প্রতিশোধ বা ভালোবাসার গল্প

প্রতিশোধ বা ভালোবাসার গল্প

সঞ্জুর সাথে আবার দেখা। রিমির বিয়েতে। সেই একই রকম আছে। মায়াকাড়া চোখ জোড়া। দুর্দান্ত হ্যান্ডসাম। সবার মন ভুলানো চেহারা। সেই সঞ্জু ই যার সাথে আমার ছিলো আত্মার সম্পর্ক! বরাবরের মতন ই হাসিখুশি সঞ্জু। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। এগিয়ে গেলাম আমি।

এমন সময় আমার নজরে পড়লো সঞ্জুর পাশের জন কে। আমি কি পাগল! আজীবন সঞ্জু কে হা করে দেখে এলাম। ওর সামনে পিছনে কাউকে দেখি নি। আজ ও সেই একই ভুল করলাম। সঞ্জু ওর বউ কে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। আমি হাসি মুখে এগুলাম তাদের দিকে। “কেমন আছিস সঞ্জু?” সঞ্জু র চোখের তারায় এক কেমন যেনো চোর চোর ভাব খেয়াল করলাম। হেসে উঠলাম আমি। সঞ্জুর বউ কে বললাম, ” আমি সঞ্জুর আমার ঠোঁট থেকে কথা কেড়ে নিলো সঞ্জু, ” ও আমার স্কুল জীবনের বান্ধবী। আমরা কলেজে ও একসাথেই ছিলাম। আর শর্মি ও আমার বউ মিলি।”

খুব হাসি পাচ্ছে। আমি হাসতে হাসতেই বললাম, ” তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেনো সঞ্জু? আমি তো মিলি কে বলতে যাচ্ছি না যে তোর সাথে আমার স্কুল জীবন থেকে ই সম্পর্ক ছিলো। বিয়ে থা করেছিস এখন এত ভয় পেলে চলে?” সঞ্জু তোতলিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই আমি মিলির হাত ধরে বললাম, ” সঞ্জু কি সুন্দর তোমাকে বউ বলে পরিচয় দিচ্ছে। জানো একসময় ও আমাকে বউ ছাড়া কথা ই বলতো না। ” সঞ্জুর চোখ মুখ লাল হয়ে উঠলো। সে কিছুটা রেগে গিয়ে ই বললো, ” তুই বড্ড বেহায়া আর নির্লজ্জের মতন কথা বলা শিখেছিস তো!” এবার বড্ড অভিমান হলো আমার।

একটু মন খারাপ করেই সঞ্জু কে বললাম, ” অথচ একসময় আমি মুখচোরা, কম কথা বলি, দশ জনের সাথে মিশতে পারি না এরকম একশ টা কথা বলে আমার সাথে সম্পর্ক টা নষ্ট করেছিস তুই। তাই আমি সব সময় ভাবি তোকে পাই নি তো কি হয়েছে তোর মনের মতন হয়ে উঠি।” কথাটা শেষ করে সঞ্জু কে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে সরে আসলাম আমি। চোখের কোণে কি যেনো হয়েছে? অকারণে পানি পড়ছে। নাহ চোখের ডাক্তার টা এবার দেখাতেই হবে। অনেক দিন হলো স্কুল জীবনের বন্ধুদের কারো সাথে দেখা নাই। এরই মাঝে সোহান এর বিয়ের দাওয়াত পেলাম। যাক অবশেষে ছেলেটা বিয়ে করছে। সেজে গুজে বিয়ে খেতে গেলাম। বন্ধুরা অনেকে ই এসেছে । গল্প গুজব আড্ডা য় সময় যাচ্ছে। এরই মাঝে সঞ্জু এলো।

কোলে ছোট্ট একটা পুতুল। এই প্রথম আমি সঞ্জুর দিকে না তাকিয়ে থেকে ওই পুতুল টার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এরকম একটা পুতুল আমার আর সঞ্জুর হওয়ার কথা ছিলো। সঞ্জু আমাকে দেখে ই যেনো একটু অন্য দিকে চলে যেতে চাইলো। কিন্তু ওর বউ মিলি আমার কাছে ই আসলো। কুশল জানতে চাইলো। ভালো ই লাগলো আমার। সঞ্জুর দিকে হাত টা বাড়িয়ে দিলাম আমি পুতুল টাকে কোলে নেয়া র জন্য। বহু বছর পর সঞ্জুর হাতের সাথে আমার হাতের স্পর্শ। মুহুর্তে শরীরে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো আমার।

মেয়েটা কে কোলে নিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে দিলাম। সঞ্জুর মেয়ে। নিজেকে ও এই মেয়ের কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে। বুকের ভেতর কেমন যেনো খাঁ খাঁ করছে। কত শখ ছিলো একটা মেয়ের! মিলি কে জিজ্ঞেস করলাম, ” নাম কি রেখেছো এই পুতুলের?” “সামান্তা। সঞ্জু রেখেছে। আমার আর ওর নাম মিলিয়ে।” হাসি পেলো আমার। ” জানো মিলি সঞ্জু আমাদের মেয়ের নাম কি রেখেছিলো? সুরঞ্জনা! হঠাৎ ই একদিন বললো, শর্মি আমাদের মেয়ের নাম হবে সুরঞ্জনা। ও যখন বড় হবে, প্রেম করবে আমি তখন ওকে বলবো, ” সুরঞ্জনা,ওই খানে যেও নাকো তুমি, বলো নাকো কথা ওই যুবকের সাথে।” বলে নিজে ই হেসে লুটোপুটি খেত। ”

মিলির মুখ থমথমে হয়ে গিয়েছে। আমি পুতুল কে ওর মায়ের কোলে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম। কিছুক্ষণ কাঁদতে হবে। বুক টা একটু হালকা করতে হবে। এরপর বহুদিন বহুবছর আমি সঞ্জু কে দেখি নি। হঠাৎ একদিন খবর পেলাম মিলি মারা গেছে অনেক দিন রোগে ভুগে । খুব কষ্ট লাগলো ওর জন্য। সঞ্জু কে দেখতে খুব ইচ্ছে করলো। সামান্তা কে ও। আবারো নির্লজ্জ বেহায়ার মতন আসলাম সঞ্জুর বাড়ি। অনেক বদলে গেছে বাড়ি টা। ভেতরে ঢুকতেই দেখলাম সতেরো কি আঠারো বছরের একটা ছেলে সাইকেল এর চেইন ঠিক করছে। আমি দেখে ই জিজ্ঞেস করলো, ” কাকে চান?”

আমি সঞ্জুর কথা বলতে গিয়ে ও বললাম না। বললাম, ” সামান্তা আছে?” ছেলেটা চিৎকার করে বললো, ” আপু তোমার কাছে কে যেনো এসেছে।” আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ছেলেটা এক মনে চেইন ঠিক করছে। আমি ছেলেটার চোখ দেখলাম। সেই মায়াকাড়া চোখজোড়া। চমকে উঠলাম আমি। বুঝলাম এ ও সঞ্জু আর মিলির অংশ। খানিক বাদে সামান্তা বের হয়ে এলো। হাফ সেঞ্চুরি করা আমাকে সে চিনতে পারলো না!! পারবে তো নাই! সে এখন বাইশ বছরের তরুণী। দেখতে পুরো মিলির মতন হয়েছে।

আমি এগিয়ে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মেয়েটা অবাক হলো। ” আপনাকে তো ঠিক চিনতে” ” আমাকে তুমি চিনবে না। আমি তোমাকে চিনি। আমি তোমার বাবার সাথে পড়তাম। তোমার শর্মী আন্টি। তোমার মার মারা যাওয়ার কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছি। তাই ভাবলাম তোমার বাবা কে দেখে যাই। আমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাবে?” সামান্তা খানিক টা অপ্রস্তুত। অচেনা একটা মহিলা। তা ও সে খানিক টা সামলে বললো, ” বাবা তো অসুস্থ। ” বলতে বলতে একটা রুমে ঢুকলো সে। বিছানায় কে ও একজন শুয়ে আছে। যার চেহারা ভেংগে পড়েছে। চোখ কোটরাগত। দেখে মনে হচ্ছে একটা কংকাল। এত কিছুর মাঝে ও আমি মায়াকাড়া চোখ দুটো চিনতে পারলাম। ” কেমন আছিস সঞ্জু?” সঞ্জু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। ওর চোখ দুটো যেন জলে ভরে উঠছে।

সামান্তা পাশে থেকে বললো, “মা মারা যাওয়ার পর থেকে ই বাবা অসুস্থ। প্যারালাইজড হয়ে আছে এক পাশ। ঠিক মতন কথা ও বলতে পারেন না। আমার চোখ জলে ভরে এলো সঞ্জু কে এ অবস্থায় দেখে। কত অন্যায় করেছে সঞ্জু আমার সাথে। আমি ওর উপযুক্ত না বলে কত অপমান করেছে। নিজের সৌন্দর্যের বড়াই ছিলো তার আজীবন । আজ কোথায় কি? সামান্তার সাথে অনেক কথা হলো। মনে হলো যেনো আমার নিজের মেয়ে সংসারের গল্প করছে আমাকে। বড়ই লক্ষী মেয়ে।

চলে আসবো ঠিক এমন সময় সঞ্জু কিছু একটা বললো। আমি বুঝতে পারি নি। পাশে থেকে সামান্তা বলে উঠলো,
“বাবা আপনার কাছে কোনো কারণে ক্ষমা চাইছে।” আমি চোখের পানি মুছে হাসলাম। বললাম,” সত্যিই আজ তোকে আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।আর কোনো অভিযোগ নেই আমার। চোখের পানি পড়ে যাচ্ছে বার বার। কি বিব্রত কর অবস্থা। চলে যাওয়ার জন্য উঠলাম। সামান্তা তখন ছেলেটিকে ডেকে বললো, ” অংকুর শর্মি আন্টি কে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে আয়।” হাঁটতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম আমি।

জিজ্ঞেস করলাম, ” ওর নাম বুঝি অংকুর?” সামান্তা মন খারাপ করে বললো, ” হুম। মা রেখেছে এই নাম। বাবার একদম পছন্দ না। মা বলেছিলো এটা নাকি তার পছন্দের একজন রাখতে বলেছিলো। আমি অংকুর ই ডাকি। বাবা ছোট বেলা থেকেই বাবু বলে ই ডাকে ওকে।” আমি আর কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে বহু বছর আগের কিছু কথা।

আমি সঞ্জু কে বলেছিলাম, “শুন সাঞ্জু ছেলের নাম কিন্তু আমি রাখবো। আমাদের ছেলের নাম হবে অংকুর। অংকুর থেকে ডাল পালা ছড়িয়ে এক সময় সে বড় হয়ে আমাদের দুই বুড়ো বুড়ি কে ছায়া দিবে।” কিন্তু একথা মিলি জানলো কিভাবে? আর মিলি আমার রাখা নাম ই বা কেনো রাখলো? আর জানা হলো না।।।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত