নূরানী ক্রন্দন

নূরানী ক্রন্দন

গত রাতে এক আপু ইনবক্সে জানতে চাইল,”আপনি কি নাস্তিক?”

প্রশ্ন শুনেই মেজাজ খিচড়ে গেল।

অত্যন্ত রুক্ষ্ম ভাষায় উত্তর দিলাম,”আমার গুরুদেব নাস্তিক। আমি আস্তিক। আমার এক ছোট ভাই জঙ্গি। what about you?” আপু প্রচন্ড রাগ করলেন। রাগ আমিও করেছি। চুলকানির এই নাস্তিক শব্দটারে আমরা ট্যাবু বানায়ে ফেলছি। অথচ ট্যাবু হওয়ার কথা জঙ্গি শব্দটা। কেউ যদি জানতে চাইত,”আপনি কি জঙ্গি?” আমি রাগ করতাম না। খোদার কসম একটুও রাগ করতাম না। খুশি হইতাম। একজন জঙ্গিকে ভয় পাওয়া উচিত। ধরে নিতাম, ভয় থেকেই হয়ত প্রশ্ন করেছে। একজন নাস্তিকের চাইতে একজন জঙ্গি যে বেশি ক্ষতিকর এইটা অনেকেই বুঝে না। বোঝার চেষ্টাও কোনদিন করে না।

একজন নাস্তিকের প্রথমত সমস্যা হল, সে সৃষ্টিকর্তা অস্তিত্বে অস্বীকার করে। করুক তাতে আমার বাপের কী? সে ধর্মকর্মের বিরুদ্ধে কথা কয়। এইখানে প্রতিবাদ করুন। সে চুপ হয়ে যেতে বাধ্য। চুপ না হলে দেশ থেকে বিতাড়িত হয়। তসলিমা এবং মুফাসিলের মতো মানুষেরা এখন আর দেশে ফেরার সাহস পায় না। ওদের রফাদফা হয়ে গেছে। ব্যস ফুরিয়ে গেল। এইবার চলুন আপনি-আমি শান্তিতে ধর্মকর্ম করি।

তারপর চলুন, একজন উগ্র ধর্মযোদ্ধা তথা জঙ্গির দিকে ফিরে তাকাই। সে চায় কি? করছেটা কি? একশটা বোমা ফাটিয়েও একজন বিজাতীয়কে স্বধর্মে ফিরিয়ে আনতে পারছে না। ফাঁকতালে বেহুদা খুনাখুনি করে বেড়াচ্ছে। নিরীহ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। আসুন, আরেকটু গোড়া থেকে শুরু করি। ইসলামের প্রতিষ্ঠার প্রারম্ভে যদি এইসব জঙ্গি সম্প্রদায়ের জন্ম হত, তবে কি হইত?

সবার আগে খলিফা ওমর (রাঃ) কে মেরে দিত ওরা। বোম ব্রাস্ট করে উড়ায়ে দিত। কেননা প্রথম জীবনে ওমর (রাঃ) ছিলেন মূর্তি পূজারী। ইসলামের ঘোর শত্রু। তাকে দাওয়াত করা হয়েছে। ধীরে ধীরে তিনি ইসলামের শান্ত-সৌম্য রূপ অনূভব করেছেন। একসময় ইসলাম গ্রহণ করে বটবৃক্ষের মতো মুসলিম উম্মাহর সেবা করেছেন। জঙ্গিরা তো দাওয়াত দেয় না। দাওয়াতে হয়ত বিশ্বাসও করে না। ওমর (রাঃ) কে ওরা দাওয়াত দিত না। বোমা ফেলে উড়ায়ে দিত। চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে ফালিফালি করে দিত। এইটা হল তাদের পলিসি।

নিজের কথা অনেক বলছি। এইবার গুণীজনের কথা বলি। গুণীজনের নাম নূর। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়, আসাদুজ্জামান নূর। কিছুদিন আগে এই জঙ্গিদের কথা বলতে গিয়ে তিনি খুব জরুরি কিছু প্রশ্নের উত্থাপন করেছেন। একজন আইএস ধর্মযোদ্ধা ইসলামের নাম করে আমেরিকায় বোমা ফাটায়, ফ্রান্সে গিয়ে ট্রাক চাপা দিয়ে মানুষ মারে, কদিন আগে পাকিস্তানের হাসপাতালেও বোমা ফাটিয়েছে- যেখানে ছিল রুগ্ন শিশু, বৃদ্ধা ও প্রসূতি মায়ের আশ্রয়।

এই আইএস জঙ্গিদের অন্যতম ঘাঁটি হল সিরিয়া। এরা সিরিয়া থেকে হাজার মাইল দূরে ইংল্যান্ড, আমেরিকা, বেলজিয়ামে গিয়ে বোমা ফেলতে পারে… অথচ মাত্র পঞ্চাশ মাইল দূরে কুখ্যাত ইজরাইল রাষ্ট্রের ইহুদি খুনিদের উপর কখনো বোমা ফেলে না! নূর সাহেব বলেন, আমি তাই আইএস মানে ‘ইসলামী স্টেট বলি না। আমি বলি আইএস মানে হল ইসরাইল স্টেট!” অর্থাৎ ইহুদী মদত পুষ্ট লেবাসধারী মুসলমান! এরা সারা পৃথিবীতে ইসলামের ভাবমূর্তি নষ্ট করার জন্য- ইসলামী রাষ্ট্র নাম ধারণ করে খুন-খারাবি করে বেড়াচ্ছে!

আইএস এর পর জঙ্গি রাষ্ট্র বলতে সবার আগে যে নামটি মাথায় আসত তা হল পাকিস্তান। বলিউডের কিছু নাটক-সিনেমার সুবাধে এই জঙ্গি তকমাটি পাকিস্তানের কপালে প্রায় ছাপ্পা মেরে লেগে গিয়েছিল। কিন্তু হায়, কদিন আগে Intelligent Khiladi নামে একটা তামিল মুভি দেখলাম- যাতে জঙ্গি সম্প্রদায়ের প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে বারবার বাংলাদেশের নাম নেওয়া হচ্ছিল!

বিস্ময়ে তব্ধা থ বনে গিয়েছি যখন এই জঙ্গিগোষ্ঠীকে দমনের উদ্দেশ্যে গল্পের নায়ক আক্ষরিক অর্থেই চট্টগ্রাম বন্দরে এসে অবতরণ করে। ভাঙচুর ও তান্ডবলীলা মধ্যে দিয়ে সিনেমা শেষ হল। আর কী চমৎকার দেখা গেল, জঙ্গিদের আর্থিক লেনদেনে এখন আর শুধু পাকিস্তানি মুদ্রা নয়। বাংলা ফ্রন্টে বন্ধুবন্ধুর ছবি যুক্ত বাংলা টাকার লেনদেন দেখছি!

ডিয়ার আপু, এইবার আপনি আমাকে বলেন- আপনার ডানপাশে একটা নাস্তিক বসে আছে, বা পাশে একজন আইএস। আপনার গর্ভে আছে আটমাসের অনাগত এক সন্তান। আপনার এই অনাগত সন্তানের জন্য কে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ? একজন নাস্তিক নাকি আইএস? আমার প্রথম উপন্যাস ‘ঝড় ও জনৈক চিন্তাবিদ’ এর নায়ক মিথুনকে দেখবেন, শুরুতে খুব নাস্তিক টাইপ কথা বলছে। আর ওর দাদা জাবের আলী হচ্ছে একজন উগ্র ধর্মযোদ্ধা। ওসামা বিন লাদেনের বন্ধু। একসঙ্গে মরু তল্লাটে যুদ্ধ করেছে

তো, দাদা এবং নাতি- দুইজন দুইমেরুর মানুষ। এরা যদি শুরু থেকেই একে অন্যকে খুন করতে চাইত, ঘৃণা করত- তার পরিণতি হতো ভয়াবহ। ভালোবেসে, উচ্চতর প্রজ্ঞা ও মাহাত্ম্য দিয়ে একটা নাস্তিক ছেলেকে ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনা যায়। কিন্তু একজন জঙ্গিকে আমরা ফেরাব কি দিয়ে? ডিয়ার আপু, প্রশ্নগুলি রেখে যাচ্ছি, পারেন তো উত্তর দিয়েন লেখক জীবনের শুরুতেই আমার এক সম্পাদক বন্ধু উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, নামের আগে থেকে ‘মুহম্মদ’ শব্দটা কেটে দে। নিজাম উদ্দীন কিংবা নিজাম নূর লেখালেখি কর। ইন্টারন্যাশনাল এওয়ার্ড পাইতে সুবিধে হবে। নামের শুরুতেই মুহম্মদ দেখে ওরা মুখ ফিরিয়ে নিবে। উদ্ধত কণ্ঠে প্রতিবাদ করেছি। মুহম্মদ নিজাম নামেই লিখে যাচ্ছি। লিখে যাব।

ওরা হয়ত জানে না, কিন্তু আমি সেই জন্মলগ্ন থেকেই জেনেছি, পৃথিবীর সবচাইতে হৃদয়বান মানুষটির নাম ছিল মুহম্মদ। আজ থেকে প্রায় ১৪০০ বছর আগে, আরবের মরুপ্রদেশে একজন প্রশংসিত বাদশার জন্ম হয়েছিল, যার নাম ছিল মুহম্মদ (দঃ) এবং তিনিই হলেন একমাত্র মানুষ যিনি- ভালোবাসা দিয়ে একজন উগ্র জঙ্গি কিংবা চরম নাস্তিকের হৃদয়েরও দয়াময় স্রষ্টার করুণাধার বইয়ে দিতে পারতেন।

আমরা শপথ করেছিলাম, আপনাকে অনুসরণ ও অনুকরণ করব হে রাসুলুল্লাহ। আমরা আপনার মতোই উদার এবং ক্ষমাশীল হওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু কই, পারছি না তো। কথা দিয়ে কথা না রাখার গ্লানিতে চরাচর ভরে গেছে। যেটুকু ফাঁকা আছে, সেখানেও দিনে দিনে উতলে উঠছে উগ্র জঙ্গিবাদ! লোক দেখানো ধর্মাচার এরপরেও কেউ যদি আমার কাছে স্পষ্ট করে জানতে চায়,”আপনি কি নাস্তিকদের ঘেন্না করেন না?”

আমি বলব একটুও না। শতভাগ আস্তিক হওয়া সত্ত্বেও একজন জঙ্গির চাইতে একজন নাস্তিক মানুষকে আমি বেশি পছন্দ করি। একজন নাস্তিকের কাছে চাইলেই আপনি-আমি ধর্মের দাওয়াত নিয়ে যেতে পারব, কিন্তু একজন আইএস যোদ্ধা, সে আমাকে এই সুযোগ দেবে না। আমাকে খুন করে জান্নাতুল ফিরদাউস হাসিল করে নেওয়া নেশাতে সে অষ্ট-প্রহর বুঁদ হয়ে আছে! আপনি কিংবা আমি তার কাছে নিতান্তই নস্যি!

নূরানী ক্রন্দন এখানেই শেষ। এইবার একটা গল্প বলি। এই গল্পটা দুই বছর আগে একবার বিভিন্ন গ্রুপে পোস্ট করেছিলাম। এরপর শত শত মানুষ, নামে বেনামে বিভিন্ন গ্রুপে ও পেইজে শেয়ার দিয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ এই গল্প পাঠ করেছেন, কিন্তু লেখকের নাম জানেন না! বিনয়ের সঙ্গেই জানাচ্ছি, গল্পটা আমার লেখা এবং প্রায় শতভাগ বাস্তব অবলম্বনে লেখা: এক অতি আধুনিকা আপু আমাকে প্রশ্ন করলেন,’একই সঙ্গে একটা হাসপাতালে এবং একটা মসজিদে আগুন লেগেছে। তুমি কোনটার আগুন আগে নেভাতে চাইবে?’

আপুটা আবার কিছু নাস্তিক টাইপ। হুমায়ুন আজাদ স্যারের অন্ধ ভক্ত। নিয়মিত নামাজ পড়ি শুনে আমাকে বিপদে ফেলার জন্যই এই প্রশ্ন করা। আমি বললাম,’পঁচিশ বছরের জীবনে অনেক আগুন লাগার কথা শুনেছি। কিন্তু একই সঙ্গে এমন দুইটা জায়গায় আগুন লাগতে শুনি নি। তবু যদি কখনো লেগে যায়, আমি হাসপাতালের আগুনটাই আগে নেভানোর চেষ্টা করব।’ ‘কেন? মসজিদ আগে নয় কেন?’

‘কারণ মসজিদে যারা থাকেন তারা সকলেই মোটামুটি সুস্থ। ইচ্ছে করলেই পালাতে পারবেন। কিংবা সকলে মিলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করতে পারবেন। কিন্তু হাসপাতালে সবাই অসুস্থ। শিশু আছে, প্রসূতি মা আছেন। অনেকেরই চলন ক্ষমতা নেই। ওদের সেভ করাটা বেশি জরুরি।’

আপু ঠোঁট বাকিয়ে তেড়ছা হাসির সহিত বললেন,’দূর মিয়া। তুমি তাইলে পাক্কা মুসলমান না।’ আমি নরম গলায় উত্তর দিলাম,’পাক্কা মুসলমান কিনা জানি না। কিন্তু হাসপাতালের আগুনটা যে আগে নিভানো দরকার- এই শিক্ষা আমি মসজিদ থেকেই পেয়েছি।’

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত