ছোট গল্প: অঞ্জলি

ছোট গল্প: অঞ্জলি

সৌদামিনী স্বামীকে লুকিয়ে নতুন ঝুড়িতে তাল ঘষছিলেন। সব কাজ রান্নার লোক দিয়ে হয় না, কিন্তু তাঁর অবুঝ স্বামী বোঝেন কোথায়! জমিদার গিন্নির নিজের হাতে রান্না করা ওঁর পছন্দ নয়। অথচ রান্নার সময়ে তদারকি না করলে বৃন্দা যা করে রাখে তা আর মুখে তোলা যায় না। ভারী তো জমিদারি – তালপুকুরে ঘটি ডোবে না, সারাজীবন কলেজে ছাত্র ঠেঙিয়ে পেট চালাতে হলো।

এদিকে সৌদামিনী নিজে রান্না করতে ভারী ভালো বাসেন। টিভিতেও বিভিন্ন চ্যানেলে কত সব নতুন নতুন রান্নার পদ্ধতি শেখায়। অবশ্য করে খাওয়াবেনই বা কাকে, এত বড় বাড়ি… মহলই বলা চলে, ধীরে ধীরে কেমন ফাঁকা হয়ে গেল। ভাগ্যিস মেজ ঠাকুরপো তাঁদের অংশের ঘরগুলোতে কয়েকটা ভাড়া বসিয়ে গেছেন। নইলে এই খাঁ খাঁ বাড়ি যেন গিলতে আসে। রান্নাঘরের কোণে বসে চুপিচুপি কাজটা সারছিলেন, ফোনটা এলো তখনই। রিংয়ের ধরন দেখেই বোঝা গেল মেজ দেওরের ফোন। কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করে পাশে রাখা গামলায় হাতটা ধুয়ে অতি কষ্টে পিঁড়ি ছেড়ে উঠে পড়লেন।

“বৃন্দা, বাকিটুকু ঘষে ঢেকে রাখিস, আর নারকেল দুটো কুরিয়ে রাখবি কিন্তু।”

উত্তপ্ত কথা কানে আসছে, সৌদামিনী তাড়াতাড়ি পা চালালেন। আগে কখনও শ্বশুরবাড়ির কোনও কথায় ওপর পড়া হয়ে কিছু বলতেন না প্রবল আত্মসম্মানবোধ আর শিক্ষার কারণে। কিন্তু ইদানিং অমলেন্দুবাবুর প্রেশার সুগার ধরা পড়ায় পরিস্থিতি সামাল দিতে দুটো কথা বলে তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। তাঁদের নিজেদের দুই ছেলেই বিদেশে, মেয়ে উড়িষ্যায়। আজ প্রায় দশ-বারো বছর হলো মেজ দেওর পাকাপাকি ভাবে দিল্লীতে ছেলের কাছে চলে গিয়েছেন। বিয়ে-শাদী, পালা পার্বণে আগে আসতেন, কিন্তু গত দু’বছর আসেন নি।

এই দিকটা এখন খুব দ্রুত উন্নত হচ্ছে। তাই জমিলোভীদের চোখও পড়েছে। নন্দী বাড়িও ওদের চোখ এড়ায় নি। অমলেন্দুর কাছে পাত্তা না পেয়ে বিমলকে ধরেছে। চির স্বার্থপর ওই মানুষ এবার প্রোমোটারের হয়ে চাপ দিচ্ছেন, প্রায়ই দাদার সঙ্গে ফোনে কথা কাটাকাটি চলছে। ছোট দেওর স্বর্ণেন্দু পাঁচ বছর হলো মারা গেছেন। ছোট জা তারও অনেক আগে। ওদের একমাত্র ছেলে দীপ্তেন্দু ফিলাডেলফিয়ায় থাকে, ডাক্তার। মাঝে একটা আমেরিকান মেয়ের সঙ্গে থাকছিল। এখন নাকি সেই সম্পর্কটা নেই। ননদরা অবস্থাপন্ন, এই বাড়ির কানাকড়িও নেবে না, তবে কোন গন্ডগোলেও থাকবে না, জানিয়ে দিয়েছে।

মেজ দেওর বিমল, মেজ জা, ওদের ছেলে-ছেলের বউ, দুই মেয়ে একসঙ্গে ক্রমাগত চাপ দিয়েই চলেছে। প্রায় চার-পাঁচ পুরুষের এই বাড়ি গুঁড়িয়ে যাবে আধুনিক শপিং মলের নীচে। একা অমলেন্দু আর লড়তে পারছেন না, এমনকি তাঁদের নিজের ছেলে-মেয়েও বাড়ি প্রোমোটারকে দিয়ে দেওয়ার পক্ষে। মোটা টাকা নিয়ে পছন্দমতো কোন পশ এরিয়ায় বড় ফ্ল্যাট নিয়ে বাকি টাকা ব্যাংকে রাখা বা ওদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার পক্ষপাতি। নিজের পরিবারের এতজনের বিরুদ্ধে মানুষটা একা লড়াই করে যাচ্ছে কবে থেকে।

সৌদামিনী দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে ফ্যানের সুইচ অন করলেন। অমলেন্দুর ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠেছে। কপালে ঘাম জমেছে।

“বেলা জানো, বিমলরা এবারেও পুজোতে আসবে না, আর পুজোর জন্য এক পয়সাও দেবে না বলে হুমকি দিল!”

“কিন্তু মেজ ঠাকুরপো পুজোর খরচ এমন কী দেন যে তুমি ঘাবড়ে গেলে?”

“আঃ, খরচের জন্য ঘাবড়াচ্ছি কে বলল? ওর সাহস কী করে হয় আমাকে এভাবে বলার!”

“আচ্ছা ঠিক আছে মাথা গরম কোরো না, এত ভেবো না, বেলা যথেষ্ট হয়েছে, স্নান করে খাবে এস।”

টেবিলের ওপর ঝকঝকে সোনার মতো কাঁসার থালায় সাদা জুঁইফুলের মতো ভাত, কোলের কাছে মেরুন রঙের শাক ভাজা,পটল ভাজা, নুন লেবু কাঁচা লঙ্কা। গোল করে ঘেরা বাটিগুলোতে শুক্তো, মোচার ঘন্ট, মুগের ডাল, রুইমাছের কালিয়া সাজানো। আগে শ্বেত পাথরের মেঝেতে ফুল তোলা কার্পেটের আসনে বসে খেতেন। এখন হাঁটুর ব্যথায় আর পারেন না, চেয়ার টেবিল ছাড়া গতি নেই।

মাথার ওপর ফ্যান ঘুরলেও সৌদামিনী ঝালর দেওয়া হাতপাখা নিয়ে বসে খাওয়ার তদারকি করেন। দীক্ষা নেওয়ার পর খাওয়ার সময় কথা বলেন না, তাই অমলেন্দু অনেকক্ষণ ভাতে শাক মেখেই যাচ্ছেন দেখে পিঠে হাত রাখলেন। চমক ভেঙে স্ত্রীর দিকে চেয়ে একটু হেসে খাওয়ায় মন দিলেন বটে, কিন্তু অর্ধেক খেয়ে উঠে পড়লেন। খাওয়ার পর অমলেন্দু লাইব্রেরিতে বসেন, কিন্তু আজ সোজা বেডরুমে চলে গেলেন, রুপোর রেকাবিতে করে দুটো সাজা পান নিয়ে সৌদামিনী উদ্বিগ্ন মুখে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনলেন, উনি ল্যান্ডলাইন থেকে দিপুর সঙ্গে কথা বলছেন ।

আজ বোধন, কাল বিকেলে বৃন্দা শিউলি তলায় খবরের কাগজ পেতে রেখেছিল। আজ থেকে পাঁচ-ছয় দিন দম ফেলবার অবকাশ থাকবে না। ভোর ভোর উঠে সৌদামিনী ফুলগুলো কুড়িয়ে সাজিতে তুলছিলেন। এমন সময় গেটের কাছে একটা গাড়ি দাঁড়াল। মাথা তুলে দেখলেন, দিপু নামল, সঙ্গে খুব কালো আর লম্বা একটা মেয়ে….চওড়া কপাল, কোঁকড়ানো চুল, জিন্স আর শার্ট পরা। মেয়েটা তাঁর দিকে চেয়ে উঁচু মাড়ি সহ ধবধবে সাদা দাঁত বের করে হাসল। দিপু এগিয়ে এসে বলল, “এবার পুজোয় দেশে চলেই এলাম বড় জেঠিমণি, এই দেখো ওর নাম লিজা, আমরা এখনও বিয়ে করিনি, তা বলে রাগ কোরো না কিন্তু। লিজার সঙ্গে তোমরা কথা বলতে পারবে না, স্প্যানিশ ছাড়া কিছু জানে না।”

পুজোর সকালে এই অভাবনীয় কান্ডে তিনি হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। না, লিজা কোনোরকমে ভাঙা ভাঙা ইংলিশ বলতে পারে। সে নিজেই বেশ আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসে সৌদামিনীকে হাগ করল। তাঁর হাত থেকে পড়ে যাওয়া ফুলের সাজিটা আবার তুলে দিল, কিছুটা ফুল হাতে নিয়ে যেন বুক ভরে ঘ্রাণ নিল।

অমলেন্দু সৌজন্যবশতই হোক বা স্ত্রীর অনুরোধেই হোক, লিজা সম্পর্কে বেশি কৌতূহল দেখালেন না। এই বাড়িই যখন থাকবে না তখন আর…তবে এই বোধহয় শেষবারের মত পুজো, দিপুটা এই সময় না এলেই পারত। ডিনারের পর আত্মীয়স্বজন যে যার মতো শুতে চলে গেল। চাপা হাসাহাসি, গুঞ্জন চলছেই সকাল থেকে। সবটাই দিপুর লিভ-ইন করা আর লিজার রূপ নিয়ে। মুখে একটা পান নিয়ে রাতে ব্যালকনিতে ইজি চেয়ারে বসা তাঁর পুরোনো অভ্যেস। আজ সৌদামিনীও একটি মোড়া নিয়ে পাশে বসলেন। অমলেন্দু মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “ওরা শুতে গেছে?”

প্রশ্ন বুঝে সৌদামিনী ছোট করে মাথা কাত করে বললেন, “ছোট ঠাকুরপোর ঘরে ওদের শোবার ব্যবস্থা করেছি।” অমলেন্দু বিতৃষ্ণা ভরা মুখ অন্ধকারের দিকে ফিরিয়ে নিলেন। এমন সময় পায়ের শব্দ শোনা গেল – দিপু আসছে।

“জেঠুমণি, তোমরা দুজনেই আছ, ভালো হয়েছে… আমার একটা কথা বলার ছিল, কাল থেকে তো আর সময় পাব না। আর আমার ছুটিও এবারে বেশিদিনের জন্য নেই। তাই যদি অসুবিধে না হয় এখন বলব?”

“বাড়ি বিক্রির টাকার কথা বলছিস তো? বিক্রির সময়ে আসার চেষ্টা করিস, বিমলরাও আসবে, তার পর নিজেরটা নিজেরা বুঝে নিয়ে….” অমলেন্দু আর শেষ করতে পারলেন না, গলা ধরে এল।

“না জেঠুমণি না, এই বাড়ি কক্ষনো বিক্রি হবে না, মেজ জেঠুমণির সঙ্গে ফোনে আমার কথা হয়েছে। প্রোমোটার যে টাকাটা দেবে বলেছিল, সেটার তিন ভাগের এক ভাগ আমি মেজ জেঠুমণিকে দিয়ে ওঁর অংশটা কিনে নেব। কিন্তু এটা একটা হিউজ অ্যামাউন্ট, সবটা এখনই আমি দিতে পারব না। লিজা আমার কাছে সব শুনে বাকিটা দিতে চেয়েছে। আমি আসছি দেখে ও আবদার করল তাই…আমি ছিন্নমূল হয়ে বিদেশে পড়ে থাকব না। কলকাতার কয়েকটা নার্সিং হোমের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। লিজাকে বিয়ে করে আমি ডিসেম্বরেই পাকাপাকি দেশে ফিরে আসছি। ওকে নিয়ে তোমাদের অস্বস্তিটা বুঝেছি, কিন্তু বিশ্বাস করো, শুধুমাত্র কালচার আলাদা, নইলে ওর মত ভালো মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। এই বাড়িতে পঁচিশে ডিসেম্বর গুলোতে ওকে ক্রিসমাস পালন করতে দেবে জেঠুমণি?”

ঢাক বাজা বন্ধ হয়ে এখন অঞ্জলি শুরু হয়েছে। লিজা টুকটুকে লাল ব্লাউজ আর নতুন হলুদ তাঁতের শাড়ি পরে অঞ্জলি দিচ্ছে, সৌদামিনী হাজার কাজের মধ্যেও ওকে আঁটসাঁট করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটা ভিড়ের মধ্যে এদিক ওদিক সবার মুখের দিকে চেয়ে দু’হাতে ধরা শিউলিগুলোর ঘ্রাণ নিল। ওর দিকে চোখ পড়তেই সস্নেহে হেসে ফেললেন সৌদামিনী, “পাগলী একটা!”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত