।”
দেবলীনা এবার স্পষ্টভাবে বলল, “দেব, তোমার যে অনুভবের ক্ষমতা আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল, সেটা কিন্তু এখন পাগলামোর দিকে যাচ্ছে।”
“গেলে যাক।”
আর কোনও কথা হলো না।
তিন
টি-টেবিলের ওপর দুটো খালি চায়ের কাপ রাখা। টেবিলের একদিকে বাবা, উলটো দিকে ভানুদেব ঘোষ নামের অসহ্য লোকটা বসে কথা বলছে। সন্ধেবেলা বাড়িতে ঢুকেই দেখতে পেল দেবাশিস। ভানুদেব পাড়ার দাদা বললে ভুল হবে। সেটা বছরকয়েক আগে ছিল।এখন ও এই কোতরং অঞ্চলের বাবা। নামকরা প্রোমোটার। এমএলএ, এমপি সব ওর কথায় ‘হ্যাঁ স্যার’, ‘না স্যার’ করে। এ লোকটা এখানে কেন? দেবাশিস পাশের ঘরে চলে যাচ্ছিল। ভানুদেব ওকে দেখে বলল, “এই তো দেব, ভালো তো?”
দেবাশিস “ভালো” বলে অসীম ঘেন্না নিয়ে লোকটার দিকে তাকাল। দু-আঙুলে নানা রঙের পাথর বসানো মোটা মোটা সোনার আংটি, হাতে রিস্টলেট, ছোট ছোট করে কাটা চুল, সলিড মোটা চেহারা। সাদা পাঞ্জাবি আর চোস্তা পরে দামি পারফিউমের গন্ধ ছড়াচ্ছে। পুরোপুরি হিন্দি সিনেমার ভিলেন।
ভানুদেব জিজ্ঞেস করল, “তারপর, ছবি আঁকা-টাঁকা চলছে তো?”
“হ্যাঁ, চলছে।”
“ভালো ভালো। হ্যাঁ, আঁকাটা ভালো করে শিখে নিয়ে সোজা আমার কাছে আমার কাছে চলে আসবে। ড্রাফটের কাজ করবে। চাকরি বাকরির যা বাজার।”
দেবাশিস একবার ঘাড়টা কাত করে “আচ্ছা” বলে পাশের ঘরে চলে গেল।
ভানুদেব শুভাশিসের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে রজতবাবু, আজকে উঠি তাহলে। দু’দিন ভাবুন। অবশ্য আমার প্রোপোজালটায় ঠকবার তো কিছু নেই। আপনাকে সবচেয়ে ভালো ফ্ল্যাটটাই দেব।”
ভানুদেব চলে যেতেই দেবাশিস ওই ঘরে এসে বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “লোকটা এখানে কেন এসেছিল?”
বাবার চোখে কেমন একটা ভয় জড়িয়ে রয়েছে।
“কেন এসেছিল?”
“ওই একটা কথা বলতে।”
“কী কথা?”
বাবা একটু চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “বোস।”
দেবাশিস বসল।
“বুঝলি, আমি ভাবছি এবার এ বাড়িটা বেচে দিয়ে…” বলতে গিয়ে দেবাশিসের স্থির চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে থেমে গেল বাবা। “ওভাবে তাকিয়ে রয়েছিস কেন? আমার কথাগুলো আগে ভালো করে শোন। মানে, নিজেই তো দেখছিস আশপাশের বাড়িগুলো কেমন দিনে দিনে চকচকে হয়ে উঠছে। তার মধ্যে এমন একটা আদ্যিকালের দাঁত বার করা লড়ঝড়ে বাড়ি… মানে ভানুদেব কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি। ওকে বাড়িটা ইয়ে করে… মানে বিক্রি করে দিলে ফ্ল্যাট হবার পর একটা ফ্ল্যাট তো আমরা পাবই, প্লাস আরও পাঁচটা মানুষেরও থাকার সংস্থান হবে। শুদ্ধু এই দুটো প্রাণীর জন্য এত বড় একটা জমি, বাড়ি আটকে রাখা, মানে এটা এক ধরনের সোশ্যাল ক্রাইম, বুঝলি।”
দেবাশিসদের বাড়িটা জিটি রোডের কাছে। ওর ঠাকুরদা তৈরি করেছিল। বাড়ির সামনের অংশ রাস্তার গা ঘেঁষেই উঠেছে। দোতলার ঝুল বারান্দা ফুটপাথের ওপর। ভেতরে অনেকটা ফাঁকা জমি। টাকার অভাব ও সেই সঙ্গে বছর ছয়েক আগে মা চলে যাবার পর ওদের ঔদাসীন্যে বাড়িটা সত্যিই লড়ঝড়ে হয়ে পড়েছে।
দেবাশিস চুপ করে বাবার কথাগুলো শুনল। তারপর বলল, “তোমার নিজের কথা বলো।”
দেবাশিসের এক ধাক্কায় বাবার কথায় সাজানো পাঁচিলটা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। ষাটোর্ধ্ব মানুষটা হঠাৎ অপরিসীম কাতরভাবে বলে উঠল, “দেব, ওদের সঙ্গে পারবি না।”
“কেন?”
“পারবি না। ওরা যখন ঠিক করেছে নেবে, তখন আজ না হোক কাল নেবেই। ওরা ভগবান। ইচ্ছে করলে সব পারে।”
“মিথ্যে কথা!” আশ্চর্য ঠান্ডা গলায় বলল দেবাশিস, “ওরা কিচ্ছু পারে না। ওরা কিচ্ছু পারবে না। তুমি দেখে নিও।”
বাবা দেবর হাতের ওপর আলতোভাবে নিজের হাত রাখল। তালু ভিজে। বাবার চোখের জল কি হাতের তালুর মধ্যে?
চার
“মন্দিরের সার্বিক উন্নয়নের জন্য মুক্ত হস্তে দান করুন” – লাল রং দিয়ে লেখা একটা সাইনবোর্ড নিমগাছের নীচে তিনফুট উঁচু মন্দিরের পাশে ঝোলানো। মন্দিরের ভেতর সেই পাথর ভানুদেবের কৃপায় মাসখানেকের মধ্যেই এখন ‘নিমশিব’ নামে পরিচিত। নিমগাছের নীচে তাঁর আবির্ভাব হয়েছে বলে তিনি এখন নিমশিব। অজস্র ফুলমালা, কুচো নৈবেদ্য আর খুচরো পয়সার মাঝখানে সেই পাথর এখন বিরাজমান।
এর মধ্যে আরেকদিন ভানুদেব দেবাশিসের বাবার কাছে এসেছিল, কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বাড়িটার বিষয়ে জানার জন্য। দেবাশিস পরিষ্কার “না” বলে দিয়েছে। ভানুদেব হেসে বলেছে, “ডিসিশনটা বোধহয় ঠিক হলো না। যা অবস্থা বাড়িটার। দেখো আবার, মিউনিসিপ্যালিটির নজরে না পড়ে।”
গতকাল সন্ধেয় নিমশিবকে কেন্দ্র করে পাড়ায় একটা মেলাও হয়ে গেল। মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ চৌধুরী এসেছিলেন প্রধান অতিথি হয়ে। কথা দিয়ে গেছেন মন্দিরের পাশের রাস্তাটার নাম অরবিন্দ রোড পালটে নিমশিবতলা রোড করতে আপ্রাণ চেষ্টা করবেন।
সকালে কলেজ যাবার সময় রাস্তায় ছড়ানো ছেটানো শালপাতা, কাগজের ঠোঙা, আইসক্রিমের কাঠি, শূন্য প্যাকেট মাড়িয়ে দেবাশিস মন্দিরটার সামনে একবার দাঁড়াল। বিড়বিড় করে বলল, “তুই এভাবে হলি?” তারপর হাঁটা লাগাল।
বিকেলে বাড়ি ফিরে দেবাশিস দেখল, বাবা বাইরের ঘরে চুপ করে বসে আছে। চোখদুটো দেওয়ালে টাঙানো লাল রং দিয়ে সিঁথি আর কপালে সিঁদুর আঁকা মা’র ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফোটোটার প্রতি স্থির।
“বাবা, বাবা।”
বাবা ধীরে ধীরে চোখ ফেরাল। মেঘলা বিকেলের মতো বাবার চোখ দুটো।
“কী হয়েছে বাবা?”
“তুই পারবি না দেব।”
“কী হয়েছে কী?”
“মিউনিসিপ্যালিটির লোক এসেছিল।”
“কেন?”
“এটা দিতে।”
“কী এটা?” দেবাশিস টেবিলের ওপর থেকে খামটা তুলল। মিউনিসিপ্যালিটির নোটিস। এই বাড়ি নাকি বিপজ্জনক, সুতরাং অবিলম্বে…। দেবাশিস কাগজটাকে টেবিলের ওপরে রেখে দিয়ে বলল, “তুমি কিছু ভেবো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“ওদের সঙ্গে পারবি না দেব।”
“বলছি তো কিছু হবে না। এত অস্থির হচ্ছ কেন?” কথাটা ইচ্ছে করেই একটু রুক্ষভাবে বলল দেবাশিস। বাবা বড্ড বেশি ভেঙে পড়েছে।
পাঁচ
সকালে বাজার করতে বেরিয়েছিল দেবাশিস। জিটি রোডের সামনে বাজার বসে। নিচু হয়ে সবজি কেনার সময় কাঁধে কার হাতের ছোঁয়া পেয়ে ঘুরে তাকাল।
ভানুদেব! একটা প্রচণ্ড ক্রোধ মুহূর্তের মধ্যে অবশ করে দিল দেবাশিসকে। ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ভানুদেব শান্ত হেসে জিজ্ঞেস করল, “বাবা কেমন আছেন?”
শব্দ যেন বেরোতে চাইছিল না। শরীরের সব শক্তি জড়ো করে দেবাশিস উত্তর দিল, “ভালো।”
“হ্যাঁ, বাবার প্রতি একটু নজর রেখো। বয়সটা তো ভালো নয়…তারপর বাড়িটার ব্যাপারে কিছু ঠিক করলে?”
“না।” একইভাবে বলল দেবাশিস।
“শুনলাম মিউনিসিপ্যালিটি নাকি নোটিস পাঠিয়েছে?”
“ঠিকই শুনেছেন।”
“আমি আগে বলেছিলাম না… যাকগে, কিছু ডিসিশন নিলে জানিও। আমি তো রয়েছিই সঙ্গে।”
দেবাশিস শুধু একবার ভানুদেবের মুখের দিকে তাকাল। ভানুদেব চলে যেতেই দাঁত চেপে বলল, “শুয়োরের বাচ্চা!”
তারপর ছোবল মারা সাপের মতো নেতিয়ে পড়ল। কিন্তু ছোবলটা ভানুদেবের মুখের ওপর মারতে পারল না কেন? ভয়ে?
বিকেলে রবীন্দ্র সদনের সবচেয়ে ওপরের সিঁড়িটার এককোণে বসে দেবাশিস বলল, “আমি লড়ব।”
দেবলীনা বলল, “তুমি কেন এমন গোঁয়ার্তুমি করছ বলো তো?”
“কোথায় আবার গোঁয়ার্তুমি করলাম?”
“করছ না? কেন ওদের সঙ্গে ঝামেলা করছ?”
“আমি ঝামেলা করছি?”
“নয়তো কী?”
“তুমি কি সত্যিটা জানো না?”
“দেখো দেব, আজকের যুগে সত্যিটা অন্যরকম।”
“তুমিও তাই ভাবো?” দেবাশিস সিগারেট ধরাল।
“ভালো লাগছে না। নেভাও ওটাকে।” দেবাশিস ওটাকে সিঁড়িতে ঠুসে দিল।
দেবলীনা বলল, “তা ছাড়া আমার সেফটিটাও তোমার ভাবা উচিত।”
“তোমার সেফটি! মানে?”
“আজকে আমাকে ভানুদেব ডেকেছিল।”
“তোমাকে! চিনল কী করে তোমায়?”
“দেখেছে হয়তো কোথাও তোমার সঙ্গে।”
“কোথায় ডেকেছিল?”
“কলেজে আসছিলাম যখন। শ্যামবাজার মেট্রোর সামনে দাঁড়িয়েছিল।”
“তোমার জন্য?”
“কী করে জানব? একটা লোকের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল।”
“অ। তা কী বলল?”
“তোমাকে বোঝাতে।”
“তাই বোঝাচ্ছ?”
“এভাবে কথা বলছ কেন?” যথেষ্ট বিরক্তির সঙ্গে বলল দেবলীনা।
“দেবী, তুমি জানো আমাদের বাড়িটা বাবার কাছে শুধু বাড়ি নয়। মা আর বাবা জীবনের চল্লিশটা বছর একসঙ্গে ওই বাড়িতে কাটিয়েছে। মা মারা যাবার পর বাড়ির প্রতিটা ইট যেন বাবার পাঁজরের একেকটা হাড় হয়ে উঠেছে। নিঃসঙ্গ লোকটার একমাত্র সম্বল এই নস্টালজিয়াটুকু, সেটাও ভেঙেচুরে দিয়ে একেবারে শেষ করে দেব লোকটাকে!”
দেবলীনা চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “আমি উঠছি।”
দেবাশিস জিজ্ঞেস করল, “কবে আসছ?”
“বলতে পারছি না।”
দেবাশিস ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি আনসেফ ফিল করলে নাও আসতে পারো।”
দেবলীনা উত্তর দিল না। গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল শ্যামবাজারের মেট্রো ধরতে।
ছয়
কিছুদিন পর আরেকটা নোটিস। তারপর আরও একটা।
“দেব পারবি না। কেন ওদের সঙ্গে…”
“আহ্… বলছি তো কিছু হবে না।”
তৃতীয় নোটিসটা সঙ্গে নিয়ে দেবাশিস বের হল চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করতে।
নিমগাছের পাশে ভানুদেবের অকৃপণ দানে বিশাল করে বড় করে তৈরি হচ্ছে নিমশিবের মন্দির। রাতদিন কাজ চলছে। দেব একবার দাঁড়িয়ে মন্দিরটাকে দেখল, তারপর আবার হাঁটা লাগাল।
চেয়ারম্যান বিশ্বনাথ চৌধুরী অফিসে নিজের রুমেই ছিলেন। দেব ঢুকেই সটান প্রশ্ন ছুড়ল, “আপনারা বারবার নোটিস পাঠাচ্ছেন কেন?”
“কীসের নোটিস?”
“৩৭/বি অরবিন্দ রোড।”
“অ। তা তুমি কি রজত মুখার্জির ছেলে?”
“হ্যাঁ।”
“তোমার বাবা প্রাইমারি স্কুলের টিচার ছিলেন না? তা তুমি কী করছ এখন?”
“ছবি আঁকি। আমার উত্তরটা দিন।”
চেয়ারম্যানের চশমার পিছনে চোখ দুটো শক্ত হল।
“নিজের বাড়ির হালতটা দেখেছ? ব্যালকনিটা ক্র্যাক হয়ে রাস্তার ওপর প্রায় ঝুলছে। কোনওদিন কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে গেলে তার দায় কে নেবে?”
“এমন কিছুই হয়নি। এর চেয়ে অনেক…”
দেবাশিসের কথা কেড়ে নিয়ে বিশ্বনাথ বললেন, “শোনো বাবা, তোমায় নিজের ছেলের মতো ভেবে একটা কথা বলি। তুমি শিক্ষিত ছেলে। তার ওপর আবার আর্টিস্ট। কেন এসব ঝামেলায় জড়াচ্ছ? পারবে ওদের সঙ্গে?”
“ওদের সঙ্গে মানে?”
চেয়ারম্যান ঠোঁটের কোণে হাসলেন। “বোঝো তো সবই। এখন ওদেরই মার্কেট। বরং ফ্ল্যাট হয়ে গেলে তোমাদেরই তো সুবিধা। টাকাও পাবে, সেই সঙ্গে একটা…”
“বাড়িটা যদি আমরা না ভাঙি, কী হবে?”
বিশ্বনাথ একইভাবে হেসে বললেন, “অনেক কিছুই হতে পারে।”
“যেমন?”
“যেমন তোমার বাড়ি বিপজ্জনক প্রমাণ করা হতে পারে। আবার ভেঙে ফেলাও যেতে পারে।”
“বিপজ্জনক আপনি বললেই প্রমাণ হয়ে যাবে?” খানিকটা ব্যাঁকাভাবে বলল দেবাশিস।
দেবাশিসের ব্যঙ্গ ধরে নিয়ে চেয়ারম্যান বললেন, “হ্যাঁ, হবে।”
“তাই? কীভাবে?”
“ধরো আমরা বলে দিলাম বিপজ্জনক। তুমি বললে, না। কী করে প্রমাণ করবে, না? তোমাকে বাড়ির খানিকটা চাঙড় খুলে নিয়ে আলিপুরে টেস্ট হাউসে যেতে হবে। সেখানে বেশ কিছুদিন চক্কর কাটতে হবে। আর তোমাদের বাড়িটা তো নিশ্চয়ই সত্তর-আশি বছরের পুরোনো, সুতরাং যা মেটিরিয়াল দিয়ে তৈরি হয়েছিল, তার লংজিভিটি অ্যাদ্দিনে ডেফিনিট অনেকটা বসে গেছে। ফলে সহজেই প্রমাণ হতে পারে, তোমাদের বাড়ি বিপজ্জনক। এর ফলে মিউনিসিপ্যালিটি তোমাদের ট্যাক্স রিসিভ করা বন্ধ করে দিতে পারে, জলের, ইলেকট্রিকের লাইন কেটে দিতে পারে। এর পর ধরো তুমি যদি কোর্টেও যাও…”
বিশ্বনাথ গড়গড় করে বলে যাওয়া সম্ভাবনার কথাগুলোকে মাঝপথে হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে খুব শান্তভাবে বলল দেবাশিস, “আপনি কি ভানুবাবুর কেপ্ট?”
“হোয়াট!”
“বলছি আপনি কি ভানুদেবের পোষা বেশ্যা?”
“হারামজাদা!” চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন বিশ্বনাথ। “বেরো, বেরো এখান থেকে! তোর বাড়ি যদি আমি না ভেঙেছি তো আমার নাম…”
দেবাশিস একবার ঠোঁট টেনে হেসে বেরিয়ে এল।
সাত
“দেশে কি আইনশৃঙ্খলা উঠে গেছে? আপনার কোনও চিন্তা নেই রজতবাবু। আমরা আপনার সঙ্গে আছি।” সিগারেটের ধোঁয়াটা নাকমুখ দিয়ে ছাড়তে ছাড়তে কথাটা বললেন তমাল চ্যাটার্জি। ইনি এ অঞ্চলের ভূতপূর্ব চেয়ারম্যান। গতবছর পুরসভা ভোটে বিশ্বনাথের কাছে হেরেছেন। সাতসকালেই ওঁর আগমনের কারণটা ঠিক বুঝতে পারছিল না দেবাশিস।
হাফহাতা পাঞ্জাবি, ঢোলা পাজামা, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা। মাথার কাঁচা-পাকা চুলগুলোয় আঙুল চালিয়ে আরেকবার গুছিয়ে নিলেন উনি। তারপর দেবাশিসের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি কি বিশ্বনাথকে খারাপ কিছু বলেছ?”
দেবাশিস বিছানায় শুয়ে থাকা বাবার দিকে একবার তাকাল। তারপর বলল, “তেমন কিছু নয়।”
“অথচ দেখো, ওরা রাষ্ট্রময় বলে বেড়াচ্ছে তুমি নাকি বিশ্বনাথকে যাচ্ছেতাই ভাবে অপমান করেছ… যদি বলেও থাকো, বেশ করেছ। শালা এক নম্বরের চোর চিটিংবাজ। কীভাবে রিগিং করে গতবার জিতেছে জানো? এলাকার উন্নয়নের কোটা থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঝাড়ছে, আর…”
এতক্ষণে তমালবাবুর আসার কারণটা বুঝতে পেরে হেসে ফেলল দেবাশিস।
তমালবাবু ভ্রুক্ষেপও করলেন না। বলে চললেন, “এমনিতে তোমাদের বাড়ির সাপোর্ট যে আমাদের প্রতি তা তো জানিই। তবে কী জানো, অ্যাকটিভ মেম্বার হলে এসব কেসে মনে আরেকটু জোর পাওয়া যায়। তোমার মতো সৎ, আইডিয়ালিস্ট ছেলেদেরই তো আমাদের পার্টিতে…” একটু থামলেন তমালবাবু। দেবাশিসের দিকে ভালো করে তাকালেন। তারপর বললেন, “তা বলে ভেবো না যেন আমি সাতসকালে এসে তোমাকে আমাদের পার্টিতে টানার চেষ্টা করছি। সেটা সম্পূর্ণভাবে তোমার নিজস্ব মতাদর্শের ব্যাপার। আমরা তো আর ওদের মতো চোর-ছ্যাঁচ্চোড়, গুন্ডা নিয়ে পার্টি তৈরি করিনি। আমাদের প্রত্যেকটা ক্যাডার শিক্ষিত, ভদ্র। সমাজের জন্য সত্যিই কিছু করবার আদর্শ নিয়ে…”
“তাহলে এখন কী করা যায়?” তমালবাবুর ভাষণ মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল দেবাশিসের বাবা।
প্রশ্নটায় একটু চুপসে গেলেন তমাল চ্যাটার্জি। তারপর খানিকটা ঝিমোনো হাসি দিয়ে বললেন, “এখন ব্যাপার হচ্ছে পাওয়ার তো ওদের হাতে, বুঝলেন। সুতরাং আমরা যদি আপনাদের হয়ে ডাইরেক্ট কোনও স্টেপ নিতে যাই, তখনই কেচ্ছা ছড়াবে। বলবে আমরা দুর্নীতিকে মদত দিচ্ছি। তা ছাড়াও আরও অনেক ঝামেলা রয়েছে…”
“তার মানে কিছুই করার নেই, তাই তো?” অনেকক্ষণ সহ্য করে কথাটা বলে ফেলল দেবাশিস।
“না, মানে সেরকম নয়। আমাদের সম্পূর্ণ মর্যাল সাপোর্ট রয়েছে তোমাদের প্রতি। বাড়িটার এমন কিছুই খারাপ অবস্থা হয়নি। তুমি এক কাজ করো। সামনের রবিবার বিকেলে আমাদের পার্টি অফিসে এসো। আমি তোমাদের ব্যাপারটা মিটিং-এ তুলব। এরকম একটা অন্যায় তো আর মেনে নেওয়া যায় না। আচ্ছা, উঠি তাহলে আজকে?”
বাবা উঠে বসতে গেল। তমালবাবু হাঁ হাঁ করে উঠলেন। “উঁ-হু-হু, আপনাকে উঠতে হবে না অসুস্থ শরীর নিয়ে। শুয়ে থাকুন, শুয়ে থাকুন।”
দেব তমালবাবুকে বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দিতে গিয়ে দেখল, ভানুদেব তিন-চারজন ছেলেকে নিয়ে ওদের বাড়ির দিকেই আসছে। তমালবাবু বোধহয় খানিকটা ভয় পেয়েই ভুরু নাচিয়ে নিঃশব্দে দেবকে ভানুদেবের আসার কারণটা জিজ্ঞেস করল। দেবাশিস ঠোঁট উলটে জানিয়ে দিল, কারণটা জানা নেই।
ভানুদেব সদলবলে ওদের কাছে এসে প্রথমেই তমালবাবুকে বলল, “আরেহ্! কী ব্যাপার সক্কাল সক্কাল এখানে?”
দেবাশিস পরিষ্কার দেখল তমাল চ্যাটার্জি নামের লোকটা হঠাৎ ভিজে গিয়ে গুটিয়ে যাওয়া একটা কেন্নোর মতো হয়ে মিনমিন করে কোনওমতে হেসে বলল, “এই রজতবাবুর শরীর খারাপ হয়েছে শুনে একটু দেখা করতে এসেছিলাম।”
“ও বাব্বা! আপনি আবার পাড়ার লোকের স্বাস্থ্যের খবরও নিচ্ছেন নাকি আজকাল! ভালো ভালো।”
“হেঁ হেঁ ওই আর কী… হেঁ হেঁ” করতে করতে সরে পড়লেন তমালবাবু।
ভানুদেব দেবাশিসের শক্ত হয়ে ওঠা মুখটার দিকে তাকিয়ে মোলায়েম হেসে বলল, “রিল্যাক্স, রিল্যাক্স। সম্পূর্ণ অন্য কারণে এসেছি ভাই।”
“কী কারণ?” দেবাশিস আজকে সাংঘাতিকভাবে তৈরি।
“কী রে, বল,” ভানুদেব সহাস্যে পাশের ছেলেটিকে বলল। ছেলেটা বলল, “ব্যাপার কিছুই না। সবই তো জানো। ভানুদাই একপ্রকার নিমশিবের মন্দিরটা তৈরি করে দিচ্ছে। তো মন্দিরের রেকারিং খরচগুলো চালানোর জন্য আমরা একটা ফান্ড করব ঠিক করেছি। এই জন্যই পাড়ার সবার কাছ থেকে, মানে যে যেমন পারে আর কী, সাহায্য হিসেবে…”
“আমি পারলাম না।” পরিষ্কার শব্দে বলল দেবাশিস।
“মানে!” ভানুদেব সমেত ছেলেগুলো একটু চমকে গেল।
“মানে আমি পারলাম না।”
ছেলেটা বলল, “পাড়ার সবাই দিচ্ছে কিন্তু।”
“দিক।”
আরেকটা ছেলে টেরিয়ে বলল, “না দেওয়ার কারণটা জানতে পারি?”
“অসুবিধা আছে।”
“পাড়ায় থেকে পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে কিচাইন করছ, কেসটা কি ভালো হচ্ছে?”
দেবাশিস একটা কিছু উত্তর দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই ভানুদেব ছেলেটাকে ধমকাল, “আহ্! থাম না! বলছে যখন অসুবিধা আছে তখন কী করে দেবে? মানুষের কি সুবিধা অসুবিধা নেই নাকি?”
ছেলেগুলো চুপ থাকল। ভানুদেব বলল, “তোরা এগো। আমি আসছি।”
ওরা যেতেই ভানুদেব হাসি হাসি মুখ করে বলল, “একটু সাবধানে থেকো ভাই। যা সব ছেলেপুলে আজকালকার। কিছু বিশ্বাস করা যায় না। আচ্ছা, চলি তাহলে…”
ভানুদেব চলে যাবার পর দেবাশিস ঘরে ঢুকতেই বাবা জিজ্ঞেস করল, “কাদের সঙ্গে কথা বলছিলি?”
দেবাশিস একটু ইতস্তত করে বলল, “ভানুদেব এসেছিল।”
“কেন? কেন এসেছিল?” বাবার গলায় আতঙ্ক।
“ওই মন্দিরের ফান্ডের জন্য টাকা চাইতে।” বাবার কাছে খুব স্বাভাবিকভাবে কথাটা বলতে গিয়েও মুখের ভেতরটা তেতো হয়ে উঠল দেবাশিসের।
“দিয়েছিস?”
“না।”
বাবা চুপ করে গেল। তারপর আস্তে আস্তে বলল, “দিয়ে দিলেই পারতিস। ভালো লাগে না… আর ভালো লাগে না।”
আট
রাত্তির সাড়ে দশটা মতো বাজে। গুমোট গরম। খেয়েদেয়ে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েছিল দেবাশিস। কিছুই কি করার নেই? হয়তো একদিন সত্যিই মিউনিসিপ্যালিটির লোকেরা বুলডোজার কিংবা বড় বড় হাতুড়ি নিয়ে চলে আসবে। পাড়ার লোক ভিড় করে দাঁড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে দেখবে কীভাবে দেবাশিসের বাবার হাড়গুলো ভাঙা হচ্ছে। দেবলীনা আর আসে নি। হয়তো আর আসবেও না। পাড়ার লোকেরা একপ্রকার কথা বন্ধই করে দিয়েছে। দেবাশিস বোঝে, সবার ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে। প্রকাণ্ড একটা ভয়! ও একবার টেস্টহাউসে যাবে ঠিক করেছিল। বাবা যেতে দেয়নি।
এ ক’দিনের মধ্যে বাবার শরীরটা ভেঙে গিয়ে কেমন যেন আরও বুড়োটে হয়ে গেছে। কথাবার্তাও বলে কম। চুপচাপ শুয়ে থেকে শুধু মৃতের মতো মায়ের ফটোটার দিকে তাকিয়ে থাকে। বাবার জন্য দেবাশিসের কলেজ যাওয়াও প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। কাজের মাসি আসা বন্ধ করে দিয়েছে ক’দিন হলো। সব কাজ দেবাশিসকে একা করতে হয়। এর মাঝখানে দু’দিন ইলেকট্রিক কানেকশন কেটে গিয়েছিল। কারা কেটেছিল খুব ভালো করেই জানে দেবাশিস। দ্বিতীয়বারের বেলায় কমপ্লেন করার সময় সাপ্লাইয়ের লোক বলেছে, “পাড়ার লোকের সঙ্গে কিচাইন করেন নাকি? বারবার এরকম হলে কিন্তু পারব না।”
নিমশিবের মন্দির তৈরির কাজ এখন প্রায় শেষের মুখে। এ মন্দির এখন অঞ্চলের গর্ব। আগাগোড়া সাদা মার্বেল পাথরে মোড়া ধবধবে সাদা মন্দিরটা পাড়া আলো করে রাখে সারাদিন।
রাস্তা থেকে আর পাথরটাকে দেখা যায় না। সিঁড়ি দিয়ে উঠে নাটমন্দির, তারপরে গর্ভমন্দির, সেখানে রুপোয় বাঁধানো গৌরীপটে সেই পাথর আসীন।
মন্দিরের সামনে বেশ কিছু ফল-ফুল মিষ্টির দোকান হয়েছে। দোকানিরা অবশ্যই ভানুদেবের পুষ্যি। ফুটপাথ আটকে দোকান বানানোর জন্য কারও পারমিশন প্রয়োজন হয়নি। সারাদিন ধরে দর্শনার্থীরা আসে, যায়। তাদের বাজানো ঘণ্টার প্রত্যেকটা শব্দ দেবাশিসদের বাড়ির দেওয়ালে গেঁথে যায়। মন্দিরটার দিকে স্থিরভাবে তাকিয়েছিল দেবাশিস। মাথার ভেতরে অস্পষ্টভাবে একটা ছবি তৈরি হচ্ছে। একটা আকাশছোঁয়া ফ্ল্যাট।ফ্ল্যাটের মাথায় একটা বিশাল চেহারার লোক দু’হাত তুলে দাঁড়িয়ে। নীচে রাস্তায় থিকথিক করছে অসংখ্য পিঁপড়ে। পিঁপড়েগুলোর মুখ অনেকটা মানুষের মতো।
গু-উ-উ-ম! গু-উ-উ-ম! হঠাৎ ভয়ঙ্কর দুটো শব্দে দেবাশিসদের গোটা বাড়িটা থরথর করে কেঁপে উঠল। একতলার দেওয়ালের বেশ খানিকটা প্লাস্টার খসে পড়ল ধড়াস করে। তারপর কয়েকটা পায়ের খুব দ্রুত পালানোর শব্দ। গোটা বাড়িটা বারুদের গন্ধ আর ধোঁয়ায় ভর্তি।
“দেব… আহ্! শু-ভ-ও-ও…”
দেবাশিস একছুটে বাবার ঘরে গেল। “বাবা… বাবা।”
“কী হয়েছে! ও কী হলো!” বাবার চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। হাতদুটো বুকের ওপরে রাখা।
“কিছু হয়নি, কিছু হয়নি…” বলতে বলতে বাবাকে জড়িয়ে ধরল দেবাশিস।
“আহ্… আহ্…”
“কী হয়েছে বাবা? ও বাবা!”
বাবার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে। বাবা কোনওমতে বুকের ওপরে হাত রেখে বলল, “কষ্ট হচ্ছে… কষ্ট হচ্ছে।”
দেবাশিস কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না। ছুটে গিয়ে জগ থেকে গ্লাসে জল ঢেলে এনে বাবাকে খাওয়াতে চেষ্টা করল। বাবার গোটা শরীর ঘামে সপসপ করছে। ও বাবার ঘাড়ে গলায় মুখে জল দিল। তারপর ফ্যানের স্পিডটা ফুল করে দিয়ে হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে করতে বলল, “কিছু হবে না। তুমি একটু শুয়ে থাকো। আমি এখুনি ডাক্তার ডেকে আনছি। একদম উঠো না কিন্তু।”
বাবা দেবাশিসের হাতদুটো চেপে ধরল। “দেব, তোর পায়ে পড়ছি। ছেড়ে দে। ওদের সঙ্গে পারবি না… দেব, প্লিজ কথা দে ছেড়ে দিবি… তুই ছাড়া আমার আর কেউ…”
কেঁদে ফেলল বাবা। বুকের ভেতরটা প্রচণ্ডভাবে মুচড়ে উঠল দেবাশিসের। ও বাবার বুকে হাত বোলাতে থাকল।
বাবা ফিসফিস করে বলল, “পারবি না। কিচ্ছু পারবি না। দেব ছেড়ে দে… সব ছেড়ে দে ওদের কাছে…”
# #
অনেক রাত। দেবাশিস আবার ব্যালকনিতে এসে দাঁড়াল। পাড়ার ডাক্তার সুধীনবাবুকে হাতেপায়ে ধরে বাড়িতে এনেছিল দেবাশিস। বাবার বুকে আক্রমণটা শুধু ছুঁয়ে গেছে। নার্সিংহোমে আর দিতে হয়নি। ঘুমের ইনজেকশনে অঘোরে ঘুমোচ্ছে বাবা।
পাড়ার আরও দু’চারজন এসেছিল বাবাকে দেখতে।
সবার চোখেমুখের বিরক্তি, মন্তব্য পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়েছে একমাত্র দেবাশিসের জন্যই পাড়ার শান্তি সুনাম নষ্ট হচ্ছে। দেবাশিস মন্দিরটার দিকে তাকাল। আকাশে রুপোর বাটির আলোয় মন্দিরের মার্বেল পাথর ঝলসে উঠছে। একদৃষ্টে চেয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ চোখের সামনে যেন মন্দিরটা বড় হতে শুরু করল। বড়… আরও বড়… বিশাল! মন্দির থেকে বেরিয়ে এল সেই পাথর। পৃথিবীর মতো প্রকাণ্ড পাথরটা দেবাশিসের মুখোমুখি হয়ে হো-হো করে হাসতে শুরু করল। হাসির শব্দে ফেটে যেতে লাগল দেবাশিসের মাথা… শরীর… “আ-আ-হ্… শাল-লা-হ নপুংসক…”, ব্যালকনির এককোণে পড়ে থাকা একটা ভাঙা চেয়ারের হাতল ছুড়ে মারল দেবাশিস পাথরটার দিকে। শূন্য রাস্তার ওপর ঠকাস করে পড়ল কাঠের টুকরোটা। তারপর পাগলের মতো ব্যালকনির দেওয়ালে, মেঝেতে লাথি-ঘুষি মারতে শুরু করল, “ভাঙ শালা ভাঙ। ভেঙে যা, সব ভেঙে যা। কেন ভাঙছিস না… ভাঙ…!” বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে মেঝেতে বসে পড়ল।
বসে রইল রাতভর স্থির অনুভূতিহীন একটা পাথর হয়ে। ভোরবেলা মন্দিরে পুরোহিত ঘণ্টা বাজাল ঈশ্বর হয়ে ওঠা পাথরকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে নৈবেদ্য দিতে।