সেদিন খালাম্মা কে অনেক বার বলেছিলাম, “খালাম্মা আমি রোজা আমি এইগুলান খাইতে পারবো না”। সে আমার চুল ধরে টানতে টানতে তাদের সেহরি তে নষ্ট খাবার গুলো খাওয়ালো কারন খালুর খাবার নষ্ট করা পছন্দ না।তাদের ছেলে মেয়েরা ভোরে খেতে উঠলে প্রায় সময়ই খাবার নষ্ট করতো কিন্তু কখনো আমাকে সেহরিতে খেতে দিতো না।সকালে জোর করেই একপর্যায়ে মাঝে মধ্যে খাওয়ায়।
কিছুদিন আগেই তো কতকিছু রান্না করলাম নিজের হাতে।একফোটা তো দিলোই না বরং আমার হাত পুড়ে যাওয়ায় আমাকে ইচ্ছামতো মারলো।আমার পরিবারে কেউ নেই এক এতিমখানা থেকে আমাকে ওনারা নিছিলো তাদের কাজ করানোর জন্য।বলছিলো পড়ালেখাও করাইবো সেইসব আর হলো না।এতিম খানা থাকতে মাঝেমধ্যে যা খেতে পেতাম ঐখানে কিছুই পাই নাই।সারাদিন শুধু মারে।আমারে নামাজ, রোজা কিছুই করতে দিতো না।আমার এই সতেরো আঠারো বছর বয়সে এতো যন্ত্রনা পাইনাই যতটা খালাদের বাসায় এই তিনবছরে পাইছি।
এসব বলতে বলতেই হাপিয়ে উঠলো সাবরিনা নামের এক অনাথ মেয়ে।চেহারাতেই বলে দেয় কতটা নির্যাতিত মেয়েটা। আজ ঈদের দিন আর আজকে সকালেই পালিয়ে এসেছে মেয়েটা ওই বাড়ি থেকে আমি সন্ধ্যা নাগাদ দেখি রাস্তার পাশে বসে আছে আর কিছুলোক ওকে তাদের নজর দিয়ে গিলে খাচ্ছে।আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
ঃকি নাম তোমার? কিছুটা ইতস্তত হয়ে বললো,
ঃসাবরিনা।আমারে মারবেন না।
বলেইআমার দিকে তাকিয়ে অঝোরে কেদে দিলো আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম তোমার ভয় নেই আমি তোমার ক্ষতি করবো না।সে কি মনে করে আমার পাশে বসে তার সাথে ঘটে যাওয়া কথা গুলো বলতে লাগলো। আমি একটা সেচ্ছাসেবী নারীদের দলের সাথে যুক্ত আছি। বঞ্চিত মেয়েদের কিছুটা সাহায্য করার চেষ্টা করি।ওর কথা গুলো শুনে আমি আমার সাথে করে নিয়ে আসলাম আমাদের এনজিওর এক বড় আপার কাছে।তাকে সব খুলে বলার পরে সে ওকে রেখে দিলো তার এইখানে অনেক মেয়ে পড়ে সে ওকে লেখা পড়া শিখিয়ে অনেকটা সচেতন আর সাবলম্বী করে দিয়েছে।সে শিক্ষিত ভালো চাকরি করে নিজের পায়ে নিজে দাড়িয়েছে।
বেশ অনেক বছর পরে আজ ঈদের দিন। আমাদের এক বৃদ্ধাশ্রম “শান্তির নীড়” এ অবহেলিত মা বাবাদের সাথে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে এসেছি।সাবরিনাও আছে আমাদের সাথে অনেক কিছু কেনাকাটা করেছি খাবার দাবার সব নিয়ে এসেছি। আমরা সারা রাস্তা গল্প করতে করতে আসলাম।কাপড়চোপড় গুলো আমরা সবাই মিলে দিলাম কিন্তু সাবরিনা আসে নি সে খাবারের দিকটা একা সামলাচ্ছিলো।নিজের হাতে সবাইকে খাওয়াবে বলে।সমস্যা বাধলো খাবার দেওয়ার সময়।এক মহিলাকে খাবার দিতে গিয়ে সাবরিনা খাবার ফেলে দিলো আর বললো,
ঃআজকে তোমারে খাওয়াবো না। মহিলাটি কাদছে আর সাবরিনার পায়ের কাছে এসে মাফ চাওয়ার জন্য আকুল হয়ে বারবার বলছে,
ঃমাফ করে দে মা।আজ আমার পাপের শাস্তি তুই দিস না।তুই মাফ কর।
ঃআমি কি মাফ চাই নাই কোনোদিন তখন কি শুনেছিলে??
ঃআজ আমি নিঃস্ব মা।আজ সব বুঝতে পারছি।আজকে তোকে পেয়েছি আজ মাফ কর।
মহিলাটি বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগলো। সাবরিনা ততক্ষনে সেখান থেকে চলে গিয়েছে।রাগে আর ঘৃণায় সে দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। পরিস্থিতি সামলিয়ে সবাইকে খাবার দিয়ে সাবরিনার কাছে গেলাম।
ঃকিরে হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো? ওনাকে চিনিস তুই?
ঃঐটা খালাম্মা ছিলো আপা।
ঃএইজন্য এমন ব্যবহার করবি?
ঃরাগ সামলাতে পারি নাই আপা।তার মুখ টা দেখে আমার বুকে মোচড় দিয়ে উঠছে। সব মনে পড়ে গেছে।(চোখে পানি ছলছল করছিলো কথা গুলো বলার সময়)
ঃতাকে ক্ষমা করে দে।শুনেছি তার স্বামী মারা গেছে একবছর আগে। মেয়ে বিয়ের পর দেশের বাহিরে চলে গিয়েছে।ছেলের বৌ সহ্য করতে পারে না বলে বৃদ্ধাশ্রমে থাকে। সাবরিনা হা করে কথা গুলো শুনলো।পরে দৌড়িয়ে তার কাছে গেলো। দুজনে গলা ধরে কতক্ষন কান্নাকাটি করে রাগ অভিমান বিসর্জন দিলো।সে কি মনোরম পরিবেশ তা উপস্থিত লোকজন বুঝেছে। সেদিনই মেয়েটা মা পেয়েছে।তার খালাম্মা কে নিয়ে গেছে তার সাথে।যাওয়ার আগে আমায় বলে গেলো,
ঃআপা আজকের ঈদটা ঈদের মতো কাটলো।সবটা তোমার জন্য আপা পেলাম।আজকের ঈদ সেরা ঈদ আমার।
বিনিময়ে একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। জীবনে অনেকের সেরা ঈদের কারণ হয়েছি।শুধু নিজের ঈদটা সেরা কবে হবে সেই অপেক্ষায় আছি।