নেহাল কাজি একটু পরেই এই পথে মসজিদে যাবেন। ভাবতে ভাবতেই ইস্ত্রির ভাঁজ ফেলা পাঞ্জাবী থেকে ভুর ভুর করে আতরের সুবাস ছড়িয়ে কুদ্দুস মিঞার দু’ধাপ সমান উঠোন পার হল।
বিদেশী আতর। গত বছর নেহাল কাজির চাচাতো ভাই সোবহান কাজি সৌদি আরব গিয়েছিলেন হজ্জ্ব করতে। ফিরে এসে আতরের ছোট্ট একটা বোতল দিয়েছিলেন নেহাল কাজিকে। আত্মীয় এবং কাছের মানুষদের উপহার দেবার জন্য আতর, তসবিহ্, জায়নামাজ, আরও বিভিন্ন জিনিস এনেছিলেন নেহাল কাজির চাচাতো ভাই। কুদ্দুস মিঞাকে ডেকেও একখানা তসবিহ্ ধরিয়ে দিয়েছিলেন। খুব ধর্মপ্রাণ আর পরোপকারী মানুষ হিসাবে পাড়ার সকলের কাছে সুনাম আছে সোবহান কাজির।
সোবহান কাজির এই সুনাম নেহাল কাজি ভেতরে ভেতরে সহ্য করতে না পারলেও মুখে মুখে ভাইয়ের জন্য একবারে নিবেদিত প্রাণ, আর সেটা যে লোক দেখানো মাত্র তা পাড়ার বেশির ভাগ বাসিন্দা বোঝে। এই তো গতবছর সোবহান কাজির পুকুরে বিষ ঢেলে নিষ্পাপ মাছগুলোর অপমৃত্যু ঘটিয়েছিল নেহাল কাজি। আর তা কপালি প্রমাণ পেয়েছে নেহাল কাজির বাড়ির বাথরুমের পানি নিষ্কাশনের ড্রেনে ছোট্ট বিষের শিশিখানা পেয়ে, শিশির ভেতরের বিষাক্ত গন্ধ শুকে টের পেয়েছিল কিন্তু ভয়ে মুখ খোলেনি, পাছে নেহাল কাজির সুনাম নষ্ট করার অপরাধে উল্টে তারই শাস্তি হয়!
নেহাল কাজির সাধ জাগে চাচাতো ভাইয়ের মত সুনামী হতে। কিন্তু সুনাম কুড়িয়ে পাওয়ার নয়, ওটা অর্জন করতে হয়। নেহাল কাজির ভেতরে এ বোধটুকু ঢুকাতে গিয়ে তার স্ত্রী তানজিলা বেগমের বেহাল দশা হবার উপক্রম হয়েছে বহুবার।
একচালা টিনের একটাই ঘর, চিকোন বারান্দা, বারান্দার এক মাথায় উনুনে ঘুটে ঠেলে ঠেলে রান্না করছে কুদ্দুসের বউ কপালি খাতুন। অভাবে আর অপুষ্টিতে ত্বক লাবন্যহীন হলেও ডাগর কালো চোখ তার, উকুনের উৎকৃষ্ট আবাদক্ষেত্র হলেও ঘন কালো কোঁকড়া চুল আর কালো জোড়া ভুরুর লম্বাটে চেহারায় এখনও হাড় জাগা পুরুষের বুকের খাঁচায় সুর তোলে। অবশ্য একটা সন্তান এর জন্ম দিয়েই কপালি নিজেকে বুড়ি ভাবতে শুরু করেছে। সত্যি বলতে কেউ নিজে থেকে নিজেকে বুড়ি ভাবতে চায় না, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং পাড়ার মহিলা মহল ভাবতে সাহায্য করে। সন্তান জন্ম দিলেই এ দেশের রীতি-নীতি কিশোরী মেয়ের মনোভাবকে ধুয়ে মুছে তাকে প্রৌঢ়া মনোভাবের ঘরে তুলে দেয়। দায়িত্ব আর বৈষয়িক প্রয়োজনগুলো ঝড়ের বেগে ছুটে এসে স্বপ্নিল ঘরটাকে মুখ থুবড়ে ফেলে দেয়। বিবাহের প্রথম বছরটা আত্মীয় স্বজনের বাড়ি বেড়িয়ে, সিনেমা হল আর পার্কে ঘুরে ফিরে কুদ্দুস মিঞার সাথে পিরিতে আড্ডায় কিভাবে কেটে গেছে টের পায়নি কপালি। এক বছরের মাথায় কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে প্রথম অপরাধটা করেছে। আরও নানা অপরাধে অপরাধী কপালি, যার কারণে শাশুড়ীর কল্যাণে শ্বশুরের ভিটে ছাড়া হতে হয়েছে শাস্তি স্বরূপ। কুদ্দুস মিঞা কতটা ভালো মানুষ আর প্রেমিক পুরুষ তা প্রতি রাতেই টের পায় কপালি। অন্যদিকে কুদ্দুস মিঞার আরেক রুপ আছে, মাঝে মাঝে তার তিব্র মেজাজের চিহ্ন পাওয়া যায় কপালির পিঠে কাঁচা কলমির সরু সরু লালচে-কালচে দাগে। কলমির কচাগুলো গত বছর লাগিয়ে দিয়েছিল টিউব-ওয়েলের ধারে ছোট্ট খানার পাড় জুড়ে। বউ-টা স্নান করার সময় গলি পথের পথচারী থেকে আড়াল করে রাখে কলমির কচাগুলো। তাছাড়া নেহাল কাজির পাঁচতলা বিল্ডিং-এর পয়ঃনিস্কাশনের জন্য ড্রেন কাটার সময় কলমির কচার বেড়া কুদ্দুসের এক চিলতে জমির আইলকেও রক্ষা করেছে।
পৌরসভার ভেতরের দামি জমির এক ইঞ্চিও নষ্ট হতে দেয়নি নেহাল কাজি। নেহাল কাজির বাড়ির পেছনে নর্দমার নোংরা পানি যখন কল কল ছড় ছড় শব্দ তুলে কপালির ছোট্ট উঠোনে বয়ে যায়, কপালির মুখ থেকেও ঠিক তেমন করে গালি গালাজ ঠেলে বেরিয়ে আসে। নর্দমার নোংরা পানি কেবল সরু ড্রেনেই সিমাবদ্ধ থাকেনা, উপচে এসে কপালির একচিলতে রোদ্রহীন উঠোনের মাটিকে স্যাঁত সেঁতে করে দেয়, কপালি সমস্ত ঘৃণা উগরে উচ্চারণ করে– ছ্যাদড় ব্যাটা, ছ্যাদড়ামী ঢেইকে রাখতি পারিস নে? নালা কাটলি ঢাকনা লাগাতি হয় জানিস নে ব্যাটা! ছ্যাদড় ব্যাটা কোয়ানকার?
একই বাক্য রিপিট করে কয়েকবার, উনুনের কড়াইয়ে খুনতির গুতা দিতে দিতে কপালি একা একা বক বক করে যায় অনেকক্ষণ। জুম্মার দিনে এই গলি পথ দিয়ে পাড়ার আরও অনেকে মসজিদে যায়, এ পাড়া থেকে কম সময়ে ওপাড়া যেতে আড়াআড়ি এ একটাই সরু পথ। পথচারী কপালির কথা শুনে কানে আঙ্গুল দেয়, ওযু নষ্ট হয়ে যাবে এসব শুনলে। কপালির প্রতি ছিঃ ছাঃ করেও তৃপ্তি হয় না কারও কারও, কেউ কেউ ভাবে নামাজ শেষে ফেরার সময় অসভ্য মহিলাটি কে দু চারটে জ্ঞ্যানের বাক্য শুনাবে। সম্মানী মানুষের সম্মানহানী করা ঘোর অন্যায়।
কপালির মেজাজ তুঙ্গে, মেয়েটা কাল রাত্রে বলেছে– মা, শুক্কুরবারে আব্বারে গোস্ত আনতি কবা?
কপালি সকালে উঠেই কুদ্দুস মিঞাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে– কুমকুমের জন্যি ভালো মন্দ কিছু বাজার করে দিও, ক’দিন জ্বরে পড়ে থেইকে কিছু গিলতি পারেনি মেয়েডা।
কুদ্দুস মিঞা টিউবয়েলে কুলকুচি করতে করতে জবাব দিয়েছিল– ফিরতি রাত হবে, আজক্যার মত ব্যাবস্থা করে নিস, কাইল দেখা যাবে।
তখন থেকেই কপালির মেজাজ খারাপ, ও পাড়ার পুকুরের পাড় থেকে আঁচলে করে দু’মুঠো হেলাঞ্চি শাক তুলেছে, একটু বেশি করে তেল পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে দেবে মেয়েটাকে। আজকাল তার মরদের মতিগতি ভালোলাগেনা, দিনকয়েক আগে কুমকুম এর বাপের মোবাইল এর ফোটো লিস্টে আম্বিয়ার ছবি দেখেছিল, নেহাল কাজির বাড়ি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আম্বিয়া। বাসন মাজা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা, শেষ করে প্রতিদিন বিকেলে পরিপাটি হয়ে ঘুরতে বের হয়। কপালির ভাষায়– ছেমড়ি পেত্যেকদিন লেপিস্টি ঘইষে রাস্তায় ওঠে ঢং করতি। কুনোদিন যদি দেখিছি আমার জামাইয়ের সাথে ঢং করতি চুলের মুঠি ধইরে ঘুরান দিবানি।
মোবাইলের স্ক্রিনে ফুল ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে অল্প কিছুদিন আগের। কপালির কথা এখন তেমন মনোযোগ দিয়ে শোনেনা কুদ্দুস মিঞা। ছেলে সন্তান হয়নি বলে শাশুড়ির মত করে আজকাল কুদ্দুস মিঞাও কপালিকে বলে— সোজা ভাবে চলিস, নয় তোর কপালে দুর্ভোগ আছে বলে দিচ্ছি !
সকাল সন্ধ্যে কথায় কথায় তেড়ে মারতে ছুটে আসে, কপালি নানা কথা ভাবে একা একা। এত ভালোবাসা ছিল মরদের বুকে, কোন খানে উবে গেছে সেসব? কপালির উস্ক খুস্ক চুল, খসখসে ফাটা ঠোঁট, এসব আর ভাল্লাগেনা বোধহয় জোয়ান তাগড়া মরদের। ভাঁজ পড়া রুগ্ন মলিন ত্বকে অভাবের নিরব স্বাক্ষর যেন।
আম্বিয়ার ফটোটার কথা মনে পড়ে গেল, টানটান ত্বক, লাল কড়া ঠোঁট, ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বাঁধা চুল, আর গলায় পাউডারের সাদা ছোপ ছোপ রং কিংবা পাউডারের বাসনা এসবেই হয়ত মজে গেছে তার মরদ। কপালিরও কখনও সখনও সাধ জাগে হয়ত একটু সাজগোজ করতে, কিন্তু স্বামীর মনোযোগ পেতে এসবের খুব প্রয়োজন পড়ে কি? এ প্রশ্নের জবাব মেলাতে পারে না কপালি । নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে– পাঁচ তলার বেগম আফা কি সুন্দর দ্যাখতে, দারুণ বাসনা আসে শরীল থেইকে, দিন রাইত সাজুগুজু নিয়া ব্যাস্ত, তাও তো দেখি তার সুয়ামী আরেক ছেরি নিয়া ঘুরে। ঘুরে ক্যান ? বেগম আফারে ছেড়ে থাকেই বা ক্যামনে ?
প্রায় দেখা যায় কপালির বেগম আফা পাঁচতলায় তার রুমের বাইরে পেছনের ঝুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে গ্রিলে একহাতে ঠেস দিয়ে অন্য হাতে মোবাইল কানে ধরে কথা বলে, হাসে। কপালি নিচ থেকে হাঁ করে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে উপরে। পাঁচ তলা থেকে তার ত্বকের প্রসাধনীর ঝলকানি নিচে এসে পড়ে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেকদিন পাঁচতলার রান্না ঘরের জানালা থেইকে কত্ত কিছু পড়ে নিচে! পেয়াজের খোসা, ডিমের খোলস, এঁটো কাঁটা, কমলার খোসা, সব উপর থেকে এসে পড়ে কপালির ঘরের দোরে ।
একদিন এক খাবল কমলার খোসা নিচে ঝুপ করে পড়া মাত্র কুমকুম দৌড়ে গিয়ে খুঁটে খুঁটে খোসায় লেগে থাকা কমলার দু তিনটি রোয়া পেয়েছিল, যেন ঝিনুকের বুকে মুক্তো দানা পাওয়ার মত আনন্দ পেয়েছিল কপালির মেয়ে কুমকুম।
কপালির মেজাজ ভালো থাকলে সেসব এঁটো-খোসা দেখে চুপ করে থাকে, মেজাজ কোন রকম বিগড়ে থাকলে এসব ফেলতে দেখা মাত্র তার গলা থেকে ককটেল ফাটার মত শব্দ ছড়িয়ে পড়ে গোটা পাড়ায়।
– বেডির আক্কেল নাই? আমার জং ধরা ফুডা টিনের চালে, ঘরের দোরে ব্যাবাক নোংরা ফ্যালায়! যেমন বাড়িওয়ালা, তেমনি ভাড়াটিয়া, ছ্যাদড়ের দল সব। শিশির মতন গলা উঁচুয়ে ফ্লাট উটাইছে, তয় পেছনে দু’আঙ্গুল জমিন ছাড়ে নাই। ওগের ঘরের গন্ধ আমার ঘরের দোরে ফ্যালায় ক্যান? ওগো ভিতরির গন্ধ আমার ভিতরি ছেটায় ক্যান?
সন্ধ্যায় চারিদিক থেকে ভেসে আসা মাগরিবের আযানের সুরে কপালির চেঁচামেচি মিলে মিশে আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। কপালি নড়বড়ে কাঠের দরজায় ছিটকানি না এঁটে কেবল পাল্লাটা ভিড়িয়ে দিয়ে শুয়েছিল, কপালির বুকের মাঝে কুমকুম অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ভালো কোন তরকারী কিংবা গোস্ত বাজার না করে দেবার অপরাধবোধ নিয়ে কুদ্দুস সেদিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরেছে। সাড়া শব্দ না করে খাটের অন্যপাশে চুপচাপ শুয়ে পড়ল।
কয়েকদিন পর, নেহাল কাজির একমাত্র ছেলের বৌভাত অনুষ্ঠান, পাড়ার সকলকে নিমন্ত্রণ করেছে। সবাই একে একে দামি উপহার দিয়ে পেট পুরে খেয়ে গেল। একমাত্র ছেলের শশুরবাড়ি থেকে পাওয়া অনেক অনেক উপঢৌকন গর্বের সাথে আমন্ত্রিতদের দেখাচ্ছে। সবাই দেখে চোখ দুটো জুড়িয়েও নিচ্ছে। কপালির মত আরও কয়েক পরিবার দামী উপহার দিতে না পারার বদলে গায়ে খেটে দিচ্ছে একবেলা গোস্ত পোলাও খাবার জন্য। কিন্তু খাবার আগেই কপালিকে কুদ্দুস মিঞার হাতে মার খেতে হল। লম্বা বেঞ্চে প্লেট নিয়ে খেতে বসে কথায় কথায় আহল্লাদের সুরে কুদ্দুসের গায়ে ঘেষা দেবার ভঙ্গিমায় বলল– ও কুমকুমের বাপ! তোমার মেয়ের বিয়েতেও কিন্তু অনেক জিনিস দিয়া সুন্দর করে সাজায়ে দিবা। শশুর বাড়িতে আমাগে মেয়েকে যত্ন করবে তাইলি।
– লাট সাহেব পাইসছ আমারে? টাকা কি ভেসে আসতেছে পকেটে?
স্বামীর অভাব অবস্থা কপালি জানে, তবু আশা করেছিল স্বামী তার আহল্লাদখানা বুঝবে, দিতে না পারলেও আহল্লাদের মান রাখতে মুখে একখানা হাসি ফুটাইতে পারতো… তার চেষ্টার কথা স্বীকার করতে পারতো। অপারগতা বা ব্যর্থতার মাঝেও আশার বাণী বেঁচে থাকাকে মধুর করে তোলে। কপালির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এক ঝটকায় সেও উত্তর দিল– টাকা আওনের সাথে সাথে আম্বিয়ার গালের ভিতরি পুরে আসতাছো, পকেটে থাকবে ক্যামনে?
অমনি কুদ্দুসের গায়ে জ্বালা উঠল, খালি প্লেট খানা হাতে তুলে কপালির পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দিল গায়ের জোরে। পাশের কয়েকজন মিলে ঠেকিয়ে নানা উপদেশ দিল ঠিকই, কিন্তু সেদিন গোস্ত-পোলাও না খেয়ে প্রাচীরের বাইরে তাদের চলে যাওয়ার বিষয়ে কারও কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। কপিলা আর কুদ্দুসের মনে আফসোস জমেছিল। খেতে বসে এত ভালো খাবার খাওয়ার পূর্বে নিজেদের মধ্যে কোন্দল না বাধালেই পারতো।
কিছুদিন পর এক সন্ধ্যা বেলায় নেহাল কাজির সহধর্মিণী তানজিলা বেগম এর গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কপালি, নেহাল কাজির উঁচু প্রাচীরের ভেতর থেকে আরও অনেকের গলার আওয়াজ উপচে আসছে কপালির উঠোনে। কপালি বারান্দায় বিছানো খেঁজুরের পাতায় বোনা পাটি থেকে উঠে এগিয়ে গেল নেহাল কাজির বাড়ির সদর গেটে। উপস্থিত মহিলাদের সোরগোলে বোঝা গেল– সকাল থেকে আম্বিয়া নিখোঁজ, আজ সারাদিন তার মুখ কেউ দেখতে পায়নি। কপালির হার্টবিট একটু করে বাড়ছে হয়ত, কুদ্দুস মিঞাও তো এখনও বাড়ি ফেরেনি, সেই খুব ভোরে বেরিয়েছে আজ। তবে কি… কুদ্দুস এবং আম্বিয়াকে ঘিরে অজানা আশংকা কপালির বুকের গহীনে অংকুরিত হতে লেগেছে, দুজনে কি প্লান করে পালাইছে? তবে অনুমানকে ভর করে কপালি আহাজারি করার মানুষ নয়।
নেহাল কাজির বাড়ির দীর্ঘদিনের কাজের মেয়ে আম্বিয়া, এক হাতে সব কাজ সামলে আসছে। নেহাল কাজিও সুবিধা অসুবিধায় অনেকভাবে আম্বিয়াকে দু হাত ভরে দিয়েছে। আজ সারাদিন তানজিলা বেগম একে ওকে দিয়ে কিছু কাজ করিয়ে, খানিকটা নিজে করেছে। নানা কাজের ঝামেলায় তেমনভাবে কোন সন্দেহ মাথায় আসেনি। সন্ধ্যা গাঢ় হতে থাকছে, দু একজন প্রতিবেশির মন্তব্য কানে যেতেই তানজিলা বেগম আলমারী খুলে দেখেন সমস্ত জিনিস এলোমেলো, উপর দিয়ে যেন পশ্চিমা ঝড় বয়ে গেছে। তানজিলা বেগম টের পেল দামী দামী শাড়ি, পোশাক, গয়না খোয়া গেছে। তানজিলা বেগমের আহাজারি এবং উত্তেজনা বেড়ে গেল, আম্বিয়ার উপযুক্ত ব্যবস্থা করে ছাড়বে। পুলিশেও খবর চলে গেছে ততক্ষণে। কপালির ভেতরে একটা বারুদের কাঠি জ্বলে ওঠার অপেক্ষায়, অতি সাবধানে দাঁতে দাঁত ঘষে দুই ঠোঁট এটে বসে আছে। পাছে চুরির অভিযোগে তার স্বামীর নামখানা পুলিশের খাতায় ওঠে! গালিগালাজ যাই করুক, কপালির মত মেয়েদের স্বামীর উপরে টান আছে, টান থাকে। সন্ধ্যের হৈচৈ পর্ব থেমে গেছে, শীতের রাত, পাড়ার সবাই যে যার বাড়িতে গিয়ে উঠেছে। কপালি বারান্দার পিলারে ঠেস দিয়ে বসে রইল নিঃশব্দে। তানজিলা বেগম টাকা, কাপড় এবং গয়না নিয়ে আম্বিয়ার নিখোঁজের ঘটনা তার স্বামী নেহাল কাজিকে অবগত করতে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে, ফোন বন্ধ। একা একা উচ্চারণ করল– রাজ্যের যত কাজ আজই জুটেছে লোকটার মাথায়, আমি এখন কী করি? ছেমড়ির খোঁজ লাগাই কারে দিয়া ?
অনেক রাত হয়েছে, পাড়াময় নিস্তব্ধতা। হঠাৎ কপালির চোখ কপালে উঠল, একি দেখছে? নেহাল কাজি সোনালী রং-এর পাজামা পাঞ্জাবী পরে মেইন গেট ঠেলে প্রাচীরের ভেতরে ঢুকে হেঁটে আসছে, গয়না আর ঝকমকে লাল কাতান মুড়িয়ে পেছনে পেছনে আসছে অন্য রুপের আম্বিয়া, পোশাক আর পদবি একই মানুষকে এতটা পাল্টে দেয় ! স্তম্ভিত কপালি ছোট্ট করে বলল– বু জান ! দেখ…
অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার কারণে গলার স্বর ছোট হয়ে গেছে, কথাখানা শুকনো ঠোঁটে বেধে বেধে গেলেও কপালির বুকের ভেতরের পাথরটা নিমেষেই বের হয়ে গেল। মিছেই তার স্বামীকে সন্দেহ করেছে।
নেহাল কাজি আম্বিয়াকে ছোট বউ পরিচয়ে ঘরে ওঠালো, তানজিলা বেগম নিরব কঠিন মূর্তি ধারণ করে বারান্দার হাতাওয়ালা চেয়ারে বসে রইল। উনুনের উপরে তপ্ত হাঁড়ির ফুটন্ত ভাতের মাড়ের মত– চোখ মুখ থেকে স্বামীর প্রতি ঘৃণা উতলে পড়ছে।
কপালি নিজের ঘরে ফিরে দরজার পাল্লাটা ভিড়িয়ে কুমকুমকে বুকের মাঝে নিল, সেই সাথে প্রাণ ভরে দীর্ঘশ্বাসও নিচ্ছে। নিশ্চিন্ত ঘুমে চোখ বুজে এল। প্রতিদিনের অভ্যেসমত কুদ্দুস মিঞা দরজা আস্তে ফাঁকা করে ঘরে এসে শুয়েছে।
পরদিন ভোরের নিঃশব্দ উঠোন, ছোট্ট একচালা ঘরে চৌকিতে হাড়জাগা তিনটি প্রাণী ঘুমের অতলে ডুবে ছিল, মাথার উপরের চালে হঠাৎ বিকট শব্দ। ঘুমের অসাড় তল থেকে চমকে জেগে উঠল তিনজন। কুদ্দুস মিঞা চোখ বন্ধ রেখেই উচ্চারণ করল– শুকনা নারকেল পড়ছে, কুড়াই আনো, কুমকুম রে নাড়– বানাই দিও… আর আইজকে দুপুরে একখান পল্ট্রি আইনে দিবানি, তয় ঝোল করিসনা কইলাম, তেল বেশি দিয়া কষোনি করিস।
কপালি আড়মোড়া ভেঙ্গে স্বামীর মুখের দিকে ড্যাপ ড্যাপ করে তাকালো। ভাবছে সেদিনের গোস্ত কিনে না দিতে পারার বিষয়টা মেকাপ দিতে চাইছে। কুমকুম দুয়ার খুলে ছুটে উঠোনে এদিক ওদিক খুঁজতে লাগল, কিছু দেখতে না পেয়ে খেলায় মেতে গেল, রোজকার মত কুদ্দুস মিঞা দু মুঠো মুড়ি চিবিয়ে টিউবওয়েলে জোড়া হাতে দু খাবল পানি গিলে বাইরে চলে গেল। কপালি মুড়ো ঝাঁটা হাতে নিয়ে আনমনাভাবে উঠোন ঝাড়– দিতে লাগল, গত রাতের ঘটনা মনে করে বার বার ভাবছে– হায়রে কপালি ! এতদ্দিন কুমকুমের বাপরে ক্যান যে সন্দেহ করিছি … এমন মরদ ক’জনার কপালে জোটে?
হঠাৎ ঝাঁটার আগায় ভারী কিছু ঠেকল, খুব সুন্দর ডিজাইনের একটা কাঁচের বোতল, বুঝতে পারলো ভোর বেলা এই বোতলটাই পাঁচতলার বেগম আফার ঘরের জানালা থেকে টিনের চালের উপরে পড়েছিল। বোতলের মুখের দিকটায় স্প্রেগান লাগানো, বোতলের উপরের অংশে একটু ফাটার দাগ। অত দূর থেকে পড়লে একটু তো ফাটবেই, তবে একেবারে ফুরিয়ে যায়নি ভেতরের সুগন্ধি তরল, পেচ ঘুরিয়ে নাড়াচাড়া করতেই দু তিন বার স্প্রে হয়ে গেল , মিষ্টি একটা গন্ধে কপালির মন উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। ওটাকে হাতের মুঠোয় পুরে ঘরে চলে গেল, খাটের নিচে ট্রাঙ্কে রাখতে গিয়ে পুনরায় নিজের গায়ে স্প্রে করল । কপালি নিচু স্বরে নিজের সাথে নিজেই কথা বলতে লাগল– “ মরদ রোজ রাইতে আইসে কয়– বেডি তোর গায়ে গন্ধ… লাথি গুতা খাইয়া পইড়ে থাকি এক থাল ভাতের জন্যি, আইজকে আসুক, ভালোমত বুঝাই দিবানি।”
রাতের ঘুট ঘুটে অন্ধকার ঠেলে ঘরে এল কুদ্দুস মিঞা, দরজার পাল্লা দিয়ে চুপচাপ নিজের জায়গায় শুয়ে গেল… অন্যদিনের মত মাঝখানে কুমকুমকে পেল না… দেয়ালের দিকে মেয়েকে শুইয়ে কপালি আজ তক্তপোষের মাঝখানে… কুদ্দুস মিঞার আগমন টের পেয়ে শীতের কাঁপুনিটা যেন একটু বেড়ে গেল। কুদ্দুস ও কাঁপছে…. কাঁপা ঠোঁটের উচ্চারণ– আইজ তোর গতর থেইকে ফাইন বাসনা আসতিছে… কই পাইছস এইরাম বাসনা শিশি ? এখন থাইকে রোজ রোজ মাইখ্যে শুবি।
আহ্লাদের স্বরে কপালি বলে– জানো খালি খালি বেগম আফারে গাইল পাড়ি… আর এইরাম গাইল দেবো না তারে…. তবে তাগের ঐ উঁচু শিশির মতন ফেলাডের জানালা থেইকে ইসপেরে করার মতন করে যত্ত সব দুর্গন্দ জিনিস ছেটায় … আর আমাগের ঘরের দোর নুংরা করে এর জন্যি এট্টু কিছু কবো …