অভিশপ্ত বিয়ে

অভিশপ্ত বিয়ে

আপনি মেয়ের বাবা আপনাকে ৭০০ মানুষ খাওয়াতে হবে,এযুগে ৭০০ মানুষ খাওয়ানো আহামরি কিছু না, আমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছে,হাজার হাজার বন্ধু বান্ধব,এখনতো দেশের শীর্ষ স্থানীয় বেক্সিমকো কোম্পানিতে জব করে,নতুন নতুন হাই কোয়ালিটির মানুষের সাথে ওঠাবসা।

আসলে সত্যি কথা বলতে কি ৭০০ মানুষ খাওয়ানো একদম কম হয়ে যায়,এরচেয়ে কম হলে বিয়েটা ক্যানসেল করে দিন,ছেলের বিয়েতো আর ফকিরের মেয়ের সাথে দিতে পারি না।মান ইজ্জত বলে তো একটা কথা আছে।আমি ছেলের বাবা,আমিতো আর সমাজের চোখে ছোট হতে পারিনা,ছেলেকে মানুষ করতে লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি।

আপনি মেয়ের বাবা,আপনার মেয়েকে বড় করতে কয় টাকাই আর খরচ হইছে!!!শুনেছি পড়ালেখার খরচ ও নাকি সরকার দেয়,আপনি যখন মেয়ে জন্ম দিছেন,তখন মনে ছিলোনা এ মেয়ে একদিন বড় হবে,বিয়ে দিতে হবে!!!তখন থেকে খেয়ে না খেয়ে টাকা জমিয়ে মেয়ের জন্য রেখে দিতেন।বুঝলাম না আসলে মেয়ের বাপগুলোর কি হলো!!!আপনি মেয়ের বাবা,আপনার থেকে যৌতুক চাইনি,শুধু সমাজ রক্ষার্থে ৭০০ মানুষ খাওয়ানোর দাবী করছি,ধ্যাত ভুল জায়গায় এসেছি!!আজকাল ফকিরের মেয়ের বিয়েতেও মেয়ের বাবা আটশো,একহাজার মানুষ খাওয়ায়।

–জ্বি এখানে বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে,দুপক্ষেরই ছেলেমেয়ে পছন্দ হয়েছে,এখন বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে দরকষাকষি চলতেছে,ছেলের বাবার দাবি ৭০০ মানুষ খাওয়াতে হবে,অন্যদিকে মধ্যবিত্ত মেয়ের বাবা ৪০০ খাওয়ানোর কথা বলতেই ছেলের বাবা রেগেমেগে আগুন কোনভাবেই ৭০০ থেকে একজন ও কম হলে বিয়েটা হবেনা বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।মেয়ের বাবার কপালে হতাশার চাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,অতি আদরের মেয়ে,ভালো ছেলে,ভালো ঘর হাতছাড়া হয়ে যাওয়া কোনভাবেই মেনে নিতে পারলেন না তাই শেষমেষ ছেলের বাবার কথাই মেনে নিলেন।

সবই ঠিকঠাক কিন্তু মেয়েটা এ বিয়েতে রাজি নয়,মেয়েটার নাম সানজিদা আফরোজ,অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী,দেখতে খুবই মায়াবী,চোখগুলো হরিণের চোখের মত,মিষ্টি হাসি যে কাউকে মুগ্ধ করবে,সানজিদা দেখতে যতটা মায়াবী,তার আচার আচরণ ও এরচেয়ে বেশি সুন্দর,খুব বেশি কথা বলে না, আস্তে আস্তে গুছিয়ে কথা বলে।স্কুল কলেজে সবসময় ছেলেরা ওর পিছে ঘুরঘুর করে,সানজিদা ওদের সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে,

দেখুন,একজন হতভাগা বাবা কি চায় না তার আদরের মেয়েটাকে তারই হাতে স্বামীর ঘরে পাঠাতে””‘কে আছে আমাদের??? বিয়ের আগে বাবাই তো সব,বিয়ের পর বাবাই আমাদের স্বামীর কাছে পাঠায় একটু সুখে থাকার আশায়।অনেক ছেলেই এসব শুনে চোখ মুছতে মুছতে আপু পারলে মাফ করে দিবেন বলে চলে যেত।সানজিদা মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তাইলো ছোটবেলা থেকেই খুবই সৎ এবং পরিশ্রমী,ক্লাস সেভেন থেকে টিউশনি করে পড়াশোনা করতেছে,সানজিদার বাবা সামান্য বেতনের স্কুল শিক্ষক,সামান্য বেতন হলেও অনেক সম্মানিত ব্যক্তি।

সানজিদার বাবা মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে চারদিক থেকে ধারদেনা করে টাকা নিচ্ছে,কোথাও বউয়ের গহনা বন্ধক দিয়ে সুদের উপর টাকা নিচ্ছে,কোথাও জমির দলিল বন্ধক দিয়ে টাকা নিচ্ছে,প্রতি হাজারে মাসে ১০% অর্থাৎ ১০০ টাকা করে সুদ দিতে হবে।সবমিলিয়ে ১০ লাখ টাকা ধারদেনা করলো,নিজের ধানের জমি বিক্রি করে ১০ লাখ পেয়েছে।২০ লাখ টাকা দিয়ে মেয়েকে বেশ জাঁকজমক করে বিয়ে দেওয়া যাবে।

অন্যদিকে সানজিদার মা বারবার ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ভাবছে,সানজিদার বিয়েতেই যদি এত টাকা খরচ হয় বাকি ছেলেমেয়েদের মানুষ করবে কিভাবে??সানজিদার ছোট দুই ভাই,দুই বোন আছে।সবাই পড়াশোনা করে,মাস শেষে সামান্য স্কুল শিক্ষকের সব টাকা এদের পিছেই খরচ হয়।

সবকিছু উপেক্ষা করে সানজিদার বাবা মেয়েকে বিয়ে দিবে,বিয়ের আয়োজন করলো,বেশ ধুমধামে,ছেলে পক্ষের ৭০০ মানুষ আসার কথা থাকলেও ১২০০ মানুষ এসেছে,অন্যদিকে নিজ সমাজের এসেছে আরো ৫০০,মোট ১৭০০ মানুষ,সবমিলিয়ে ছেলে পক্ষের ২০ থেকে ২৫ জন খাবার পায়নি,এ নিয়ে ছেলে পক্ষ এবং মেয়ে পক্ষের কথা কাটাকাটি।

যাই হোক সানজিদার বাবা সবার কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চায়,তারপর পরিবেশ কিছুটা শান্ত হয়,পরিশেষে বিয়ের কাজটা সম্পন্ন হয়।সানজিদার কান্নায় থমথমে পরিবেশ সৃষ্টি হয়,মা বাবা ছোট ছোট ভাইবোন সবাই কান্নাকাটি করে,কিছুক্ষণ পর সানজিদার বাবা বরের হাতে তুলে দিয়ে একটা কথাই বলে বাবা আমার মেয়েটাকে সুখে রেখো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে।

সানজিদা শশুড়বাড়ি চলে যায়,সেখানে গিয়ে শুনতে পায় সবাই খাওয়া দাওয়া নিয়ে বদনাম করছে,সানজিদা শাশুড়ি তো বলেই দিলো ফকিরের মেয়ে বিয়ে করালে যা হয়, ১২০০ মানুষও ঠিকমত খাওয়াতে পারে না,সানজিদার শশুড়বাড়ির লোকজন খাবারের স্বাদ নিয়েও প্রশ্ন তুলছে,গরুর মাংসে জাল একটু বেশি হইছে,রুই মাছ না দিয়ে চিংড়ি মাছ দেওয়া উচিত ছিলো,ইত্যাদি ইত্যাদি সাথে যারা রান্না করছে তাদের ও বদনাম করছে।

সানজিদা এসব শুনে চুপচাপ কান্না করছে,জামাই এসে দেখলো সানজিদা কাঁদছে,ভাবলো নতুন বউ,সবেমাত্র শশুড়বাড়িতে এসেছে,তাই হয়তো বাড়ির কথা মনে করে কাঁদছে,সানজিদার চোখের পানি মুছতে মুছতে বললো,দেখ সানজিদা সব মেয়েকেই একদিন নিজের ঘর ছেড়ে স্বামীর ঘরে আসতে হয়,আমি তোমার স্বামী,তোমাকে সবসময় সুখে রাখার চেষ্টা করবো,তুমি শুধু আমার জন্য দোয়া কর,সানজিদাকে বুকে টেনে নিলো,স্বামীর কথাগুলো শুনে কিছুটা শান্ত হলো।

অন্যদিকে সানজিদার বাবা বিয়ের পর পরই বিয়েতে কত খরচ হলো তা হিসাব করতে লাগলেন,গরু ৯ টার টার দাম ৮ লাখ টাকা, খাসি ১৮ টার দাম ৪ লাখ,রুইমাছ ৭০০ কেজির দাম ২ লাখ ১০ হাজার টাকা,মোরগ ৮০০ কেজির দাম ১ লাখ ৯০ হাজার,এছাড়াও বিভিন্ন কাঁচা বাজার সহ রান্নায় ব্যবহৃত উপাদান,গেইট খরচ থেকে শুরু করে সব যোগ করলো = মাত্র ২৪ লাখ টাকা খরচ হইছে।

সানজিদা বাবা বেশ হতাশ,ভেবেছে ১৫ লাখ টাকায় হয়ে যাবে,বিয়ের পর আবারো ধারদেনা শুরু করলো,বাবুছি খরচই দিলো ৫২ হাজার,গেইট খরচ দিলো ৮৮ হাজার।সবমিলিয়ে সানজিদার বাবা ১৬ লাখ টাকা দেনা,মাসে মাসে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়,সামান্য বেতনের স্কুল শিক্ষক এ টাকা না দিতে পেরে প্রতিদিন পাওনাদারদের কথা শুনতে হয়।যার জন্য বাড়ির বাহিরের জমি বিক্রি করে মাস শেষে সুদের টাকা শোধ করে,আসল দেওয়ার তো সামর্থ্য নেই।

এতকিছুর মধ্যে ও সানজিদার বাবা শশুড়বাড়িতে ঘর সাজানোর সমস্ত জিনিসপত্র,খাট পালাং, সোফাসেট,ফ্রীজ,আলমারি,হাঁড়ি পাতিল,লেপ তোষক,কম্বল, পাঠায়,যাতে করে,মেয়ের মুখ বড় থাকে,একটু শান্তিতে থাকে স্বামীর সংসারে। সানজিদা বেশ সুখেই আছে,মনের মতো স্বামী পেয়েছে,একজন অন্যজনকে ছাড়া দুই মিনিট ও থাকতে পারে না।

এদিকে গ্রীষ্মকাল এসে গেছে,সানজিদার শাশুড়িবাড়ি থেকে গ্রীষ্মকালীন ফল ফালাদী পাঠানো জন্য সানজিদাকে চাপ দিচ্ছে,সানজিদাও বাবার বাড়ি এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে এসব বলে,বাবা নিরুপায় তারপরও ধারদেনা করে ৩০ কেজি আম,২৫ টা কাঠাল,৪০ জোড়া আনারস,২০ কেজি জাম সহ বিভিন্ন ফল ফালাদি পাঠায় শশুড়বাড়িতে।এসব পেয়ে তো শশুড়বাড়ির লোকজন প্রসংসায় পঞ্চমুখ,সবাই বেহাই সাহেবকে বড় মনের মানুষ বলে আখ্যা দেন।

কিছুদিন পর রমজান মাস আসলো শশুড়বাড়িতে ১ বস্তা ছোলা,১০ কেজি মুড়ি,১০ কেজি ভালো মানের খেজুর যেটার কেজি ৬০০ টাকা,সবমিলিয়ে একটা বস্তায় করে পাঠালো,টাকা???সেটাতো গরীব স্কুল শিক্ষক ধারদেনা করে নিচ্ছে।

কিছুদিন পরই ঈদ,ঈদের সেমাই চিনি না পাঠালে মেয়েটাতো শশুড়বাড়িতে ছোট হয়ে যাবে,আবার ভালো মানের ২০ প্যাকেট সেমাই,৫ কেজি চিনি, ৫ কেজি সাখুদানা,আতপ চাউল ১০ কেজি,নুডলস ১ কাঠন,২০ টা হালিমের প্যাকেট আরো যা যা আছে সব মিলিয়ে বস্তায় করে শশুড়বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।

আবার আসলো শীতকাল থাক বললাম না এরপর ঈদুল আজহা অর্থাৎ কুরবানীর ঈদ এলো শশুড়বাড়ি থেকে আগেই বলে দিছে বড় দেখে গরু পাঠাতে, ছাগল টাগল দিলে হবে না,মেয়েটা কোন সরম নিয়ে এ বাড়িতে থাকে দেখমু,সানজিদার বাবাও ধারদেনা করে বড় দেখে একটা গরু মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে কিনলো,,পাঠালো শশুড়বাড়ি।

সবই ঠিকঠাক ছিলো কিন্তু সানজিদার বিয়ের ১ বছর হয়ে গেল এখনও বাচ্চার নাম গন্ধ নেই,এ নিয়ে শশুড়বাড়ির লোকজনের মুখে শুনতে হয় হাজারো কথা। অন্যদিকে সানজিদার বাবা ধারদেনায় মধ্যে ডুবে থাকে, প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা সুদ দিতে হয়,আস্তে আস্তে সবকিছু বিক্রি করে দেয়, সানজিদার বাচ্চা না হওয়ায় স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়,যা ছিলো অমানবিক।

সানজিদা বাবার বাড়িতে চলে আসে,কিছুদিন পর পাওনাদাররা টাকার জন্য ঘরবাড়ি সব দখল করে নেয়,তাদের ঘর থেকে বের করে দেয়। এখন তারা বেশ সুখেই আছে,রেল লাইনের ধারের কোন এক বস্তিতে থাকে,সানজিদা ও বেশ ভালোই আছে মাঝে মাঝে স্বামী সংসার এসব ভেবে কান্নায় ভেঙে পড়ে।

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত