স্টেশনে ঢুকতেই, গেরুয়া পোশাক পরা একটা লোক সায়নের হাতে লিফলেটটা ধরিয়ে দিল। কোথায় যেন হরিনাম সংকীর্তন হবে তারই লিফলেট। মুচকি হেসে নীলির দিকে তাকিয়ে সায়ন জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কি খুব বুড়ো বুড়ো দেখাচ্ছে?”
আড়চোখে সায়নের দিকে তাকিয়ে নীলি হেসে উত্তর দিল, “না না, এক্কেবারে কচি খোকা দেখাচ্ছে।”
ট্রেনটা বেশ ফাঁকা। জানলার দুপাশে ওরা দুজন মুখোমুখি বসল। হাতে ধরা লিফলেটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছিল সায়ন। বেশ কালারফুল। বড় বড় করে তাতে লেখা আছে, ‘এ জন্ম ও পরজন্মের পাপক্ষয়। মৃত্যুর পর স্বর্গে স্থান।’
লিফলেটটা পড়ে মনে মনে হাসল সায়ন। এ যেন কোনও কম্পিউটার সেন্টারের বিজ্ঞাপন – ‘এখানে পড়লেই সরকারী চাকরি নিশ্চিত।’ আবার ইন্স্যুরেন্স কোম্পানীর বিজ্ঞাপনের মত দু’মাস পয়সা জমা দিলে এক মাস ফ্রী অফারও দিয়েছে। এজন্মের সঙ্গে পরজন্মের পাপক্ষয় ফ্রী।
“কী দেখছ অত মন দিয়ে?” নীলি জিগ্যেস করল।
সায়ন নীলির দিকে তাকিয়ে বলল, “আজকাল হরিনাম সংকীর্তনও একটা ব্যবসা হয়ে গেছে।”
“কেন, কী হলো আবার?”
“এই দেখ,” বলে সায়ন লিফলেটটা নীলিকে দেখাল।
“আরে সবই এখন প্রফেশনাল। যে কোনও কাজেই আজকাল স্কিলড লোকজন নেওয়া হয়, ব্যাপারটাকে প্রেজেন্টেবল করার জন্য। জানো, একবার আমি ঠাকুমার সঙ্গে এইরকম এক সংকীর্তন সভায় গিয়েছিলাম।কী সুন্দর করে সাজিয়েছিল পুরো হলটা। গোছা গোছা ফুল আর ফুলের মালা দিয়ে গেটটা ডেকরেট করেছিল। হলটাতে ঢুকতেই সামনে একটা কাচের বড় বাক্স। একজন গেরুয়া পোশাক পরা সন্ন্যাসী পাশের চেয়ারে বসে আছেন। তুমি যদি সেই সন্ন্যাসীকে দেখতে, গায়ের রঙ ধবধবে ফরসা। লম্বা চওড়া শরীর, টিকোলো নাক, সারা শরীর দিয়ে যেন তেল ঝরে পড়ছে এমন চকচক করছে।”
ট্রেন ছাড়তে এখনো অনেক দেরী। সায়ন চোখ কুঁচকে একটু ফিচেল হেসে বলল, “বাব্বা, এমনভাবে চেহারার বর্ণনা দিচ্ছ যেন ওই সন্ন্যাসীর প্রেমে পড়ে গেছিলে।”
নীলি তাড়াতাড়ি এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল, “ফালতু ইয়ার্কি না মেরে পরে কী হলো বলছি শোনো, ওই বাক্সে যে যেমন টাকা দিচ্ছে সন্ন্যাসী তাকে তেমন স্লিপ কেটে দিচ্ছেন। সন্ন্যাসীর ঐ রকম চেহারা দেখে কেউ তো কম পয়সা দিতে সাহসই পাচ্ছে না।”
সায়ন বলল, “ওই জন্যই তো সুন্দর চেহারার সন্ন্যাসীকে ওখানে বসানো হয়েছে। তারপর কী হলো?”
নীলি বলল, “তারপর, যে যেমন টাকা দিচ্ছে তাকে তেমন জায়গায় বসার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। বেশী টাকা দিলে প্রথম সারি। গুরুদেবের একদম কাছে।”
সায়ন নীলিকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা নীলি, তুমি ভগবানে বিশ্বাস কর? এইসব নামগান, ভণ্ডামি মনে হয় না?”
নীলি একটু যেন অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “জীবনে অনেক কিছুই এমন ঘটে, তার ঠিক ব্যখ্যা পাওয়া যায় না। তখন সুপার পাওয়ার বলে কিছু একটা আছে মেনে নিতেই হয়। আর তাছাড়া, কেউ ভালো কাজ করলে মানুষ কিন্তু সেটা ঠিক বুঝতে পারে।” তারপর নিজেকে একটু ঝাড়া দিয়ে বলল, “ধ্যুৎ, তখন থেকে কী হরিনাম সংকীর্তন, স্বর্গমর্ত্য নিয়ে পড়ে আছ। তোমাদের দেশের বাড়ি যাচ্ছি, সেখানকার কথা কিছু বলো।”
(২)
নীলি সায়নের বউ। বিয়ের একবছর কেটে গেলেও এই প্রথমবার বউকে নিয়ে দেশের বাড়ি যাচ্ছে। সায়ন যখন কলেজে পড়ে তখন ওর বাবা চাকরি সূত্রে কলকাতা চলে আসেন। তখন থেকেই বাবা-মা আর সায়ন এখানে থাকে। আগে ছুটিছাটা পড়লেই দেশের বাড়ি ছুটত, এখন যাওয়া আসা অনেক কমে গেছে। নীলি একটা স্কুলে চাকরি করে। এবার ডিসেম্বরের ছুটিতে খাঁটি পাটালি গুড়ের পিঠে খাওয়ানোর জন্য ওকে দেশের বাড়ি মানকরে নিয়ে যাচ্ছে।
সায়ন বলল, “আমাদের বাড়ির পিছনে একটা বড় পুকুর আছে।”
“তোমাদের পুকুর?”
“হ্যাঁ আমাদেরই। পুকুরের চারিদিকে অনেক খেজুর গাছ সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে। ছোটবেলায় শীতের ভোরে কুয়াশা ঘেরা অন্ধকারে জানলা দিয়ে যখন পুকুরের দিকে তাকাতাম, মনে হতো প্রত্যেকটা গাছে যেন একটা করে মানুষ বসে পুকুরের মাছ পাহারা দিচ্ছে।”
“এত লোক মাছ পাহারা দিত কেন?”
সায়ন হাসল, বলল, “আরে ওগুলো মানুষ নয়।”
“তবে?”
প্রত্যেক গাছেই খেজুরের রসের জন্য হাঁড়ি বাঁধা থাকত। হাঁড়িগুলোকেই আবছা অন্ধকারে মানুষের মাথা বলে মনে হতো।”
নীলিও সায়নের কথা শুনে হেসে বলল, “ও, তাই বলো।”
সায়ন যেন নিজের ছোটবেলাটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। বলল, “রোজ সকালে নিতাইকাকু এসে হাঁড়ি নামিয়ে রস দিয়ে যেত। তারপর হাঁড়ি ধুয়ে আবার নতুন করে পেতে দিত। রোদ ওঠার আগেই এই কাজটা করতে হয়। নাহলে রস থেকে কেমন মদা মদা গন্ধ বের হয়। ছোটবেলায় ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়েই সব ভাই বোনেরা এক গ্লাস করে খেজুরের রস খেতাম। দাদু বলত, এতে নাকি শক্তি বাড়ে। আহা! কী স্বাদ সেই রসের। ঠাম্মী যখন ঐ রস জ্বাল দিয়ে গুড়ের পায়েস বানাত, গন্ধে সারা ঘর ম ম করত।”
সায়নের মুখে ছোটবেলার গল্প শুনতে শুনতে নীলির দু’চোখ বুজে আসছে। আসলে ট্রেন ধরবে বলে অনেক সকালে উঠতে হয়েছে ওদের। ট্রেনও চলতে শুরু করেছে এখন। যত এগিয়ে চলছে, ভিড়ও বাড়ছে। সায়নও জানলার পাশে বসে ঘুমোবার চেষ্টা করল।
(৩)
ঘুমোবার চেষ্টা করলেও ঘুম আসছিল না সায়নের। হরিনাম সংকীর্তনের লিফলেটটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে মুখটা মনের আয়নায় ঝলক দিয়ে উঠেছিল, সেই মুখটাই বারবার চিন্তায় আসতে থাকল। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল পুরোনো কষ্টটা। সায়ন গেটের সামনে এসে দাঁড়াল।
শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, সব ঋতুতেই ভোর চারটের সময় উঠে গোপালজেঠু হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ নাম করতে করতে সারা পাড়া ঘুরে বেড়াত। জেঠুর এই নামগান পাড়ায় এক একজনের চোখে ছিল এক একরকম। ঠাকুমার যেমন খুব ভালো লাগত জেঠুর নামগান। বলত, “গোপাল সকাল সকাল হরিনাম করে নিজে তো পুণ্য সঞ্চয় করছেই, তার সঙ্গে আমাদেরও উপকার করছে।” ঠাকুমার ধারণা ছিল, হরিনাম শুনে দিন শুরু হলে সমস্ত দিনটাই ভালো যায়। কোনও কোনও দিন ঠাকুমাও ঐ সময় উঠে মালা জপতে বসে যেত।
কারো আবার খুব ভোরে কাজে বেরোনোর দরকার হলে আগের দিন জেঠুকে বলে আসত। ঠিক সময়ে এসে জানলার সামনে জেঠু হাঁক পাড়ত, “ওরে ওঠ, তোকে কাজে বের হতে হবে।”
কিন্তু সবাই যে জেঠুর এই হরিনাম ভালোভাবে নিত, তা নয়। আচ্ছা, গোপালজেঠু কি জানত তার এই হরিনাম অনেকেই পছন্দ করে না? জানত নিশ্চয়ই। কারণ সেই সময় পাড়ার ক্লাবে অনেকেই ভোরবেলায় গোপালজেঠুর হরিনাম করা নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলত। কেউ কেউ বলত, ভোরবেলা জেঠু হরিনাম করার নামে চুরি করতে বের হয়। এর গাছের ফুল, ওর গাছের ফল চুরি করাই তার আসল কাজ। ঠাকুরের নাম-টাম ওসব ভড়ং। সায়নের হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা জেঠু তো খঞ্জনী বাজাতে বাজাতে হরিনাম করত। চুরি করতে বের হলে কি কেউ আওয়াজ করে? আসলে বদনাম যারা করতে চায়, তারা মনে হয় কারণ ছাড়াই বদনাম করে। গোপালজেঠুর ছোট ছেলে রূপম সায়নের সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ত। সায়ন দেখেছে ক্লাসের ছেলেরা রূপমকে রাগাত। বলত, “মুখে করে হরিনাম/ চুরি করা তার কাম।”
রূপমের চোখমুখ লাল হয়ে উঠত এই কথা শুনলে। কখনো কখনো যারা এসব কথা বলত তাদের মারতেও যেত। রূপম মাঝেমাঝেই দুঃখ করত সায়নের কাছে। বলত, ও যদি বড় হতো তাহলে এই গ্রাম ছেড়ে দূরে শহরে চলে যেত।
গাড়িটা একটা স্টেশনে থামল। খানা জংশন। বেশী লোক উঠল না। সাধারণত জংশনে প্রচুর লোক ওঠানামা করে, কিন্তু এখানকার মানুষজন খুব একটা ট্রেনে যাতায়াত করে না।
স্টেশনের উল্টোদিকে একটা রাইস মিল। প্রচুর ধান গোল গোল করে রোদে শুকোতে দেওয়া হয়েছে। একপেচে করে শাড়ি পরা মহিলারা কাজ করছে। এখানকার বেশীরভাগ মানুষের চেহারাই একটু রুক্ষ ধরনের। হয়ত আবহাওয়ার জন্যই। কতদিন হয়ে গেল সায়ন এই সব জায়গা ছেড়ে চলে গেছে, তবুও এদের দেখলে মনটা কেমন আনন্দে নেচে ওঠে। বড় আপন মনে হয় এদের। আবার সাথে সাথে এ কথাও মনে হলো, যতটা সাদাসিধে এদের দেখতে লাগে, এরা কি সত্যিই অতটা ভালো? না মনে হয়। হলে রূপমদের অত কষ্ট পেতে হতো না। সায়ন আবার এসে বসল নিজের জায়গায়। আর দুটো স্টেশন – গলসী, পারাজ। তার পরই মানকর। সায়নের জন্মস্থান।
হরিনামের লিফলেটটা সায়নের পকেটে। আজ গোপালজেঠু যেন সায়নের পিছু ছাড়ছে না। সায়ন তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। মাঝেমাঝে পাড়ার ক্লাবে ক্যারম খেলতে যেত। অনেক বড়রাও ওই ক্লাবে খেলত, তবে অন্য বোর্ডে। ওদের কথা সায়নরা শুনতে পেত, কিন্তু কোনও মন্তব্য করার অধিকার ছিল না। একবার ঐ দাদাদের মধ্যে একজন তখন নতুন বিয়ে করেছে। সে ক্যারম খেলতে খেলতে বলছিল, “এই গোপালজেঠু বড় জ্বালাচ্ছে বুঝলি। রোজ পাঁচটার সময় আমাদের জানলার কাছে গিয়ে জোরে জোরে খঞ্জনী বাজাবে। কী বিরক্তিকর বল তো, আমার বউ তো বলে, ওনার চরিত্রে দোষ আছে। নিজের বউ তো বুড়ো হয়ে গেছে, তাই অন্যের অল্পবয়সী বউ দেখলেই ছোঁক ছোঁক করা ওনার স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভীষন রেগে আছে আমার বউ। বলেছে, একদিন খুব অপমান করবে। রোজ সকালে খঞ্জনী বাজানো বন্ধ করে দেবে।”
(৩)
জেঠু সরকারি চাকরি করত। সকাল আটটায় কাজে বেরিয়ে সন্ধ্যে ছটায় ঘরে ফিরত। সায়ন যখন টুয়েলভে পড়ে তখন জেঠু রিটায়ার করল। তারপর নামগান আরও বেড়ে গেল। ভোর চারটের বদলে রাত তিনটের সময় পাড়ায় নাম বিলি করতে বেরিয়ে পড়ত। পাড়ার অনেকেই বিরক্ত হয়ে উঠল জেঠুর নামগানের জ্বালায়। জেঠিমাকে কতদিন মায়ের কাছে কাঁদতে দেখেছে সায়ন। রূপমও সায়নকে বলত, “আমার বাবা তো কারো ক্ষতি করে না বল, তবুও লোকজন কেন যে আমাদের এত অপমান করে। আজকাল ঠাকুর দেবতার প্রতি আমার খুব রাগ হয়, জানিস। মনে হয় বাবার ঐ গীতা-টিতা সব জলে ফেলে দিই।” সায়ন কী বলবে ভেবে পেত না।
তারপর হঠাৎ একদিন কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল জেঠু। এই নিয়ে আবার চলল, একেক জনের এক এক মন্তব্য। ওই ছোটবেলাতেই সায়ন বুঝে গেছিল, তুমি ভালো কাজ করো আর খারাপ, লোকে তোমার সমালোচনা করবেই। যাই হোক, কেউ বলল, জেঠু বৃন্দাবনে চলে গেছে। কারো মতে, অত রাতে উঠে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতেন, নিশ্চয়ই কোনো অপদেবতা নিয়ে গেছে। আবার কারো কারো ধারণা হলো, অপদেবতা-টেবতা কিছু নয়। রাতের অন্ধকারে কত রকম বেআইনি কাজ হয় চারদিকে। তার কিছুর সঙ্গে নিশ্চই জেঠু জড়িয়ে পড়েছিল। ওরাই ওকে মার্ডার করে কোথাও পুঁতে ফেলেছে।
ওদের বাড়িতে সবাই তখন দিশাহারা। জেঠুর পেনশনেই ওদের সংসার চলত। দু’তিন মাস পর পাড়ার একজন এসে খবর দিল, জেঠুকে বর্ধমানের একটা দোকানে নাকি সে দেখেছে। তক্ষুনি পাড়ার দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে ওর দুই ছেলে ছুটল বাবার খোঁজে। বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় আর পুলিশের সাহায্য নিয়ে ওরা জেঠুকে বাড়ি নিয়ে এল। কিন্তু এ জেঠু আগের সেই মানুষ নয়। পুরোপুরি উন্মাদ। কখনও হাসছে, কখনো কাঁদছে, কখনো চিৎকার করছে। স্কুল যাওয়ার সময় কতদিন সায়ন দেখেছে, জেঠিমা জেঠুকে জোর করে স্নান করাচ্ছে।
জেঠুর এই পাগলামো নিয়ে আবার বিভিন্ন মতামত হাওয়ায় উড়তে লাগল। কেউ বলল, রিটায়ার করার পর জেঠুর সাথে ওর বাড়ীর সবাই খুব খারাপ ব্যবহার করত, তাই সে পাগল হয়ে গেছে। কেউ বলল ভোরবেলায় জেঠুর এই পাড়ায় নামগান অনেকেরই অসুবিধার সৃষ্টি করছিল, তাই হয়তো কেউ কিছু খাইয়ে দিয়েছে। আবার কারো মতে, বেশী ঠাকুর-দেবতা নিয়ে থাকলে এই রকমই হয়। তারা বামাখ্যাপার উদাহরণ দিল।
ডাক্তার বলল, জেঠুর ব্রেনে স্ট্রোক হয়েছে, আবারও হতে পারে। হলোও তাই। কিছুদিনের মধ্যে আবার স্ট্রোক হয়ে জেঠু মারা গেল। আবার শুরু হলো নানা মতামত। কেউ কেউ রূপমদের ভবিষ্যৎ কী হবে ভেবে কেঁদে বুক ভাসাল। যতটা দুঃশ্চিন্তা ওরা করছিল, ততটা দুঃশ্চিন্তা রূপমদের নিজেদের জন্য ছিল কিনা সায়নের সন্দেহ হয়। আবার কিছু মানুষ বলল, “এ তো হওয়ারই ছিল, কোনও কিছুই বাড়াবাড়ি করা ভালো নয়।” বলে ঠোঁট ওলটাল।
(৪)
কলকাতায় এসে সায়নের সবচেয়ে যেটা ভালো লেগেছিল, এখানে কারো ব্যাপারে কেউ ইন্টারফিয়ার করে না। যে যার ফ্ল্যাটে নিজের মতো থাকে। যদিও মা আজকাল বলে, শহরের সব কিছুই কেমন মেকি। কোনও আন্তরিকতা নেই। সায়নের অবশ্য এইসব কথা ভাবার সময় নেই, সকালে কাজে বের হয়, রাত দশটায় বাড়ি ফেরে। মা-বাবার সঙ্গে বসেই ঠিকমতো কতদিন কথা বলাই হয় না। মাঝেমাঝে বড় যান্ত্রিক মনে হয় নিজেকে।
“এই, তুমি যে বললে পারাজের পরই আমাদের নামতে হবে?” নীলির ডাকে অতীত থেকে বাস্তবে ফিরে এল সায়ন। তাড়াতাড়ি ট্রলিব্যাগটা নামিয়ে গেটে এসে দাঁড়াল। নীলিকে বলল, “এই প্রথমবার যাচ্ছ, মাথায় একটু ঘোমটা দিয়ে নাও। গ্রামের বাড়ি, বুঝতেই পারছ। নিন্দা করার লোকের তো এখানে অভাব নেই।” নীলি একটু হেসে শিফনের আঁচলটা তুলে মাথায় দিল।
রিক্সা নিয়ে গ্রামে ঢুকতেই চৌরাস্তার মোড়ে গোপালজেঠুর বাড়ি। দেখল, জেঠিমা রোদ পোহাচ্ছে। সায়ন রিক্সা থেকে নেমে প্রণাম করে বলল, “জেঠিমা, কেমন আছ?”
একগাল হেসে জেঠিমা বলল, “ওমা টুবলু, কেমন আছিস বাবা? তোর মা-বাবা কেমন আছে?” সায়ন দেখছে, জেঠিমার গলা শুনে আশেপাশের বাড়ি থেকে অনেকেই বেরিয়ে এসেছে।
সবাই নীলিকে দেখছে। কেউ বাবা-মায়ের খোঁজ নিচ্ছে। কেউ বলছে, “কতদিন পরে এলি, রোগা হয়ে গেছিস।” কেউ আবার নীলির বাপের বাড়ি কোথায় জানতে চাইছে। অনেকে নীলিকে তাদের বাড়ি পিঠে খেতে যাওয়ারও নিমন্ত্রণ করল। একটা অল্পবয়সী ছেলে এসে বলল, “সায়নদা, ব্যাগটা দাও, আমি পৌঁছে দিয়ে আসছি।” সায়নের মনটা এক অদ্ভুত আনন্দে ভরে উঠল। মনে মনে ভাবল, ভালোমন্দ নিয়েই এই সংসার। বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে গর্বের সঙ্গে নীলিকে বলল, “এই আমাদের গ্রাম। দেখেছ, কত আন্তরিকতা এখানে।”
(৫)
“এই শুনছ, দেখ কোথায় যেন খঞ্জনী বাজছে?” নীলির ডাকে ধড়ফড় করে উঠে বসল সায়ন। ভালো করে কান পেতে শুনল। এই শীতেও সে ঘেমে উঠেছে। ঘড়ি দেখল, ভোর চারটে। তা হলে কি জেঠু? পরক্ষনেই ভাবল, কি সব উল্টোপাল্টা ভাবছে, গায়ে চাদর জড়িয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে এল।
এ কী! পাঁচ-ছয়জন মহিলা। সঙ্গে গোপালজেঠুর বউও।
“তোমরা? এত সকালে?” সায়ন জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ রে বাবা। তোর জেঠু বলত, সকালে হরিনাম শুনে দিন শুরু করলে সারাটা দিন ভালো কাটে। তাই সকাল সকাল সবার মঙ্গলের জন্য আমাদের এই চেষ্টা।” বলে হরিনাম করতে করতে এগিয়ে চলল জেঠিমার দল।
নীলি পিছন থেকে এসে সায়নের পিঠে আস্তে করে হাত রেখে বলল, “সত্যিই আজ সকালটা কী সুন্দরভাবে শুরু হলো।” সায়ন এগিয়ে যাওয়া দলটার দিকে তাকিয়ে বলল, “জেঠু চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু তার গান এখনও রয়ে গেছে।”