বৃদ্ধাশ্রম

বৃদ্ধাশ্রম

এই বৃদ্ধ বয়‌সে এ‌সে তা‌হেরা বেগ‌মের একটাই দুঃখ তার ছে‌লের বউ তা‌কে মা ব‌লে ডা‌কে না। প‌রের মে‌য়ের এমন আচরন য‌দিও বা সহ্য করা যায় কিন্তু নি‌জের ছে‌লেও য‌দি মা ব‌লে না ডা‌কে তো সেই কষ্ট তি‌নি কা‌কে ব‌ল‌বেন। গত একটা মা‌সে তি‌নি শুভ্রর ম‌ু‌খে একবারও মা ডাক শো‌নেন‌নি। এমন‌কি ছে‌লের কন্ঠটাও শো‌নেন‌নি। বউ ছে‌লের কা‌ছে তার না‌মে না‌লিশ দেয়। ছে‌লে লজ্জায় মা‌কে কিছু বল‌তে পা‌রে না। তাই কথা বলাই বন্ধ ক‌রে দি‌য়ে‌ছে। ছে‌লের গলা শুন‌বেন ব‌লে আজ ওর ঘ‌রের দরজায় কান পে‌তে‌ছি‌লেন। কিন্তু ছে‌লে বউ‌য়ের যে কথা তি‌নি শুন‌লেন তা‌তে তার অন্তরাত্মা শু‌কি‌য়ে গে‌ছে। নী‌লিমা বল‌ছিল,

: এ্যাই, তোমার মা‌কে কোন একটা ওল্ড হো‌মে পা‌ঠি‌য়ে দি‌লে হয় না? শুভ্র হয়ত একটু অন্যমনস্ক ছিল। তাই সে অস্পষ্টভা‌বে জবাব দিল,

–ওল্ড হোম কেন? নী‌লিমা রুষ্ট হয়। ‌
: কেন নয়? উ‌নি শুধুই একটা রুম দখল ক‌রে ব‌সে আ‌ছেন। আর এম‌নি‌তে তো বাসায় সারা‌দিন একাই থা‌কেন। ওল্ড হো‌মে তার কিছু সঙ্গী সাথী হ‌বে। শুভ্রর নিরুত্তাপ জবাব। ‌

–বেশ তো।

এরপর তাহেরা বেগম আর দাঁ‌ড়ি‌য়ে থাক‌তে পা‌রেন‌নি। শুভ্রর নিরুত্তাপ জবাব তার ম‌নে য‌থেষ্টই উত্তাপ ছড়ি‌য়ে‌ছে। বয়‌সের কার‌নে এম‌নি‌তেই চো‌খে কম দে‌খেন। তারউপর এই কথা শু‌নে চোখ আরও ঝাপসা হ‌য়ে গে‌ছে। ধী‌রে ধ‌ী‌রে সিঁ‌ড়ি থে‌কে নাম‌লেন। একবার হোঁচট খে‌য়ে প‌ড়ে যা‌চ্ছি‌লেন। কিন্তু কে যেন ধ‌রে ফেলল। পা‌শে তা‌কি‌য়ে দেখ‌লেন শুভ্রর বাবা তার হাত ধ‌রে আ‌ছেন। সে যেন একটু রাগত স্ব‌রেই বলল,

: একটু সাবধা‌নে চল‌তে পা‌রো না? তা‌হেরা বেগম তরে প্র‌তি একটা কটাক্ষ হে‌নে বল‌লেন, ‌

–সিঁ‌ড়ি থে‌কে প‌ড়ে য‌দি মরন হয় তাও ভা‌লে‌া।ওল্ড হো‌মে তো আর যে‌তে হ‌বে না। শুভ্রর বাবা একটু হাস‌লেন।
: এই দোতলা সিঁ‌ড়ি থে‌কে প‌ড়ে মরার চিন্তা ক‌রো তু‌ম‌ি? বড় জোড় হাত পা ভাঙবা। ম‌নে নাই পড়‌ছিলা একবার। হাত ভাঙল তোমার আর গাঁধার মত খাট‌তে হল আমা‌কে। ‌

–তোমার আম্মা তো বলেই ফে‌লে‌ছিল তু‌মি বউ ছাড়া কিচ্ছু বো‌ঝো না।
: আমা‌দের ছে‌লেটাও কিন্তু আমারই মত বউ পাগল।
–তাই ব‌লে মা‌কে ভু‌লে যা‌বে? তোমার মা তো উঠ‌তে বস‌তে আমা‌কে কথা শুনা‌তেন তারপরও কি আ‌মি তার কোন অযত্ন ক‌রে‌ছি? ত‌বে আমার ছে‌লের বউ কেন আমা‌কে সহ্য কর‌তে পা‌রে না?

: সবাই তো আর তোমার মত ভা‌লো হয় না, তা‌হেরা। তা‌হেরা বেগম অনু‌যো‌গের স্ব‌রে ব‌লে ও‌ঠেন,

–এত ভা‌লো হ‌য়ে আমার লাভটা কি হ‌লো?

“আপ‌নে বিড়‌বিড় কইরা কার ল‌গে কতা কন খালাম্মা?” কা‌জের মে‌য়েটার কন্ঠ শু‌নে তা‌হেরা বেগম হঠাৎ চম‌কে উঠ‌লেন। নি‌জে‌কে তি‌নি সিঁ‌ড়ির ধা‌পে বসা অবস্থায় আ‌বিষ্কার কর‌লেন। হঠাৎ কি জবাব দে‌বেন বুঝ‌তে না পে‌রে ধরা পড়া চো‌রের মত শূন্য দৃ‌ষ্টি‌তে তা‌কি‌য়ে রই‌লেন। কা‌জের মে‌য়েটা ভয় পে‌য়ে চিৎকার জু‌ড়ে দি‌লো।

: ও ভা‌বি, নি‌চে আ‌সেন তাড়াতা‌ড়ি। খালাম্মায় একলা একলা কতা কয়। ডাক শু‌নে শুভ্র নী‌লিমা নী‌চে নে‌মে এল। নী‌লিমাকে দে‌খেই মে‌য়েটা আবারও বল‌তে শুরু ক‌রে।

: বুঝ‌লেন ভা‌বিসাব আ‌মি সিঁ‌ড়ির সাম‌নে দিয়া যাই‌তে‌ছিলাম তহন দে‌হি খালাম্মায় সিঁ‌ড়ির উপর বইসা বিড়‌বিড় কর‌তে‌ছে। আ‌মি যে তার সাম‌নে খাড়া দে‌হেই নায়। উল্টা একলা একলা হা‌সে রাগ হয়। নী‌লিমা কিছু না ব‌লে মুখ কা‌লো ক‌রে আবারও ওপরে চ‌লে যায়। শুভ্র কি কর‌বে বুঝ‌তে পার‌ছে না। মা‌কে যে সিঁ‌ড়ি থে‌কে তু‌লে ঘ‌রে দি‌য়ে আস‌বে সেরকম কোন লক্ষন তার ম‌ধ্যে দেখা যা‌চ্ছে না। আবার এভা‌বে ফে‌লে রে‌খে মুখ ঘু‌ড়ি‌য়ে চ‌লে যে‌তেও পার‌ছে না। ছে‌লে হ‌য়ে প‌ড়ে‌ছে মহা বিপ‌দে! শেষ পর্যন্ত কা‌জের মে‌য়েটা তা‌কে বিপদ থে‌কে রক্ষা করল। সেই তা‌হেরা বেগ‌মের হাত ধ‌রে ঘ‌রে নি‌য়ে যে‌তে উদ্যত হল।

: চ‌লেন খালাম্মা আপনা‌রে ঘ‌রে দিয়া আ‌সি। শুভ্র চুপচাপ নি‌জের ঘ‌রে চ‌লে যায়। সা‌থে সা‌থেই নী‌লিমা ব‌লে ও‌ঠে, ‌
–কোনটা বে‌শি ভা‌লো হ‌বে ওল্ড হোম না‌কি মেন্টাল হস‌পিটাল? তোমার মা‌য়ের যা অবস্থা!

কথাটা ব্যঙ্গ বা বিদ্রুপ নয় বরং শুভ্রর উপর চা‌পি‌য়ে দেওয়া একটা সিদ্ধান্ত। তারও তো তেমন আপ‌ত্তি নেই। মা‌কে তার ওল্ড হোমেই পাঠা‌তে হ‌বে তাহ‌লে। আজ মা‌সের বাইশ তা‌রিখ। ঠিক হয় আগামী মা‌সের এক তা‌রি‌খেই তা‌হেরা বেগম‌কে বৃদ্ধাশ্র‌মে রে‌খে আসা হ‌বে। তি‌নি তা‌তে খুব একটা উ‌দ্বিগ্ন নন। শুভ্রর বাবার চো‌খে মু‌খে চিন্তাটা বে‌শি। এই মানুষটা পৃ‌থিবী থে‌কে বিদায় নি‌য়েও কেমন সর্বদা তা‌হেরা বেগম‌কে ঘি‌রে আ‌ছে। সবই হয়ত তার অব‌চেতন ম‌নের কল্পনা। তি‌নি বো‌ঝেন না এমন না। কিন্তু এটা‌কে কল্পনা ব‌লে মান‌তেও মন চায় না।

আজ ঈদ। আর এই ঈ‌দের জন্যই তা‌হেরা বেগ‌মের ওল্ড হো‌মে যাওয়ার তা‌রিখটা ‌পি‌ছি‌য়ে গে‌ছে। ঈ‌দের আ‌মেজটা শেষ হ‌লেই তা‌কে এই বা‌ড়ি ছাড়‌তে হ‌বে। খা‌টের উপর ছে‌লের দেওয়া শাড়ীটা পড়ে আছে। প্র‌তি ঈ‌দেই ছে‌লে তা‌কে একখানা শাড়ী কি‌নে দেয়। এক রঙা সাদা শাড়ী। এইটুকুই তার ঈ‌দের শৌ‌খিনতা। শুভ্রর বাব‌া মারা যাওয়ার পর থে‌কে তি‌নি র‌ঙিন কিছুই প‌ড়েন‌নি। ত‌বে প্র‌তি ঈ‌দে ছে‌লের দেওয়া শাড়ী পড়‌তেন। ছে‌লে নামায প‌ড়ে এ‌সে তা‌কে পা ছুঁ‌য়ে সালাম করত। এবা‌রেও তি‌নি পাট ভে‌ঙে খুব যত্ন ক‌রে নতুন শাড়ীটা পড়‌লেন। বেশ অ‌নেকক্ষন অ‌পেক্ষা কর‌লেন। কিন্তু ছে‌লে বা ছে‌লের বউ কেউই তার ঘ‌রে এল না। মারও আর নতুন শাড়ী পড়ে থাক‌তে ইচ্ছা ক‌রল না। তি‌নি আবার শাড়ীটা পা‌ল্টে ভাঁজ ক‌রে আলমারী‌তে তু‌লে রাখ‌লেন।

শুভ্রর বাবা অবশ্য বেশ রঙচঙা পাঞ্জাবী প‌ড়ে ব‌সে আ‌ছে সেই সকাল থে‌কে। তা‌হেরা বেগম ফি‌রেও তাকা‌চ্ছেন না। হঠাৎ-ই তার মন খারাপ লাগ‌ছে। খুব মন খারাপ। কোন অ‌স্তিত্বহীন কল্প‌লো‌কের মানুষ তার মান ভাঙা‌তে পার‌বে না। ‌তি‌নি মা ডাক শুন‌তে চান। একবার হ‌লেও। নি‌জের ছে‌লের কা‌ছে এইটুকু মাত্র চাওয়া তার। শরীরটা হঠাৎ-ই খুব ক্লান্ত লাগ‌ছে। সকাল থে‌কে কিছু খাওয়া হয় নি। কা‌জের মে‌য়েটা টে‌বি‌লে পা‌য়েশ রে‌খে গেছে। খাওয়া হয়‌নি। আজকাল একদমই মি‌ষ্টি খে‌তে ইচ্ছা ক‌রে না। মাথাটা কেমন ঘুর‌ছে। বু‌কের ভেতর চিন‌চি‌নে ব্যথা অনুভব কর‌ছেন। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জ‌মে‌ছে। তা‌হেরা বেগম কোন ম‌তে বিছানায় শরীরটা এ‌লি‌য়ে দি‌লেন। শুভ্রর বাবা ব্যস্তভা‌বে এ‌গি‌য়ে এ‌লেন।

‌: তোমার কি শরীর খারাপ লাগ‌ছে?

‌তি‌নি জবাব দি‌লেন না। তার কেবলই ম‌নে হ‌তে লাগল তা‌কে তার চির প‌রি‌চিত ঘর ছে‌ড়ে চ‌লে যে‌তে হ‌বে। যে ঘ‌রের প্র‌তিটা কো‌নে শুভ্রর বাবার স্মৃ‌তি জীবন্ত সেই ঘর ছে‌ড়ে বৃদ্ধাশ্রম হ‌বে তার নতুন ঠিকানা। তা‌হেরা বেগ‌মের খুবই অ‌স্থির লাগ‌ছে। তার উ‌পেক্ষা স‌ত্ত্বেও শুভ্রর বাব‌া কা‌ছে ব‌সে মাথায় হাত বু‌লি‌য়ে দি‌তে লাগ‌লেন। তা‌হেরা বেগম এবার আর বাঁধা দি‌লেন না। তার ঘুম পা‌চ্ছে। প্রচন্ড ঘুম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত