পুরানো সেই দিনের কথা

পুরানো সেই দিনের কথা

তখন ক্লাস এইটে পড়ি। Hossain হোসাঈন স্যারের ক্লাস চলছিল। আমি মনোযোগ দিয়ে স্যারের মুখপানে তাকিয়ে তার কথাগুলো শুনছিলাম। যদিও মাথায় কিছুই ঢুকাতে পারছিলাম না। তবুও এমন একটা ভাব ধরে বসে আছি যে স্যার মনে করেন আমি কতকিছু বুঝে গেছি। তো তারই মধ্য আদিবা আমার গালে আলতো পরশ দিয়ে বলল, “দোস্ত তোর দুই গালের লোমগুলা কিন্তু সেই। অনেক্কেই মানায় না বাট তোকে হেব্বি লাগে।” অর কথার পাত্তা না দিয়ে, কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললাম, “থামতো, স্যারের কথা শুন।”

স্যারের ক্লাস শেষ মানেই ছুটির ঘন্টা পড়ে গেছে। তড়িগড়ি করে ক্লাস রুম থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরলাম। গুনগুন করে গান গাইছি আর রাস্তার পাশে থাকা ঘাস ফুলগুলো টেনে-টেনে ছিরছি। তো বাড়ির গেইটে আসতেই কাকিমনি চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, “ওরে মিষ্টি, সকালে দেবের নতুন গান বের হইছে রে। ‘ওরে মন কথা শুন যাবি চল বীন্দ্রাবন, নাগরের নাগর দোলায় দুলবী নাকি বল‌ কাকির বেসুরা গলায় গান শোনার অপেক্ষা না করে খিচ্চা দিলাম দৌড়। ঘরে ঢুকেই কাঁধ থেকে ব্যাগ না নামিয়ে টিভি অন করে সংগীত বাংলা চ্যানেল দিলাম। টিভি অন করতে না করতেই গান এসে হাজির।

উচ্চ শব্দে গান শুনছি আর বাড়ির পোলাপানগুলাও সব এসে পড়েছে। আমার পরিবার দেবকে নিয়ে পাগলামি করাটা তাদের অভ্যাসে পরিণত করে ফেলেছিল বিধায়, আর কখনো কিছু বলেনি। যাই হোক পাশের বাড়ি থেকে একটা ফুপিও এসে টিভি দেখছিল। তো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে ফুপিকে উদ্দেশ্য করে বললাম, “রেশমী ফুপি, গালের লোমগুলো বেশি বড় হওয়ায় বেমানান লাগে। ফেসিয়াল করতে গেলে কত লাগে গো?” আমার কথা শোনা মাত্রই পাশের রুম থেকে আম্মা উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন, “আসেন সোনা পাখী, ময়না পাখী, তোতা পাখী আপনারে ফেসিয়াল করাই। হাতের সামনে ঝাড়ুটা রেডিই রাখছি।” তারপর থেকে আর দুই ঠোঁট দিয়েও ফেসিয়াল করার কথা মুখ দিয়ে বের করিনি।

নিস্তব্ধে আম্মার রুমের দিকে পা বারাচ্ছি। দরজায় সামনে গিয়ে উঁকি দিতেই দেখি আম্মা জামা-কাপড় ভাজ করে আলমারীতে রাখছে। দেখে মনে হচ্ছে মেজাজটা ফুরফুরে। সুযোগ বুঝে পেছন থেকে আম্মাকে জড়িয়ে ধরি। আম্মা অবাক না হয়ে মুখে রহস্যময় হাসি এঁকে বললেন, “কত টাকা লাগবে আম্মাজান?” কিছুটা লাজুক ভাব নিয়ে বললাম, “ওই তো ক্রীম কিনতে যত টাকা লাগে আর কী।” আম্মা এবার আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন, “কিসের ক্রীম?”

আমিও তাকে অবাক করে দিয়ে বললাম, “আমার ক্লাসের মেয়েগুলো একএকটা বলিউডের হিরোইন ঐশরিয়ার মতোন হয়ে গেছে। ওরা নাকি বারো ধরনের ক্রীম একসাথে মিক্স করে মুখে মাখে। তো অর্ধেক কথা মুখের মধ্য থাকতেই আম্মা চিল্লানী দিয়ে বলল, “আল্লাহ্ যে কাঁচা হলুদের মতোন গায়ের রঙটা দিয়েছে তা নিয়ে খুশি না? বারো ধরনের আটা, ময়দা, সূজি দিয়ে সাদা বিড়াল হইতে চাস?” আর কি কোনো কথা মুখ দিয়ে আসে? বিড়ালের মতোন চুপষে গিয়ে, নিঃশব্দে আম্মার রুম ত্যাগ করি।

আম্মা আমাকে অন্য সবকিছুতে বাধা দিলেও কখনো চুলের যত্নের বেলায় বাধা দেননি। কারণ আমাদের তিন বোনের মধ্য আমিই একমাত্র সৌভাগ্যবতী যে, আম্মার মতোন লম্মা, কালো, ঘন চুলের অধিকারীনি হয়েছি। তাই আম্মাকে যখনি বলতাম, ‘আম্মা শ্যাম্পু শেষ, আম্মা কুমারীকা তৈল কম অর্ধেক আছে, আম্মা কিছু টাকা লাগবে চুলের জট ছাড়ানোর জন্য লিভন কিনতে হবে।’ আম্মা তখন একটা কথাও মুখ দিয়ে বলতেন না। চুপচাপ টাকাগুলো হাতে দিয়ে দিতেন। তেমনি ভাবে একদিন এসে আম্মাকে বললাম, “আম্মা, একশো টাকা লাগবে।”

হাতের কাজ করতে-করতে বললেন, “কি হবে একশো টাকা দিয়ে?” আমি হাসিমাখা মুখে বললাম, “একটা দৌলহান তৈল কিনবো। মাথার চুল পড়া কমে, ঘন কালো আর আরো বেশি লম্বা করে।” কথাটা শুনা মাত্রই আম্মা ঝড়ের বেগে আলমারী খুলে একশো বিশ টাকা হাতে ধরিয়ে দিলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে আম্মার দিকে তাকিয়ে বললাম, “বিশ টাকা বেশি দিলেন কেন?” মুখে কিঞ্চিৎ হাসি এঁকে আম্মা বললেন, “বিশ টাকা তোর হাত খরচ।”

মাঝে-মাঝে ভেবে পাই না, চুলগুলো কি আমার নাকি আম্মার? আমার চুল নিয়ে তার যে কেন এত মাথা ব্যথা কে জানে? তবে হ্যাঁ তার একটাই কড়া আদেশ কখনো যেন চুল কেটে ছোট না করি। যাই হোক টাকা নিয়ে খুশি মনে স্কুলের পথে যাত্রা শুরু করলাম। সারাদিন ক্লাস শেষে ছুটির সময় স্কুলে গেইটে থাকা রুবেল ভাইয়ের দোকান থেকে দৌলহান তৈল নিয়ে বাড়ি ফিরি। তৈলটা আম্মার হাতে দিতেই তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগলেন। তারপর আমায় বললেন, “ড্রেস বদলিয়ে এখানে এসে বসতো সোনা মা। তৈলটা তোর মাথায় মাখিয়ে দেই।”

আম্মার আদেশ পাবা মাত্রই আমি জামা পাল্টিয়ে এসে আম্মার সামনে এসে বসে পড়লাম। আম্মাও তড়িগড়ি করে বোতলের ক্যাপ খুলে গড়গড় করে আমার মাথায় ঢেলে দিল। আম্মার এমন কাণ্ডতে আমিসহ আম্মাও পুরো আহাম্মক হয়ে রইলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই আম্মা এক বালতি পানি এনে আমার মাথায় ঢেলে বললেন, “সোনা মা, এ কেমন তৈল কিনে এনেছিস? কালো তো কালো আলকাত্তার মতো কালো।” ততক্ষণে আমার বুঝা শেষ যে, এ মুহূর্তে আমি তো আমি নাই, আমি মনে হয় মিতু আপাদের গাব গাছে থাকা কালো পেত্নীটার রূপধারণ করে আছি। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই নিজেকে নিজে দেখেই তিন মিনিট তাড়খাম্বার মতো ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিলাম। তারপর কি হয়েছিল আর কিছু মনে নেই।

সামনেই ঈদ। তাই ঈদ উপলক্ষ্যে সবাই সবার পছন্দের মতো ড্রেস কিনে ফেলছিল। বান্ধবীরা এসে বলল, “কিরে পঁচিশ রোজা তো চলে যাচ্ছে, ঈদের কেনা-কাটা করবি কবে?” আমি হেসে-হেসে বলেছিলাম, “ঈদের আগের দিন রাতে। মানে চাঁদ রাতে।” সেদিন বাসায় এসে দেখি, আম্মা বেগুনী, আলুর চ্প, পেয়াজু ভাজছিলেন। আমি আম্মার গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, “আম্মা, আমার বান্ধবীরা তো কেনা-কাটা করে ফেলেছে। আমরা শপিং করতে কবে যাবো?” আম্মা আগুনের তাপে ঘেমে একাকার হয়ে গেছেন। আঁচলে মুখ মুছতে-মুছতে বললেন, “আল্লাহ্ বাঁচালে কয়েকদিনের মধ্যেই যাবো।”

আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে আম্মাকে বললাম, “ওরা অনেকেই পাগলু২ ড্রেস আর আওয়ারা জুতা কিনেছে। আমাকেও কথাটা শেষ করার আগেই আম্মা বলে উঠলেন, “কাকের ঠ্যাং, মুরগীর ঠ্যাং, কুকুরের ঠ্যাং, এইসব নামে জামা-জুতা নামেনি মার্কেটে?” সেদিন আম্মার কথা শুনার পর পাগলু২ জামা আর আওয়ারা জুতা কেনার ইচ্ছে মিটে গিয়েছিল। তারপর আর এই নামগুলো মুখেও আনা হয়নি।

আম্মা দরজার সামনে বসে চাল বাছছিলেন। আমাদের তখন স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি পড়েছিল। তবে সামনে পরিক্ষা থাকায় হোসাঈন স্যার ছুটি দিলেন না। তার কাছে একমাত্র শুক্রুবার ছাড়া প্রতিদিনই প্রাইভেট পড়তে যেতাম। তো এমনি একদিন রোদেলা দুপুরে প্রাইভেট পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরি। এসেই আম্মার সামনে প্রায় সতেরোটা ছবি রেখে বলি, “দেখেন তো আম্মা আপনার মেয়ের জামাইয়ের সাথে আপনার আদরের মেয়েকে কেমন মানিয়েছে?”

আম্মা একটা-একটা করে ছবিগুলো দেখে, অগ্নি শিখা হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই ছেলে টিভির ভেতর থেকে কিভাবে বের হলো? আবার দেখি আমার মেয়েটাকে কিভাবে জড়িয়ে ধরেছে। ছিঃ…. তুইও পারলি কি করে? আমাদের মান সম্মান তো আর রাখলি না। যা হবার তো তা তো হয়েই গেছে। এই ছেলেকে ফোন করে বল তার বাবা মাকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসতে। তাকে বলবো যদি মুসলিম হতে পারে তবেই আমার মেয়েকে তার সাথে বিয়ে দেবো এর আগে না।” আম্মার কথায় আমি হাসবো নাকি কাঁদবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তবুও আরো একটু মজা নেওয়ার জন্য বললাম, “এ্যাহ্…..! এ ছেলের ঠ্যাকা পড়েছে মুসলিম হয়ে আমায় বিয়ে করবে।”

আম্মা এবার রাগান্বিত হয়ে বললেন, “তাহলে এমন বেহায়ার মতো ধরে রেখেছে কেন তোকে?” কথাটা বলেই আম্মা কাকিমনিদের জ্বলন্ত চুলায় সবকয়টি ছবি ঢুকিয়ে দিলো। আমি শুধু নির্বাক হয়ে ভাবছি কেয়া স্টুডিওতে গিয়ে, আকাশ ভাইকে দিয়ে, দেবের সাথে নিজের ছবিগুলো এডিট করাটাই বৃথা গেল। একটা দিনও নিজের কাছে রাখতে পারলাম না। সাথে প্রায় দুশো টাকা ধলেশ্বরী নদীর জলে ভেসে গেল।

বি:দ্রঃ ঘটনাগুলো প্রায় অনেক বছর আগের। তখন আল্লাহ্’র হেদায়েত প্রাপ্ত ছিলাম না বলেই পাপগুলো করেছি। জানি না কখনো আল্লাহ্’র কাছে ক্ষমা পাবো কিনা। আম্মার সাথে এমন অনেক মজার ঘটনা রয়েছে। যা লিখেও শেষ করতে পারবো না। আজ হঠাৎ করেই পুরানো সেই দিনের কথা মনের মধ্য উঁকি মারছিল। তাই মনের কথাগুলো প্রকাশ করলাম।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত