ছোট গল্প: গুপ্তচরের ইতিবৃত্ত

ছোট গল্প: গুপ্তচরের ইতিবৃত্ত

জোসেফ ডি’সুজার চোখেমুখে স্পষ্ট যে তিনি বেশ কিছুদিন যথেষ্ট চিন্তায় আছেন, ঘুম হচ্ছে না ঠিকমতো। রোজ বেশ সকাল সকাল অফিসে চলে আসছেন, বাড়ি ফিরছেন মধ্যরাতে। সারাদিন শুধু কফি খেয়ে চলেছেন আর ফোনে কথা বলে চলেছেন। নিজের কেবিন ছেড়ে এক দণ্ড নড়ছেন না। খুব ইম্পর্টেন্ট কল ছাড়া বাইরের কল একেবারেই নিচ্ছেন না। জুনিয়র স্টাফেরা তাঁর ধারেকাছে ঘেঁষতে ভয় পাচ্ছে। একদম কাছের কয়েকজন ছাড়া প্রায় কার‌ও সঙ্গেই বাক্যালাপ করছেন না। অথচ এই মানুষটি কত হাসিখুশি ছিলেন। জুনিয়রদের কখন‌ও জুনিয়র বলে মনে করেন না। সব সময় হাসি ঠাট্টা করে দিন কাটিয়ে দেন। নিশ্চিত কিছু বড় বিপদ ঘটেছে। র’য়ের দুঁদে অফিসারদের মধ্যে ডি’সুজার নাম সবার প্রথমে থাকে। নিজের গুপ্তচর জীবনের অনেকটা কাটিয়েছেন পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ, সিরিয়ার মতো দেশে। কত বিপদ, বহু অভিজ্ঞতার কথা ট্রেনিং সেশনে জুনিয়রদের শুনিয়েছেন।

সপ্তাহখানেক এভাবে চলার পর একদিন সাতসকালে অফিসে এসে তাঁর ডিপার্টমেন্টের সব অফিসারকে কনফারেন্স হলে ডেকে নিলেন। হলের দরজার বাইরে দু’জন অতিরিক্ত সিকিউরিটি গার্ড মোতায়েন করার নির্দেশ দিলেন। হলে তখন নিস্তব্ধ থমথমে পরিবেশ। হঠাৎ তিনি বজ্রকঠিন গলায় বলে উঠলেন,
“অফিসারস, গত সপ্তাহে আমাদের আন্ডার কভার এজেন্ট বিনোদ রাঠোর ইসলামাবাদে ধরা পড়েছিল, সে তো আজ তোমাদের কার‌ও কাছে অজানা নয়। আমরা র’য়ের ডেটাবেস থেকে তার সমস্ত রেকর্ড ডেসট্রয় করেছি অলরেডি। হি ইজ নো মোর ইন র। এটাই আমাদের নিয়ম। কিন্তু বাস্টার্ড পাকিস্তান ওকে ইন্টেরোগেশনের নামে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে। দে কিলড্ হিম উইথ আ লট অফ পেইন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, শেষ মুহূর্তে সে অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে দিলবাগের কথা উগরে দিয়েছিল। ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড বয়েজ, আমি অনেক চেষ্টা করেও দিলবাগকে রক্ষা করতে পারলাম না। হি ইজ নাও ইন আইএসআই কাস্টডি। হি হ্যাজ সার্ভড্ আস আ লট। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, অ্যাজ পার সিস্টেম, উই অলসো হ্যাভ টু ডেসট্রয় অল হিজ রেকর্ডস ফ্রম র’স সার্ভার।”

ঘরের নীরবতাকে ডি’সুজার কথাগুলো যেন আর‌ও গাঢ় করে দিল। সবাই সবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল। কিন্তু ওরা সবাই জানে র’য়ের নিয়ম এটাই। কোন‌ও আন্ডার কভার এজেন্ট যখন বিদেশে ধরা পড়ে, প্রথমে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করা হয় খুব গোপনভাবে, আর তা খুব কমই সাফল্য পেয়েছে। ছাড়াতে না পারা গেলে তার সমস্ত রেকর্ড র’য়ের তরফ থেকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে তারা ডি’সুজার “ইউ মে লিভ নাও” শুনে একে একে হল ছেড়ে বেরিয়ে এল। শুরু হলো দিলবাগ সিংয়ের রেকর্ড মুছে ফেলার প্রক্রিয়া।

কিন্তু কে এই দিলবাগ! দিলবাগ সিং, অমৃতসরের এক ক্ষুদ্র পরিবারের মেধাবী ছাত্র। কলেজ জীবনে তার অভিনয় পারদর্শীতা মুগ্ধ করেছিল নামী ফিল্ম ডাইরেক্টরদের। সেবার মুম্বইতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক বিশাল নাট্যোৎসব। সেখানে গোয়ার হয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন জোসেফ ডি’সুজা আর পাঞ্জাব থেকে দিলবাগ সিং। ঘটনাক্রমে সেবার ওই নাট্যোৎসবে উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন র চিফ অমরেন্দ্র জালান। দু’জনের অভিনয় দক্ষতা তাঁর মনে এনেছিল এক ভয়ংকর পরিকল্পনা। পরে গোপনে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে তিনি বুঝতে পারেন, এরা দু’জন শুধু মাত্র অভিনয়ে পারদর্শী নয়, দু’জনেই মেধাবী ছাত্র এবং দু’জনের মধ্যে এমন অনেক গুন আছে যা সচরাচর সবার মধ্যে দেখা যায় না। খেলাধূলাতেও ওরা বেশ পারদর্শী। ‌জালান নিজের পরিচয় দিয়ে জানতে চান, ওরা দেশের হয়ে কাজ করতে চায় কিনা। এক মুহূর্ত সময় না নিয়ে ওরা সম্মতি জানায়।

তারপর হঠাৎ একদিন দু’জন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওদের কোন‌ও সন্ধান মেলে না। পুলিশের খাতায় ওরা নিরুদ্দেশ হয়েই থেকে যায়। এদিকে মুম্বইয়ের গোপন ডেরায় ওদের ট্রেনিং শুরু হয়। শুরু হয় পাকিস্তানের মানুষের রীতিনীতি কেমন হয় তার শিক্ষা, কীভাবে উর্দু কথা বলতে হয়, কী ভাবে গোপনে খবর জোগাড় করতে হয়। দেখতে দেখতে দু’বছর কেটে গেল। ওদের সুন্নত করা হলো।

ডি’সুজাকে পাঠানো হলো সিরিয়ায় আর দিলবাগকে পাকিস্তানে। ডি’সুজা বছর খানেক সিরিয়ায় থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে দেশে ফিরলেন, দিলবাগ নিজের নাম বদলে আলি হায়দার নাম নিয়ে করাচি কলেজে ভর্তি হলো। তার লক্ষ্য, পাকিস্তান আর্মি। দিলবাগ যেহেতু পাঞ্জাবি, আর উর্দু ভাষাটাও বেশ বলতে শিখে গেছে, তাই ওখানে কোন‌ও অসুবিধায় পড়তে হলো না। কারণ ওখানকার অনেক লোক পাঞ্জাবী ভাষাতেও কথা বলে। জালানের হস্তক্ষেপে সে এক অনাথ আশ্রমের ছাত্র হিসাবে কলেজে ভর্তি হলো।

বছরখানেকের মধ্যে সে পাকিস্তান আর্মির ট্রেনিংয়ে যোগ দেয় এবং সফলভাবে তা সম্পূর্ণ করে আর্মিতে জায়গা করে নেয়। এর মধ্যে ডি’সুজাও বার দুয়েক পাকিস্তান থেকে ঘুরে গেছেন। বছর দশেক পর দিলবাগ মেজর পোস্টে প্রোমোশন পায়। সেই সুবাদে সে বিভিন্ন গোপন খবর পেতে থাকে এবং র’য়ের দপ্তরে আর্মি মুভমেন্ট বা টেররিস্ট মুভমেন্টের খবর কোড মেসেজ করে পাঠাতে থাকে। ততদিনে জালান রিটায়ার করেছেন। এখন সেখানকার বড়বাবু ডি’সুজা।

দু’জনের মেলবন্ধনে বহুবার ইন্ডিয়ান আর্মি বর্ডারে টেররিস্ট মুভমেন্ট বা দেশের ভিতরে আরডিএক্স, ডিটোনেটর সাপ্লাই আটকে দিয়েছে। ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট ওদের কাজে খুব খুশি। একদিন এক রেস্তোরাঁয় বিনোদ রাঠোরকে দেখেন ডি’সুজা। ইভটিজিং করা জনা সাতেক যুবককে একা হাতে শায়েস্তা করতে। তিনিও একই ভাবে রাঠোরের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যেমনটা জালান একদিন ওদের সঙ্গে করেছিলেন। রাঠোরের ট্রেনিং শুরু হয় মুম্বইতে। ওদিকে দিলবাগের পাঠানো মেসেজে একটা প্লেন কলকাতায় হাইজ্যাক হওয়া থেকে বেঁচে যায়।

রাঠোর একটি অন্য মিশনে পাকিস্তানে যায় এবং সেই কাজে তাকে দিলবাগ সাহায্য করবে বলে জানতে পারে। কিন্তু এক সপ্তাহের মধ্যে সে ধরা পড়ে যায়। পাকিস্তান আর্মির অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সে দিলবাগের কথা উগরে দেয়।

মাসখানেক কেটে গেল, সবাই সবার নির্দিষ্ট কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দিলবাগের ধরা পড়াটা র’য়ের কাছে বিরাট বড় এক ধাক্কা। এই অপূরণীয় ক্ষতি এবং বন্ধুপ্রীতি ডি’সুজাকে তিলে তিলে কুরে কুরে খাচ্ছিল। হঠাৎ এক রাতে ডি’সুজার মেলে একটা কোডেড মেসেজ এলো। তখন বাড়ির ব্যালকনিতে স্কচের গ্লাস হাতে বসে তিনি। টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে চোখে লাগাতেই দেখলেন একটা কোডেড মেসেজ এসেছে। পরনের নাইট ড্রেসটা না বদলেই গ্যারাজের দিকে দৌড়োলেন। হাতের ইশারায় গার্ডকে গেটটা খুলতে বলে তীব্রবেগে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। গাড়ি অফিসের সামনে দাঁড় করিয়ে চাবিটা পার্কিং সুপারভাইজারের দিকে ছুড়ে দিয়ে তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা লিফ্টে। লিফ্টের সাত নম্বর বটনটা প্রেস করে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখেমুখে উদ্বেগ স্পষ্ট। লিফ্টের দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকলেন একটা বিশাল বড় হলঘরে।

ঘরটার চারিদিকের দেওয়ালে অসংখ্য আধুনিক মনিটর। কোন‌ওটায় প্রতিবেশী দেশের স্যাটেলাইট চিত্র তো কোন‌ওটায় ড্রোন মারফৎ পাঠানো ছবি। কোন‌ওটায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসবাদীর গোপন ফুটেজ তো কোন‌ওটায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের বাইরের লাইভ ফুটেজ। তিনি কালবিলম্ব না করে মোবাইলটা এক রকম মুখার্জীর দিকে ছুঁড়ে দিয়েই বললেন, “মুখার্জী, ডিকোড দ্য মেসেজ ফাস্ট। আই থিঙ্ক ইট ইজ দিল‌বাগ। ফাস্ট ফাস্ট, মুখার্জী হোয়াট আর ইউ থিঙ্কিং অ্যাবাউট?”

মুখার্জী কোড ব্রেক করতে ব্যস্ত, এদিকে ডি’সুজা সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে চলেছেন। কখন‌ও পায়চারি করছেন তো কখন‌ও মুখার্জীর পি সি-র উপরে ঝুঁকে পড়ছেন। মুখার্জী সিক্রেট কোড ডিকোড করায় পারদর্শী। ডি’সুজা খুব ভরসা করেন ওঁকে। কিন্তু এতটা উদ্বিগ্ন কখন‌ও দেখায় না ডি’সুজাকে।

“স্যার লুক, দ্য মেসেজ ইজ ডিকোডেড। ইউ আর রাইট স্যার, দিলবাগ স্যারেরই মেসেজ। লুক স্যার, ইট ইজ ফ্রম করাচি। এজেন্ট কে-০০৫২ অ্যান্ড ইট ইজ দিলবাগ স্যার।”

“ইয়েস ইয়েস, আমি জানতাম! ও এত সহজে হার মানতেই পারে না। হি ইজ আ রিয়েল জিনিয়াস। সময় নষ্ট কোরো না মুখার্জী, বলো বলো কী বলছে ও?”

“স্যার, দিলবাগ স্যার কাস্টডি থেকে পালিয়েছেন। ওঁর শরীর খুব একটা ভালো নয়। উনি লাহোরের কাছাকাছি আছেন। হি নিডস সাপোর্ট।”

পায়চারি করতে করতে ডি’সুজা ভেবে চলেছেন এই মুহূর্তে কী করা উচিৎ। কী করলে দিলবাগকে বাঁচাতে পারবেন। ওর সব ডেটা তো র’য়ের সিস্টেম থেকে, সার্ভার থেকে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এমনকি কোন‌ও কনট্যাক্ট নম্বরও নেই। চকিতে কিছু একটা মনে পড়তেই বলে উঠলেন, “মুখার্জী, কনট্যাক্ট লাহোর এজেন্ট এল-০১২১ ইমিডিয়েটলি। আই অ্যাম গিভিং ইউ দিলবাগ’স ফোটো।”

মুখার্জী কানে হেডসেট তুলে নিয়ে কিবোর্ডে কয়েকটা নাম্বার প্রেস করতেই রিং হতে শুরু করল। এদিকে মুখার্জীর হাত থেকে নিজের মোবাইলটা এক রকম কেড়ে নিয়েই ঘাঁটতে শুরু করলেন ডি’সুজা। একটা আলতো হাসি খেলে গেল ওঁর মুখে। গতবার করাচিতে গিয়ে দিলবাগের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তখন দু’জনের একটা সেলফি নিয়েছিল। সেটা খুঁজে পেয়ে মুখার্জীর দিকে এগিয়ে দিলেন মোবাইলটা। “সেন্ড ইট ফাস্ট।”

লাহোরের এজেন্টকে নির্দেশ দিয়ে ফোটো পাঠানো হলো। আবার শুরু হলো উৎকণ্ঠা। বর্ডারে সকলকে তৎপর করে দেওয়া হলো। ডি’সুজা টেলিকমিউনিকেশন সার্ভেইলান্সের রোশন গুপ্তাকে নির্দেশ দিলেন লাহোরের এজেন্টের ফোন ট্র্যাক করতে। ফোনে নির্দেশ দিলেন অমৃতসরের এমার্জেন্সি টিকিট বুকিং-এর।

ভোর ভোর ডি’সুজা রওনা হয়ে গেলেন অমৃতসরের উদ্দেশ্যে। ফ্লাইট জার্নির সময়টুকু ছাড়া গুপ্তা প্রতি মিনিটের আপডেট দিয়ে চলেছে। ওরা লাহোর হয়ে ভাইনি রোড ধরে মান্ডিলার দিকে এগোচ্ছে। হঠাৎ মুখার্জীর ফোন পেয়ে ডি’সুজা চমকে উঠলেন। নিশ্চিত বিপদের খবর কিছু। মনে মনে ভগবানকে ডেকে নিয়ে ফোন রিসিভ করতেই মুখার্জী জানাল, “দে আর নিয়ার টু দ্য বর্ডার স্যার।”

“জিসাস, সেভ দেম।”

ডি’সুজা এয়ারপোর্টে নেমেছিলেন বেশ কিছুক্ষণ আগেই। ওখানে এজেন্সির গাড়ি আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। গাড়ি শহরের ভিড় কাটিয়ে এখন একটা গ্রাম্য রাস্তা ধরেছে। আবার মুখার্জীর ফোন। “স্যার, অল ফিনিশড। দে কান্ট সারভাইভ। পাকিস্তানি আর্মি বর্ডারের কাছে ওদের দু’জনকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। হ্যালো স্যার, হ্যালো, হ্যালো….।”

ডি’সুজা বুকের ভিতর দলা পাকানো একটা কষ্ট নিয়ে মোবাইলটা নামিয়ে রাখলেন। গত কয়েকদিনের মধ্যে তিন তিনটি ধাক্কা, কিছুতেই যেন মেনে নিতে পারছেন না। দুঃখটা এতটাও গভীর হতো না, যদি না দিলবাগ কাস্টডি থেকে পালাতে সক্ষম হতো। পালিয়েও ছেলেটা ধরা পড়ে গেল। তীরে এসে তরী ডুবে গেল। তার মানে র’য়ের নেটওয়ার্কে বিশাল বড় ফাঁক থেকে গেছে।

কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে গোয়া চলে গেলেন ডি’সুজা। বেশ কয়েক বছর পর বাড়ির সঙ্গে আবার যোগাযোগ করেছিলেন। বাবা মা কেউ-ই আর এ দুনিয়ায় নেই। তবুও তো শেষ বয়স পর্যন্ত নিজেদের ছেলেকে কাছে পেয়েছেন ওঁরা, কিন্তু দিলবাগের বাবা-মা তো সে সুযোগও পেলেন না।

লনে একটা বেতের চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসতেই নিজেদের কঠোর ট্রেনিংয়ের দিনগুলোর স্মৃতি ভিড় করে এলো। কী পরিশ্রমটাই না করেছিলেন! সামনে সাদা টেবিল ক্লথে মোড়া বেতের টেবিলের উপর টি-পট আর মোবাইলটা পাশাপাশি রাখা। হঠাৎ একটা আননোন নম্বর থেকে ফোন আসে।

“হ্যালো…”

“হ্যালো, মেজর জেনারেল প্রকাশ দেওয়ানজি বলছি। আপনি?”

“সরি স্যার, আমি আপনাকে আমার আইডেন্টিটি ডিসক্লোজ করতে পারছি না। বলুন কী বলতে চাইছেন।”

“ওকে। আমি আপনাকে একটা ভিডিও পাঠাচ্ছি, প্লিজ চেক ইট।”

ফোনটা কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই একটা হোয়াটসঅ্যাপ এলো। প্লে বটন ক্লিক করতেই একজন দাড়িওয়ালা লোকের মুখ ভেসে উঠল। কাঁচাপাকা অগোছালো দাড়ি, মুখটা ক্ষতবিক্ষত। দুটো ফোলা, পল্লবহীন চোখে জমাট বাঁধা রক্ত। ঠোঁটের কোল বেয়ে শুকনো খয়েরি রক্তধারা তীব্র দাবদাহে যেন জমে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে আছে লোকটা। হঠাৎ চোখ চলে গেল নাকের পাশের গাঢ় খয়েরি আঁচিলটার দিকে। ইটস্ দিলবাগ! যেখানে ভিডিওটা নেওয়া হয়েছে সেটা কোন‌ও হাসপাতাল। কালবিলম্ব না করে মুখার্জীর নম্বরে ভিডিওটা এবং নম্বরটা সেন্ড করে ঘরের দিকে ছুটলেন ডি’সুজা। মেসেজে লিখলেন, ‘ট্র্যাক দ্যা নাম্বার অ্যান্ড ফাইন্ড দ্যা প্লেস ফাস্ট। ইটস দিলবাগ। উই হ্যাভ টু ফাইন্ড হিম।’

ইচ্ছে করেই ওই নম্বরটায় ফোন করলেন না ডি’সুজা, কারণ ওঁদের বন্ধুর থেকে শত্রুর সংখ্যাই বেশি। তাই কাউকেই ওঁরা চট করে বিশ্বাস করতে পারেন না। এটা পাকিস্তানের চালও তো হতে পারে।

পাঁচ মিনিটের মধ্যে মুখার্জীর ফোন এলো। “স্যার, নম্বরটা মুম্বইয়ের এক আর্মি অফিসারের।” ডি’সুজা তখন এয়ারপোর্টের পথে।

দিলবাগের জ্ঞান এখন‌ও ফেরেনি। তাবড় তাবড় র অফিসার আর আর্মির কর্মকর্তারা তার জ্ঞান ফেরার অপেক্ষায়। জানা গেছে, আরব সাগরে কোস্ট গার্ড নিজেদের টহলদারির সময় একটা লাইফবোট দেখতে পায়। ওখানেই অজ্ঞান অবস্থায় পাওয়া যায় দিলবাগকে। ওরা রেসকিউ করে আর্মি হাসপাতালে ভর্তি করে। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় এখানে নিয়ে আসে। পরিচয় জানতে পারেনি। পাকিস্তানের চর ভেবেছিল প্রথমে। কিন্তু ওর শারীরিক অবস্থা দেখে সন্দেহ কিছুটা হলেও কমেছিল।

ডি’সুজাকে ডাক্তাররা জানান, দিলবাগের হাত পায়ের সব নখ উপড়ে নেওয়া হয়েছে। কোন‌ও ভারি জানিস দিয়ে ডান হাতের তালু এবং দু’ পায়ের পাতা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সারা গায়ে অজস্র সিগারেটের ছ্যাঁকা এবং আঘাতের চিহ্ন। গত বেশ কিছুদিন কিছুই খায়নি প্রায়।

“কিন্তু ওঁরা আমার নম্বর পেলেন কোথায়? এটা আমার খুব কনফিডেন্সিয়াল নম্বর! আমার ডিপার্টমেন্টের অনেকের কাছেই নেই।”

“স্যার, আমরা যখন ওঁকে ড্রেসিং করাচ্ছিলাম তখন হঠাৎ ওঁর হাতের তাবিজটা খুলে মেঝেতে পড়ে যায় এবং ওটার একটা সাইড ঢাকনার মতো খুলে যায়। ওর মধ্যে থেকে আমরা একটা কাগজ পাই। ওটাতেই আপনার নম্বর লেখা ছিল। আমরা কাগজটা আর্মির হাতে তুলে দিই।”

“ডক্টর, প্লিজ সেভ হিম।”

মাস ছয়েক কেটে গেছে। দিলবাগ অনেকটাই সুস্থ এখন, কিন্তু হুইলচেয়ার ওর সারা দিনের সঙ্গী। পায়ে এখনও মোটা প্লাস্টার। ডান হাতটা বুকের কাছে ঝোলানো। একটা গোপন সেফ হাউসে গুটিকয় মানুষ একটা টেবিল ঘিরে থাকা চেয়ারে বসে আছেন। আছেন র-‌এর অ্যানালিস্ট মুখার্জী, টেলিকম সার্ভেইলেন্সের রোশন গুপ্তা, চিফ অফ আর্মি স্টাফ দীপক রাঠী এবং আর‌ও কয়েকজন। দিলবাগের হুইলচেয়ার ঠেলতে ঠেলতে ঘরে ঢুকলেন র চিফ, দিলবাগের প্রাণের বন্ধু ডি’সুজা। সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানালেন। সবার সঙ্গে করমর্দনের পর দিলবাগ ধীরে ধীরে সমস্ত ঘটনা তুলে ধরল সকলের মাঝে। জানাল, পাকিস্তানে বিয়েও করেছিল এক মুসলিম যুবতীকে। দুই পুত্রসন্তানও ছিল, আশফাক আর ইমরান। ধরা পড়ার পর আই এস আই তাদেরও ছাড়েনি। শরীরে বোমা লাগিয়ে ওদের উড়িয়ে দেয় এবং লাইভ ভিডিও দেখায় ওকে ইন্টেরোগেশনের সময়।

“নিজের চোখে আমি দেখেছি স্ত্রী-সন্তানের মৃত্যু। নিমেষে তিনটি শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। আমি ক্যাম্পে বসেছিলাম, হঠাৎ জনা পনেরো আর্মি জ‌ওয়ান আমার টেন্টে ঢুকে পড়ে। তখনই আমি বুঝতে পারি পরিস্থিতি প্রতিকূল। আমাকে গ্রেফতার করা হয়। ইন্টেরোগেশনের জন্য আমাকে প্রথমে আর্মি ক্যাম্পে, পরে আই এস আই-এর হাতে তুলে দেওয়া হয়। প্রতি ঘণ্টায় আমার উপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়ানো হতে থাকে। পুরো একটা রাত আমাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রেখে গায়ে সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া হয়, মারা হয় হকি স্টিক দিয়ে। কখনও একজন তো কখনও দু’জন মিলে আমাকে মারতে থাকে। পরদিন আমাকে নামিয়ে একটা চেয়ারে বসিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। একটা হাত টেবিলের উপর রেখে হাতুড়ি দিয়ে ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে।”
ডি’সুজা বারেবারে চোখ মুছে চলেছেন। একই প্রতিক্রিয়া দেখা গেল বসে থাকা বাকি মানুষগুলোর মধ্যেও।

“কখন দিন হতো কখন রাত, বুঝতে পারতাম না। একটা গোটা দিন ভাঙা হাত নিয়ে চেয়ারে বসে কাতরেছি, তারপর যেন ব্যথাটা সয়ে গিয়েছিল। আমি জানতাম এখানেই সব কিছু শেষ নয়, ওরা ইনফরমেশন পাওয়ার জন্য আমার উপর আরও অত্যাচার করবে। আমি এ-ও জানতাম, ওরা এত সহজে আমায় মেরে ফেলবে না। কিন্তু আর্তনাদ ছাড়া একটা কথাও আমার মুখ থেকে বার করতে পারেনি। কারণ আমি জানতাম, এক একটা ইনফরমেশন আমাকে ধাপে ধাপে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে।

“আমার মুখে ততক্ষণ ধরে পাঞ্চ করত, যতক্ষণ না আমি অজ্ঞান হয়ে যেতাম। একদিন ওরা একটা ভারি লোহার হাতুড়ি মেঝেতে আওয়াজ করতে করতে নিয়ে এলো। প্রথমেই এক এক করে পায়ের নখগুলো উপড়ে নিল, তারপর আমার দুই থাইতে আঘাত করল। এর পর দুই পায়ের পাতায়। আমি নিরুপায় ছিলাম। নিজের পা দুটো নাড়াতেও পারিনি। শুধু চোখ বন্ধ করে আঘাতের অপেক্ষা করছিলাম। পরে একদিন আমার চোখের পাতা দুটো কাঁচি দিয়ে কেটে দিলো। তারপর থেকে আজ পর্যন্ত ঠিক করে ঘুমাতে পারি না।”

দীপক রাঠী বলে উঠলেন, “পাকিস্তান মুর্দাবাদ।” দিলবাগ হাত উঁচু করে ইশারায় তাঁকে থামতে বলল। “দেখুন, আমার মনে হয় ওরা নিজেদের দেশকে বাঁচাতেই এই কাজগুলো করছিল। আমরাও হয়তো ওরকম পরিস্থিতিতে একই কাজ করব। যাই হোক, এর পর আমার পার্সোনালি গ্রুম করা একজন, যে আই এস আই-এর মাঝে মিশে ছিল – সে আমাকে পালাতে সাহায্য করল। আমি নিজে বর্ডারের দিকে না গিয়ে ওর সঙ্গে অন্য একজনকে বর্ডারের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। আমার লক্ষ্য ছিল আরব সাগর। মাছের ট্রলারে লুকিয়ে আমি পাড়ি দিলাম ইন্ডিয়ার দিকে। মাঝরাতে ওরা যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন নিজের ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে টানতে টানতে এনে একটা লাইফবোটে চেপে বসি। তারপর আর কিছুই মনে নেই।”

সারা ঘরে একটা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। হঠাৎ দীপক রাঠী এবং ডি’সুজার তালে তাল মিলিয়ে করতালিতে ফেটে পড়ল ঘরটা। সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হতে লাগল, “বন্দে মাতরম, ভারত মাতা কি জয়।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত