আমার আর নাজমা’র বিয়ের দু’ দিন পরের ঘটনা। নাজমা আমার ২য় বৌ। আমার প্রথম বৌ চলে গিয়েছিলো।কারন আমার কোন কিছুই তার ভালো লাগে নাই। আমাকে ভালো লাগার তেমন কিছু নাই। আমি খুবই সাধারণ একজন মানুষ। তবে আমাকে খারাপ লাগার, অনেক কারন ছিলো। এর মধ্যে অন্যতম একটা কারন ছিলো, আমি আমার মায়ের একান্ত বাধ্য গত সন্তান ছিলাম। মা আর আমার বৌয়ের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো।
আমি বৌয়ের পক্ষে কোন কথা কখনো বলতাম না।শুধু বৌকে বলতাম, মা’ একটা কথা বলছে তো কি হইছে।একটু মানায়ে চলো।এক সময় সে চলে যায় সংসার থেকে। আর তার এক বছর পর মা চলে যায় দুনিয়া থেকে। তার পর আমি একাই ছিলাম।এবং খুব একটা খারাপ ছিলাম না। এর মধ্যে হলো টাইফয়েডে। একা মানুষ এক গ্লাস পানি খেতেও নিজেকে উঠতে হয়। এর পর আমার এক খালা নাজমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করে। নাজমারও আগে বিয়ে হয়েছিল। সেই ঘরে একটা ছেলে আছে।
নাজমার বর রোড এক্সিডেন্টএ মারা যায়।তখন নাজমার বাচ্চার বয়স ছিলো চার। বিয়ের পরে যেদিন নাজমাকে নিয়ে ওদের বাসায় আসি।তার পরের দিনের কথা। একা একা ওদের বসার ঘরে বসে আছি।একটু পর পর একটা বাচ্চা পর্দার আড়াল থেকে আমাকে দেখছে।আবার চলে যাচ্ছে। আমার মনে হয় এই বাচ্চাটাই নাজমার আগের ঘরের সন্তান।আমি নাজমার বাচ্চা কে দেখি নাই বিয়ের আগে। আর নাজমার বাচ্চা বিয়ের পরে কোথায় থাকবে। এটা নিয়েও কোন কথা হয় নাই।
আমাকে কেউ কিছু বলে নাই। আমারও এই বিষয়টা মাথায় আসে নাই।আবার বাচ্চা’টা উকি দিয়ে আমাকে দেখছে। আমি হাতের ইশারায় বাচ্চা’টাকে ডাকলাম। বাচ্চাটা আসলো কি সুন্দর একটা বাচ্চা। বাচ্চাটার চোখে মুখে একটা ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। আমার পাশে বসতে বললাম। বাবু তোমার নাম কি? বাচ্চাটা আমার দিকে চেয়ে আছে, কিছু বলছে না। আমি আবার বললাম তোমার নাম কি বাবু?বাচ্চাটা আস্তে করে বলল। তুমি আমার মাকে কেন নিয়ে গেছো? আমি মা ছাড়া ঘুমাতে পারি না। আমি থমকে গেলাম তাইতো,আমি একজন বিধবা মহিলাকে বিয়ে করবো, তার একটা বাচ্চা আছে।
সবার প্রথমেতো কথা হবে বাচ্চাটাকে নিয়ে, তার মায়ের বিয়ের পর বাচ্চাটা কোথায় থাকবে সে বিষয় নিয়ে। বিয়ের রাতে নাজমা তার বাচ্চা নিয়ে, একটা কথাও বলেনি আমার সাথে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো।আমি বাচ্চাটার হাত ধরে বললাম, আমার ভুল হয়ে গেছে।আসলে এখন থেকে তুমি, আমি আর তোমার আম্মু আমরা এক বাসায় একসাথে থাকবো।আমি তোমার নতুন আব্বু।এই কথা শুনে বাচ্চা র চোখে মুখে একটা খুশির ঝিলিক দেখতে পেয়েছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলাম নাজমার সাথে আমার পারিবারিক জীবন সুখের বা দুঃখের যাই হউক। এই বাচ্চাটা আমার কাছ থেকে কোন কষ্ট কখনো পাবে না।
ওকে আমি আগলে রাখবো আমার সন্তান হিসেবে। তার পর নাজমা আর তার ছেলে নিলয়কে নিয়ে চলে আসলাম আমাদের বাসায়।অবাক ব্যাপার নাজমার চাইতে, নিলয়ের সাথে আমার বেশি খাতির হয়ে গেলো।আমাদের মধ্যে দু’দিনই এমন একটা সহজ সমপর্ক হয়ে গেলো যে, বাচ্চাটা সারাক্ষণ আমার কোল ছুঁয়ে থাকতে চায়। আমাদের সংসার হয়ে গলো ছেলেকে কেন্দ্র করে। আমার হঠাৎ হঠাৎ মনে হতো, নিলয় ছিলো আমারই সন্তান। ও হারিয়ে গিয়েছিল। এখন আবার ফিরে পেয়েছি। না এই সুখ আমাদের জীবনে স্হায়ী হয়নি। নিলয় আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়।এবং আমি বুঝতে পারি মায়া-মমতার কোন মূল্য নাই সংসারে। এখানে রক্তের সম্পর্ক বড়ো।আত্মার সম্পর্ক কিছু না।বিয়ের দু’বছর পরের ঘটনা। আমাদের পরিবারে নতুন সদস্য এসেছে। নিলয়ের একটা বোন হয়েছে। আমি মেয়ের নাম রাখলাম নিপা।
আমি ছোট খাট একটা কাপড়ের দোকান চালাই। আমাদের সংসারে প্রাচুর্য নাই।আবার কোন অভাবও নাই। আমার বাসার সামনে বড় গাড়ি থেকে একলোক নামলো এবং আমাকেই বললো আপনি রহমান সাহেব। আমি বললাম হ্যাঁ। উনি বললেন আমি নিলয়ের চাচা। আমি ওনাকে বাসার ভেতরে নিয়ে বসালাম এবং কেন জেন মনে হলো উনি এর আগেও এই বাসায় এসেছে। উনি বেশি ভনিতা না করে সরাসরি বললেন, আমি কানাডা থাকি। আমি এবার দেশে এসেছি নিলয়কে কানাডা নিয়ে যাওয়ার জন্য। ওর কাগজ পত্র সব রেডি করার জন্য, একটু দেরি হলো।আমার বুক ধরফর করছে এই মানুষটা কি বলে? আমার ছেলেকে সে কোথায় নিয়ে যাবে? আমি কোন রকমে বলি না আমার ছেলেকে আমি কোথাও যেতে দেবো না। আমি সব চাইতে বেশি অবাক হয়েছিলাম নাজমার ব্যবহারে।নাজমা একবারের জন্যও বলেনি আপনি নিলয়কে নিয়ে যেতে পারবেন না।
আসলে নাজমা হয়তো চেয়েছিলো ছেলের আরো উন্নত জীবন যা হয়তো আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব না।হয়তো ভেবেছে এখন আমার মেয়ে হয়েছে আমি আর আগের মতো নিলয়কে ভালোবাসবো না। কি হলো আব্বু আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি নিলয়। নিলয়ের কথায় হুস হলো। সতেরো বছর আগের জীবন থেকে বাস্তবে ফিরে আসলাম। কি বলবো ছেলেকে তোকে আমি চিনবো না? তো কে চিনবেরে বাবা। কি সুন্দর হয়েছে ছেলেটা।
আমি বললাম আমার কথা তোর মনে ছিলো নিলয়?নিলয় ওর বুক পকেটে থেকে একটা ছবি বের করে আমার হাতে দেয়। আমি ছবি দেখে চোখের পানি লুকাতে পারছি না। এই ছবিটা তুলেছিলাম ঈদের দিন নিলয়কে কোলের কাছে বসিয়ে। নিলয় কথা বলছে আব্বু আমি এই ছবিটা সব সময় আমার কাছে রাখতাম এবং দেখতাম আপনাকে। আমার ভয় হতো। ছবিটা হারিয়ে গেলে যদি আমি আপনাকে চিনতে না পারি। যদি ভুলে যাই আপনার চেহারা নিলয়কে বুকে জড়িয়ে কাঁদছি। আমার সন্তান ফিরে এসেছে আমার কাছে।