” ৩ টা বছর হয়ে গেলো এখন পর্যন্ত আমি বাবা হইতে পারলাম না। তোমারে ক্যান যে আমি বিয়া করছিলাম!! আমার জীবনডাই শেষ।” শামিম বিরক্ত নিয়ে তার স্ত্রী সিমাকে বলল। সিমা চুপচাপ বসে আছে। শামিম আবার বলল,” কত ডাক্তার কত কিছু করলাম তাও কোনো কাজ হইলো না। আর কত!!” এবার সিমা আস্তে করে বলল,” গ্রামের ডাক্তাররা ভালো না। তারা কেমন জানি চিকিৎসা করে। তার চেয়ে আমরা যদি শহরের ডাক্তাররে দেহাই হেইডা কিন্ত ভালো হইবো। এইসব ডাক্তাররা খালি ঔষধ ধরায় দেয়। আমার ভালো লাগে না।” শামিম ক্ষিপ্ত হয়ে বলল,” তোর পিছনে আর কত টাকা নষ্ট করবো?? তোর জন্য কি এখন আমি ফকির হয়ে যাবো??” শামিমের ধমক খেয়ে সিমা চুপসে যায়। আর কোনো কথা বলার সাহস পায়না।
৩ টা বছর ধরে চেষ্টা করের সন্তানের মা হতে পারছে না সিমা। গ্রামের ডাক্তারের কাছে গেলে এটা ওটা অনেক ঔষধ ধরিয়ে দেয় খালি। যা খেয়ে কোনো লাভই হয়না। উল্টো শরীর আরো খারাপ করে সিমার৷ সিমা ম্যাট্রিক পাশ মেয়ে। ইন্টার পড়ার আগেই তাকে বিয়ে দিয়ে দেয় তার বাবা-মা। সিমার স্বামী একজন কন্টাক্টার। বাড়ি বানায়। ভালোই টাকা আয় করে। শিক্ষাগত যোগ্যতা তার খুবই কম। কিন্তু তার কাজে সে অনেক পটু। তাই সিমার বাবা-মা শামিমের কাছে সিমাকে বিয়ে দেয়। সিমা দেখতে বেশ সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী। কিন্তু শামিম সিমাকে বিয়ে করে অনেক কষ্টে আছে। কারণ বিয়ের তিন বছরের মাথায়ও সিমা এখনো মা হতে পারেনি। শামিম সারাদিন সিমাকে কথা শুনায়। সিমা মুখ বুঝে সব কথা শুনে। সে কিছুই বলতে পারে না। কারণ সে অধিকার এ সমাজ তাকে দেয় না। শামিম এবার কড়া গলায় বলে,
শামিমঃ একজন কবিরাজের খবর পাইছি। কালকে তোকে তার কাছে নিয়ে যাবো। এরপরও যদি কিছু না হয় তাহলে দেখিস তোকে কি করি। রাগী ভাবে।
সিমা অনেক ভয় পেয়ে যায়। ভয়ে কিছুই বলতে পারছে না। ও এসব কবিরাজ টবিরাজের কাছে যেতে চায় না। ওর ইচ্ছা শুধু একটাই, একবার শহরের ডাক্তার দেখানো। মেয়ে মানুষ তার উপর মা হতে পারছে না। সিমা যেন এখন এ বাড়ির বোঝা। তার সাথে কেউই ভালো আচরণ করে না। শ্বাশুড়ি সারাদিন কথা শুনায় আর অত্যাচার করে। এভাবেই কাটে সিমার জীবন।
পরদিন সকালে শামিম সেই কবিরাজের কাছে নিয়ে যায় সিমাকে। সেখানে আরো অনেকজন ছিল। তাদের কারো কারো হাতে পানির বোতল, তেলের বোতল, চাল ভাজা, আবার কিছু ছেলে-মেয়ের হাতে বইও। শামিমের সিরিয়াল পরলে শামিম সিমাকে নিয়ে ভিতরে যায়। সিমা দেখে, শার্ট প্যান্ট পরা একজন লোক। তার স্বামীর বয়সীই হবে বোধহয়। লোকটার সামনে কীসব যেন হাবিজাবি রাখা। তার গলায় আর হাতে বিভিন্ন ধরনের তবজির মতো কীসব যেন পরা। চেহারায় কেমন জানি এক শয়তান শয়তান ভাব। সিমার মোটেও ভালো লাগছে না এখানে। কবিরাজ শামিমকে আর সিমাকে বসতে বলল। তারা বসলে সিমা খেয়াল করে কবিরাজ কেমন কেমন ভাবে জানি সিমার দিকে তাকাচ্ছিল। সিমার অসহ্য লাগছিল তখন।
শামিমঃ ভাই, ৩ বছর হইয়া গেলো কিন্তু আমার বউডার কোনো বাচ্চা হইতাসে না। আপনার কাছে বলে সব রোগের চিকিৎসা আছে। দেখেন না ওর কি হইছে।
কবিরাজঃ আপনি বাইরে গিয়া বসেন আমি একান্ত ভাবে দেখছি।
শামিমঃ জ্বি ভাই।
শামিম সিমাকে একা রেখে বাইরে চলে গেলো। সিমার খুব খারাপ লাগছে এখন। এসব মোটেও ওর ভালো লাগছে না। শামিম বাইরে গেলেই কবিরাজ সিমাকে বলে,
কবিরাজঃ ওই খাটে গিয়ে শুয়ে পরেন।
সিমা অনিচ্ছা সত্ত্বেও গিয়ে শুয়ে পরে। কারণ সিমাও চায় ওর একটা সন্তান হোক। সিমা শোয়া মাত্রই কবিরাজ সিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। আর সিমাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখতে থাকে। সিমা স্পষ্ট বুঝতে পারছে এটা কোনো স্বাভাবিক দেখা না। উনি খারাপ ভাবে সিমাকে দেখছে। এরপর কবিরাজ যা করলো সিমা বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। কবিরাজ সিমার পেটে হাত দিয়ে সমানে টিপছে। সিমার পুরো শরীরে এখন যেন আগুন জ্বলছে। হঠাৎই কবিরাজ সিমার গলার আশেপাশে, গালে, ঠোঁটে হাত বুলাচ্ছে। আর যখনই বুকের কাছে হাত নিতে যাচ্ছিলো সিমা একলাফে উঠে বসে আর হাপাতে থাকে।
সিমাঃ কি করতাছেন এসব?? এসব কি?? বিরক্ত নিয়ে।
কবিরাজঃ না মানে আপনার কি সমস্যা তা দেখছিলাম।
সিমাঃ এইভাবে কেউ দেখে?? রাগ নিয়ে।
কবিরাজঃ আপনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছেন শুধু শুধু। আচ্ছা আসেন হইছে আপনাকে দেখা। সিমা তার আগের জায়গায় গিয়ে বসে৷ কবিরাজ শামিমকে ডাক দেয়।
শামিমঃ ভাই কি অবস্থা ওর??
কবিরাজঃ ওনার সমস্যা আছে অনেক। আমি দেখলাম। ওনাকে আমি যা বলবো তাই করতে হবে। তাহলেই উনার সন্তান হবে৷
শামিমঃ জ্বি ভাই বলেন বলেন।
কবিরাজঃ ওনাকে কাল সকাল ৫ টা থেকে আগামী ১০ দিন না খেয়ে শুধু পানি খেতে পারবে। আপনার বাসার পাশে যে পুকুরটা আছে সেখানে আমার এই পানি পড়াটা ঢেলে ওনাকে প্রতিদিন ৫ ঘন্টা গলা পর্যন্ত ডুবে থাকতে হবে। তাহলে সেই পানিতে ওনার সব রোগ ধুয়ে যাবে। আর ওনার সন্তান হবে। সিমা রীতিমতো কাঁপছে এসব আজগুবি কথা শুনে। সিমা আস্তে করে শামিমকে বলে,
সিমাঃ আমি এসব করতে পারবো না। এসব করলে কোনো দিনও বাচ্চা হবে না। শামিম চোখ বড় করে রাগী গলায় বলে,
শামিমঃ চুপ। উনার কাছে দূর দূর থেকে লোকজন আসে। উনার উপরে কথা বলস। উনি যা বলছে তাই করবি। আমার সন্তান চাই ব্যাস।
শামিমঃ ভাই কত দিবো??
কবিরাজঃ দেন খুশী হয়ে যা। তিন হাজার দিলেই হবে। এর বেশি আমি নি না। আর এই পানি পড়াটা একদম ফ্রী দিলাম আপনাকে। নেন। শামিম খুশী হয়ে কবিরাজকে তিন হাজার টাকা দিয়ে চলে আসে সিমাকে নিয়ে। ওরা গেলে কবিরাজ বলে,
কবিরাজঃ আমাকে অপমান না। এবার বুঝ কষ্ট কারে কয়। হুদাই মাতাল পাবলিক সব। এরপরের দিন থেকে শুরু হয় সিমার উপর নির্যাতন। স্বামী আর পরিবারের জোরাজোরিতে কবিরাজের কথা শুনতে বাধ্য হয় সিমা। না খেয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে বসে থাকতে থাকতে ৬ষ্ঠ দিন সিমা এমন অসুস্থ হয় যে সিমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারেনি। সিমার প্রচন্ড জ্বর আর দুর্বল হয়ে পরায় সিমা দুনিয়া ত্যাগ করে স্বামীর সন্তান কামনা পূরণ করতে গিয়ে।
এই হলো আমাদের কথিত কবিরাজদের অবস্থা। কবিরাজ, ওঝা কিংবা ফকির যাহাই বলেন তারা সবাই একই শ্রেণির। এরা ইসলামের বাইরে। এদের কাছে যারা যায় তারা সরাসরি মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক করে। কারণ একমাত্র আমি আবার বলছি একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো প্রতি আমাদের বিশ্বাস করা যাবে না। সবার প্রথম আল্লাহ তায়ালার কাছে সাহায্য যেতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে এসব রোগের জন্য আমরা কি করবো?? এর জন্য ডাক্তার আছে। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় একমাত্র একজন ডাক্তারই পারে আমাদের বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত করতে। কারণ ডাক্তার হলো আল্লাহ তায়ালার উছিলা। তাহলে কি এরা আল্লাহ তায়ালার উছিলা না?? না। কারণ এরা ইসলামের বিধি বিধান মেনে চিকিৎসা করে না। এখন প্রশ্ন হলো তাহলে জ্বিন কিংবা পরী দ্বারা আক্রান্ত হলো তখন আমরা কি করবো?? তখন আমরা একজন ভালো হুজুর কিংবা আলেমের কাছে যেতে পারে। তবে অবশ্যই যাচাই বাছাই করে। দেখতে হবে তিনি সম্পূর্ণ ইসলামিক পথে তার কাজ করেন কিনা। জ্বিন কিংবা পরীরা একমাত্র আমাদের পবিত্র কুরআন শরীফকে ভয় পায়। তাই এই হুজুর কিংবা আলেমগণ আমাদের কুরআন শরীফের সাহায্য নিয়ে এদেরকে তাড়িয়ে দেন। তাই এদের কাছে যাওয়া যায়।
আমাদের শারীরিক সকল সমস্যার জন্য ডাক্তার রয়েছে। তারা অনেক পড়াশোনা করে একজন ডাক্তার হয়েছে। তাদের সাথে কখনোই কবিরাজের তুলনা হয়না। কারণ একজন ডাক্তার কখনোই চাবেন না তার পেশেন্টটা কষ্ট পাক বা তার কিছু হয়ে যাক। কিন্তু কবিরাজরা সবসময়ই উদ্ভট চিকিৎসা দিয়ে থাকে যা আমাদেরকে অনেক কষ্ট দেয় এবং আমাদের ধর্মকে ছোট করে। একজন কবিরাজ কখনোই ইসলাম ধর্মের হন না। কারণ হলে তিনি এসব কখনোই করতে পারতেন না। সে শুধু শয়তানের পূজারী হয়ে থাকে। যার কারণে শয়তানের সাহায্য নিয়ে গুটি কয়েকজন হয়তো মানুষের সেবা দিয়ে থাকে। যা আমরা দেখে তার ভক্ত হয়ে যাই। যার ফলে আমরাও শিরক করে ফেললাম আল্লাহ তায়ালার সাথে। শিরককারীর কোনোও মাফ নাই।
আমরা অনেকেই সবার সামনে ভালো সেজে কিন্তু সবার আড়ালে ঠিকই এসব কবিরাজ কিংবা ওঝাদের কাছে যেয়ে থাকেন। জেনে রাখুন আপনি যেদিন তার কাছে গিয়েছেন সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আপনি আমার মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে শিরক করে আসছেন। আপনি আল্লাহকে বিশ্বাস না করে মাটির তৈরি আপনার মতোই আরেকজনকে আপনি বিশ্বাস করেছেন। এর কোনো মাফ নাই। যদি আল্লাহ না করেন।
অবশেষে বলতে যাই, পানি পড়া, তেল পড়া কিংবা বই পড়া দিয়ে কোনোদিন কোনো কিছু হয়না। তার চেয়ে আল্লাহ তায়ালাকে দৃঢ়ভাবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে জায়নামাজে বসে আল্লাহর কাছে আপনার দুফোঁটা চোখের জল আপনার সকল সমস্যা থেকে মুক্তি দিতে পারে। কিন্তু এসব কবিরাজের কাছে গিয়ে নিজের সুস্থতা বা অন্যের ক্ষতি কামনা করলে জেনে রাখুন আপনি মহান আল্লাহ তায়ালার সাথে সরাসরি শিরক করছেন। মৃত্যুর পর আপনার জন্য জাহান্নামের কঠিন আগুন আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
জীবনে যাহাই করুন ভেবে চিন্তে যাচাই বাছাই করে তারপর করুন। সবচেয়ে মজার কথা কি জানেন, শামিম কিন্তু তার স্ত্রী সিমার মৃত্যুর পর আবার বিয়ে করে ছিলো। সেখানেও তার সন্তান হচ্ছিলো না। তখন সে শহরের ডাক্তারের কাছে যায়। এবং ডাক্তার দুজনকেই পরীক্ষা করে জানতে পারে আসলে সমস্যা সিমার ছিল না, সমস্যা ছিল শামিমের নিজের। কিন্তু অসহায় সিমাকে কোনো অপরাধ ছাড়াই তার জীবন দিতে হলো এই ভন্ড কবিরাজকে বিশ্বাস করে।
সমাপ্ত