গুটিবাজ বউ

গুটিবাজ বউ

মেয়েরা যে আসলে কি রকম ধুরন্ধর হয় আগে টের পাইনি। কত যে মিঠা মিঠা কথা বলে আমার মনটা খেয়েছে ভাবলেই এখন শিউরে উঠি। আমি সবসময়ে চেয়েছি এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে যে বই পড়ে। কবিতা পড়ে। অন্তত আমার বই পড়া নিয়ে যেন কোন সমস্যা না নয়। আল্লাহ্ মানুষের ভাল ইচ্ছে গুলো পূরণ করেন। পেয়েও গেলাম এমন একটা মেয়ে। তথাকথিত অন্য মেয়েদের মতো রূপচর্চা বা সব কথাকে রান্নার রেসিপিতে নিয়ে যায় না। বা এটাও বলে না যে, কোন ছেলে তার জন্য পাগল। কে কে প্রপোজ করেছে ব্লা ব্লা ব্লা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দারুণ আড্ডা দেয়া যায়। আর এটাই চেয়েছি বউ যেন আমার sসবচেয়ে ভাল বন্ধু হয়। ইয়ার দোস্ত যাকে বলে।

এমন মেয়ে হাতছাড়া করা মানেই হলো বোকামি। তাড়াতাড়ি ঘরে তুলে না আনলে সারা জীবন পস্তাতে হবে। সমস্যা হলো ফ্যামিলীতে বিয়ের কথাটা তোলা। কি করবো ভাবছি। কারণ ওকে অনেক ভালোবাসি। কতটা ভালোবাসি সেটা আসলে বলার কিছু নেই।

বিয়ে নিয়ে প্রায় সময় কথা হয় আমাদের। মনে মনে অনেকদিন থেকেই ভাবছি যৌতুক প্রথা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে একটু ভিন্নভাবে। শ্বশুরের কাছ থেকে কয়েক তাক বই তো নেয়াই যায় এতে তো খারাপ কিছু নেই তাই না। যদিও এখনো বিয়ে হয়নি আমাদের তবুও ওকে আমি বউ বলেই ডাকি।

“আচ্ছা বউ তোমার আব্বু আমাকে যৌতুক দিবে না?”
“কি বললে যৌতুক। তোমাকে ঝাঁটার বারি দিবে।”
“এহ কি যে বলো না। মেয়ের জামাইকে কেউ ঝাঁটার বারি দেয়h নাকি ছি!”
“যৌতুক চাইলে দিবে। কেমন ছেলে তুমি এই যুগে যৌতুক চাও।”
“আরে বাবা আমি কি আমার জন্য চাইছি নাকি। তুমি সারাদিন বাসায় একা একা থাকবে। তোমার কথা ভেবেই তো চাইছি।”
“মানে?”

পুনার হাতটা কোলের উপরে নিয়ে দুই হাতে শক্ত করে ধরলাম।
“আমরা দুজনেই তো বই পড়ি তাই না। তো তোমার বাবা যদি আমাদের বিয়েতে দুই তিন সেলফ বই যৌতুক দেয় তো ক্ষতি কি। আর ইটা যৌতুক না মনে করে গিফট মনে করলেই তো হয়ে যায় তাই না।”
“ইস কি শখ।” বলেই পুনা ঝাপটা মেরে হাতটা সরিয়ে দিলো।
“আরে বাবা সমস্যা কি। বই ই তো চাইছি। সোনার চেইন আর সাইকেল তো চাই নাই নাকি।”
“নো। aএইসব হাংকি পাংকি চলবে না। তবে তোমার জন্য একটা ছাড় দিতে পারি।”
“কি ছাড়।”
“তুমি যদি আমায় এক হাজারের মতো বই বিয়েতে উপঢৌকন হিসাবে দাও তাহলে তোমার থেকে বিয়ের সময় ঐ সব শাড়ি গহনা নিবো না। রাজি তো?”

আমি হিসাব করতে পারলাম না যে স্বর্ণের দাম কেমন এখন। বা এই সব শাড়ি গহনার দাম কেমন হতে পারে। নিশ্চয়ই এক হাজার বইয়ের কাছাকাছি হবে। নইলে পুনা আমায় এই প্রস্তাব দিতো না। হাজার হোক ও আমার বউ হবে। তাই এতোকিছু না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। আমার এমনিতেই এইসব বৈষয়িকk ব্যাপারে ধারণা কম।
“আচ্ছা ঠিক আছে রাজি। তোমাকে দুই হাজার বই দিবো।”
অতি উৎসাহে আরো এক হাজার বই বাড়িয়ে দিলাম। ধরাটা আমি এখানেই খেয়েছিলাম। অনেকেই বুঝতে পারছেন হয়তো কি ধরা। এই গল্পের কোন টুইস্ট নাই। তাই না বোঝারও কিছুই নাই।
“সত্যি! ওকে! আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই তোমায় লিস্ট করে দিবো কেমন।”
“আচ্ছা দিও। আমিও লিস্ট করি তাহলে। দুই জনের পছন্দে মিলিয়ে ঝুলিয়ে কিনলাম আর কি।”
“নো। তোমার কোন পছন্দ অপছন্দ নাই। বই গুলা আমার জন্য গিফট। আমার পছন্দে কিনতে হবে। আর শোন সেই বই তুমি কখনো ধরেও দেখতে পারবা না। ধরলে একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবো।”
কি জ্বালা যন্ত্রণা আমার বউয়ের বই আমি ধরতে পারবো না। এ তো রীতিমতো অবিচার। মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমি এই অনিয়মের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে যাবো এমন সময় পুনা আবার বলল।
“কোন লাভ নাই সোনার চান পিতলা ঘুঘু। আমি যা বলি তা। আমার কথা না রাখলে তোমার আম্মুকে গিয়েই বলে দিবো তুমি আমার কাছে যৌতুক চাইছো। বাকিটা তুমি ভেবে দেখো আমার হবু শাশুড়ি আম্মা তোমার কি হাল করবে তাহলে।”
কি যে এক গ্যারাকলে পড়ে গেলাম। l পুনাকে আম্মু নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসে। যদিও জানে যে ও আমার বন্ধু। কিন্তু ছেলের বউ করতে একটু সময়ও হয়তো ভাববে না। মানে এতোটাই পছন্দ করে আরকি। তবুও বিয়ের কথা তুলতে সাহস পাই না।
“আরে ধুর কি যে বলোনা এসব। চল আইসক্রিম খাই।”
“হিহিহি! তুমি যে কিসের পাল্লায় পড়ছো এখনো টের পাও নাই।”

মনে মনে ভাবি টের পাই নাই আবার। হাড়ে হাড়ে, শিরায় শিরায়, গিরায় গিরায় টের পাচ্ছি। আর এই পুনাকে আমি এই কারণেই পাগলের মতো ভালবাসি। আমি এটাও জানি আমি ওকে যতোটা ভালবাসি পুনা আমায় তারচেয়েও কয়েক শত গুন বেশি ভালবাসে।

অফিসের কারণে আমাদের প্রতিদিন দেখা হয় না। প্রতি বুধবার আর শুক্রবারr দেখা করি আমরা। কিন্তু ফোনে কথা হয় প্রতিদিন। বুধবার হলো আমাদের চিঠি চালাচালির দিন। এই যুগে এসেও আমরা সেই চিঠির সময়ে আটকে আছি। মজা ব্যাপার হলো চিঠি নিয়ে কোন কথাই আমরা বলি না। চিঠির উত্তরে চিঠি দেই। চিঠি চালাচালি হয় প্রতি সপ্তাহে। এই চিঠির কারণে আমরা এতোটা কাছাকাছি আজ। মনের কথা গুলো চিঠি ছাড়া প্রকাশ করার আর কোন সেরা মাধ্যম আমাদের দুই জনের জানা নেই। এই যে এতো পাগলী পাগলী পুনা আমার। সারাক্ষণ আমায় জ্বালিয়ে মারে। এই পুনার একেকটা চিঠি পড়ার সময় আমি চাই যে চিঠিটা যেন শেষ না হয়। এতো ভালবাসা কেউ বুকে কি করে ধারণ করে রাখে আমি বুঝতেই পারি না।

বাসায় বিয়ের ব্যাপারে এক সময়ে সব ঠিক হয়ে গেল। পুনাকে আঙটি পরিয়ে এলাম। বিয়ের কথা বার্তাও চলছে। এদিকে প্রায় হাজার খানিক বই কিনা শেষ। পুনা তাড়া দিয়েই যাচ্ছে যেন বাকি বই তাড়াতাড়ি কিনে ফেলি। কেন এতো তাড়া তখন যদি বুঝতাম!

বাসায় মা বাবা আপুরা বলাবলি করছে শাড়ি গয়না কি কি দিতে হবে। আমি ওদেরকে বলতেই পারছিনা যে পুনার তো এইসব লাগবে না। ওকে এর বিনিময়ে বই দিচ্ছি। কিন্তু কথাটা তুলতেই পারছিনা। পুনার সাথে এটা নিয়ে ফোনে কথা বলে একটু হালকা হলাম।

“আচ্ছা বাসায় তো তোমার শাড়ি গহনা নিয়ে কথা বলছে কি করি বলতো?”
“আরে এসব ভাবার কি দরকার। আমার তো এইসব দরকার নাই। তুমি দুই হাজার বই দাও তাহলেই হবে। প্লিজ তাড়াতাড়ি বাকি বই গুলো কিনে ফেল। আর ভুলেও কিন্তু বলবে নাn কাউকে কেন এতো বই কিনছো।”
“কেন বললে সমস্যা কি?”
“সে তুমি বুঝবানা।”
“সে নাহয় না বুঝলাম কিন্তু আম্মু আর আপুদের কি বলি।”
“শোন তোমার কিছু বলার দরকার নাই। বিয়েতে এসব নিয়ে কথা হয় ই।”
“ওহ আচ্ছা।”

কিন্তু বিয়ের এক মাস আগেই পুনার আসল রূপ বের হয়ে গেল। ততোদিনে আমি দুই হাজার বই কিনে আমার পুরো রুম ভর্তি করে ফেলেছি। আপুদের সাথে গিয়ে পুনা শাড়ি পছন্দ করে এলো। গয়নার মাপও দিয়ে এলো।
“পুনা তোমারে একটা আছাড় মারতে পারলে একটা পাশবিক সুখ পাইতাম আমি।”
“হিহিহি! এই এখানেই মারবে নাকি বিয়ের পরে ঘরে তুলে আছাড় মারবে। এইখানে সবার সামনে মারতে চাইলে বলো তোমার কোলে উঠি।”
“ইয়ার্কি করবা না। তোমার মতো গুটিবাজ মেয়ে আমি জিন্দেগিতে দেখি নাই।”
“আহা এইভাবে বলেনা ছি! লোকে কি বলবে। নিজের বউকে কেউ গুটিবাজ বলে বুঝি।”
“ন্যাকামি করবেনা একদম। কত মধুর মধুর কথা। শাড়ি গহনা কিছুই চাইনা আমি এক হাজার বই হলেই হবে। আর এখন!”
“হিহিহি! তুমি এতো বোকা এটা তো তোমার সমস্যা। আমার সমস্যা না। আমি আমার অধিকার ছাড়বো কেন শুনি। আমার সবই লাগবে। শরীর ভর্তি শাড়ি গহনা। রুম ভর্তি বই। সবই চাই আমার বুঝলা সোনার চান পিতলা ঘুঘু। আর বইয়ের জন্য আমার জামাইর সাথে চুরি বাটপারি গুটিবাজি সবই করতে রাজি আছি আমি। হিহিহি!”

এমন গ্যারাকলে পড়েছি কোন উপায় নেই বের হওয়ার। পুনা একেবারে ফতুর করে দিলো আমায়। বিয়ের সব আয়োজন চলছে। আমাকে এইসবে কেউ জড়ায় না। কারণ এইসবে আমি আজীবন উদাসীন। বুঝি কম। আপুরাই সব সামলাচ্ছে। বিয়ের সপ্তাহ খানিক আগে আপু শুধু আমায় একটা কথা বলেছিল।
“এই মেয়েরে তুই কতদিন ধরে চিনিস?”
“অনেকদিন আপু। কেন?”
“পুনার সাথে তোর সম্পর্ক হইলো কেমনে?”
“হইছে আর কি। অন্যদের যেমনে হয়।”
“তোর মতো একটা বলদরে এই মেয়ে কেমনে পছন্দ করলো। তোর মধ্যে আছেটা কি। দুনিয়াতে বই পড়া ছাড়া আর কিছু পারিস। দুই দিন বাদে বিয়া। আর তুই বাসাটা বাংলাবাজারের গোডাউন বানাই রাখছিস।”
“আপু তুই…”
“শোন এই মেয়েরে কখনো কষ্ট দিস না। আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না।”
“কি বলো এইসব। ওরে কষ্ট দিবো কেন! আর বিয়ের আগেই বুঝি পুনা তোমাদের আপন হয়ে গেল আর আমি পর হয়ে গেলাম।”

“পুনা আমার ছোটবোন। এমন মেয়ে এই যুগে পাওয়া যায় না। বিয়ের অনুষ্ঠানে না পরলেই না এমন একটা শাড়ি নিছে ও। আর আমরা যেই গয়না দিতে চাইছি তার কিছুই নেয় নাই। হালকা পাতলা গয়না নিছে। ওর নাকি এইসব ভাল লাগে না।y আমি নিজেও তো এমন না। গয়নাগাটির উপরে আকর্ষণ নাই এমন মেয়ে পাবি কই তুই।”

মনে মনে কেঁপে উঠলাম আপুর এই কথা শুনে। পুনা যে কি সেটা আরো একবার বুঝতে পারলাম। আমার আপু সহজে কারো প্রশংসা করেনা। ও মানুষ খুব ভাল চিনে। পুনাকে যে আপু কতো পছন্দ করেছে এটা আপুর কথা শুনেই বুঝা যায়। তবুও একটু অভিমান করেই বললাম।

“ওহ! পুনা দামি গয়না নেয় নাই বলেই ও অনেক ভাল হয়ে গেল বুঝি।”
“ভাই শোন। একটা কথা বলি। তুই আসলেই একটা বলদ। পুনার মতো একটা মেয়ে যে কি করে তোর সাথে প্রেম করলো; আর তোরে বিয়ে করতে রাজি হইলো আমি বুঝি না। পুনা মেয়েটা লোভী না। যদি লোভী হইতো তাহলে ওরে যা দিতে চাইছিলাম আমরা তাই নিতো। যাক তোরে এইসব বলে লাভ নাই। তুই তো দুনিয়াতে তাড়াহুড়া করে আসার সময় বুদ্ধিশুদ্ধি সঙ্গে করে নিয়ে আসতে ভুলে গেছিলি। বলদের মতো শুধু বই ই পড়তে পারিস। খালি এইটা মনে রাখিস, এই মেয়েটারে পাওয়া তোর ভাগ্য। আল্লাহ্ সবাইরে কত ভাল ভাল ভাই দেয়। আর আমাগোরে দিছে একটা বলদা ভাই।”

আমার পিঠে দু’টো পাখা থাকলে হয়তো আকাশেই উড়ে যেতাম। পুনা যে কি তাতো আমি জানি। আপু আম্মু যে পুনাকে ভালবাসে এটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লাগার। পুনা সব সময় আমার কাছে একটা পরিবার চেয়েছে। সবাইকে নিয়ে সুখে থাকতে চেয়েছে। আমি সেই জায়গাটা কেবল ওকে তৈরি করে দিতে চেয়েছি। কিন্তু আমাকে কিছুই করতে হয় নাই। ও নিজেই ওর স্থান করে নিয়েছে।

বাসর রাতে আমার জন্য একটা সারপ্রাইজ যে অপেক্ষা করছিলো সেটা ভাবতেও পারি নাই। পুনার সাথে আসা লাগেজ থেকে ও একটা বড় প্যাকেট বের করলো।

“নাও। এটা তোমার যৌতুক। এতো করে যৌতুক চাইছিলা না দেই কি করে।”
প্যাকেট খুলে দেখি আমার পছন্দের পাঁচটা বই। খুশিতে বুকটা ভরে গেল আমার। যেই বই গুলা কতোদিন ধরে কিনবো কিনবো করেও কিনা হচ্ছিলো না। পুনাকে একটু কাছে টানলাম। ওর জন্য যেই বই গুলা কিনেছি সেগুলো দেখিয়ে বললাম, “আর এই গুলা তোমার উপঢৌকন।”

পুনা জড়িয়ে ধরলো আমায়। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, “খবরদার আমার বই গুলোর দিকে আর তাকাবা না। চোখ গেলে দেবো একেবারে। তোমায় যে যৌতুক দিয়েছি সেগুলোই শুধু পড়বে। আমার বইয়ের দিকে হাত বাড়ালেই একেবারে কাঁচা খেয়ে ফেলবো।”

গল্পের বিষয়:
গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত